শমীক লাহিড়ী
“এমনকি একজন ব্যক্তি মহান হ’লেও তাঁর পায়ের কাছে নিজেদের স্বাধীনতা জমা রাখা যায় না অথবা ক্ষমতাসীনকে এমন অন্ধ বিশ্বাস করা যায় না, যা তাকে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে ধ্বংস করার শক্তি যোগায়।” ১৯৪৯ সালের ২৫শে নভেম্বর ভারতবাসীর প্রতি নতুন সংবিধান উৎসর্গ করার সময় প্রখ্যাত ব্রিটিশ দার্শনিক, রাজনৈতিক অর্থনীতিবীদ এবং সাংসদ জন স্টুয়ার্ট মিল’কে উদ্ধৃত করে দেশবাসীর প্রতি এই সতর্ক বার্তা দিয়েছিলেন বি.আর.আম্বেদকার।
আজ আমাদের দেশের গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি স্বাধীনতা প্রসঙ্গে মিলের সতর্কবার্তা আমাদের কাছে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে দেশের শাসক শ্রেণীর কার্যকলাপে।
দেশের নতুন সংসদ ভবন আজ উদ্বোধন করা হবে। ১৯২৭ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ শাসকদের তৈরী সংসদ ভবনের পরিবর্তে এই নতুন সংসদ ভবন থেকেই সংসদের উভয় কক্ষের কাজ পরিচালনা করা হবে আগামী দিনে। নতুন সংসদ ভবন তৈরীর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন খুব সঙ্গত কারণেই উঠেছে। তবে তার চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ বিতর্কিত বিষয় হলো – এই সংসদ ভবন উদ্বোধন করবেন কে? দেশের প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, তিনি নিজেই এই সংসদ ভবন উদ্বোধন করবেন। সত্যিই কি তার এই সাংবিধানিক অধিকার আছে?
সংবিধান কি বলছে?
দেশের সংবিধানের ৭৯নং অনুচ্ছেদে স্পষ্ট উল্লেখ করা আছে “সংসদ রাষ্ট্রপতি এবং দুটি কক্ষ নিয়ে গঠিত”। প্রধানমন্ত্রী সংসদের নিম্নকক্ষ বা লোকসভার সদস্য হলে তার নেতা হন, আর উচ্চকক্ষ বা রাজ্যসভার সদস্য হলে তার নেতা হন। তিনি কোনোভাবেই সমগ্র সংসদের নেতা নন। সংসদ ভবনে লোকসভা এবং রাজ্যসভা দুই কক্ষেরই অধিবেশন হয় এবং দুই কক্ষের যৌথ অধিবেশনও প্রয়োজন অনুযায়ী হয়। এটি কোনও একটি কক্ষের নেতার অধীন নয়। সংবিধানে একমাত্র রাষ্ট্রপতিকেই অধিকার দেওয়া আছে, সংসদের অধিবেশন আহ্বান বা Summon করার এবং অধিবেশন স্থগিত করা Prorogue করার।
সংবিধানের ১০৮নং অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা আছে, উভয় কক্ষের সদস্যদের নিয়ে যৌথ অধিবেশন আহ্বান করতে পারবেন রাষ্ট্রপতি। এক্ষেত্রে অবশ্যই মন্ত্রীসভা সংসদ অধিবেশনের নির্দিষ্ট তারিখ সুপারিশ করবে। অর্থাৎ একমাত্র রাষ্ট্রপতিই সংসদের উভয় কক্ষ আহ্বান করতে পারেন এবং তা স্থগিত করতে পারেন। এই অধিকার সংবিধানের কোথাও প্রধানমন্ত্রীকে বা তাঁর মন্ত্রীসভাকে দেওয়া হয়নি।
সংবিধানের ১১১নং অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা আছে সংসদে পাশ হওয়া কোনও বিল রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাতে হবে তাঁর অনুমোদনের জন্য। অর্থাৎ সংসদ, প্রধানমন্ত্রী বা তার মন্ত্রীসভার কাছে কোনও বিল পাঠায় না অনুমোদন নেওয়ার জন্য। এই বিলে রাষ্ট্রপতি অনুমোদন দিতেও পারেন, আবার নাও দিতে পারেন। তিনি পুর্নবিবেচনার জন্য আবার সংসদে ফেরতও পাঠাতে পারেন সুপারিশ সহ। তবে এক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির অধিকারের নির্দিষ্ট সীমাবদ্ধতা আছে। কোনও বিলকে আইনে পরিণত করার অথবা অর্থসংক্রান্ত বিলকে আইনি স্বীকৃতি দেওয়ার অধিকার একমাত্র রাষ্ট্রপতিকেই দেওয়া আছে এবং সংসদ একমাত্র রাষ্ট্রপতির কাছেই এক্ষেত্রেও দায়বদ্ধ থাকে।
সংবিধানের বিভিন্ন অনুচ্ছেদের ছত্রে ছত্রে লেখা আছে সংসদ এবং রাষ্ট্রপতির সম্পর্ক সম্বন্ধে। সংসদ না রাষ্ট্রপতি, কে কার উর্দ্ধে এই বিতর্ক নিরর্থক কারণ ভারতবর্ষের সংবিধানের ৭৯নং অনুচ্ছেদে লেখা রয়েছে – রাষ্ট্রপতি এবং লোকসভা ও রাজ্যসভা নিয়ে গঠিত ভারতের সংসদ। এখানে প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন একটাই – প্রধানমন্ত্রী কোন সাংবিধানিক অধিকারে নতুন সংসদ ভবনের উদঘাটন করার সিদ্ধান্ত নিলেন এবং রাষ্ট্রপতিকে আমন্ত্রন পর্যন্ত জানানোর কোনও প্রয়োজনীয়তাই অনুভবই করলেন না। প্রধানমন্ত্রীর নিজের দাবী অনুযায়ী তিনি নাকি ‘হোল পলিটিক্যাল সায়েন্স’ নিয়ে এম.এ পাশ করেছেন দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তা যিনি ‘হোল পলিটিক্যাল সায়েন্স’ জানেন অথচ তিনি দেশের সংবিধান পড়েন নি, এটা কি হতে পারে? যদিও এমন কোনও বিষয় দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ে কস্মিনকালেও পড়ানো হয়েছে, এই তথ্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও খুঁজে পায়নি।
গোয়েবেলসও হার মানবে
বিজেপি নেতারা এই সব প্রশ্নের উত্তর দিতে না পেরে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক কিছু উদাহরণ টেনে আনছেন। তাঁরা বলছেন, রাজীব গান্ধী সংসদের লাইব্রেরীর উদ্বোধন করেছিলেন। অর্ধসত্যের সংজ্ঞা এই বক্তব্য। প্রথমত সংসদের পৃথক লাইব্রেরী ভবনের নির্মাণ শেষ হয় ২০০২ সালে এবং ওই বছর ৭ই মে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি কে.আর নারায়াণন এই ভবনের উদ্বোধন করেন। ১৯৯৪ সালে এই ভবনের শিলান্যাসও করেছিলেন ১৯৯৪ সালে তৎকালীন লোকসভার অধ্যক্ষ শিবরাজ পাতিল। রাজীব গান্ধী প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন বা তারঁ জীবিতকালে লাইব্রেরী ছিল সংসদের বর্তমান ভবনেই। তিনি হয়ত কোনও একটি বিভাগ উদ্বোধনে ছিলেন। এটা আর নতুন ভবন উদ্বোধন এক হ’লো?
দ্বিতীয়ত ইন্দিরা গান্ধী জরুরী অবস্থার সময় সংসদের এনেক্স (Annex) ভবনের উদ্বোধন করেছিলেন। প্রথমত এই ভবনে সংসদের নানা অফিসিয়াল কাজকর্ম মূলত হয়। সাংসদদের প্রাথমিক চিকিৎসা হয়, ওষুধ দেওয়া হয়। আর ১৯৯০এর দশকে স্ট্যান্ডিং কমিটি গঠিত হ’লে, কয়েকটি কমিটির চেয়ারম্যানের বসার ঘর তৈরি করা হয় ও কিছু কমিটির সভাও কখনও হয়। এটিতে সংসদের কোনও কক্ষের অধিবেশনও বসেনা আর তার কোনও ব্যবস্থাও নেই। এটা আর সংসদের দুই কক্ষ বিশিষ্ট নতুন ভবন এক হ’লো? এছাড়াও জরুরী অবস্থায় যা হয়েছিল তাকে কি সমর্থন করছে না কি বিজেপি এখন? তাহলে সে সময়ের কাজকে উদাহরণ দেখিয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর অসাংবিধানিক সিদ্ধান্তকে কেন বৈধতা দিতে চাইছেন বিজেপি সরকারের মন্ত্রীরা?
ক্ষমতার পৃথকীকরণ
ভারতবর্ষের সংবিধানের ৫০নং অনুচ্ছেদে স্পষ্ট উল্লেখ করা আছে – রাষ্ট্র বিচার ব্যবস্থা এবং প্রশাসনকে পৃথক রাখবার ব্যবস্থা করবে। সংবিধান সুস্পষ্টভাবে আইনসভা, বিচার ব্যবস্থা এবং কার্যনির্বাহী ব্যবস্থা বা প্রশাসনকে নির্দিষ্ট দায়িত্ব দিয়েছে এবং তাদের অধিকারও নির্দিষ্ট করেছে। ভারতীয় গণতন্ত্রের এই তিনটি অঙ্গ পৃথকভাবে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করবে, এটাই সংবিধানের মূল কথা। আইনসভা আইন প্রণয়ন করবে, কার্যনির্বাহী ব্যবস্থা বা প্রশাসন বা সরকার সেই আইন অনুযায়ী কাজ করবে, বিচার ব্যবস্থার দায়িত্ব আইন অনুযায়ী সরকার কাজ করছে কিনা এবং আইনসভা সংবিধান অনুযায়ী আইন প্রণয়ন করছে কিনা, সেটা দেখা। এর অর্থ এই তিনটি অঙ্গ স্বাধীনভাবে কাজ করলেও প্রত্যেকেরই দায়বদ্ধতা থাকবে দেশের সংবিধানের প্রতি। আইনসভা নিজের ইচ্ছেমত সংবিধান বিরোধী কোনও আইন যেমন প্রণয়ন করতে পারবে না, সরকার আইন ভেঙ্গে ইচ্ছেমত যা খুশি কাজ করতে পারবে না, বিচার ব্যবস্থাও সংবিধানে প্রদত্ত অধিকারের বাইরে ইচ্ছেমত রায় দিতে পারবে না। এই ব্যবস্থাকেই ক্ষমতা পৃথকীকরণ বলা হয়। এটাই আধুনিক সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্যতম একটি স্তম্ভ।
ক্ষমতার একটাই কেন্দ্র
কোনও ব্যক্তি যদি একাধারে রাষ্ট্রপতির অধিকার ও ক্ষমতা, আইনসভা পরিচালনার সব অধিকার এবং সরকার পরিচালনার সব অধিকার নিজের হাতে কুক্ষিগত করতে চায়, তখনই গণতন্ত্র বিপন্ন হ’য়ে পড়ে, গণতন্ত্রের পরিবর্তে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। একনায়কতন্ত্রের বা রাজতন্ত্রের কালো অধ্যায় মানব সভ্যতা বহু আগেই পেরিয়ে এসেছে। গণতন্ত্রের নাম করে কোনও একজন ব্যক্তিকে মহান বানিয়ে অতিরিক্ত উজ্জ্বলভাবে প্রতিষ্ঠিত করা আর তার প্রতি অন্ধ বিশ্বাসে নিজেদের স্বাধীনতা তার পদতলে সমর্পন করা ভয়ংকর বিপজ্জনক।
এক দেশ, এক ভাষা, এক ধর্ম, এক দল, এক নেতা – এই ব্যবস্থা কায়েম করাই আর.এস.এস পরিচালিত বিজেপি’র লক্ষ্য। ভারতবর্ষের মতো বৈচিত্র্যপূর্ণ ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাস সম্পন্ন দেশ কখনও ঐক্যবদ্ধ থাকবে এমন একদেশদর্শিতা নিয়ে রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম করলে? নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধানের ভারতবর্ষ কখনোই ঐক্যবদ্ধ থাকবেনা এই ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হলে।
তাই প্রধানমন্ত্রী দেশের সংসদ ভবনের উদ্বোধন করবেন এটা কোনও মামুলি বিষয় নয়। এটা করা হচ্ছে এক নেতা ও এক দল নিয়ন্ত্রিত এক ভাষা, এক ধর্মের দেশ হিসাবে ভারতবর্ষকে রূপান্তরিত করার জন্যই। বিপদটা এইখানেই। কাউকে যদি সংবিধানের উর্দ্ধে প্রতিস্থাপিত করা হয়, দেশের একমাত্র নায়কে রূপান্তরিত করা হয় তাহলে তা গণতন্ত্রের অস্তিত্বকেই চ্যালেঞ্জ করে। আর এটাই করতে চাইছে আর.এস.এস নিয়ন্ত্রিত বিজেপি সরকার।
আক্রান্ত সংবিধান
দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসেই সংসদ ও সংবিধানকে অস্বীকার করার কাজ শুরু করেছিল নরেন্দ্র মোদীর সরকার। ২০১৯ সালে ৬ই আগষ্ট সংসদে হঠাৎই সংবিধানের ৩৭০নং অনুচ্ছেদকে বাতিল করে এবং জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যকে বিভক্ত করে দেওয়া হয়, একরকম জবরদস্তি করেই। জম্মু- কাশ্মীরের নির্বাচিত বিধানসভাকে ভেঙে দিয়ে, সেখানকার মানুষের মতামতকে উপেক্ষা করেই সম্পূর্ণ অসাংবিধানিকভাবেই এই ব্যবস্থা নেয় মোদী সরকার। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য বিগত আড়াই বছর আগে সরকারের এই অসাংবিধানিক কাজকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালতে মামলা দায়ের করা হলেও, এখনও তার কোনও শুনানি হয়নি। অথচ আর.এস.এস পন্থী একটি টেলিভিশন চ্যানেলের সম্পাদকমশাইকে মুম্বাই পুলিশ আর্থিক প্রতারনার দায়ে গ্রেপ্তার করলে, মাঝরাতে আদালত বসিয়ে তাকে জামিন দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। একইভাবে রামমন্দির সংক্রান্ত বিতর্কিত রায়দানকারী বিচারপতিকে অবসর গ্রহণের সাথে সাথে রাজ্যসভার সদস্য করা হয়, যা ভারতীয় বিচার ব্যবস্থার কলঙ্কজনক একটি অধ্যায়। একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র একটি নির্দিষ্ট ধর্মের জন্য মন্দির নির্মান করতে পারে না দেশের সংবিধান অনুযায়ী। অথচ ঐ বিতর্কিত প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ সংবিধানকে উপেক্ষা করেই এই রায় দিয়েছিলেন, তাঁর অবসর গ্রহণের ঠিক আগের দিন। অর্থাৎ আর এস এস পরিচালিত বিজেপি যে কেবলমাত্র সংসদীয় ব্যবস্থাকেই দুরমুশ করছে তাই না, বিচার ব্যবস্থাকেও কুক্ষিগত করে দেশের সংবিধানকেই অস্বীকার করছে।
আর কার্যনির্বাহী ব্যবস্থা বা প্রশাসন তো প্রথম থেকেই আর.এস.এস পরিচালিত বিজেপির দৃষ্টিভঙ্গীতেই কাজ করছে। দিল্লী শহরে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে সংগঠিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় দিল্লী পুলিশের লজ্জাজনক ভয়ংকর ভূমিকা সমগ্র বিশ্বের মানুষ দেখেছে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, সাংসদ সহ বিভিন্ন সঙ্ঘ পরিবারের নেতারা প্রকাশ্যে মুসলমান সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষদের গুলি ক’রে হত্যা করার প্ররোচনা দেওয়া সত্ত্বেও তাদের বিরুদ্ধে দিল্লী পুলিশ কোনও ব্যবস্থা নেয়নি, উল্টে সি.পি.আই(এম)-এর সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি সহ বহু বিরোধী রাজনৈতিক নেতা এবং সামাজিক ও মানবাধিকার আন্দোলনে যুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে চার্জশীট দাখিল করেছে। এরকম হাজার হাজার উদাহরণ রয়েছে কিভাবে কার্যনির্বাহী ব্যবস্থা বা প্রশাসনকে দাঙ্গার কাজে এবং বিরোধী কন্ঠকে স্তব্ধ করার কাজে ব্যবহার করে চলেছে আর.এস.এস পরিচালিত বিজেপি সরকার। আর কর্পোরেট মিডিয়ার নামই তো এখন ‘গোদি মিডিয়া’। এরা হিটলারে গোয়েরিং গোয়েবেলসকেও ছাড়িয়ে গেছে।
মনুবাদই ওদের সংবিধান
রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদি মুর্মুকে নতুন সংসদ ভাবনের উদ্বোধক না করার পিছনে যেমন একনায়কতান্ত্রিক দেশ গঠনের ভাবনা কাজ করেছে, তেমনই মনুবাদী ভাবনারও প্রতিফলন এই ঘটনা। দেশের সংবিধান যেদিন জাতির প্রতি উৎসর্গ করা হয়, তার ৩দিন পরেই নতুন সংবিধান সম্পর্কে আর.এস.এস-র মনোভাব এবং বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৪৯ সালের ৩০শে নভেম্বর, তাদের ইংরাজি মুখপত্র অর্গানাইজার পত্রিকায়।
“ভারতবর্ষের নতুন সংবিধানের সবচেয়ে খারাপ Subject হ’ল এতে ভারতীয় কিছুই নেই ……… মনুস্মৃতি হল সেই ধর্মগ্রন্থ যা আমাদের হিন্দু জাতির জন্য সবচেয়ে বেশি উপাসনাযোগ্য এবং যেটি প্রাচীনকাল থেকে আমাদের সংস্কৃতি, প্রথা ও চিন্তাধারার ভিত্তি হয়ে উঠেছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে অনুশীলন করা এই বইটি আমাদের জাতির আধ্যাত্মিক ও ঐশ্বরিক অগ্রগতিকে সংহত করেছে। আজও কোটি কোটি হিন্দু তাদের জীবন ও অনুশীলনে যে নিয়মগুলি অনুসরণ করে, তা মনুস্মৃতির উপর ভিত্তি করেই। আজ মনুস্মৃতিই হিন্দু আইন।“ সাভারকার
আর.এস.এস- এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বিনায়ক দামোদর সাভারকর চেয়েছিলেন মনুস্মৃতিই হোক সংবিধানের মূল ভিত্তি। এই সাভারকারের ১৪১তম জন্মদিবসকেই নরেন্দ্র মোদী বেছে নিয়েছেন নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধন করার দিন হিসাবে। যে সাভারকার আন্দামান সেলুলার জেলে বন্দী থাকাকালীন ব্রিটিশ সরকারের কাছে ৬বার লিখিতভাবে ক্ষমা ভিক্ষা করেন এবং অবশেষে মুচলেকা দিয়ে মুক্ত হয়েছিলেন এবং পরবর্তী কালে ব্রিটিশ সরকারের পেনশন ভোগী ছিলেন, তাঁর জন্মদিবসকেই ‘সংবিধান, সংসদ ও গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ হিসাবে বেছে নিয়ে আর.এস.এস-এর সেবক নরেন্দ্র মোদী সঠিক কাজই করেছেন। সেদিন নরেন্দ্র মোদীর পূর্বসূরী স্বাধীনতা আন্দোলনের পিছনে ছুরি মেরেছিলেন, আর তার যোগ্য উত্তরাধিকার হিসাবে নরেন্দ্র মোদী সংবিধানের পিছনে আজ ছুরিকাঘাত করছেন।
মনুবাদের খাঁচায় বন্দী দ্রৌপদী
যে মনুস্মৃতিকে ভারতীয় সংবিধানের ভিত্তি করতে চান আর.এস.এস- এর সেবক নরেন্দ্র মোদী, সেই মনুস্মৃতিতে নারী এবং আদিবাসীদের কি চোখে দেখা হয়?
মনু সংহিতার ৫ম অধ্যায়ের ১৫৫নং শ্লোকে বলা আছে –
“নাস্তি স্ত্রীণাং পৃথগ্ যজ্ঞো ন ব্রতং নাপ্যুপোষণম।
পতিং শুশ্রূষতে যেন তেন স্বর্গে মহীয়তে।।”
এর অর্থ – (পতির থেকে) স্বতন্ত্রভাবে স্ত্রীলোকের যজ্ঞ, ব্রত বা উপবাস নেই। তিনি যে পতিসেবা করেন, তাতেই স্বর্গে পুজিতা হন।
তাহলে সংসদ ভবনের উদ্বোধন উপলক্ষ্যে সকাল ৭টা থেকে যে যজ্ঞ করা হবে, তাতে দ্রৌপদী মুর্মু থাকেন কি ভাবে? তাই তিনি বাদ। ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটাকেই তুলে দিয়ে বর্ণবাদকে আবার ফিরিয়ে আনতে উদ্যত আর.এস.এস-বিজেপি।
মনু সংহিতার অষ্টম অধ্যায়ের ২৮০-২৮১ নং শ্লোকে বিধান দেওয়া হয়েছে – ব্রাহ্মণকে হাত দিয়ে মারলে শূদ্রদের হাত এবং পদাঘাত করলে পা কেটে নেওয়ার। ব্রাহ্মণদের সাথে এক আসনে বসলে শূদ্রদের পশ্চাতে বা কোমরে তপ্ত লৌহশলাকা দিয়ে চিহ্ন এঁকে দেওয়া হবে বা এমনভাবে নিতম্ব ছেদ করা হবে যাতে তার মৃত্যু হয়। একইভাবে কোনও আচার ও সংস্কার পালনেও শুদ্রদের অধিকারহীনতার কথা দশম অধ্যায়ের অনেকগুলি শ্লোকে বারবার উল্লিখিত হয়েছে। তাহলে একজন আদিবাসী নারী কিভাবে উচ্চ বর্ণের মানুষদের চাইতে উচ্চাসনে বা এক আসনে বসবেন হোম-যজ্ঞ-পূজা-পাঠের এই মনুবাদী উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে? এই মনুবাদী ভাবনার দ্বারাই পরিচালিত আর.এস.এস, সংঘ পরিবার ও বিজেপি। তাই একে নারী তার সাথে আদিবাসী, যাদের শূদ্রতুল্য ম্লেচ্ছ বলেই মনে করে মনুবাদীরা, তাদের প্রতিনিধি কখনো রাজকার্য বা রাষ্ট্রকার্যের উদঘাটন করতে পারে?
ভোট পাওয়ার জন্য দ্রৌপদী মুর্মুকে রাষ্ট্রপতি করা হলেও, একাধারে নারী, অপরদিকে ম্লেচ্ছ দ্রৌপদী মুর্মু সাংবিধানিক প্রধান রূপে সোনার খাঁচায় বন্দী থাকেন এবং তাঁকে ব্রাত্যই রাখা সংসদের নতুন ভবনের দ্বারোদঘাটন অনুষ্ঠানে।
অন্ধকারের এই অসভ্য আইন বিধিতে কি একবিংশ শতকের ভারতবাসী শাসিত হবে? আধুনিক মানব সভ্যতাকে এই অন্ধকারের বিভীষিকা গ্রাস করতে চায়। এ হ’তে দেওয়া যায়না।
“বরং দ্বিমত হও, আস্থা রাখো দ্বিতীয় বিদ্যায়।
বরং বিক্ষত হও প্রশ্নের পাথরে।
বরং বুদ্ধির নখে শান দাও, প্রতিবাদ করো।
অন্তত আর যাই করো, সমস্ত কথায় সম্মতি দিওনা।
কেননা, সমস্ত কথা যারা অনায়াসে মেনে নেয়,
তারা আর কিছুই করেনা,
আত্মবিনাশের পথ
পরিষ্কার করে।“
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী