ইন্দ্র
জলের কলসিতে হাত দেওয়াটা এতটাই অপরাধ ছিল যে মাত্র 9 বছরের শিশুকে পিটিয়ে মারতে হল? গত বছর (২০২২) আগস্টে রাজস্থানের এক প্রাথমিক স্কুলের ঘটনা। তৃষ্ণা মেটাতে স্কুলে রাখা কলসি থেকে জল তুলে পান করেছিল নয় বছরের শিশু ইন্দ্র। দলিত হয়ে স্কুলের যে কলসি থেকে জল তুলেছে , সেই কলসির জল পান করেন খোদ উচ্চ বর্ণের শিক্ষক। শিশুটির অপরাধ সেটাই। কিন্তু জল তো সেই মাটির তল থেকেই আসছে। যে বৃষ্টির জল দলিতের শরীর ভিজিয়ে দলিতের বাড়ির মাটি চুঁইয়ে নিচে পৌঁছায়! সেই জল ‘উচ্চ বর্ণের’ কলসিতে উঠলে হাত দেওয়া অপরাধ? নয় বছরের ইন্দ্র জানতো না তার অপরাধ, জানতো না সেই অপরাধের শাস্তি কতটা ভয়ংকর হতে পারে! আগে জানতে পারলে ছোট্ট শিশুটি নিশ্চিত তৃষ্ণায় মরে যেত কিন্তু অপরাধটা করতো না। জল নেওয়ার অপরাধে আগেও বহুবার দেশে দলিত সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ নেমে এসেছে। উচ্চ বর্ণের গ্রাম কিংবা পাড়া দিয়ে দলিত দের চপ্পল পায়ে হেঁটে যাওয়ার শাস্তিও আমাদের অজানা নয়।
২০১৭ সালের সেই ভাইরাল হওয়া ভিডিও ভুলি কেমন করে? পাঁচ বছরের মৃত মেয়েকে কাপড়ে ঢেকে বাবা কোলে করে নিয়ে যাচ্ছেন হাসপাতাল থেকে ১৫ কিলোমিটার দূর নিজের বাড়িতে। পায়ে হেঁটে। পরে আরেকটা ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল। মৃত স্ত্রীকে কাপড়ে বেঁধে দানা মাঝির ১২ কিলোমিটার পথ হাঁটা। সঙ্গে সমানে হেঁটে চলেছে তাদের মেয়ে। দলিত বলে তাদের সরকারি সাহায্যে একটা অ্যাম্বুলেন্স পর্যন্ত জোটেনি। দিল্লির থেকে নাকের ডগার দূরত্ব ফরিদাবাদ। ২০১৫ সালে শুধু উচ্চ বর্ণের সঙ্গে ঝগড়ার কারণে রাত্রি আড়াইটার সময় মাত্র আড়াই বছর এবং এগারো মাসের দুই দলিত শিশুকে ঘরে পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। ঘটনার প্রেক্ষিতে তৎকালীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ভি কে সিং মন্তব্য করেছিলেন ‘কেউ কুকুরের ওপর পাথর ছুড়লে তার দায় সরকার নেবে না’। দলিতদের প্রতি বর্তমান সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছেন সেদিন।
এইতো, বছর খানেক আগের ঘটনা। গুজরাটে এক দলিত পরিবারের বিয়েতে পাথর ছুড়ে হামলা করে গ্রাম প্রধান সহ উচ্চবর্ণের সম্প্রদায়। অপরাধ, দলিত হয়ে বিয়েতে পাগড়ি কেন পরেছিল? উঁচু জাতের কোনো একজনের জমিতে প্রস্রাব করার অপরাধে উত্তর প্রদেশে এক দলিত যুবককে গুলিবিদ্ধ হয়ে খুন হতে হয়েছিল।
আজ আজাদীর অমৃত মহোৎসবে ঘরে ঘরে পতাকা তোলার আনন্দে কি আমরা বছর দুই আগের হাতরাসের ঘটনা ভুলে গেছি? ১৯ বছরের দলিত কে গণধর্ষণ করে জিভ কেটে হত্যা করার সেই নৃশংস ঘটনা। আবার মারা যাবার পর রাতের অন্ধকারে বাড়ির মানুষদের তালা বন্দী করে প্রশাসনের দ্বারা পেট্রোল ঢেলে মর দেহ জ্বালানোর সেই ঘটনা।
২০১৬ এর জানুয়ারিতে আত্মহত্যা (?) করে হায়দ্রাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের দলিত গবেষক রোহিত ভেমুলা। শুধুমাত্র কেন্দ্র সরকারের অনুরাগী ছাত্র সংগঠনের দেওয়া অভিযোগের ভিত্তিতে তৎকালীন মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি রোহিতের সঙ্গে আরও চার জন দলিত ছাত্রের ফেলোশিপ বন্ধ করে তাদের সাসপেন্ড করে দেয়। অপরাধ, দলিত হয়ে প্রতিবাদ করার সাহস পায় কোথা থেকে? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বৈষম্যমূলক আচরণ সম্পর্কে অধ্যাপক শুকদেও থোরাটের বিস্তারিত গবেষণা আছে। অধ্যাপক থোরাটে তখন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান। তাঁর নেতৃত্বে দিল্লির বিখ্যাত AIIMS এ ছাত্রছাত্রীদের বৈষম্যমূলক অভিযোগের ভিত্তিতে একটি কমিটি গঠন করা হয়, সেখানে তিনি যে রিপোর্ট জমা দেন, তাতে শিক্ষাঙ্গনে দলিত ছাত্রছাত্রীদের সাথে বৈষম্যমূলক আচরণের সমস্যা নিরসনে বারে বারে সমানাধিকার সংক্রান্ত বিভাগ ((Equal Opportunity Office) চালু করার সুপারিশ রয়েছে। এবং এটি শুধু এইমসের জন্য নয়, বরং সারা দেশের একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য বলা হয়েছে। ২০০৭ সালে এই প্রতিবেদন জমা করা হলেও তার বাস্তব রূপায়ণে রাষ্ট্রের অনিচ্ছা থাকায় হায়দ্রাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে রোহিত ভেমুলা, জে এন ইউ তে মুথুকৃষ্ণন কিংবা চলতি বছরে আইআইটি বোম্বে তে দর্শন সোলাঙ্কি দের এখনও আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হচ্ছে।
একটি গাড়ির কোনো একটি চাকা পাংচার হয়ে গেলে গাড়িটি থেমে যাবে। সমাজেও কোনো একটি সম্রদায়কে পেছনে ফেলে রাখলে সে সমাজই বা এগোই কেমন করে? সেই জন্যই আম্বেদকর সংবিধান রচনা করার সময় দলিত এবং তফসিলিদের জন্য সামাজিক ক্ষেত্রে, শিক্ষা ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে, সরকারি চাকরিতে, এইরকম নানা ক্ষেত্রে কতগুলো রক্ষাকবজ তৈরি করে যান। কিন্তু দেখা গেল ৯০ এর দশক পর নতুন উদারীকরণ অর্থনীতি শুরু হওয়ার পর থেকে জনকল্যাণ মূলক এই বিষয়গুলো অকার্যকরী হতে শুরু করলো। ব্যাপক বেসরকারিকরণ সরকারি ক্ষেত্র গুলোকে তো সংকুচিত করলোই, সেই সঙ্গে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হল সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া অংশের মানুষ। যেখানে ‘৭৪-‘৭৫ সালে ৪৪.৩৮ গ্রামীণ দলিত পরিবারের হাতে জমি ছিল, সেখানে নবউদার অর্থনীতির প্রথম দশকে তা নেমে গেল ৩৫.০৫ শতাংশে। ২০০১ সালে জমি আছে এমন পরিবার পড়ে রইল ২০ শতাংশে এবং ২০১১ পর্যন্ত এসে দাঁড়ালো ১৪.৮ শতাংশ। তফসিলি জাতিভুক্তদের মধ্যে ভুমিহীনদের সংখ্যা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। বর্তমানে সরকারের পক্ষ থেকে এসসি এবং এসটিদের সরাসরি বিভিন্ন সুবিধাদায়ক প্রকল্পগুলো কীভাবে বন্ধ করা হয়েছে তা সম্প্রতি ন্যাশনাল ক্যাম্পেইন ফর দলিত হিউম্যান রাইটস স্পষ্টভাবে পরিসংখ্যানে দেখিয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে সবকটি চাকাকে মজবুত করা দরকার। যে চাকাটি অপেক্ষাকৃত দুর্বল তাকে একটু বেশি যত্ন নিয়ে মেরামত করে বাকি চাকাগুলোর সমান করতে পারলেই দেশ এগিয়ে যাবে তার সর্বোচ্চ গতি নিয়ে। তাই সংরক্ষণ দরকার। ‘৯০ এর সময় শুরু হলেও নয়া উদারবাদ আগ্রাসী রূপ নিয়েছে বিগত এক দশকে, বর্তমান সরকারের জমানায়। ফলে শিক্ষা, সরকারি কাজ এবং বিভিন্ন ক্ষেত্র ভয়ঙ্কর ভাবে সংকুচিত হয়েছে এবং এই বাস্তবতাকে আড়াল করতে নিজেদের দায় সংরক্ষণের ওপর চাপিয়ে সাধারণ ঘরের মানুষদের দলিতদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলছে। অলকেশ দাস তাঁর সম্প্রতি এক প্রবন্ধে লিখেছেন “উদারীকরণের পাল্লায় শ্রমক্ষেত্রের ৯৮ শতাংশ অসংগঠিত ক্ষেত্র। সেখানে কোনো সংরক্ষণ নেই। পরে রইল ২ শতাংশ সংগঠিত ক্ষেত্র, যদিও তার সবটা সরকারি নয়। ধরে নিলাম ১ শতাংশ সরকারি সংগঠিত ক্ষেত্র। এর মধ্যে অর্ধেক প্রমোশন, সেখানে সংরক্ষণ নেই। পড়ে থাকলো ০.৫ শতাংশ। সংরক্ষণের সাংবিধানিক সিলিং হচ্ছে চাকরি বা কাজের ৪৯.৫ শতাংশ। সুতরাং সংরক্ষণ কার্যকরী হবে কাজের ০.২৫ শতাংশ।” অথচ প্রচার করা হচ্ছে তফসিলি এবং আদিবাসীরা সব চাকরি খেয়ে নিল। দেশে ১৬.৬ শতাংশ দলিতদের হাতে আছে দেশের মোট সম্পদের ৭.৬ শতাংশ আর ২২.৪ শতাংশ উচ্চ জাতির হাতে আছে ৪১ শতাংশ সম্পদ। এই অসম চাকা নিয়ে দেশের গাড়ি কীভাবে চলতে পারে?
ভোট যখন আসল বালাই, তখন পরিচিতি সত্তার সস্তা রাজনীতি হয়ে ওঠে লুডোর ডাইস। তাই ভোটের আগে কুম্ভ মেলায় মেথর মেথরানির পা ধুইয়ে দেন যাঁরা, তারাই আবার বর্ণবাদী মনুস্মৃতি আইনকে দেশের সংবিধানে আনতে চান। তারাই বলেন “গরুর জীবনের দাম দলিতদের জীবনের দামের চেয়ে অনেক বেশি”, দলিতদের জন্য মন্দিরের দরজা বন্ধ করতে তারাই বিশ্বাসী। ব্রাহ্মন্যবাদ যাদের কাছে মূল ভিত্তি, তাদের কাছে দলিতদের স্থান পায়ের নিচে। তাই কিছু দলিতদের পা ধুয়ে দিলেই দলিতদের মসীহা যেমন হওয়া যায় না, তেমন আমাদের মনে রাখতে হবে পশ্চিমবঙ্গ ‘বাউড়ী উন্নয়ন পর্ষদ’, ‘বাগদী উন্নয়ন পর্ষদ’ কিংবা ‘হাড়ী উন্নয়ন পর্ষদ’ গঠন করে পশ্চিমবঙ্গে দলিতদের সমষ্টিগত উন্নয়ন করা যায় না। এটা আসলে সাব-অল্টার্ন রাজনীতি। যেখানে দলিত সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভিন্ন ছোটো ছোট উপ সম্প্রদায়ে ভাগ করে জনগোষ্ঠীগুলির মধ্যেকার দ্বন্দ্বকে ব্যবহার করে তাদের পরস্পরের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা। ফলে অখণ্ড পিছিয়ে পড়া দলিত সম্প্রদায়ের আর্থ সামাজিক উন্নয়নের সামগ্রিক পরিকল্পনা থেকে বিচ্ছিন্ন করে বিচ্ছিন্নতাবাদী সামাজিক ঐক্য বিরোধী ধারায় যুক্ত করা।
কলসি স্পর্শ করার ‘অপরাধে’ ইন্দ্রকে মেরে ফেলা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এর পেছনে আছে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা। জাতপাত ভিত্তিক রাজনৈতিক ফায়দা। তাই রামনাথ কোবিন্দকে রাষ্ট্রপতির চেয়ারে বসালেও আমরা ভুলি কেমন করে যে যারা তাঁকে রাষ্ট্রপতির চেয়ারে বসালেন তারাই চান না রামনাথ কোবিন্দরা মন্দিরে প্রবেশ করার অধিকার পাক। সেই অধিকার নিয়ে আম্বেদকরের সঙ্গে লড়াইয়ে সামনের সারিতে যে নামগুলো আসে তারা হলেন পি সুন্দরাইয়া, এ কে গোপালন এবং নাম্বুদিরিপাদ। আম্বেদকর বলেছিলেন ‘হিন্দু-রাজ যদি বাস্তবে পরিণত হয়, নি:সন্দেহে এটি এই দেশের জন্য সবচেয়ে বিপর্যয় হবে। (এটি) স্বাধীনতা, সাম্য এবং ভ্রাতৃত্বের জন্য হুমকি। সে কারণে যে কোনো মূল্যে হিন্দুরাজ প্রতিরোধ করতে হবে’। সুতরাং দেশকে প্রকৃত ভালোবাসতে হলে, দেশকে স্বনির্ভর করতে হলে, দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে দেশের সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গকেই সমান ক্ষমতায় সচল করতে হবে। আর যারা দলিত, আদিবাসী, সংখ্যালঘুদের অধিকার কেড়ে দেশকে বিকলাঙ্গ করার চেষ্টা করছে সেই মানসিকতার রাজনীতিকে আস্তাকুড়ে ছুড়ে ফেলার দায়িত্ব নিতে হবে সারা দেশের দেশপ্রেমীদের।