Cuba Diary II

Cuban Diary (Part II)

শ্রেয়সী চৌধুরী

সকাল সকাল উঠে স্প্যানিশ ক্লাস করতে যাবার কথা, পৌঁছতে পৌঁছতে ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। ‘প্রফেসরা’ ইয়ামিলা আমাদের কিউবান স্প্যানিশে তুখোড় করে তুলবেন দু’সপ্তাহে এমন ভাবার একেবারেই কারণ নেই, তার উপর স্প্যানিশে স্প্যানিশ ক্লাস, আর সহপাঠীরা ইংরাজিতে তর্জমা করতে পারবেন না। কোনোরকমে দাঁত ভেঙে তিন ঘন্টা ক্লাস পার করলাম, হোমওয়ার্কও  জুটল।

তারপর আমাদের পরিচিত কফির দোকানে গেলাম আড্ডা মারতে, আর এস্প্রেসো খেতে, গী-ও চলে এলো ইতিমধ্যেই। গতকাল তিনশো ডলার মুদ্রা অদলবদল করে হঠাৎ বুঝতে পেরেছি আগামী কুড়ি দিনে এক লাখ কিউবান মুদ্রা খরচ করতে পারবো। মনের আনন্দে অর্ডার করলাম, গতকাল জল কিনতেও ভয় ভয় করছিলো, আজকে মন হচ্ছে আমিও যেন রাজা। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, টাকা থেকেও কিউবাতে খুব আলাদা কিছু লাভ নেই, সাধারণ জিনিসপত্র কিনে টাকা ওড়ানোর সুযোগই নেই এখানে, কারণ প্রয়োজনের বাইরের প্রলোভনের বিপণীই খুঁজে পাওয়া দায়, কেবল কিছু টুরিস্ট স্পেশ্যাল জায়গায় সেসব মেলে।

PIC II I

আজ দুপুরে আমাদের কুইন্তা দে লস মলিনোস-এ। অসাধারণ এবং ঐতিহাসিক এই বট্যানিকাল গার্ডেনটি ইউনিভার্সিটি থেকে পায়ে হেঁটে পাঁচ মিনিট।

‘ক্যাপিটোলিও দে লা হাভানা’র খুব একটা দূরে না ছোট্ট বোটানিক্যাল গার্ডেনটি। কিন্তু সে জমিতে যখন রেলপাত বসানোর কাজ শুরু হয় এবং স্টেশন নির্মাণের প্রয়োজন হয়। কিউবার রাজধানীর নগরায়ণ ও সৌন্দর্যবর্ধনে নিয়োজিত তৎকালীন ক্যাপ্টেন জেনারেল মিগুয়েল ট্যাকন সে সময়ে নির্দেশ দেন যে বাগানটিকে ‘পাসেও দেল প্রাদো’র উত্তরে স্থানান্তর করা হবে। অঞ্চলটি তামাকের মিলে ভর্তি, এইসব মিলগুলি উণিশ শতকের শেষের দিক অবধি চালু ছিলো, অঞ্চলটি ছিলো মিল, শ্রমিকদের বসবাসের জায়গা। জনপ্রিয় নাম তখন ছিলো  ‘লস মোলিনোস’ অর্থাৎ, ‘মিলসমূহ’।

গাছপালায় মোড়া জায়গাটিতে তখন ট্যাকন সাহেব স্প্যানিশ ক্যাপ্টেন জেনারেলদের জন্য একটি একতলা বিনোদন ভিলা নির্মাণের আদেশ দেন। পরবর্তীকালে ক্যাপ্টেন জেনারেল ও’ডোনেল ভিলাটিতে আরও একটি তলা নির্মাণ করেন। সে সময়ে পাঁচ-ঘরের এই ভিলার গ্যালারিগুলিতে বাতাস চলাচল ও আলো নিয়ন্ত্রণের জন্য শাটার লাগানো হয়েছিল। ভিলার ঘন সবুজ বাগানটি পাথরের বেদির উপর লোহার রেলিং দিয়ে ঘেরা ছিল, বসার জন্য ছিলো বেঞ্চ। বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালা ছাড়াও, ছিলো মিনার্ভা, জুনো বা সেরেসের মতো অলিম্পিয়ান দেবদেবীর মূর্তি, এখনও রয়েছে। বিরল প্রজাতির গাছগাছালি এবং বাগান। ১৯০৬ সালে এই বাগানটি বিশ্ব বোটানিক্যাল গার্ডেন সিস্টেমে স্থান পেয়েছিলো। এছাড়াও এখানে একটি ছোট চিড়িয়াখানা ছিল, যেখানে প্রধানত জলচর পাখি রাখা হত। ১৯৩৬ সালে এই বাগানেই প্রথম ঘোষণা করা হয় কিউবার জাতীয় ফুল ‘মারিপোসা’ (Hedychium coronarium)।

ষোড়শ শতাব্দী থেকেই বটানিক্যাল গার্ডেন্টি এখানেই রয়েছে, তখন ছিলো স্প্যানিশ কঙ্কুইস্তেদর জেনারেলদের থাকার জায়গা আর প্রমোদকানন। আজ সেখানেই কিউবার সমাজতন্ত্রী সরকার শারীরিক এবং মানসিক প্রতিবন্ধকতার শিকার সমস্ত বাচ্চাদের ট্রেনিং দেয়, তারা মাটি ঘেঁটে হাতে কলমে গাছগাছালি, এবং প্রাণীজগৎ সম্বন্ধে শেখে, জানে, আরও শেখে নানারকম সহজ হাতের কাজ, রিসাইকেলিং ইত্যাদি। একেবারে গেঁড়ে বয়েস থেকে আট-ন’বছরের বাচ্ছারা এই ক্লাসগুলিতে যুক্ত হয়। সপ্তাহান্তে একটি দিন এই কম্পাউন্ডেই তাদের হাতে তৈরী জিনিস বিক্রি করার বাজারও বসে এখানেই। তাছাড়াও রয়েছে আএওও নানা ইভেন্ট। গোটাটাই চলে সরকারি উদ্যোগে এবং মুনাফা ব্যাতিরেকে। এই উদ্যোগটিতে যে সমস্ত কর্মী কাজ করেন প্রেত্যেকেই প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত। এই প্রকল্পটির মাধ্যমে সরকার নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস এবং পরিবেশ সংরক্ষণ সম্পর্কিত জ্ঞান-চর্চ্চার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পরিচলনার সাথে সাথেই সক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্যোগকে জুড়ে দিয়ে বেশ অভিনব ধাঁচে ‘কুইন্টা দে লস মোলিনোসে’র বিবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছে।  জায়গাটি যেমন ইতিহাসে মোড়া, পরিবেশবিজ্ঞানের চর্চায় মগ্ন, ঠিক তেমনই তার একটি পা এগিয়ে রাখা ভবিষ্যতের প্রযুক্তি নির্মাণের লক্ষ্যে।  

এই বোট্যানিকাল গার্ডেনেই শুরু হয়েছে একটি যুগান্তকারি প্রকল্প, রিনিউএবেল এনার্জি অর্থাৎ নবায়নযোগ্য শক্তির প্রদর্শনী কেন্দ্র। বাচ্চারা ক্লাস করতে এসে কেবল যে হাতের কাজ শেখে, পরিবেশের এবং বাস্তুতন্ত্রের  ভারসাম্য সম্পর্কে জানতে পারে তাই নয়, কিভাবে এই জ্ঞানকে জবীনের নানা স্তরে কাজে লাগানো যায় এবং কেন এই শিক্ষা অপরিহার্য্য তাও শেখে। এটি কিউবার প্রথম নবায়নযোগ্য শক্তির প্রদর্শনী কেন্দ্র। প্রক্রল্পটি আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ফলেই সম্ভব হয়েছে, এবং একটি বৃহত্তর আন্তর্জাতিক প্রকল্পের আওতায় পড়ে। উদ্দেশ্য নবায়নযোগ্য শক্তির একটি নতুন মডেল তৈরী করা এবং আস্তে আস্তে জায়গাটিকে একটি শক্তি-সাশ্রয়ী কেন্দ্র হিসেবে গঠন করা, এই মডেলটি প্রাথমিকভাবে গবেষণার আওতায় থাকলেও ভবিষ্যতে তাকে বিভিন্ন সরকারি নীতির অন্তর্ভুক্ত করা হবে। প্রোজেক্টটি সম্পূর্ণ হলে এটি পরিচালনায় যে পরিমাণ শক্তি লাগে তার একশ শতাংশ যাতে প্রজেক্টটি নিজেই উৎপাদন করতে পারে তাই আদতে চূড়ান্ত লক্ষ্য। এই লক্ষ্যে নানা রকম কৌশল ব্যবহার করা হচ্ছে, তার মধ্যে রয়েছে ফোটোভলট্যাইক সিস্টেম। বেশ কিছু নিয়মাবলীও রয়েছে পরিচালনার, বেশকিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে যাতে শক্তির সুদক্ষ এবং সাশ্রয়ী ব্যবহার সম্ভব হয়। রয়েছে কৃ্ত্রিম মাটি (ইকো-মাদেরা) দিয়ে তৈরী ইঁট, সেই দিয়ে বানানো দেওয়াল, স্বচালিত সৌরপাত যা সূর্য্যের আলোর তেজ ও দিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নিজের অবস্থান পাল্টাতে সক্ষম, রয়েছে হাইড্রোলিক পাওয়ার জেনারেটর, উইন্ডমিল। এসব নিয়ে ক্লাস করানো হয় বাচ্চাদের, এবং বড়োদেরও। তার সঙ্গে সঙ্গে গবেষণার কাজ তো চলছেই, আসল উদ্দেশ্য গবেষণা করে প্রাপ্ত জ্ঞান যাতে সমাজের বিভিন্ন প্রকল্পে কাজে লাগানো যায়, গরিব, খেটে খাওয়া মানুষের যাতে বিপূল বিদ্যুৎ সমস্যা কিউবাকে সাম্প্রতিককালে কাবু করে ফেলেছে, তা থেকে যেন মুক্তি পায় কিউবা।

ইতিমধ্যেই আগের মাসে কিউবার সরকার আইন পাশ করেছে যাতে নবায়োনযোগ্য শক্তির প্রয়োজনে কোনোরকম যন্ত্রপাতি বিদেশ থেকে আমদানী করতে হলে একেবারেই বিনা শুল্কে তা করা সম্ভব। চিনের সঙ্গে কিউবার এই নিয়ে চুক্তিও হয়েছে, ২০২৮-এর মধ্যেই ৫৫ টি সোলারপার্ক, এবং ৯২টি সোলার ইন্সটলেশন নির্মাণে কিউবাকে সাহায্য করছে চীন।

চীন-কিউবার নবায়নযোগ্য শক্তির জোট গড়ে উঠছে, আর আমি বাগানে ঘুরছি। প্রজাপতী গার্ডেনে গেলাম, বিশাল বিশাল গাছ। কিউবার জাতীয় উদ্ভিদ রয়েল পাম– তাও দেখতে পেলাম। জানতে পারলাম এক বিশেষ প্রজাতির পামের ছোটো ছোটো অংশ খাইয়ে পেটমোটা করা হয় কিউবান শুয়োরদের, যাতে উদরস্থ হওয়ার আগে তারা সুস্বাদু হয়ে ওঠে।

আমার কিউবান সহপাঠী আমার জন্যে তর্জমা করে দিচ্ছেন।

এভাবেই লা হাভানাতে আরও একটা দিন পেরিয়ে গেল।

আগামীকাল যাবার কথা কিউবার চায়না টাউনে।

Spread the word

Leave a Reply