৭ জুলাই ২০২৩ (শুক্রবার)
পর্ব-১
ছিরু পালের সেল্ফি,
গণদেবতার গ্রাম
ছিরু পালকে মনে আছে? ছিরু পাল এবং শ্রীহরি একই লোক। মোড়ল। গণদেবতার মোড়ল — শ্রীহরি পাল।
গণদেবতা তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের। গণদেবতা তরুণ মজুমদারের। গণদেবতা সৌমিত্র চ্যাটার্জি, শমিত ভঞ্জ, রবি ঘোষ, সন্ধ্যা রায়, মাধবী মুখার্জির। এবং অবশ্যই অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের।
১৯৪৩-র লিখিত গণদেবতা। ১৯৭৯-র সেলুলয়েডের গণদেবতা। আসলে ২০২৩-র সেলফি। তাৎপর্যপূর্ণ হলো, রাজ্য সরকার চলচ্চিত্রটি প্রযোজনা করেছিল। এখন সরকার মেলা করে, মন্দির বানায়। ‘গণদেবতার’ শ্রীহরিকে তুলে ধরা, মনে করিয়ে দেওয়ার কোনও দায় তার নেই।
আগামীকাল রাজ্যের দশম পঞ্চায়েত নির্বাচন। এখন ছিরু পালকে নিয়ে আলোচনা কেন? কারন — শ্রীহরির প্রোফাইল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে গত দশ বছর। আজকের গ্রামে গ্রামে শ্রীহরির সেলফি। প্রায় ৮০ বছর আগে ফুটে ওঠা একটি চরিত্র কীভাবে আজকের পশ্চিমবঙ্গে প্রাসঙ্গিক হতে পারে? হতে পারে। গত ১২ বছর তার প্রমাণ।
শ্রীহরি এক আস্ত কালভার্ট। অতীত আর বর্তমানের মাঝে এক হাইফেন শ্রীহরি। তাকে বেয়েই পৌঁছোতে হবে তৃণমূলে — তা সে সমাজেরই হোক কিংবা কালিঘাটের।
শ্রীহরির মোবাইল ফোন ছিল না। তখন বাল্বই পৌঁছোয়নি ঘরে ঘরে। কম্পিউটার ছিল না, স্বাভাবিক। ফলে তার হোয়াটস অ্যাপ, টুইটার কিচ্ছু ছিল না। কিন্তু স্পর্ধা ছিল অসীম। অনেকদিনের শিলা ভেঙে, ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নতুন শিলা পুঁতে দেওয়ার ক্ষমতা ছিল তার। সেই পুরোন শিলায় সমাজের, সংস্কৃতির ঐতিহ্যের ছোঁয়া থাকলেও তার হাত কাঁপতো না। বরং নতুন শিলায় নিজের নাম খোদাই করে যাবতীয় সৃষ্টিকে নিজের অবদান বলে দাবি করার নির্লজ্জতা ছিল শ্রীহরির ধমনিতে। সে মূর্খ ছিল। সবদিক দিয়ে, সব অর্থে সে মূর্খ ছিল। তাই দুঃসাহসের রঙ চেনাতে তারই কাঁধ বেছে নিয়েছিল সময়।
শ্রীহরির আরও কী ছিল? একজোড়া লালসা, লোভ, বিদগুটে কাদা মাখানো, পঙ্কিল চোখ ছিল। তবে দোষ তার চোখের নয়। দোষ ছিল তার নজরে, দেখার ভঙ্গীতে। তা দিয়ে সে পাড়ার গরিব পরিবারের মহিলাদের দিকে কুৎসিত ভাবে তাকাতে পারতো। বয়স্কদের, সন্মানীয়দের চোখ রাঙাতে পারত, গরিবদের প্যাঁচে ফেলতে পারত আর সব দখল করার জন্য যে কোনও ষড়যন্ত্র করতে পারত। এখনও শ্রীহরি তাই। হেন খারাপ কাজ নেই, যা শ্রীহরি করতে পারে না।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় দেখাচ্ছেন শ্রীহরি কিভাবে গরিব দেবু পন্ডিতকে ষড়যন্ত্র করে জেলে পাঠাচ্ছেন। কীভাবে গরিবের জমি জিরেত দখলের চেষ্টা করে যাচ্ছে লাগাতার ছলে বলে কৌশলে। কিভাবে বিদ্রোহী হয়ে ওঠা গ্রামীণ শ্রমজীবী ‘অনিভাই’কে দমন করতে যা খুশি করার চেষ্টা চালায় শ্রীহরি। তেলতেলে মুখের, বিগলিত এঁটো হাসিময় মুখের পুলিশ শ্রীহরির সাকরেদ। শ্রীহরি ঘর জ্বালায়। পুলিশ পৌঁছোয় না। শ্রীহরি গ্রামের মানুষকে উসকায়। খোচররা হাসে। শ্রীহরি অত্যাচার করে, লড়াকু-বিদ্রোহীদের ভয় করে — তাই অত্যাচার করে।
বিজ্ঞান বলে পুনর্জন্ম হয় না। কিন্তু ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয়, নতুন মাত্রায়। সেই সূত্রে এখন শ্রীহরিদের আত্মপ্রকাশ।
গণদেবতা উপন্যাস। গণদেবতা সিনেমা। গণদেবতা একটি ধারনা।
১৯৪৩-এ লেখা ‘গণদেবতা’-র প্রেক্ষাপট আর মমতা ব্যানার্জির আজকের প্রশাসনের কোন তফাৎ নেই? তফাৎ আছে। গ্রামের চেহারায়। সেই রাস্তা নেই। সেই দুর্গম নদীঘাট নেই। গণদেবতার শ্যুটিং যে গ্রামগুলিতে হয়েছিল, সেই বর্ধমান, বীরভূমের সেই গ্রামের আজকের ছবি তার নিশ্চিত প্রমাণ। যে বামফ্রন্ট সরকার গণদেবতার প্রযোজনা করতে পারে, তারাই তো পারে গ্রামের অবস্থা বদলে দিতে। তাই হয়েছে। কিন্তু তবু গণদেবতার কিছু পরিপ্রেক্ষিত আবার ফুঁড়ে উঠছে রাজ্যে। ‘গণদেবতা’-র শ্রীহরি ঘোষরা গোটা গ্রামের বিরুদ্ধেই চক্রান্তে নেমেছিল। গ্রামের গরিবদের সব সম্পত্তি দখল করার চেষ্টা শুরু করেছিল। সঙ্গে ছিল দুষ্কৃতীরা। আর তাঁবেদাররা। ব্রিটিশ শাসন হলেও গ্রামের ওই নব্য, ‘নেটিভ’ ধনীদের বিশ্বস্ত সহযোগীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল পুলিশ। নারীদের প্রতি অশ্লীলতা কিংবা নাটমন্দিরে বয়স্কদের বেইজ্জত করার চেষ্টা — সবেরই ধারক ছিল শ্রীহরি ঘোষরা। তারা নিজেদের ক্ষমতা জাহির করতে, সবার অবদান মুছে ফেলতে সব শিলা উপড়ে ফেলে নিজেদের নাম লেখা শিলা খোদাই করে দিত। প্রতিবাদ মুছে দিতে মুচলেখা লেখাতো। কাউকে দমন করতে না পারলে মিথ্যা অভিযোগে মামলা ঠুকতো।
মিল পাওয়া যাচ্ছে না? মানুষ মুখ খুলবে না, প্রতিবাদ করবে না, পরামর্শ, মতামত দেওয়ার অধিকারই তাঁর নেই। এই তো ছিরু পালদের গ্রামের ধারনা। গনতন্ত্রের ধারনা। এখনও তাই।
ছিরু পালরা ধাক্কা খেল ১৯৬৭-তে। ১৯৬৯-এ। তারপর ১৯৭৭-এ। জোরালো ধাক্কা। ১৯৭৮-এ পঞ্চায়েত নির্বাচন। তার আগে ভূমিসংস্কার কর্মসূচী শুরু হয়েছে। পঞ্চায়েত নির্বাচনে গ্রাম পরিচালনার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিল সেই অনিরুদ্ধরা।
কি পরিস্থিতি ছিল গ্রামের ১৯৭৮-এর আগে?
বিধানসভার কার্যবিবরণীতে পাওয়া যাচ্ছে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অশোক মিত্র বাজেট ভাষনের একটি অংশ। ২৫শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৮। অশোক মিত্র বিধানসভায় জানাচ্ছেন যে, রাজ্যের গ্রামঞ্চলে খেতমজুর প্রায় ৪০ লক্ষ। তাঁদের মাথাপিছু দৈনিক রোজগার ৩৫ পয়সা! ১৯৭৭-এ বামফ্রন্ট ‘কাজের বদলে খাদ্য’ প্রকল্প চালু করে। সরকারী রিপোর্ট বলছে ১৯৭৭-র সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর — এই দু’মাসে ঐ প্রকল্পে রাজ্য সরকার ৬৯লক্ষ ৮৬হাজার ৭৭ টি শ্রমদিবস তৈরি করেছিল। মজুরি বাবদ ১কোটি ২৪ লক্ষ ৩৭হাজার টাকা ব্যয় হয়েছিল। দেওয়া হয়েছিল ২৪হাজার ৮০৪ টন গম। সর্বাধিক শ্রমদিবস সৃষ্টি হয়েছিল অবিভক্ত ২৪ পরগণায়।
তখন কেন্দ্রীয় প্রকল্প রেগা ছিল না। কিন্তু মেলা, উৎসব করে টাকা নষ্ট না করে বামফ্রন্ট গ্রামের গরিবের কাজ সৃষ্টিতে যতটা সম্ভব টাকা ঢেলেছিল।
বদলে গেছিল গ্রাম।
আর বদলে ছিলেন গ্রামের মানুষ। মানুষের হাতে ক্ষমতা। রাজ্যের পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দপ্তরের মুখপত্র ‘পঞ্চায়েতী রাজ’। সেই পত্রিকায় কলকাতা বিশ্ব বিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের জনপ্রশাসনের শতবার্ষিকী অধ্যাপক প্রভাত দত্ত একটি ধারাবাহিক প্রবন্ধ লেখেন। ২০১২-র এপ্রিল সংখ্যার ‘পঞ্চায়েতী রাজ’ পত্রিকায় তাঁর প্রবন্ধটির শিরোনাম ‘গ্রামীণ বিকেন্দ্রীকরণ ও জনগন’।
তার ষষ্ঠ অনুচ্ছেদে তিনি লিখছেন,‘‘পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত ব্যবস্তার নেতৃত্বে আছে গরিব মানুষের প্রতিনিধি। এদিক থেকে পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত ভারতবর্ষে নজিরবিহীন। ১৯৭৮-’৮৩ সালে পঞ্চায়েতে বর্গাদারদের শতকরা হার ছিল ১৮ শতাংশ। ভূমিহীন-সহ ৩ একরের জমি মালিকদের প্রতিনিধিত্ব ছিল ২১.৮ শতাংশ। ১৯৮৮-’৯৩ সালে এই প্রতিনিধিত্ব বেড়ে বর্গাদারদের ক্ষেত্রে হয় ৩.১৭ শতাংশ এবং ভূমিহীনদের ক্ষেত্রে হয় ৩০.১৭ শতাংশ। ফলে এ রাজ্যে ঘটেছে অবদমিত মনুষত্বের বিকাশ। সম্ভবত এ এক ধরনের ‘শূদ্র জাগরণ’।’’
পর্ব -২
জ্যোতি বসুর ঘোষনা,
জয়রাম রমেশের চিঠি
কারা গ্রাম চালাবেন? কেন পঞ্চায়েত ‘গ্রামের সরকার’?
গণতন্ত্র, মানুষের অধিকারের সর্বোত্তম রক্ষক কমিউনিস্টরা — ১৯৭৮ আর ২০২৩-র তফাৎ তা স্পষ্ট বুঝিয়ে দেবে।
তখনও মুখ্যমন্ত্রীই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। পুলিশ তবু বিরোধী দলের প্রার্থীদের তাড়া করেনি, মিথ্যা কেস করেনি, জেলে ভরেনি। কোনও মহিলাকে বেধড়ক মার খেতে হয়নি। কী এমন অসুবিধা ছিল? বামফ্রন্ট চাইলে তৎকালীন পুরো প্রদেশ কংগ্রেস অফিসটাই জেলখানা করে দেওয়া যেত।
উলটে রাজ্যবাসী কী শুনেছিল? উদাহরণ সেদিন ২৩শে মে, ১৯৭৮। জনসভা হয়েছিল অবিভক্ত মেদিনীপুরে। যেখানে ২০১৮-তে জেলাশাসকের অফিসের সামনে মনোনয়ন পত্র জমা দিতে গিয়ে শাসক দলের আক্রমণের শিকার হয়েছেন বামফ্রন্টের প্রার্থীরা, সেখানেই, সেই তমলুকের সভাতে শোনা গিয়েছিল — ‘‘গ্রামের উন্নয়নের কাজ বি ডি ও, এস ডি ও, ম্যাজিস্ট্রেট — এদের দিয়ে হয় না। গ্রামের মানুষই ভালো বুঝবেন গ্রামের কোন কাজটা কীভাবে করতে হবে। আমরা চাই গ্রামের যাবতীয় উন্নয়নমূলক কাজে গ্রামের মানুষ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করুন। এখন আমলা, অফিসাররা যা পারেন, যা ভালো বোঝেন করেন, গ্রামের মানুষ কিছু জানতে পারেন না। কোনও কাজে অংশ নিতে পারেন না। আমরা এই অবস্থার পরিবর্তন চাই।’’ যেখানে মনোনয়ন পত্র জমা দেওয়ার চেষ্টা করায় সি পি আই (এম)-র আদিবাসী প্রার্থী বুল্টি সিংয়ের বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেসীরা, সেদিন সেই পাঁশকুড়াতেও সভা হয়েছিল।
বক্তার নাম? কমরেড জ্যোতি বসু। সেদিন তিনি বা সি পি আই (এম)-র রাজ্য সম্পাদক প্রমোদ দাশগুপ্ত অন্য কিছু বললে শুধু অবিভক্ত মেদিনীপুর না, পুরো রাজ্যটা ‘অনুব্রতর বীরভূম’ বানিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা ছিল সি পি আই (এম)-র। মমতা ব্যানার্জি এবং তাঁর দল তাই করে দেখালো।
বামফ্রন্টের প্রার্থীর থেকে বামফ্রন্ট বিরোধীদের প্রার্থী বেশি ছিল — অনেকটাই বেশি। বামফ্রন্টের থেকে বামফ্রন্ট বিরোধী প্রার্থী বেশি? ১৯৭৮-এ? অবাক হওয়ার কথা। কিন্তু তথ্য কথা বলে। তথ্য বলছে ভোট হয়েছিল। বামফ্রন্ট বেশিরভাগ আসনে জিতেছিল। আবার কিছু আসনে তারা হেরেওছিল। কিন্তু কোনও দল মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারেনি, এমনটি হয়নি।
বিরোধীশূন্য করতে পারলে পঞ্চায়েত পিছু টাকা দেওয়ার আহ্বান কোনও মন্ত্রী, সি পি আই (এম) নেতা সেদিন করেননি। যদি একবারও বলতেন— টাকা দেব না, এমনই বিরোধীশূন্য পঞ্চায়েত গড়ো, বিরোধীরা উড়ে যেতেন। তাই তিনটি পর্যায়ে প্রায় ৫১৫০টি আসন সেবার কংগ্রেস (আই) জিতেছিল।
২০০৮-এও রাজ্যে পঞ্চায়েতের তিনটি পর্যায়ে নির্বাচিত মোট সদস্য ছিলেন ৫১,৪৯৯জন। তার মধ্যে শুধু পঞ্চায়েতের সদস্য ছিলেন ৪১,৮৮৪জন। তাঁদের মধ্যে সংখ্যালঘু রয়েছেন প্রায় ২৪% —মোট ৯৭৩৫জন। পঞ্চায়েতে তফসিলী জাতিভুক্ত সদস্য ছিলেন ১৪,৫৭১ জন — প্রায় ৩৫%। আদিবাসী মানুষ ছিলেন ৩৩৯২ জন — প্রায় ৮.০৯%। তফসিলি জাতি এবং আদিবাসী — এই দুটি ক্ষেত্রেই সংরক্ষণের নির্দ্ধারিত সংখ্যার বেশি গ্রামবাসী নির্বাচিত হয়েছিলেন।
গ্রাম সভার মাধ্যমে জনগনের অংশগ্রহণের বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গে গুরুত্ব পায় ৭৩ তম সংবিধান সংশোধনের পূর্বে, ১৯৯২সালে তৈরি হয় গ্রাম সংসদ। সংবিধান সংশোধনের বাধ্যবাধকতার জন্য পঞ্চায়েত আইনে প্রয়োজনীয় সংশোধন হয় ১৯৯৪সালে।
অর্থাৎ মানুষের মতামত প্রতিষ্ঠা করায় দেশকে পথ দেখিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ।
সরকারে এসেই মমতা ব্যানার্জি এখানেই আঘাত করেন। একদিকে বিরোধী দলের সদস্যদের জোর করে, ভয় দেখিয়ে, মেরে পদত্যাগ, দলত্যাগে বাধ্য করল তাঁর দল। নয়া শ্রীহরিদের হাতে গ্রামের ক্ষমতা গেল। কেউ সুফিয়ান তো কেউ আরাবুল। আর কেউ — অনুব্রত। পঞ্চায়েতের কাজ পরিচালনায় জেলা পরিষদগুলিকে এড়িয়ে আমলাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করলেন মমতা ব্যানার্জি। এই ক্ষেত্রে তৎকালীন কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী, কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশের একটি চিঠির উল্লেখ করা যায়।
‘ডিয়ার মমতাদিদি’ সম্বোধন করে ২০১১-র ৩০ শে নভেম্বর জয়রাম রমেশ লেখেন,‘‘ সংবিধানের ২৪৩(জি) ধারা পঞ্চায়েতকে প্রয়োজনীয় ক্ষমতা এবং কর্তৃত্ব দিয়েছে যাতে তা স্বশাসিত সংস্থা হিসাবে কাজ করতে পারে। এই উপলব্ধিকে মনে রেখে, ২০০৫-র এম জি রেগা আইনে পঞ্চায়েতকে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।’’ এই প্রসঙ্গে জয়রাম রমেশের সতর্কতা —‘‘সংবিধানের ২৪৩(জি) ধারায় নির্দিষ্ট ভূমিকা যাতে কোনভাবেই এড়িয়ে যাওয়া না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রেখে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া জরুরী।’’প্রসঙ্গত, জয়রাম রমেশের সেই চিঠির নং ছিল —এফ টি এস-৬৬৫৯২/২০১১।
তাতে কিছু হয়নি। গত ১১বছরে রাজ্যের পঞ্চায়েত ব্যবস্থা পুরোপুরি আমলাদের মুঠোয় চলে গেছেে।
২০০৮ সালে রাজ্যে সপ্তম পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রাক্কালে গণশক্তিকে দেওয়া এক একান্ত সাক্ষাৎকারে জ্যোতি বসু বলেছিলেন, “এটা অনেকেরই মনে নেই যে আমাদের রাজ্যে পঞ্চায়েত দেখেই সারা দেশে পঞ্চায়েত চালু করার জন্য আইন তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়। রাজীব গান্ধী তখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। উনি নিজেই সেকথা বলেছিলেন। আমাদের পঞ্চায়েতই দেশে মডেল, এটা আমাদের গর্ব।”
গত ১২ বছরে সেই গর্ব ধ্বংস করেছে তৃণমূল এবং বিজেপি। সারা দেশের গনতন্ত্রের পক্ষে তা বিপজ্জনক। এই পঞ্চায়েত নির্বাচন শুধু তাই রাজ্যের ‘গ্রামের সরকার’ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম নয়। এর সঙ্গে দেশের মানুষের সংগ্রামের যোগ আছে।
রাজ্যে বামফ্রন্ট এবং গনতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি জয়ী হলে তা দেশের বিজেপি সরকার বিরোধী, সাম্প্রদায়িক, স্বৈরাচার বিরোধী সংগ্রামকে অনুপ্রেরণা জোগাবে।
পর্ব-৩
তৃণমূলের জমি, পঞ্চায়েত বনাম
‘কৃষি-শিল্প-মানুষ’
‘‘এই বছরই ১০লক্ষ ছাত্রছাত্রী মাধ্যমিক পরীক্ষা দিচ্ছে। এটা আমাদের গর্বের ব্যাপার। কিন্তু এই সব ছাত্রছাত্রী পাস করে বেরোনর পর কী করবে?’’
প্রশ্নটি করেছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। ২০১১-র ২৫শে জানুয়ারি। তাঁর একটি লেখায়। শিরোনাম ছিল — ‘বামপন্থাই পথ।’
প্রশ্নটি আজও রয়ে গেছে। আরও প্রবল হয়েছে। কারন — এই ভাবনাটি মমতা ব্যানার্জিকে কখনও ভাবায়নি। তাঁর লক্ষ্য যে কোনও ভাবে সরকারে টিঁকে থাকা। দখলে রাখা।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর যুক্তি কী ছিল?
‘‘আমাদের বিরোধীরা মানুষকে ভুল বোঝানোর জন্য মা-মাটি-মানুষের স্লোগান দিচ্ছে। কিন্তু আমরা বলি ‘কৃষি-শিল্প-মানুষ।’ কেবল এই পথেই পশ্চিমবঙ্গ সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারে। নতুন প্রজন্মের কর্মসংস্থানের জন্য শিল্পায়নের কাজ আমাদের করতেই হবে। কিন্তু সতর্কভাবে অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই এই কাজ আমরা করবো। কৃষির সঙ্গে শিল্পের ভারসাম্য রক্ষা করে এগোব। স্বাধীনতার আগে থেকে জমির আন্দোলনের মাধ্যমে কৃষির উন্নয়নের জন্য বামপন্থীদের লড়াইয়ের মূলে ছিল মানুষের স্বার্থরক্ষা। এখন কৃষির উন্নয়নের ভিত্তিতে শিল্পায়নের মূল উদ্দেশ্যও তাই — মানুষের স্বার্থ রক্ষা।’’
‘মানুষের স্বার্থ’ কী?
১৯৭৮-এ পঞ্চায়েত গঠন। তার আগেই ভূমিসংস্কার শুরু। যা একই সঙ্গে দুটি কাজ করে। গ্রামের আর্থিক উন্নয়ন হয়। মানুষের আর্থিক অবস্থার উন্নতি হয়। কৃষির উৎপাদন বাড়ে। গ্রামে একটি বাজার তৈরি হয়। যেখানে বামফ্রন্ট বিরোধীতায় তৎপর খবরের কাগজের মালিক কাগজ বিক্রীর সুযোগ পান। আবার চাল থেকে দাঁতের মাজন, জুতো, জামা — সবেরই চাহিদা বাড়ে। পরবর্তীকালে চাষে আয় কমতে থাকে। কৃষি আর আগের মত কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে পারছিল না। দরকার হয় কাজের ব্যবস্থার। প্রয়োজন পড়ে শিল্পের।
কিন্তু ১৯৯০-৯১ থেকেই দেশে নয়া আর্থিকনীতি প্রয়োগ শুরু হয়। রাষ্ট্র শিল্প গড়ে তোলার পথ থেকে সরে আসে। শিল্পের দায়িত্ব পুরোপুরি তুলে দেওয়া হয় বেসরিকারি পুঁজিপতিদের হাতে। এমনকি লাভজনক রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থার মালিকানাও তুলে দেওয়া শুরু হয় বহুজাতিক সংস্থাগুলির হাতে। এই পরসস্থিতিতে রাজ্যে বেসরকারি বিনিয়োগের প্রশ্ন আসে। বামফ্রন্ট সরকার সিদ্ধান্ত বেসরকারি পুঁজিকে শিল্প গড়ার কাজে সহায়তা করা হবে। তবে প্রধান লক্ষ্য — কাজের সুযোগ। সেই ‘১০লক্ষ ছাত্রছাত্রীর’ জন্য কর্মসংস্থান।
শিল্প দরকার ছিল গ্রামীণ সমাজের আরও বিকাশের জন্যও। কারন — ফসলও পণ্য হয়ে উঠতে পারত। যা কৃষির সাফল্যকে আরও সংহত করত। নাহলে?
২০০৭-এ মার্কসবাদী পথ পত্রিকায় একটি প্রবন্ধের শিরোনাম ছিল ‘পশ্চিমবঙ্গে কৃষি বিকাশের প্রশ্নটি কী?’ সেখানে সূর্য মিশ্র লিখেছিলেন,‘‘কেবল কৃষির বিকাশের ভিত্তিতে শিল্পায়নের প্রশ্নই নয়। সব দিক থেকে বিবেচনা করলে প্রশ্নটি এখন কৃষক ও কৃষির স্বার্থেই শিল্পায়নের প্রশ্ন। ভূমিসংস্কার ও পঞ্চায়েতের ব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করে কৃষি ক্ষেত্রে রাজ্য ও রাজ্যের জনগন যে সাফল্য অর্জন করেছেন তা বিপদাপন্ন হবে যদি এখনই শিল্প ও পরিষেবা ক্ষেত্রের বিকাশ শুরু না হয়।’’
রাজ্যে ভূমিসংস্কার ইতিমধ্যেই বিপন্ন। প্রান্তিক মানুষের হাতে আরও জমির অধিকার তুলে দেওয়ার কাজ অনেকদিনই বন্ধ। উল্টে কৃষকদের একাংশ জমি রাখতেই পারছেন না। যে জমি তাঁরা অর্জন করেছিলেন, তা বিক্রি করে দিয়েছেন, দিচ্ছেন, এমন উদাহরণ আছে আজকের বাংলায়। চাষ লাভজনক তো নয়ই, এখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তা লোকসানের বোঝা হয়ে উঠেছে। এই পরিস্থিতিতে তৃণমূলের জমির দালালরা জমি কিনে নিচ্ছেন। বিশেষত, যে জমিগুলি তাদের লাভজনক মনে হচ্ছে।
পঞ্চায়েত নিষ্ক্রীয়। কারন — গনতন্ত্র বিপন্ন। গ্রামের ক্ষমতা আমলা, পুলিশ এবং ফাটকাবাজ তৃণমূলের নেতাদের পকেটে। পশ্চিমবঙ্গের যুবকরা কাজের খোঁজে ভিন রাজ্যে ছুটছেন। পশ্চিমবঙ্গের গ্রাম পরিণত হয়েছে ভিন রাজ্যের শিল্পের শস্তা শ্রমে।
মমতা ব্যানার্জির মনোভাব কী? ‘‘যাঁরা শিল্প করবেন, তাঁরা নিজেরা ভালোবেসে, আদর করে জমি কিনে নিন।’’ মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি বলেছিলেন। তাঁর শততম প্রশাসনিক বৈঠকে। ২০১৫-র ১৬জুলাই।
৮ বছর পেরিয়েছে। শিল্প আসেনি। কিন্তু তৃণমূলের নানা সাইজের ল্যাম্পপোস্ট দেদার জমি কিনে ফেলেছেন — ‘ভালোবেসে, আদর করে।’’
মমতা ব্যানার্জির ‘জমি নীতি’র মূল কথা ছিল সরকার জমির ব্যবস্থা করবে না। পঞ্চায়েতের কোনও ভূমিকা থাকবে না। শিল্পপতিরা কী করে তাঁরা জমি খুঁজবেন? তাঁরা তৃণমূলের স্থানীয় নেতা তথা জমির দালালের কাছে যাবেন। তারা কৃষককে ‘বুঝিয়ে সুঝিয়ে’ জমি আদায় করবে। সেটা তারা বিক্রি করবে শিল্পপতিকে।
অর্থাৎ তৃণমূলের জমি নীতির গোড়ার কথাই ছিল — পঞ্চায়েত, পৌরসভা, সরকার বাদ। জমির কলকাঠি তৃণমূলের নেতাদের কব্জায়। ধান্দার জমিনীতি। শিল্প রাজ্যে আসেনি। কাজের ব্যবস্থা হয়নি। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে দেদার জমি কিনেও ফেলেছেন তৃণমূলের নেতারা। কিন্তু তারা গাদা গাদা জমি কেনে কেন? বাড়ি করে — প্রকান্ড, রংচঙে। কেন? কেন সোনাদানা কিনে ব্যাঙ্কের লকার কিংবা বাড়ি বোঝাই করে?
বড়ঞার জীবনকৃষ্ণ সাহা একটি উদাহরণ। ১২টি জমি তাঁর। ২০১৭-র পর জমি কিনেছেন। কিংবা কাজরী-কার্তিক ব্যানার্জি। কালীঘাট থেকে এসে তাঁরা জমি কিনেছেন বোলপুরে। সেই মৌজাতে জীবনকৃষ্ণরও জমি। বীরভূমের রামপুরহাট, তারাপীঠ, বোলপুর, শিলিগুড়ির আশেপাশে, ভাঙড়-সোনারপুর, ইএম বাইপাসের লাগোয়া এলাকার মত রাজ্যের কিছু এলাকা তৃণমূল নেতাদের অনেকেরই পছন্দের জায়গা — জমি কেনার। তাতে তাঁরা চাষ করেন না। অর্থাৎ জমিতে ফসল হয় না। ফেলে রেখেছেন। গত কয়েক বছরে সেখানে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্কটদীর্ণ কৃষককে নতুন কোনও পদ্ধতিতে ফসল উৎপাদনে উৎসাহিত করার উদ্যোগ নিয়েছেন, মোটেও এমন নয়।
কিন্তু মনস্তত্বটি কী?
জীবনকৃষ্ণ প্রাক্তন জোতদার পরিবারের ছেলে। কৃষক আন্দোলন এবং যুক্তফ্রন্ট, পরবর্তীকালে বামফ্রন্ট সরকারের সময়কালে এই বাস্তুঘুঘু অংশর প্রতিপত্তি গত হয়েছিল। কিন্তু তৃণমূলের সব নেতা, বিধায়ক, মন্ত্রী তেমন জোতদার পরিবারের নন। তবু তাঁদের মধ্যে ছোটখাটো জমিদার হয়ে বসার একটি স্পষ্ট মানসিকতা বিদ্যমান।
অর্থনীতির হিসাবে এই সবই অনুৎপাদনশীল খাত। এ’ সব থেকে নতুন কিছু সৃষ্টি হবে না। এমন কিছুই হবে না, যাতে পাঁচ-দশজনের কাজের বন্দোবস্ত হয়। এই সবই ফেলে রাখলে, সুযোগ সুবিধামত বাজারের দামের ওঠাপড়ায় নজর রেখে বিক্রি করতে পারলে বাড়তি কিছু টাকা পাওয়া যাবে। মোদ্দা কথা — ধান্দা।
তৃণমূলের নেতাদের সম্পত্তি কেনার পিছনে যা আছে, তা হলো ধান্দার মানসিকতা। ফাটকার মনস্তত্ব। এই মানসিকতা পরের ঘাড়ে চেপে শোষণ করা ছিনে জোঁকের চরিত্র।
এই চক্রর মাধ্যমে পুরোন জোতদারি ব্যবস্থা ফিরে আসেনি। তার বাস্তবতাও নেই। কিন্তু সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতা, চেতনার মৃত্যু হয়নি। বিপ্লব এবং বিপ্লবোত্তর কর্মসূচী ছাড়া আমাদের মত আধা সামন্ততান্ত্রিক-আধা পুঁজিবাদী রাষ্ট্রকাঠামোয় পরিচালিত দেশে তা নির্মূল করাও যায় না। গত বারো বছরে তাই ক্ষমতা হারানো জোতদার পরিবারের উত্তরপুরুষ কিংবা রাজ্যে মাথা তোলা নব্য ধনীর ধান্দার মধ্যে দিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে সামন্ততান্ত্রিক চেতনা।
মাধ্যম তৃণমূল।
‘বিকল্পের সন্ধানে’ কমরেড নিরুপম সেন অনেকগুলি বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছিলেন আমাদের সামনে। তার মধ্যে একটি আশঙ্কার কথা উল্লেখ করেছিলেন রাজ্যের তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী। ২০০৫-র ২১জুন গণশক্তিতে প্রকাশিত তাঁর প্রবন্ধে সেন এক জায়গায় লিখেছিলেন,‘‘এসময়কালে একদিকে যেমন সাম্প্রদায়িকতা মৌলবাদের উত্থান হয়েছে, তেমনই বিভিন্ন রাজ্যে জাতপাতসহ আঞ্চলিকতাবাদেরও প্রসার ঘটেছে। অন্যদিকে বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিরও প্রাদুর্ভাব ঘটেছে। বামপন্থী সরকারের নেতৃত্বাধীন এ রাজ্যের জনগন এই সঙ্কীর্ণতার বিরুদ্ধেও সাফল্যের সঙ্গে নিরন্তর লড়াই করে যাচ্ছে — যার ফলে অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় এক্ষেত্রে আমাদের রাজ্য তার পৃথক অবস্থানকে সুস্পষ্ট করতে পেরেছে। আমাদের দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বিকাশে এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম।’’
গনতান্ত্রিক আন্দোলনের বিকাশ ফ্যাসিবাদকে, সাম্প্রদায়িকতাকে রোখার জন্য প্রয়োজনীয় ছিল। পশ্চিমবঙ্গে কৃষির বিকাশের উপর শিল্পের অগ্রগতি সেই গনতান্ত্রিক আন্দোলন এবং চেতনা বিকাশের অন্যতম শর্ত ছিল। যা শেষ পর্যন্ত সামন্ততান্ত্রিক চেতনাকে আরও দুর্বল করে ভূমিসংস্কারকে রক্ষা করত, পঞ্চায়েতকে আরও দৃঢ় করত।
মমতা-শাসন রাজ্যে সামন্ততান্ত্রিক চেতনাই উৎসাহিত হয়েছে। শ্রীহরি পালরা উৎসাহিত হয়েছে।
যার সুযোগ নিয়েছে বিজেপি, আরএসএস-র মত শক্তি।