কিউবা- এক অনন্য সমাজতান্ত্রিক নির্মাণ…

১৯ জানুয়ারি, ২০২৩

অব্যাহত মৃত্যুমিছিলে ক্রমশ মানবশূন্য হতে চলেছে ইতালির তুরিণ। মারণ করোনার দাপটের থেকে সভ্যতা টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে মুখ থুবড়ে পড়ছে ইতালির উন্নত পুঁজিবাদ। সংকট মোকাবিলায় হিমশিম খাচ্ছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন। ঠিক তখনই আলাদিনের জিনির মতো অসম্ভবের স্বপ্নের ঝুলি সমেত তুরিণ বিমানবন্দরে পৌঁছোল কিউবান মেডিকেল মিশন। সাদা অ্যাপ্রনে সমাজতন্ত্রের জীবনিশক্তির স্ফুরণের সাক্ষী থাকল সারা দুনিয়া। প্রাণের স্পন্দনের উচ্ছাসে মহিমায় ফিরল তুরিণ।

শুধু ইতালি নয়, করোনা অতিমারির বিপদ মোকাবিলায় বাইশটি দেশে মেডিকেল মিশন পাঠিয়েছে সমাজতান্ত্রিক কিউবা। ইবোলা সময়ে আফ্রিকার নানা প্রান্তে ছুটে বেড়িয়েছিল এই অপ্রতিরোধ্য মেডিকেল মিশনই। বিশেষ করে লকডাউন পর্বেই দুনিয়াজুড়ে পারি দিয়েছে প্রায় ১২০০ স্বাস্থ্য সৈনিক। এছাড়াও ইতিমধ্যেই ৬০ টি দেশে স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নতিকল্পে কাজ করে চলেছে প্রায় ৩০,০০০ কিউবান ডাক্তার। সার্বজনীন গণচিকিৎসা ব্যবস্থার অতুলনীয় দিকদর্শন হিসেবে পৃথিবীর বুকে উদাহরণ হয়ে আছে আজকের কিউবা। কিউবার সমাজতান্ত্রিক সরকার জাতীয় আয়ের ১১ শতাংশেরও বেশি ব্যয় করে জনস্বাস্থ্যে। প্রতি ১০০০ জন মানুষ পিছু ডাক্তারের সংখ্যা ৬। যেখানে বিশ্বপুঁজির কাণ্ডারি তথা পুঁজিবাদী উন্নয়নের রোল মডেল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে সেই সংখ্যা ৩-এর সামান্য কম। সমগ্র কিউবায় সুস্বাস্থ্য অবৈতনিক। জন্ম থেকে মৃত্যু — রাষ্ট্রের দায়িত্বেই লালিত হয় দেশের নাগরিক।

কোভিডের সময় চিকিৎসকদের টিম ফিদেলের ছবি নিয়ে

১৯৫৯-এ বিপ্লবপূর্ব সময়ে কিউবার ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গড় আয়ু ছিল যথাক্রমে ৬৪ ও ৭০, বর্তমানে তা ৭৯ ও ৭৬। মানবসম্পদ, প্রাকৃতিক সম্পদ ও শিক্ষার সর্বোচ্চ সুষম ব্যবহারে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেই মানবিক চাহিদা নিঃশেষ হয়নি কিউবার মানুষের। দীর্ঘ ছয় দশকের শাণিত মূল্যবোধ তাদের উদ্ভাবনকে ছড়িয়ে দিতে ব্যাকুল হয়েছে বিশ্বের শোষিত-আর্ত মানুষের প্রয়োজনে।

মানবিক আবেদন, বিশ্বভ্রাতৃত্বের‌- আন্তর্জাতিকতাবাদের এই অনুভূতির নির্মাণ কিউবার সমাজতান্ত্রিক সাফল্যের মূল অক্ষ। তাই বিপ্লবের অব্যাবহিত পর থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাপিয়ে দেওয়া অর্থনৈতিক ব্লকেড ‘এমবার্গো’র থাকা সত্ত্বেও ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্রটির বিশ্বজনীন উপস্থিতি এত প্রকট। নব্বইয়ের সেই বিষাক্ত অধ্যায়ে সমূহ বিপদের সম্মুখীন হয়েও অর্থনৈতিক পুনর্জাগরণের স্পর্ধার বিচ্ছুরণ দেখা গেছে কিউবার প্রতি পরতে। মনকাডায় গেরিলা যুদ্ধ লড়তে যাওয়া সেই ১২০জন বিপ্লবীর স্পর্ধার ঝলকানি ম্লান হয়নি চেতনার অনুশীলনে। চে-ফিদেল-রাউল-ক্যামিলো-ভেলমার প্রত্যয় শপথে শপথে ছড়িয়ে পড়েছে প্রজন্মান্তরের সমাজতান্ত্রিক মানুষগুলির মধ্যে। সেই মানুষগুলোর বিশ্বাসের প্রতিফলনেই একরত্তি কিউবার কমান্দান্ত ফিদেল কাস্ত্রো একমুখী দুনিয়ার রাঘব বোয়ালদের চোখে চোখ রেখে বলতে পারে “History remains undecided and refuses to end.”

চে-ফিদেল-রাউল

আবার ফিদেলের দেখানো পথেই কিউবার মানুষের ভ্যানগার্ড ২০২১-এর পার্টি কংগ্রেসে ঘোষনা করে, ” There is but one commitment: to defend the Revolution and to continue”। কোরোনা অতিমারির পর্বে কিউবার সাফল্যের জয়জয়কারে যখন শ্রমজীবী জনতা মুখর তখনও মার্কিন মদতে প্রতিবিপ্লবী অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টা চালানো হয়। কিন্তু ইস্পাত কঠিন ভিত্তির‌ উপর দাঁড়িয়ে থাকা নির্মাণ টলানোর মত ক্ষমতা সাম্রাজ্যবাদের নেই। জনতার মুখরিত সখ্যে বিপ্লব রক্ষার আকাঙ্ক্ষায় রাজপথে নেমে আসা সমগ্র কিউবা বিস্মিত করে দেয় ফিনান্স ক্যাপিটালের ক্যাপ্টেনদের। ওরা ভোলেনি চে’র সেই শেষ কয়েকটা কথা “নতজানু হয়ে বাঁচার থেকে, মৃত্যু ভালো!” ভোলেনি যুদ্ধের দুই প্রান্তে দুটো ঠিকানা- হয় সমাজতন্ত্র, নয় মৃত্যু। তাই মৃত্যুকে হারিয়ে দুনিয়ার প্রতি কোণায় ছড়িয়ে পড়া সমাজতন্ত্রের অমোঘ জীবনীশক্তিতে ভর করে।

১৯৫৯’র ১লা জানুয়ারি বিপ্লব সমাধা হওয়ার পরপরই নতুন সরকার তেল পরিষোধনাগার এবং টেলিকমিউনিকেশনের জাতীয়করণ করে। অল্প সময়ের ব্যবধানেই জাতীয়করণ হয় সামগ্রিক শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থার। ১৬ বছর বয়স অবধি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়। শিক্ষার সফল গণতন্ত্রীকরণের মধ্যে দিয়ে সমস্ত রকম শিক্ষাকে অবৈতনিক করা হয়। ১৯৫৩ সালেও যে দেশের সাক্ষরতার হার ছিল ৫৬ শতাংশ সেই‌ দেশের সাক্ষরতার হার ১৯৮৬ সালেই ১০০ শতাংশ ছুঁয়ে ফেলে। মোট জাতীয় আয়ের ১৩ শতাংশ খরচ করা হয় শিক্ষাখাতে। উৎপাদন, প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানে মানবসম্পদের সৃজনশীল প্রয়োগে কিউবা কলকাতার সম জনসংখ্যার একটা দেশ হয়েও অপ্রতিরোধ্য বনে যায় লাতিন আমেরিকায় মার্কিন হস্তক্ষেপের প্রতিষেধক হিসেবে।

মাতৃ দেহ থেকে সন্তানের দেহে এইচআইভি ভাইরাস সংক্রমণের ঘটনাকে একমাত্র নির্মুল করতে পেরেছে যে দেশ, তার নাম কিউবা। যৌন শিক্ষাকে সামাজিক মান্যতা দেওয়া এবং প্রয়োগ করার কাজেও সফল। বাবা-মা হারা সন্তানদের রাষ্ট্রীয়ভাবে লালন‌ করা হয় সেখানে। শ্রমিকশ্রেণীর বর্তমানে নুন্যতম মজুরি দৈনিক ২৫০ পেসো (কিউবান মুদ্রা), ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৮৫০ টাকা। উৎপাদনী কর্মতৎপরতায় ওভারটাইমের প্রয়োজন পড়লে মজুরির দেড়গুণ বরাদ্দ করা হয়। ১.৫ লাখ কৃষককে সমবায় ব্যবস্থার অধীনে আনা হয়েছে। চিনি রপ্তানিতে নব্বইয়ের ভরাডুবি কাটিয়ে আবার হৃত গৌরব পুনরুদ্ধার হয়েছে। নয়া উদারবাদী আক্রমণের মুখে কৌশলগত লড়াইয়ের অংশ হিসেবে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে বেসরকারি সংস্থার বিনিয়োগের সুযোগ দিয়েছে কিউবা। কেবলমাত্র বেসরকারি উপার্জনকারীদের উপরই ন্যস্ত হয়েছে আয়কর।

কিউবার ছাত্র ছাত্রীরা

চুরাশিতম বৃহৎ জনসংখ্যার দেশটি মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের নিরিখে ৬২তম। তামাক উৎপাদন ও রপ্তনিতে শীর্ষস্থানে। সামাজিক পশ্চাদপদতা সমূলে উৎপাটন করার অভিযানে কিউবা হয়ে উঠেছে প্রগতির সমার্থক শব্দ। প্রতি ১০০ জন গর্ভবতী নারীর মধ্যে ৭২ জন গর্ভপাত করেছে ২০২১ সালে। গর্ভপাতের সামাজিক মান্যতা অর্জন করেই তা আইনে রূপান্তরিত করা হয়েছে। চাপিয়ে দেওয়া হয়নি। একইভাবে গণতন্ত্রের অনুশীলনের মাধ্যমে বৈধতা পেয়েছে সমলিঙ্গ বিবাহ।

নিকারাগুয়া-বলিভিয়া-ভেনেজুয়েলা-কলোম্বিয়া-চিলি সমেত সমগ্র লাতিন আমেরিকার অতন্দ্র প্রহরী হয়ে বিকল্প উন্নয়নের অধিনায়কোচিত ভূমিকা নিয়ে যাচ্ছে কিউবা আজও। হুগো সাভেজ থেকে সালভাদোর আলেন্দে — যখনই জনতার নায়ক বিজয়োৎসব করেছে, তখন অবলম্বনের গুরুভার সামলেছে কিউবা। বলিভিয়ায় চে গুয়েভারার শাহাদতের পরও চে’র চেতনা মোটর সওয়ারে লাতিন আমেরিকার অন্ধ কোটরও স্পর্শ করেছে। ‘সারা দুনিয়া আমার বাড়ি’র মন্ত্র গ্রাণমা থেকে ছড়িয়ে গেছে আফ্রিকা-এশিয়ার অন্ত্যজ মানুষের শিরা-ধমনীতে।

চে গুয়েভারা ও তার মোটর সাইকেল

আবার যখন চক্রান্ত আর শোষনের জাঁতাকলে ব্যাকফুটে গেছে বিকল্পের হুঙ্কার তখন চে-ফিদেলের সবটুকু বুঝে নেওয়া স্পিরিটের দ্বারস্থ হয়ে হার না মানার সংকল্প নিয়েছে মুক্তিকামী মানুষ। সোচ্চারে ঘোষণা করেছে “The People United Shall Always Be Victorious!” ‘ইতিহাস আমাকে মুক্ত করবে’-ই যেন ফিরে এসেছিল আলেন্দের ভাষনে ” My people and the people of Americas will write the rest” হয়ে।

কিউবার মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের একটা বড় অংশ তৃতীয় বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের সহায়তায় ব্যবহৃত হয়। কোভিডের যন্ত্রণাময় দিনগুলিতে উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলো যখন হিমশিম খাচ্ছিল পরিত্রাণের খোঁজে, তখন ত্রাণকর্তার বেশে কিউবা হাজির‌ হয়ে সাধন করেছে এক অন্যরকম বিপ্লব। মানবমুক্তিরই বিপ্লব। কার্পণ্যের অবকাশ না রেখে আন্তর্জাতিকতার মতাদর্শের পথ‌ বেয়ে মানব প্রজন্ম রক্ষার্থে তাদের বিপ্লব রক্ষা করার মতোই নিবিড় সংকল্প। এই অনন্যতার মন্ত্রবলেই নব্বইয়ের ধ্বংসাত্মক সন্ধিক্ষণে যখন তাবড় সমাজতান্ত্রিক নির্মাণ তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ছিল তখন মাত্র বিয়াল্লিশ হাজার বর্গমাইলের ভূখণ্ড আত্মবিশ্বাসে গর্জন করে বলেছিল “Socialism is the future and the future is ours!”

Spread the word

Leave a Reply