সৌভিক ঘোষ
প্রেক্ষাপট
রাশিয়ায় বলশেভিকদের নেতৃত্বে দুনিয়ায় প্রথম সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সফল হওয়ায় সবচাইতে বেশি উৎসাহিত হয়েছিলেন ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী শোষণের শিকার হওয়া দেশগুলি। সেই আগুনের আঁচ ভারতেও এসে পৌঁছেছিল। অক্টোবর বিপ্লবের (সংশোধিত ক্যালেন্ডার অনুসারে নভেম্বর বিপ্লব) পরেই বিভিন্ন দেশের বিপ্লবীরা রাশিয়ায় হাজির হতে শুরু করেছিলেন। ভারতের বিপ্লবীরাও সেই উদ্দেশ্যে সক্রিয় হয়েছিলেন। ইউরোপের বিভিন্ন প্রদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ভারতীয় বিপ্লবীদের একাংশ (যারা বার্লিন কমিটি হিসাবে পরিচিত) বিপ্লবের দিনই সন্ধ্যায় লেনিন’কে টেলিগ্রাম লিখে শুভেচ্ছা ও সংগ্রামী অভিনন্দন জানিয়েছিলেন, দেশের ভিতরে থাকা বিপ্লবীরাও পিছিয়ে ছিলেন না। মনে রাখতে হবে ইউরোপের মাটিতে আশ্রয় নেওয়া ভারতীয় বিপ্লবীদের (Émigré Revolutionaries) তুলনায় দেশের সীমানার ভিতরে সক্রিয় বিপ্লবীদের জন্য বাধা ছিল অনেক বেশি। চিঠিপত্র আদানপ্রদান, বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যেকার সংযোগ রক্ষার কাজে তাদের অনেক বেশি গোপনীয়তা বজায় রাখতে হত। বিদেশে থাকা বিপ্লবীরা যত সহজে পৃথিবীর নানা প্রান্তের ঘটনাবলী জানতে পারতেন, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনস্থ ভারতে সেই সুযোগ অনেকটাই কম ছিল। তা স্বত্বেও রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লবের খবর এদেশে চেপে রাখা যায়নি। সেই খবরই ভারতীয় বিপ্লবীদের নতুন করে উৎসাহ যোগায়। এর পরেই শুরু হয় বিপ্লব উত্তর রাশিয়ায় যাওয়ার প্রচেষ্টা। লেনিনের সাথে দেখা করার ইচ্ছায় দেশে বিদেশে বিপ্লবীরা রওনা হলেন।
Émigré Revolutionaries’দের প্রচেষ্টা
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে থাকায় ভারতীয় বিপ্লবীদের একটি অংশ ‘শত্রুর শত্রুকে মিত্র’ হিসাবে ব্যবহারের নীতি গ্রহণ করেছিলেন। তাদের আশা ছিল ব্রিটিশ বিরোধিতার কারণেই জার্মানির থেকে অস্ত্র, অর্থ এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা সহজেই মিলবে। এরাই কিছুজন প্রবল বাধা কাটিয়ে জার্মানি পৌঁছন। তাঁরাই গড়ে তোলেন বার্লিন কমিটি। জার্মানির অবস্থা সন্তোষজনক নয় উপলব্ধি করে তারাই পরবর্তীকালে স্টকহোমে নতুন করে বিপ্লবী সমিতির কেন্দ্র স্থাপন করেন। ততদিনে ইউরোপের একাধিক সোশ্যাল-ডেমোক্র্যাটরা সেখানে বসবাস করতে শুরু করেছিলেন। এদের প্রায় সকলেই দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের সদস্য ছিলেন। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়রা এদের সঙ্গেই যোগাযোগ করলেন। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের সদস্যদের মধ্যে সংশোধনবাদীরাও ছিলেন (তখনও লেনিন বার্নস্টৈইনের মতবাদকে চুরমার করেননি)। এইসব দক্ষিণপন্থী সোশ্যাল-ডেমোক্র্যাটরা ভারতীয়দের কথাবার্তায় বিশেষ গুরুত্ব দেননি। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখছেন, ‘জাতিসমূহের মুক্তি আন্দোলনকে সোশ্যালিস্টরা আদৌ গুরুত্ব দিতে চান না, একথা আমরা ক্রমেই বুঝতে পারি’। প্রথমে জার্মানরা, পরে সোশ্যালিস্টরাও তাঁদের হতাশ করলেন। ঐ পরিস্থিতিতে ভারতীয়দের সামনে নতুন বন্ধুর সন্ধান করা ছাড়া কোনও উপায় ছিল না। তারা দেখলেন একমাত্র রাশিয়ার বলশেভিকরাই সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইকে জাতিসমূহের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের সাথে সম্পৃক্ত ও জরুরি বিবেচনা করছেন। উপনিবেশগুলিতে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন লেনিন। এম.এন. রায়ের সঙ্গে ভারতে বিপ্লবের পথ নির্ধারণ সংক্রান্ত বিতর্কে লেনিনের মতামত আরও স্পষ্ট হয়।
বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লেনিনের সাথে দেখা করতে সত্যিই আগ্রহী ছিলেন। যদিও তাঁদের দেখা হয়নি। ১৯৩৪ সালে লেনিনগ্রাদের ইউএসএসআর আকাদেমি অফ সায়েন্সেস-এর সম্মেলনে বক্তব্য রাখার সময় স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে তিনি উল্লেখ করেন, ‘১৯১৭ সালে আমি যখন স্টকহোমে এসে পৌঁছই, তখন দেখি বিভিন্ন দেশ থেকেই দেশান্তরী বিপ্লবীরা সেখানে জড়ো হয়েছেন। তাঁরা প্রায় সকলেই একে অন্যের কাছে লেনিনের সন্ধান করছিলেন, সকলেই তাঁর সঙ্গে পরিচয় করতে আগ্রহী ছিলেন’। লেনিনের সাথে কখনো সরাসরি পরিচয়ের সুযোগ হয়নি বলে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বিশেষ আক্ষেপ ছিল, সেই কথা তিনি বারে বারে উল্লেখ করেছেন। এমনকি লেনিনের সাথে ভারতীয় বিপ্লবীদের কেউ কখনো দেখা করেছেন কি না, বা তাদের আগে অন্য কোনও দলের সাথে তার চিঠিপত্র আদানপ্রদানের কোনও ঘটনা রয়েছে কি না এগুলি সম্পর্কে চট্টোপাধ্যায় নাঝেদযা ক্রুপ্সকায়াকেও চিঠি লিখেছিলেন। বিপ্লবের পরে রাশিয়ায় জাতি সমূহের নৃতাত্ত্বিক গবেষণা কেন্দ্র (Institute of Ethnography) গড়ে তোলা হয়, এই কেন্দ্রটি অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সেরই অন্তর্গত ছিল। লেনিনগ্রাদেই ছিল ইন্সটিটিউট অফ এথনোগ্রাফি’র দফতর। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সেই কেন্দ্রেই গবেষণা ও অধ্যাপনার কাজে যুক্ত হন। লেনিনের সাথে ভারতীয় বিপ্লবীদের সশরীরে সাক্ষাৎ হওয়ার খোঁজ তার নিজস্ব গবেষণা ‘লেনিন ও ভারতবর্ষ’-এরই অনুসঙ্গ ছিল, তাই ১৯৩৪ সালে ক্রুপ্সকায়া’র কাছে চিঠি লিখে তিনি জানতে চেয়েছিলেন-
‘ডিয়ার কমরেড ক্রুপস্কায়া,
লেনিনের জীবনের কয়েকটি বিশেষ অধ্যায় সম্পর্কে জানতে আমি রীতিমত চেষ্টা করে চলেছি। যদিও ইতিমধ্যে তাঁর যতগুলি জীবনী প্রকাশিত হয়েছে কিংবা আপনি যে স্মৃতিকথা লিখেছেন তাতে সেই সম্পর্কে কোনোরকম উল্লেখ নেই। যদি আমার কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর আপনার কাছ থেকে পাই তবে বিশেষ কৃতজ্ঞ থাকব। আমার জিজ্ঞাসাঃ
১) লন্ডনে বসবাস করার সময় লেনিনের সাথে ভারতীয় কারোর পরিচয় বা যোগাযোগ হয়েছিল কি? যদি সেরকম কোনও ঘটনা আপনার মনে পড়ে তবে আমাকে অবশ্যই জানাবেন।
২) ১৯০৭ সালে স্টুটগার্ট কংগ্রেসে দুজন ভারতীয় প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন মহিলা, তার নাম রুস্তমজি কামা। তিনি ঐ সম্মেলনে ভারতীয়দের মুক্তি সংগ্রাম পরিচালনার প্রসঙ্গে বিতর্কে অংশগ্রহনও করেছিলেন। আমি জানতে চাইছি, ভারত সম্পর্কে লেনিনের সাথে ম্যাডাম কামার কোনও আলোচনা হয়েছিল কি?
৩) অক্টোবর বিপ্লবের পূর্বে, বিশেষ করে ১৯১২-১৭ পর্যায়ে লেনিন নিজে বা অন্য কারোর মাধ্যমে ভারতীয় বিপ্লবীদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলেন কি?
অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সের পক্ষ থেকেই আমি ‘লেনিন ও ভারতবর্ষ’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ রচনার কাজ করছি। এই কাজে উপরোক্ত তথ্যগুলি সংগ্রহ করা আমার বিশেষ প্রয়োজন।
আমি আশা করছি আপনি আমাকে সেই কাজে সহযোগিতা করবেন এবং যত দ্রুত সম্ভব এ সম্পর্কিত তথ্য যদি আপনার কাছে থাকে বা আপনার মনে পড়ে তবে সেগুলি আমাকে জানাবেন।
আপনি হয়ত আমাকে চিনবেন না ধরে নিয়ে আমি অনুরোধ জানাচ্ছি আমার পরিচয় ও কাজ সম্পর্কে কমরেড পিয়াতানস্কি অথবা কমরেড মানৌলস্কি’র কাছে খোঁজ করতে পারেন।
ইতি
ভ্রাতৃবৎ অভিনন্দন সহ
চট্টোপাধ্যায়
২৫শে জানুয়ারি, ১৯৩৪’
১৩ দিন পরে ক্রুপস্কায়া সেই চিঠির উত্তর দেন। ৭ই ফেব্রুয়ারি চট্টোপাধ্যায়’কে জানান, তিনি যা যা জানতে চাইছেন সেরকম ঘটণার কথা তাঁর স্মৃতিতে নেই। স্টুটগার্ট কংগ্রেসে লেনিন একাই উপস্থিত ছিলেন, ক্রুপস্কায়া তাঁর সাথে যাননি। এমনকি পরেও সেই সম্মেলনের ঘটনাবলি সম্পর্কে তাদের মধ্যে কোনও আলোচনা হয়নি। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যা খুঁজছিলেন তা পেলেন না।
কিন্তু লেনিনের সাথে ভারতীয় বিপ্লবীদের সশরীরে যোগাযোগ হয়েছিল! তবে সেই সাক্ষাৎ ঘটেছিল ১৯১৮ সালে, একান্ত গোপনে। যারা এসেছিলেন তাঁদের কেউই বিদেশে বসবাস করতেন না, ভারত থেকেই লেনিনের সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলেন। চট্টোপাধ্যায়’রা যা খুঁজছিলেন তাতে ভুল কিছু ছিল না, শুধু অমন সাক্ষাৎ বা পরিচয়ের সময়টুকুর সম্ভাবনা তারা সঠিক নির্ধারণ করতে পারেননি। হয়ত তারা ভাবতে পারেননি বার্লিন কমিটির প্রতিনিধিদেরও আগে সরাসরি ভারত থেকে কোনও বিপ্লবী রাশিয়ায় এসে উপস্থিত হতে পারেন। তাই হয়ত চট্টোপাধ্যায়ের চিঠিতে বিপ্লবের আগেকার সন-তারিখ উল্লেখ করা হয়েছিল, স্টুটগার্ট কংগ্রেসের খোঁজ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বার্লিন কমিটি বা বিদেশে আশ্রিত অন্যন্য বিপ্লবীদেরও আগে ভারত থেকেই বিপ্লবীদের সেই দল মস্কোয় পৌঁছে যায়। তাঁরা লেনিনের সাথে দেখা করেন, রাশিয়ায় কমিউনিস্টদের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সাথে রীতিমত আলোচনাও করেন। এর অনেক বছর বাদে সাইবেরিয়ার প্রাদেশিক সরকারের অধীনস্থ মহাফেজখানায় সেই আলোচনার লিখিত দলিল খুঁজে পাওয়া যায়, ১৯৫৮ সালে। ১৯৬৭ সালের অক্টোবর মাসে ভারতে অবস্থিত রাশিয়ান দূতাবাসের তথ্য দফতর থেকে প্রকাশিত একটি প্রেস রিলিজে সেই দলিল সম্পর্কে সকলকে জানানো হয়।
মস্কোয় লেনিনের সামনে ভারতীয় বিপ্লবীরা
রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লবের খবর পেয়ে ভারত থেকেই বিপ্লবীদের একটি ছোট্ট দল লেনিনের সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলেন। পথে বাধা ছিল, বিপদের আশঙ্কা ছিল- ব্রিটিশ গোয়েন্দা ও পুলিশের নজরে এলে তৎক্ষণাৎ গ্রেফতার তো বটেই এমনকি ‘শ্যুট অ্যাট সাইট’-র সম্ভাবনাও যথেষ্টই ছিল। এসব জেনেও তারা এগিয়েছিলেন।
১৯১৮ সালের নভেম্বর মাসে দুজন ভারতীয় রাশিয়ায় পৌঁছান।
ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের নজর এড়াতে তারা নকল নাম ব্যবহার করেছিলেন। পাসপোর্ট ইত্যাদিতে যেটুকু উল্লেখ রয়েছে তাতে জানা যায় ঐ দুই ভারতীয় ছিলেন মহম্মদ হাদি এবং আহমত হ্যারিস। এরা উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি, দুজনেই দিল্লীর স্থায়ী বাসিন্দা।
রাশিয়ার সীমানায় প্রবেশ করার পরে তারা প্রাদেশিক পিপলস কমিশার অফ ফরেন অ্যাফেয়ার্স’র দফতরে যোগাযোগ করতে সমর্থ হন। সেখানেই তারা লেনিনের সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্য জানান। কমিশার তাদের মস্কোয় থাকার বন্দোবস্ত করে দেয় এবং জানায় কিছুদিনের মধ্যেই তারা লেনিনের সাথে দেখার করার, কথা বলার সুযোগ পেতে পারেন।
২৩শে নভেম্বর, সন্ধ্যায় ক্রেমলিনে তারা দুজনেই লেনিনের সাথে আলোচনায় বসেন। ভারতে ব্রিটিশ শাসনের তৎকালীন অবস্থা, ভারতীয় জনগণের লড়াই-সংগ্রাম ও মুক্তিআন্দোলনের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা হয়। সেই সাক্ষাৎকারের বিবরণ লিখিত দলিল আকারে সংরক্ষণেরও সিদ্ধান্ত হয়। সেই দলিলটিই ৪০ বছর পরে কোলচাকের প্রাদেশিক সরকারের মহাফেজখানা থেকে উদ্ধার হয়।
দলিলের এক জায়াগায় উল্লেখ রয়েছে-
‘ঐ দুই ভারতীয় বিপ্লবী ইতিমধ্যেই পিপলস কমিশার অফ ফরেন অ্যাফেয়ার্সের দফতরে একটি লিখিত বিবৃতি জমা দিয়েছিলেন। সেই বিবৃতির শিরোনাম ছিল ‘মেসেজ ফ্রম দ্য পিপল অফ ইন্ডিয়া’। দিল্লীর বাসিন্দা ঐ দুই সুশিক্ষিত যুবক ভারতীয় মুসলমানদের প্রতিনিধি হিসাবে মস্কোয় এসেছিলেন। ভারত সহ ঔপনিবেশিক শাসনে জর্জরিত প্রাচ্যদেশসমূহের মুক্তি সংগ্রামের সমস্যা প্রসঙ্গে তারা লেনিনের সাথে দীর্ঘ আলোচনা করেছিলেন।’
২৫শে অক্টোবর ঐ দুজন ‘নিখিল রাশিয়া কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি’র সাথে আলোচনায় বসেন। অক্টোবর বিপ্লব সংক্রান্ত দলিল-দস্তাবেজ সংরক্ষিত ছিল মস্কোর কেন্দ্রীয় লেখ্যাগারে, সেখানেই ঐদিনের সভার কার্যবিবরণী মেলে। সভায় ভারতীয় বিপ্লবীদের তরফে বক্তব্য রাখার সময়ই হলঘর কাঁপিয়ে উচ্চারিত হয়- ‘কমরেডস অ্যান্ড ব্রাদার্স!’।
‘কমরেডস অ্যান্ড ব্রাদার্স, লিডার্স অফ দ্য রাশিয়ান রেভোল্যুশন!
আমরা অনেক দূরের দেশ থেকে আপনাদের সামনে এসে উপস্থিত হয়েছি। আপনারা বিপ্লবে সাফল্য অর্জন করেছেন। ভারত আপনাদের অভিনন্দন জানাচ্ছে। আপনাদের সাফল্য কেবল রাশিয়ার জয় না, সারা পৃথিবী জুড়ে মুক্তিকামী মানুষের লড়াইতে নতুন রসদ। রাশিয়ার বিপ্লবের সাফল্য আমাদের কার্যকরী রূপে দূরদর্শী হতে সহায়তা যুগিয়েছে, আমরা আশাবাদী একটি দেশে বিপ্লবের সাফল্যেই এই লড়াই আটকে থাকবে না। নিপীড়িত মানুষের মুক্তি সংগ্রামের কাজ সবে শুরু হয়েছে, গোটা দুনিয়াজুড়ে সেই কাজ শেষ অবধি এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই এখন লক্ষ্য। যে বিপ্লবী কর্মধারার সূত্রপাত আপনারা করেছেন তাকে পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে পৌঁছে দিতে হবে।’
ভারতীয় বিপ্লবীদের সাথে আলোচনা শেষে রাশিয়ার কমিউনিস্ট নেতৃবৃন্দ রীতিমত উত্তেজিত ছিলেন। তাদের নিজস্ব স্মৃতিচারণায় সেইসব কথা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। ঐ দুই বিপ্লবী একান্ত গোপনীয়তা অবলম্বন করে ভারত থেকে রাশিয়ায় এসেছিলেন, মস্কোর কমিউনিস্টরাও সেই গোপনীয়তা শেষ অবধি মেনে চলেছেন। এমনকি ক্রুপস্কায়া অবধি এই খবর জানতে পারেননি, তাই চট্টোপাধ্যায়ের চিঠির উত্তরে নিজের অপারগতার কথা লিখে জানিয়েছিলেন। রাশিয়ায় বিপ্লব সফল হওয়ার এক বছরের মধ্যেই কুখ্যাত ব্রিটিশ নজরদারিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ভারত থেকে দুজন যুবক মস্কোয় এসে লেনিনের সাথে মিটিং করেছেন, সেদেশের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সাথে বিস্তৃত আলোচনায় বিশ্ববিপ্লবের আহ্বানে সমর্থন জানিয়ে গেছেন। মস্কোর কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার থেকে দলিল খুঁজে পাওয়া না গেলে হয়ত এই ঘটনা কোনোদিনই জানা যেত না।
২৫শে নভেম্বরের সেই সভার স্মৃতিচারনা করতে গিয়ে ওয়াই এম সর্ভেদলভ বলছেন-
‘ঐ দিন ভারতীয় বিপ্লবীদের প্রতিনিধিরা আমাদের হাতে একটি স্মারকলিপি তুলে দেন। তার শিরোনাম ছিল ‘দ্য ভয়েস অফ এনস্লেভড ইন্ডিয়া’- দাসত্বের শৃংখলে জড়িয়ে থাকা ভারতবর্ষের আহ্বান। তাতে উল্লেখ ছিল- দুনিয়া জানে না ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের আসল চেহারাটা ঠিক কেমন, ভারতীয় জনগণ কি ধরণের অত্যাচার, নিপীড়ন ও শোষণের শিকার। ঐ স্মারকলিপি পাঠের পরে আমরা বেশ কিছুটা বিহ্বল হয়ে পড়েছিলাম। তারা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছিলেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালাতে ইতিমধ্যে ভারতীয় বিপ্লবীরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্সের নিকটে সাহায্য প্রার্থনা করেছেন- তারা ভারতীয়দের প্রতি কর্ণপাত করেননি। ব্রিটেনে তাদের ঢুকতেই দেওয়া হয়নি। এর পরে তারা স্যুইৎজারল্যান্ড হয়ে ডেনমার্ক অবধি গেছেন, এমনকি জাপানও তাদের সাহায্য করেনি। ব্রিটিশ বন্ধুদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রদর্শনে এরা কেউই ভারতবর্ষের পাশে দাঁড়ানোর হিম্মৎ দেখায়নি… রাশিয়ার বিপ্লব ভারতীয় জনসাধারণের চেতনায় বিশেষ পরিবর্তন এনেছে। ইংলন্ডের তরফে যতরকম অপচেষ্টাই করা হোক না কেন, জাতি সমূহের আত্মনিয়ন্ত্রনের অধিকার সম্পর্কে বলশেভিকরা যে নীতি নিয়েছে সেই স্লোগান আজ ভারতের প্রতিটি প্রান্তে পৌঁছে গেছে।’
রাশিয়ায় প্রবেশের পর থেকে এই সর্ভেদলভ’ই ভারতীয় বিপ্লবীদের সাথে থেকেছেন। ক্রেমলিনে লেনিন ও মস্কোয় কমিউনিস্ট পার্টি নেতৃত্বের সাথে ভারতীয় বিপ্লবীদের যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম ছিলেন তিনিই। ইজভেস্তিয়া কাগজে ১৯১৮ সালের ২৬শে নভেম্বরই ঐ সভা সম্পর্কে তিনি একটি প্রতিবেদন লিখেছিলেন-
‘ভারতীয় বিপ্লবীদের তরফে পেশ করা স্মারকলিপির শেষ কটি কথা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এতে রয়েছে- আমরা আশা করি ভারত সহ গোটা দুনিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রামেই সদ্য মুক্ত আমাদের রাশিয়ান ভায়েরা নিজেদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবেন। আমরা নিশ্চিত মুক্তির আদর্শে অনুপ্রাণিত যেকোনো মানুষই সেই দিনের কল্পনায় বিশেষ আনন্দ অনুভব করবেন যখন ৩২৫ মিলিয়ন ভারতবাসী বিদেশী কর্তৃত্বের কবল থেকে নিজেদের দাসত্বের বন্ধন ছিন্ন করবেন ও স্বাধীন হবেন।’
ভারতীয় বিপ্লবীরা রাশিয়ায় যে উদ্দেশ্যে পৌঁছেছিলেন তা সফল হয়েছিল। যদিও এর পরের ইতিহাস খুবই অস্পষ্ট। সরকারি নথি ইত্যাদিতে যতটুকু পাওয়া যায় তার ভিত্তিতে এটুকু নিশ্চিত রাশিয়া থেকে দেশে ফেরার পথে সিঙ্গাপুরের কাছাকাছি ঐ দুজন ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের হাতে গ্রেফতার হন। দেশে আর ফেরা হয়নি। যে পরিচয়ে তারা রাশিয়া গেছিলেন তা নকল ছিল, মহম্মদ হাদি ও আহমত হ্যারিসের আসল পরিচয় কি আজও তা অজানাই রয়ে গেছে। কেউই নিশ্চিতভাবে বলতে পারেন না গ্রেফতার হওয়ার পরে তাদের শেষ পরিণতি কি হয়েছিল।
শুধুই ইতিহাস চর্চা?
সামনেই ১৭ই অক্টোবর। তাই কি অতীত চর্চার দায় থেকে এমন প্রতিবেদন? একেবারেই না। বরং ঠিক উল্টোটাই সত্যি। এই লেখার উদ্দেশ্য আজকের ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলনে, কমিউনিস্ট পার্টিতে যুক্ত হতে আসা কম বয়সী ছেলে-মেয়েদের চিনিয়ে দেওয়া, তাদের ঐতিহ্যের শিকড় কতদুর বিস্তৃত। হাতের মুঠোয় লাল ঝাণ্ডাটি ধরার সময় তারা যেন মনে রাখেন কোন উত্তরাধিকার তাদের কাঁধে রয়েছে। আজকের দুনিয়ায় সশরীরে উপস্থিত না হয়েও পৃথিবীর দুই প্রান্তের মানুষ একে অন্যের সাথে মুখোমুখি কথা বলতে পারেন, ইন্টারনেট প্রযুক্তি সম্বলিত ভয়েস কল এবং ভিডিও কল সেই সুযোগ দিয়েছে। আজকের ভারতেও শাসক আগামী প্রজন্মকে দাস বানাতে নিত্যনতুন আইন, বিধি-নিষেধ জারী করে চলেছে। শাসক আজও মনে করে সন্ত্রস্থ করে মানুষকে দমিয়ে রাখা যায়, নিপীড়ন-শোষণ চালিয়ে জনসাধারণকে ভয় দেখানো যায়, তাদের মুক্তির দাবী অগ্রাহ্য করা যায়। শাসক বারে বারে নিজেদের পরাজয়ের ইতিহাস ভুলে যেতে পারে, মেহনতি মানুষ, নিপীড়িত, লাঞ্ছিত, অত্যাচারিত মানুষ নিজেদের জয়ের ইতিহাস ভোলে না। সেই উদ্দেশ্যেই এই প্রতিবেদন, আসলে অতীত চর্চা না, সামনে এগিয়ে চলার সাহস পেতে পিছন ঘুরে দেখা- আমরা কি ছিলাম, কেমন ছিলেন আমাদের পূর্বসূরীরা। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের জমানায় বিপ্লবীদের প্রকাশ্য রাস্তায় গুলি করে মারার লাইসেন্স দেওয়া ছিল, সেই যুগেও দুজন ভারতীয় এদেশ থেকেই রাশিয়ায় হাজির হয়েছিলেন। তারা কেউই সুপারহিউম্যান ছিলেন না, বিপ্লবী ছিলেন বলেই অমন কাজের পরিকল্পনা নিয়েছিলেন, সফলও হয়েছিলেন। আন্দাজ করতে অসুবিধা হয় না বাধা হিসাবে কত কিই না তাদের পেরোতে হয়েছে। আজ যখন শাসক আরেকবার ভাবছে ভয় দেখিয়েই লুঠ করা চালিয়ে যাবে তখন আমরা যেন মনে রাখি আমাদের পূর্বজরা কি আহ্বান জানিয়েছিলেন- ‘কমরেডস অ্যান্ড ব্রাদার্স’।
বিপ্লবের ইতিহাস কোনোদিনই সরলরেখায় এগোয় না, তাতেও জোয়ার-ভাঁটার টান দেখা দেয়। মানবচরিত্রের সাথে সদৃশতা বজায় রেখেই বিপ্লবী শক্তিও কখনো পিছিয়ে পড়ে আবার শক্তি সঞ্চয় করে সামনেও এগোয়। আন্তনিও গ্রামশি’র সবচাইতে বড় আবিষ্কারই হল এই তত্ত্ব। ফ্যাসিস্ত কারাগারে বসে লেখাপত্রকে সেন্সরশিপের বাধা কাটিয়ে প্রকাশ করতে তিনি নিজের রচনায় বেশ কিছু নতুন শব্দ ব্যবহার করেছিলেন, নানা কারণে সেগুলিকেই বেশি প্রচার করা হয়। গ্রামশি কেবল ভাষাবিদ ছিলেন না, ভাষা বিজ্ঞানে তার বিশেষ পাণ্ডিত্য অবশ্যই ছিল। ইতালির তুরিন বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনের পাশাপাশি তিনি ভাষা বিজ্ঞানেরও ছাত্র ছিলেন। কিন্তু সেটাই তার অস্তিত্বের আসল কথা না। তাঁর প্রকৃত পরিচয় এই যে তিনি কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকতাবাদী বিপ্লবী। ফ্যাসিস্ত আক্রমণের মুখে মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও যিনি নিজের আদর্শ পরিত্যাগ করেননি। আজকের ভারতে শাসক এমন ভাব দেখাচ্ছে যেন ইতিহাসের মৃত্যু ঘটেছে।
তাই এই প্রতিবেদন।
গ্রামশি অক্টোবর বিপ্লবকে বিশ্ববিপ্লবে জোয়ারের পর্ব হিসাবেই চিহ্নিত করেছিলেন। ফ্যাসিস্ত বাহিনীর ক্ষমতাসীন হওয়াকে নির্ধারণ করেছিলেন ভাঁটার যুগ বলে। ইতিহাস সাক্ষী, পৃথিবী সেই ভাঁটার আগুন পেরিয়েও টিকে রয়েছে। আজকের দুনিয়াতেও বিপ্লবের বাস্তবায়নে পুনরায় জোয়ার উঠবে, আগামিদিনে কোনও এক প্রান্তে আবার উচ্চারিত হবে সেই আহ্বান- ‘কমরেডস অ্যান্ড ব্রাদার্স!’
সেই প্রত্যাশাতেই এমন প্রতিবেদন।