ডা: দীপ্তজিৎ দাস
চে-তনায় মুখরিত কল্লোলিনী তিলোত্তমা স্বাগত জানিয়েছে অ্যালেইদা গ্যেভারা ও এস্টেফানিয়া গ্যেভারাকে। সংগ্রামের মাটিতে বাংলার ছাত্র যৌবন হৃদয়ের উষ্ণতা দিয়ে বরণ করে নিয়েছে স্বপ্নের নায়কের উত্তরাধিকারকে। দমদম, বরানগর, যাদবপুর, উত্তরপাড়া ও কলেজ স্ট্রিটে উপচে পড়েছে মানুষের ঢল চে’র কন্যা ও নাতনির মুখে কিউবার অনবদ্য লড়াইয়ের উপাখ্যান শুনতে। চে মানে সেই আশ্চর্য চুম্বক যা হাজার হাজার মাইল দূরত্ব অতিক্রম করে স্থান নেয় মানুষের হৃদয়ে তার আপনজন হিসেবে।
‘চে গ্যেভারার জীবন যে কোনো স্বাধীনতা প্রেমী মানুষের কাছেই একটি অনুপ্রেরণা। আমরা সর্বদা তার প্রদর্শিত পথের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করব।’ বর্ণবৈষম্যের বীজ সমাজের বুক থেকে উপড়ে ফেলার স্বপ্ন নিয়ে নতুন দক্ষিণ আফ্রিকা গড়ার কাজ শুরু করেছেন নেলসন ম্যান্ডেলা। বিপ্লবের বরপুত্র চে’র সম্পর্কে তখনই তার এমন অমোঘ উক্তি। বিশ্বের যে কোন প্রান্তে যে কোন নিপীড়িত, বঞ্চিত মানুষের কাছেই আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ তিনি। সব হারানো মানুষকে সব পাওয়ার স্বপ্ন দেখানোর জাদুকর সেই কমান্দান্তে। সিয়েরা মায়েস্ত্রার সেই অকুতোভয় গেরিলা যোদ্ধাই সদ্য ভূমিষ্ঠ বিপ্লবের শিল্পমন্ত্রী কিউবায়। সমাজতান্ত্রিক কিউবার ভিত্তি সুদৃঢ় করে অবলীলায় স্বাচ্ছন্দ্য ঝেড়ে ফেলে কঙ্গো বা বলিভিয়ায় তার অনন্য সংগ্রাম বিশ্বজনীনতার এক অনবদ্য দলিল। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের আধুনিক আইকন তিনি। আবার পুঁজিবাদ, পণ্যায়নের হাতেও প্রতিনিয়ত অপব্যবহৃত হওয়া একটি ব্র্যান্ড চে। তবে সবকিছুর মাঝেই প্রচারের আলোর আড়ালে থাকে তার চিকিৎসা বিজ্ঞান সম্পর্কিত বিপ্লবী চেতনা।
নিজের জীবনে গ্যেভারা অসংখ্যবার বলেছেন চিকিৎসক হিসেবে তার কাজ করার অভিজ্ঞতাই তাকে বিপ্লবী হয়ে উঠতে অনুপ্রাণিত করেছিল। ১৯২৮ সালের ১৪ই জুন রোজারিওতে জন্ম হয় তার। শৈশব থেকেই প্রিম্যাচিউরিটিজনিত সমস্যার কারণে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম ছিল চে’র। মূলত তার স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্যই ১৯৩২ সালে তার পরিবার আলা গ্রাসিয়াতে স্থানান্তরিত হয়। শ্বাসকষ্ট জনিত ব্যাধি শৈশব থেকেই সঙ্গী হয় তার, নিয়মিত নিতে হতো ইনহেলার। ছোটবেলা থেকেই মেধাবী ছাত্র গ্যেভারা ছিলেন সাহিত্য অনুরাগী। পড়ার নেশা থেকেই সংস্পর্শে আসেন মার্কসীয় দর্শনের। পাশাপাশি নিজের শারীরিক দুর্ভোগই তার মনে জেদ সৃষ্টি করেছিল চিকিৎসক হওয়ার। ১৯৪৭ সালে আর্জেন্টিনার রাজধানী শহরে বুয়েন্স এয়ার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ মেডিসিনে ভর্তি হন চে। পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন রোগ সংক্রান্ত বিষয়ে গভীর চর্চায় উৎসাহী হয়ে ওঠেন তিনি। মূলত চিকিৎসা বিজ্ঞান সংক্রান্ত গবেষণার মাধ্যমে নিজের ছাপ রেখে যাওয়ার স্বপ্ন নিয়েই চিকিৎসা বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে পঠনপাঠন শুরু তার। তবে প্রায়োগিক জ্ঞান আহরণের নেশা তাকে করে তুলেছিল পরিযায়ী। তাই মেডিকেল কোর্সে শেষ বর্ষের পরীক্ষা না দিয়েই শৈশবের রাগবি কোচ পাশাপাশি বায়োকেমিস্ট আলবার্তো গ্রানাডোকে সাথে নিয়ে লাতিন আমেরিকা চষে বেড়ান চে। হাইতি ও ডমেনিকান রিপাবলিক ছাড়া মহাদেশের প্রায় প্রতিটি দেশের সাধারণ মানুষের সাথে চিকিৎসার কাজ করেন তারা। এই অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা তার জীবনে দিয়েছিল এক অকৃত্রিম শিক্ষা। সমাজের বিভিন্ন রোগ ব্যাধির মূলে সামাজিক ব্যবস্থা অপুষ্টি, সম্পদের অসম বন্টন,বর্ণবৈষম্য ,উপনিবেশবাদ ,দারিদ্র ,ক্ষুধা ইত্যাদি বেড়াজালকে মূল কারণ হিসেবে আবিষ্কার করেন তিনি। চিকিৎসা বিজ্ঞানে ততদিনে ছড়িয়ে পড়েছে রুডলফ ভির্চৌর সামাজিক মেডিসিন সংক্রান্ত গবেষণা। লাতিন আমেরিকার চিকিৎসক মহলের একটা বড় অংশ অনুপ্রাণিত হয়েছেন জনস্বাস্থ্যের বিষয়। পপুলার ফ্রন্টের স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে চিলিতে তার প্রয়োগের আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন আলেন্দে। পেরুতে থাকাকালীন চে সংস্পর্শে আসেন বিখ্যাত কমিউনিস্ট চিকিৎসক হুগো পেস্কোর। পেস্কোর সাথেই প্রায় ৬০০র বেশি কুষ্ঠ রোগীর চিকিৎসা করেন গ্যেভারা। কুষ্ঠ রোগীদের সংহতি তার মনে গভীর প্রভাব ফেলে। তাদের সেই সংহতির বার্তাই সারা জীবনে বিপ্লবের স্ফুরণের মাধ্যমে পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন সমাজের চিকিৎসক। আলবার্তোর সাথে এই মোটরসাইকেল সফর চে’র জীবনে ছিল গুরুত্বপূর্ণ টার্নিং পয়েন্ট। পরবর্তী জীবনে সমস্ত অবকাশেই চিকিৎসা বিজ্ঞান কে অন্য দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিশ্লেষণ করে জনস্বাস্থ্য এবং সামাজিক মেডিসিনকে তুলে ধরার প্রয়াস চালান তিনি।
ঐতিহাসিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে কিউবায় সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল বিপ্লবকে শক্ত ভিতের উপর দাঁড় করানো। কাস্ত্রো সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিজ প্রতিভার বিচ্ছুরণ ঘটিয়ে সেই কাজে অন্যতম প্রধান ভূমিকা নেন গ্যেভারা। দারিদ্র, ক্ষুধা, জরায় বিধ্বস্ত জাতির কাছে চে’র স্বাস্থ্য নীতি হয়ে ওঠে বিশল্যকরণী। নিজ অভিজ্ঞতা থেকে তিনি অনুধাবন করেন সরাসরি অসুখের চিকিৎসা করার পরিবর্তে অসুখের কারণ সন্ধান করা এবং তা সমূলে উৎখাত করা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ১৯শে আগস্ট ১৯৬০, কিউবান মিলিশিয়ায় ঐতিহাসিক বক্তৃতায় চে বলেন , ‘ মেডিসিনে আমাদের একটি শক্তিশালী কাঠামো গড়ে তোলা দরকার। যে কাঠামো কেবল একজন চিকিৎসকের দুর্বল অনুজীবের উপর পারদর্শিতার উপর নির্ভর হবে না। বরং সমষ্টির চিকিৎসায় জন্যসমষ্টির অংশগ্রহণের মাধ্যমে গঠিত হবে।’ তার বক্তব্য এবং লেখনীর মাধ্যমে বরাবর ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার বিরুদ্ধে সমষ্টির স্বার্থে নিজেদের তুলে ধরবার জন্য কিউবার তরুণ প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করেন বিপ্লবের নায়ক। তিনি মনে করতেন মেডিসিনকে রোগ প্রতিরোধের লক্ষে এবং প্রতিষেধক মূলক বিজ্ঞান হিসেবে গড়ে তোলা প্রয়োজন। কেবল মানুষের সাধ্যাতীত জটিল রোগের ক্ষেত্রেই ওষুধের ব্যবহার আবশ্যক।
জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত নিজের পরিকল্পনা সামাজিক মেডিসিনের পরিবর্তে বিপ্লবী মেডিসিন নামে
আখ্যায়িত করেন চে। রোগের পরিবর্তে রোগের কারণ নির্মূল করার জন্য চলতে থাকে বিপ্লবী রাষ্ট্রের লড়াই। চে মনে করতেন দারিদ্র্য, অপুষ্টি, সম্পদের অসম বন্টন দূর করার মাধ্যমে রোগের প্রকোপ অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব। তার জন্য শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতি সমান্তরাল করার জন্য সওয়াল করেন তিনি। চিকিৎসকদের রোগীর আপনজন হয়ে ওঠার পরামর্শ দিয়েছিলেন তিনি।প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্বাস্থ্য কেন্দ্র গড়ে তোলা এবং সেখানে ডাক্তার ও নার্সের উপস্থিতি সুনিশ্চিত করা তার মতে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতির অন্যতম শর্ত। পুষ্টি এবং পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে মানুষকে ওয়াকিবহল করার মাধ্যমে স্বাস্থ্যের বিষয় তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার পরিকল্পনাও ছিল তার। এলাকায় এলাকায় স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে তুলে তাদের মাধ্যমে স্বাস্থ্য বিষয়ক বিভিন্ন প্রকল্প গড়ে তোলার পরিকল্পনাও শুরু করেন গ্যেভারা। মূলত প্রতিষেধক মূলক মেডিসিন উন্নত স্বাস্থ্যের সহায়ক হতে পারে বলে বিশ্বাস ছিল তার। স্বাস্থ্য দপ্তরকে তিনি জানান প্রত্যেক চিকিৎসকের মধ্যেকার সৃজনশীল ক্ষমতা সামাজিক মেডিসিনে ব্যবহার করাই আশু কর্তব্য।
পেরুতে কুষ্ঠ রোগীদের সাথে কাজ করার সময় তাদের সংহতি হৃদয়ে আঁচড় কাটে চে’র। বিপ্লবের প্রতীক হিসাবে কিউবায় নতুন মানুষ গড়ে তোলার পথিকৃৎ ছিলেন তিনি। ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার পরিবর্তে সমষ্টির স্বার্থ এবং নিজেকে সমাজের একজন হিসাবে অনুধাবন করাই ছিল তার মতে বিপ্লবের তৈরি নতুন মানুষের কাজ। দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় যেমন জনস্বাস্থ্যের উপর নজর দেন, তেমনই বিশ্বের অন্যপ্রান্তেও স্বাস্থ্য বিষয়ক সাহায্যের জন্য দরাজ ছিলেন তিনি। নিজের দেশে প্রত্যেক মানুষকে সামাজিক দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে সকলের স্বাস্থ্যকে চ্যাম্পিয়ন করার আহ্বান ছিল গ্যেভারার। বিপ্লবী এই চিকিৎসকের মনে ছিল বিশ্বজনীনতার স্পন্দন। মূলত তার উদ্যোগেই ১৯৬০ সালে চিলিতে ভূকম্পনের পরবর্তী সময়ে কিউবা চিকিৎসক দল প্রেরণ করে। ১৯৬৩ সালে আলজেরিয়ার মুক্তি সংগ্রাম চলাকালীন কিউবান মেডিকেল টিম পাঠানোর নেপথ্যেও ছিল তার ভূমিকা। আন্দিজের দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলের বসবাসকারী মানুষদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য চে’র নির্দেশে ৭৫০ জন চিকিৎসকের দল পাঠায় কিউবা। পরবর্তীতে ৪০০০ চিকিৎসক স্বাস্থ্যকর্মী নার্স পাঠানোর পরিবর্তে ভেনেজুয়েলার সাথে খনিজ তেলের আদান প্রদানের চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল কিউবা। পণ্যায়ন নয়, বিশ্বসংহতির মাধ্যমে সুস্বাস্থ্য ও সুন্দর বিশ্ব গড়ে তোলার আহ্বান দিকে দিকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন গ্যেভারাই।
চে’র মৃত্যুর পরেও স্বাস্থ্য সম্পর্কিত তার বিপ্লবী চিন্তার আশ্চর্য প্রদীপ রক্ষা করছে তার স্বপ্ন দ্বারা নির্মিত রাষ্ট্র কিউবা। ১৯৭৬ সালে আর্টিকেল ৫০ এর মাধ্যমে কিউবার সংবিধানে সকল নাগরিকের স্বাস্থ্যের অধিকার ও বিনামূল্যে চিকিৎসার স্বীকৃতি দেওয়া হয়। প্রধানত ফ্যামিলি মেডিসিন এবং ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান দ্বারা আশ্চর্য জালকের মত সমাজের ভূমিস্তর পর্যন্ত ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশের ছাত্র-ছাত্রীদেরও সকলের শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার অঙ্গনে বেশি করে এনে উচ্চশিক্ষিত করার প্রয়াস নেওয়া হচ্ছে। ফলে সমাজের সর্বস্তরের প্রতিনিধিত্ব বাড়ছে চিকিৎসা পেশায়। কিউবার গ্রাম ও শহরে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সম উন্নত। প্রত্যন্ত অঞ্চলে হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র গড়ে তুলে চিকিৎসকদের সেখানেই প্র্যাকটিস করার জন্য উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। ফ্যামিলি ফিজিশিয়ানরা বছরে অন্তত একবার প্রত্যেকটি পরিবারের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে থাকে। হাসপাতাল স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পাশাপাশি রোগীর চাপ কমানোর জন্য এলাকায় এলাকায় সরকারি উদ্যোগে গড়ে তোলা হয়েছে পলিক্লিনিক। বেসরকারি অনুপ্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে স্বাস্থ্যে। চিকিৎসার পাশাপাশি বীমা ব্যবস্থাও সম্পূর্ণ রাষ্ট্রায়ত্তকরন করা হয়েছে কিউবায়। এমনকি বহু ওষুধেরও রাষ্ট্রায়ত্তকরন করা হয়েছে। গবেষণা চলছে, নতুন নতুন প্রতিষেধক এবং ওষুধ আবিষ্কারের। স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকদের দ্বারা পরিচ্ছন্নতা অনুশীলনের জন্য শৃঙ্খলিত করা হচ্ছে মানুষকে। এছাড়াও রাষ্ট্রের উদ্যোগে গর্ভধারিণী ও শিশুদের পুষ্টির জন্য বিশেষ খাদ্যের সরবরাহের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।পূর্বে স্বাস্থ্যে বাজেটের দশ শতাংশ অনুমোদিত হলেও সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর তা কিছুটা কমে। তবে আজও কিউবার স্বাস্থ্যে বরাদ্দ পুজিবাদী দেশগুলোর থেকে বেশি।
বিপ্লবের অব্যবহিত পরে ১৯৬০ সালে দেশে চিকিৎসকের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩০০০। সার্বজনীন শিক্ষা এবং সমাজের প্রতি স্তরে শিক্ষার আলোকবর্তিকা পৌঁছে দেওয়ার ফলে বর্তমানে কিউবা প্রতি হাজার জনে নয় জন চিকিৎসক রয়েছেন। স্বৈরাচারী বাতিস্তা শাসনে কিউবায় শিশু মৃত্যুর হার ছিল প্রতি হাজারে ৩২। প্রসূতি এবং শিশুদের জন্য বিশেষ পুষ্টির কর্মসূচির মাধ্যমে বর্তমানে নেমে হয়েছে ৪.২ যা সমগ্র লাতিন আমেরিকায় সর্বনিম্ন। বাতিস্তা আমলের ভঙ্গুর পরিকাঠামোয় কিউবানদের গড় আয়ু ছিল ৬৩.৯। সে সময় আমেরিকায় যা ছিল ৬৯.৭৭। সমাজতন্ত্রই সেই অদৃশ্য মেকানিজম যা মানুষকে মাথা তুলে বাঁচতে শেখায়। বদলে যাওয়া সিস্টেমের ছোঁয়ায় আজ কিউবায় মানুষের গড় আয়ু ৭৮.৯। দীর্ঘদিন ধরে দ্বীপ রাষ্ট্রের উপর অমানবিক অবরোধ চালিয়ে আসা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে ৭৬.১। গ্যেভারার উত্তরসূরিরা এভাবেই প্রতিদিন শুনিয়ে যাচ্ছে সত্যি বাঁচার গল্প।
অভ্যন্তরীণ স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতির পাশাপাশি স্বাস্থ্য আন্তর্জাতিকতাবাদ কিউবার অপূর্ব নজির। গ্যেভারার বিপ্লব ও নতুন মানব তত্ত্ব এবং সংহতির চিন্তন একরত্তি দ্বীপ রাষ্ট্রকে উদ্বুদ্ধ করেছে পৃথিবীর সকল প্রান্তে আর্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে। দুনিয়া বদলের স্বপ্ন যারা দেখেন পৃথিবীর সকল মানুষের উন্নতির জন্য নিজেদের উৎসর্গ করতে প্রস্তুত হন তারাই। ১৯৬৩ সাল থেকেই নির্দিষ্ট প্রোগ্রামের মাধ্যমে কিউবা বিপদাপন্ন রাষ্ট্রগুলোতে স্বাস্থ্য কর্মীদের দল প্রেরণ করে থাকে। ভূকম্প বিধ্বস্ত চিলি ,ইরান ,ভেনেজুয়েলা টর্নেডো বিধ্বস্ত হাইতি, হান্ডুরাস অথবা সুনামি বিধ্বস্ত শ্রীলংকা বা ভূমিধসে ক্ষতবিক্ষত কাশ্মীর সর্বত্রই মানবতার ক্রন্দনে সাড়া দিয়ে নিজেদের নিয়োজিত করেছেন কিউবানরা। পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও মেডিকেল টিম পাঠিয়ে সংহতির বার্তা জানানো হয়েছে। বর্তমান সময়ে ডিজাস্টার ট্যুরিজম অর্থাৎ বিপর্যয়গ্রস্ত স্থানে দল পাঠিয়ে অভিজ্ঞতা সংগ্রহের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলোর তরফ থেকে। এর সরাসরি বিপরীতে অভিজ্ঞ এবং পারদর্শী চিকিৎসক নার্স বাহিনীকে দুর্ঘটনাস্থানে পাঠিয়ে শেষ পর্যন্ত লড়ার হিম্মত দেখায় কিউবা।
বিশ্বমানবতার হাহাকারে সাড়া দিয়ে স্পন্দিত হয়েছে কিউবার হৃদয়। সংহতিতে ধর্ম,বর্ণ ,ভাষা এমনকি রাজনৈতিক মতবাদ কখনও ব্যারিকেড তৈরি করতে পারেনি। দীর্ঘদিন ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অমানবিক অবরোধ রুদ্ধ করেছে দেশটির উন্নতি। অত্যাবশ্যকীয় পণ্য থেকে জীবনদায়ী ওষুধও অমিল থাকে দেশটির কাছে এই অবরোধের ফলে। কিন্তু দেশে-বিদেশে সংকটের পরিস্থিতিতে ত্রাতার ভূমিকায় মেডিকেল টিম প্রেরণ করে কিউবা, যার নাম হেনরি রিভ ব্রিগেড। স্প্যানিশ অধীনতা থেকে মুক্তির জন্য যখন মরণপণ লড়াই করছে কিউবার সাধারণ মানুষ তাদের সঙ্গী হয়েছিলেন এই অসম সাহসী আমেরিকান। এমনকি তামাম বিশ্বের বিপ্লবী চেতনার আবেগ গ্যেভারাকে হত্যা করেছিলেন যে বলিভিয়ান সেনা সেই মারিও টেরনের চোখে জটিল অস্ত্র প্রচারের মাধ্যমে তার দৃষ্টি শক্তি ফিরিয়ে আনেন কিউবান চিকিৎসকরা। আন্তর্জাতিকতাবাদে অনুপ্রাণিত বিপ্লবী স্পর্ধা যেন তাচ্ছিল্যভরে পরাস্ত করে ফ্যাসিবাদকে।হাভানায় স্থাপিত লাতিন আমেরিকা স্কুল অফ মেডিসিনের দ্বার উন্মুক্ত বিশ্বের সব প্রান্তের চিকিৎসা বিজ্ঞানের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য। সেখান থেকে প্রায় ৩০ হাজারের বেশি পড়ুয়া চিকিৎসা বিজ্ঞানে শিক্ষিত হয়েছে। কিউবার বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের প্রধান অবলম্বন হয়ে উঠেছে চিকিৎসা ব্যবস্থা। ১৯৯৮ থেকে ২০০৩ পর্যন্ত একটি মেডিকেল টিম কাজ করে হন্ডুরাসে। এই পাঁচ বছরের মধ্যেই মধ্য আমেরিকার এই রাষ্ট্রে শিশু মৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ৩০.৮ থেকে কমে ১০.১ এবং প্রসূতি মৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ৪৮.১ থেকে কমে ২২.৪ হয়। এই তথ্যই কিউবার স্বাস্থ্যকর্মীদের নৈপুণ্য ও দায়বদ্ধতার প্রামাণ্য নিদর্শন। রাষ্ট্রপুঞ্জের তথ্য অনুযায়ী ২০১৯ সালে বিশ্বের ৬৭ দেশের প্রায় ৩০ হাজার কিউবার চিকিৎসক কর্মরত ছিলেন। ১৯৬৩ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন মিশনে প্রায় ১০৩ টি দেশে ছয় লক্ষের বেশি স্বাস্থ্যকর্মী পাঠিয়েছে এই দ্বীপ রাষ্ট্রটি। সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলি যখন বিশ্বের দেশে দেশে সামরিক ঘাঁটি গড়ে তোলে সেই সময়ের চে’র চেতনায় বলীয়ান কিউবা দেশে দেশে প্রেরণ করে হোয়াইট কোট ভলান্টিয়ার বাম্পন্থার পতাকা উড্ডীন করেই।
‘মনে রাখবে বিপ্লবই হল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এবং তা আমাদের প্রত্যেকের জন্য। বিচ্ছিন্নভাবে প্রত্যেকেই আমরা মূল্যহীন। সর্বোপরি নিজেদের মর্মস্থল থেকে পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে যে কোন মানুষের প্রতি সংগঠিত যে কোন অপরাধের প্রতি হতে হবে সংবেদনশীল।’নিজের সন্তানদের প্রতি শেষ চিঠিতে এই বার্তাই দিয়েছিলেন স্নেহময় পিতা চে। মাত্র ৩৯ বছরের জীবনে যিনি পৃথিবীর প্রতিটা প্রান্তে অবচেতন মনে চেতনার স্ফুলিঙ্গ জ্বালানোর অদৃশ্য বারুদের কাজ করেন, তিনি পরবর্তী প্রজন্মের কাছে নিজের ছাপ রেখে যাবেন এটাই স্বাভাবিক। একজন আদর্শ বামপন্থী হিসেবেই নিজের উত্তরাধিকার কে শ্রেণী চিনতে শিখিয়েছিলেন গ্যেভারা। সন্তানের পড়াশুনা এবং তাদের আদর্শ মানুষ হয়ে ওঠার রসদ যোগানোর কাজে সদাই তৎপর ছিলেন তিনি। তাই প্রিয় কন্যা অ্যালেইদা যখন তাকে প্রশ্ন করেন বিপ্লবকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তার কি করা উচিত। চে’র সহজ উত্তর ছিল মানুষের দুঃখ নিবারণের জন্য তুমি একজন ভালো চিকিৎসক হয়ে ওঠো। পরবর্তী সময়ে নিজের চিকিৎসক হয়ে ওঠার পিছনে বাবার চিন্তার অবদানকে উল্লেখ করেছেন অ্যালেইদা।
বিশ্বজুড়ে প্রতিস্পর্ধী মানুষের চোখে লড়াইয়ের দাবি ছিনিয়ে নেওয়ার মূর্ত প্রতীক চে গ্যেভারা।স্বভাবতই তার উত্তরাধিকার বহনের কাজ অত্যন্ত কঠিন। কিন্তু তার শেখানো আন্তর্জাতিকতাবাদ এবং সংহতির মন্ত্রই নিজের জীবনে অনুশীলন করে চলেছেন অ্যালেইদা।কিউবার মেডিকেল স্কুল থেকে চিকিৎসা বিজ্ঞানে উত্তীর্ণ হয়ে দেশের মেডিকেল টিমের সঙ্গী হয় নিকারাগুয়া যান তিনি। সাধারণ মানুষের হাহাকারের ভয়াবহ চিত্র তার মনে গভীর রেখাপাত করে। পাশাপাশি এক শ্রেনীর চিকিৎসকদের স্বার্থলোভ তার মানসিক পীড়ার কারণ হয়। পরবর্তীতে নিকারাগুয়ার রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠলে স্বয়ং কাস্ত্রো মেডিকেল টিমের ছাত্র-ছাত্রীদের দেশে ফিরিয়ে আনেন। পরবর্তীতে অ্যাঙ্গোলার মুক্তিযুদ্ধের পর নতুন গড়ে ওঠা জাতির স্বাস্থ্যের বুনিয়াদ গঠনের জন্য কিউবার কাছে সাহায্য প্রত্যাশা করা হয়। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে কিউবার প্রেরিত মেডিকেল টিমের শরিক হন অ্যালেইদা। আফ্রিকার মানুষের সারল্য, দারিদ্র ,ক্ষুধা, বঞ্চনা ,উপনিবেশিকতাবাদের টাটকা ক্ষত তার মনে গভীর রেখাপাত করে। রোগব্যাধি ,স্বাস্থ্যহানির পিছনে সমাজে প্রোথিত কারণগুলিকে আরো কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়েছিল তার। অ্যাঙ্গোলার ১৬ টি প্রদেশের ১৫টি প্রদেশেই ছড়িয়ে পরেন কিউবান চিকিৎসকরা। এই সময় দুবার কলেরার প্রাদুর্ভাব হলে পরিস্থিতি দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। অ্যালেইদা’র অভিজ্ঞতায়,’ বাবা মায়েরা মৃত শিশুদের নিয়ে হাসপাতালে আসছিল আর আমরা কিছুটি করে উঠতে পারছিলাম না।’ অ্যাঙ্গোলা সফরের পর অ্যালেইদাও হয়ে ওঠেন একজন আন্তর্জাতিকতাবাদী চিকিৎসক। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে কিউবার পাঠানো মেডিকেল দলের শরিক হন তিনি। উত্তর ইকুয়েডরে আদিম জনজাতির চিকিৎসার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন চে – তনয়া। ব্রাজিলে ভূমি শ্রমিকদের আন্দোলনে সংহতি জানাতে কিউবার মেডিকেল দল নিয়েও যান তিনি। আর্জেন্টিনার বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের হয়ে বিনা পারিশ্রমিকে দুঃস্থ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর কাজ চালিয়ে গেছেন সমান তালে। চাভেজের সাধের ভেনেজুয়েলায় সকলের স্বাস্থ্যের কর্মসূচিতে গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনারও অংশীদার ছিলেন বিপ্লবী মহাপ্রাণ এর উত্তরাধিকার।
বর্তমান সময়ে বিশ্বে কোভিড মহামারী আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেছে পুঁজিবাদের ব্যর্থতা। বিপরীতে সার্বজনীন স্বাস্থ্যের প্রয়োজনীয়তা ,জনস্বাস্থ্যের গুরুত্ব অনুভূত হয়েছে প্রতিনিয়ত। ইবোলা, জিকা ,এইচআইভির মতই করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে লড়াইয়ে নেমেছে দ্বীপ রাষ্ট্র কিউবা। তথাকথিত উন্নত রাষ্ট্রগুলি যখন করোনা নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খেয়েছে তখন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে হোয়াইট কোট ভলেন্টিয়ার পাঠিয়ে সংহতির বার্তা পৌঁছে দিয়েছিল কিউবা। অকালে মৃত্যুপুরী হয়ে ওঠা ইতালির লম্বার্ডির জনগণের কাছে যেন নতুন জীবনের বার্তা বাহক হয়ে নেমেছিল ক্যারিবিয়ান রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা। তেমন ভাবেই গোটা বিশ্বে প্রায় ৬০ টি দেশে নিজেদের স্বাস্থ্য সহায়তা পাঠিয়ে সাহায্য করেছিল কিউবা। করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে বামপন্থার অগ্রণী সেনানি হিসেবে আবির্ভাব হয়েছিল একাধিক কমিউনিস্ট রাষ্ট্রর। কঠোর লকডাউনের মাধ্যমে ভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয়েছিল চীন। আর্থিকভাবে তুলনায় পিছিয়ে থাকা হলেও পূর্ব অভিজ্ঞতা দ্বারা সামাজিক স্বাস্থ্যে প্রাধান্য দিয়ে অতিমারিকে জয় করতে সক্ষম হয়েছিল ভিয়েতনাম,লাওসের মত রাষ্ট্র। যে ভিয়েতনাম জুড়ে ছড়িয়েছিল মার্কিন বর্বরতার রক্তস্বাক্ষর সেই ভিয়েতনামের মাটি থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য পৌঁছে গিয়েছিল সাড়ে ৪ লক্ষ পি পি ই কিট। মানবতার যুদ্ধে কমিউনিস্টরা কখনো পিছিয়ে আসেনি। তেমন নিদর্শন দেখেছি আমরা আমাদের দেশে। করোনার বিরুদ্ধে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে বারবার প্রশংসিত হয়েছে এই দেশের একমাত্র কমিউনিস্ট রাজ্য কেরালা। আমাদের বাংলায় ভোটের ফলাফলের তোয়াক্কা না করে মৃত্যুর মুখে জীবন বাজি রেখে মানুষের কাছে প্রয়োজনীয় ওষুধ ,অক্সিজেন সিলিন্ডার পৌঁছে দিয়েছিল রেড ভলেন্টিয়াররা। আসলে চে মানে একটি চেতনা যার কোন মৃত্যু নেই। সাম্রাজ্যবাদীদের বুলেটে ঝাঁঝরা হওয়ার পর প্রতিটা রক্তবিন্দু থেকে গোটা বিশ্বে বিপ্লবের নেশা সংক্রমিত করেছিলেন চে। সেই ধারায় আপ্লুত হয়ে মানুষের জন্য জীবন বাজি রাখতে প্রস্তুত কমিউনিস্টরা।
বর্তমান সময় প্রতিনিয়ত পুঁজিবাজার দ্বারা আক্রান্ত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। মুনাফা তৈরীর ঠেকে পরিণত হয়েছে সমগ্র পরিকাঠামো। তার বিরুদ্ধে লড়াই চলছে নিরন্তর। প্রতিনিয়ত বিকল্পের সন্ধান নিয়ে হাজির হচ্ছে বামপন্থীরা। চিকিৎসা বিপ্লবের পথিকৃৎ ভির্চৌ, অ্যালেন্দে, চে’রা। চে’র রোমান্টিকতা ভালোবাসার গোলাপ হয়ে ফোটে প্রতিটা বিপ্লবী আন্দোলনে। সে আন্দোলন মানুষের খাদ্যের দাবিতে হতে পারে, শ্রমিকের মজুরির দাবিতে হতে পারে, কৃষকের ফসলের মূল্যের দাবিতে হতে পারে, ছাত্রের অধিকারের জন্য হতে পারে।তেমনভাবেই সার্বজনীন স্বাস্থ্যর লড়াই চে’র উত্তরাধিকারদের হাত ধরে ছড়িয়ে পড়ে বিপ্লবী মেডিসিন রূপে। সমাজতন্ত্রের মূল শর্ত হিসেবে এই দাবির লড়াই আমাদের প্রত্যেকের।