সোমনাথ ভট্টাচার্য
কমরেড লেনিন (১৮৭০-১৯২৪) জন্মেছিলেন আজ থেকে দেড়শ বছর আগে। মারা গেছেন প্রায় একশ বছর হতে চলল। তবুও লেনিন আজও জীবন্ত,প্রানবন্ত। কমিউনিস্টদের আঁকাবাঁকা, বন্ধুর পথে এগিয়ে চলার প্রেরণা (খুব সচেতনভাবেই ‘অনু’ উপসর্গটা শব্দের সঙ্গে যুক্ত করলাম না)। নিপীড়িত মানুষের যন্ত্রনা মুক্তির পথপ্রদর্শক।
মার্কস (১৮১৮-১৮৮৩) ছবি এঁকেছিলেন শোষনহীন সমাজের। মার্কস এবং এঙ্গেলস (১৮২০-১৮৯৫)তাদের জীবদ্দশায় হাজার চেষ্টা করেও সে সমাজ গড়তে পারেননি। যদিও এর তত্ত্বগত বুনিয়াদ তারাই রচনা করেছিলেন। দার্শনিক ভিত্তি, অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ, সমাজবিপ্লবের ধারণা কোনটাই তারা বাকি রাখেননি। প্রচলিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে গিয়ে এইসব নতুন কথা বলা আর সমাজের ‘ছোটলোকদের’ মাথায় তোলার অপরাধে কম নির্যাতন তাদের সহ্য করতে হয়নি। দেশ থেকে বিতাড়িত হওয়া, মারাত্মক অর্থকষ্টে জীবন কাটানো, বিনা চিকিৎসায় ছেলের মৃত্যু চাক্ষুষ করা – এ সবই সহ্য করেছেন কার্ল মার্কস। এর সঙ্গে ছিল লাগামহীন কুৎসা, ষড়যন্ত্র, আর বেইমানি। ভাবলে চোখে জল চলে আসে, মার্কসের কবরের সময় উপস্থিত ছিলেন মাত্র ১৩ জন । অথচ ২০০০ সালে বিবিসি ঘোষণা করল : সহস্রাব্দের শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ হলেন কার্ল মার্কস (Thinker of the Millennium)।
১৮৮৩ থেকে ২০০০ সাল – মার্কস মূল্যায়নের এই বিবর্তনের পেছনে যে ব্যক্তির নাম সবার আগে আসে তিনি কমরেড লেনিন। তবে তার চেয়েও বড় অবদান নিঃসন্দেহে মার্কসের নিজের এবং মার্কস এঙ্গেলসের যৌথ সৃষ্টির।
মার্কসের জীবদ্দশায় তাকে ব্যঙ্গ করে বলা হল , এ যুগের ‘প্রমিথিউস’ ! গ্রিক পুরাণের সেই ব্যক্তি, যিনি স্বর্গ থেকে আগুন চুরি করে মর্তের মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন। বলা হল : মার্কস নাকি কল্পনার স্বর্গরাজ্য প্রতিষ্ঠা করবে মর্তের মাটিতে ! তাকে পাগল প্রতিপন্ন করে কুকুর লেলিয়ে দেওয়া হত ।
লেনিন ১৯১৭ র অক্টোবরে (তৎকালীন রাশিয়ার ক্যালেন্ডারে যা ছিল ২৫ অক্টোবর , আধুনিক পৃথিবীর সার্বজনীন ক্যালেন্ডারে সেটাই ৭ নভেম্বর) নভেম্বর বিপ্লব সম্পন্ন করে প্রমাণ করলেন, মার্কস সত্যিই এ যুগের প্রমিথিউস। প্রমাণ করলেন, সমাজের নিচুতলার মানুষগুলোও দেশের কর্ণধার হতে পারে। প্রমাণ করলেন, কল্পনার স্বর্গরাজ্য এই মর্তের মাটিতেই প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব। যেখানে ক্ষুধার্তের হাহাকার নেই, নেই বস্ত্র বাসস্থানের দুশ্চিন্তা, আছে সবার জন্য শিক্ষার আলো আর সুচিকিৎসার বন্দোবস্ত। এর নাম সমাজতন্ত্র। এতদিন যারা মার্কসবাদকে তত্ত্বের আড়ালে ঢেকে রাখতে চাইতেন, লেনিন তাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন এটা কোন আপ্তবাক্য নয়, এগিয়ে চলার পথনির্দেশ ।
এই দেশটা দেখেই রবীন্দ্রনাথ ‘রাশিয়ার চিঠি’তে লিখেছিলেন, “এখানে না এলে আমার তীর্থদর্শন অসম্পূর্ণ থেকে যেত।”
১৯২৪ সালের ২১ জানুয়ারি লেনিনের মৃত্যু হয়। ১ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিশ্রুত মনীষী রঁমা রলাঁ লেখেন, ” লেনিন ও রুশ বলশেভিকবাদের মতবাদ আমি স্বীকার করি না।… কিন্তু এই শতাব্দীর ইউরোপে লেনিনের চেয়ে শক্তিমান পুরুষ জন্মেছেন বলে আমার জানা নেই।… জীবন দিয়ে কালের বুকে যে নৈতিক প্রতিমূর্তি তিনি স্থাপন করে গেলেন তা কোনদিন ম্লান হবে না।” (Romain Rolland : I will not Rest)
আর জওহর লাল নেহরু তাঁর Glimpses of World History তে লিখলেন , ” সকলের ওপরে ছিলেন লেনিন স্বয়ং । তাঁর অধিনায়কত্বে আপত্তি বা সংশয় প্রকাশ করতে পারে এমন কেউ ছিল না। রাশিয়ার প্রজারা তাকে মেনে নিয়েছিল একজন অর্ধদেবতা বলে। আশা এবং নির্ভয়ের প্রতীক তিনি। তিনিই জ্ঞানী পুরুষ, যিনি প্রতিটি সঙ্কটে তাদের উদ্ধার করার উপায় জানেন। কোনো বিপদেই যিনি বিভ্রান্ত বা বিচলিত হন না।”
বলার অপেক্ষা রাখে না রবীন্দ্রনাথ, রঁলা বা নেহরু কেউই মার্কসবাদের প্রতি বিন্দুমাত্র আসক্ত ছিলেন না।
কোন পথ ধরে এগিয়েছিলেন লেনিন? সে ছিল এক সম্পূর্ণ অজানা পথ। গভীর জঙ্গলে প্রথম পদচারির জন্য কোন রাস্তা কাটা থাকে না, তাকেই জঙ্গলে কেটে পথ বানাতে হয়। অজানা সমুদ্রে পাড়ি দেওয়া প্রথম নাবিকটির হাতে কোন মানচিত্র থাকে না, তাকেই চলতে চলতে মানচিত্র এঁকে নিতে হয় । লেনিনের ক্ষেত্রেও তাই। এক না-চলা পথে পাড়ি দিয়েছিলেন তিনি। সঙ্গে শুধু মার্কসবাদের সার্চ লাইট। সেই আলোতেই পথ চিনে নিতেন; কোন পথে যাবেন আর কোনটা পরিত্যাগ করবেন। এভাবে অচেনা পথে শুরু হয়েছিল তার যাত্রা। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় –
অচেনাকে ভয় কী আমার ওরে ?
অচেনাকেই চিনে চিনে উঠবে জীবন ভরে ॥
একের পর এক প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে আর সমস্যার সমাধান করতে করতে এগিয়েছেন লেনিন। লেনিন যখন রাশিয়ায় বিপ্লবের প্রস্তুতি নিচ্ছেন তখন এক বিরাট প্রশ্ন হাজির হল তার সামনে । মার্কস এঙ্গেলস বলেছেন উন্নত পুঁজিবাদী দেশে আগে বিপ্লব হবে । যেমন ফ্রান্স, জার্মানি, ইংল্যান্ড। কিন্তু রাশিয়াতো অনুন্নত দেশ, ইউরোপের উঠোন । সেখানে কী করে বিপ্লব হবে ? লেনিন বললেন বিপ্লবের Objective Condition আর Subjective Condition কে handshake করিয়ে দিতে হবে। বিপ্লবের Objective Condition কী ? দেশের অধিকাংশ মানুষ যদি শাসকের অত্যাচারের অবসান চায়, শাসকের পরিবর্তন চায় তার মানেই Objective Condition প্রস্তুত। রাশিয়ার মানুষ এটাই চাইছিলেন।
কিন্তু মানুষ চাইলেই তো শাসক বদলায় না। তারজন্য চাই মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ , ত্যাগ স্বীকারে ব্রতী , জনগণের জন্য নিয়োজিত প্রাণ একটি বিপ্লবী পার্টি। রাশিয়ার বলশেভিক পার্টি। এটাই হল Subjective Condition । এই দুইয়ের মিলনেই সম্ভব হয়েছিল নভেম্বর বিপ্লব।
বিপ্লবী সংগ্রামে ব্যাপক অংশের মানুষকে সমবেত করতে হবে।তাদের একত্রিত করার জন্য ডাক দিতে হবে।কী হবে পার্টির স্লোগান ? লেনিন শেখালেন কীভাবে স্লোগান নির্দিষ্ট করতে হয়।সঠিক সময়ে সঠিক স্লোগান।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছে। রাশিয়া যুদ্ধরত দেশ। তাই রাশিয়ায় যুদ্ধ আছে, যার অর্থ শান্তি নেই। লেনিন বললেন আওয়াজ তোল : শান্তি চাই।
যুদ্ধের টাকা জোগাড় হচ্ছে কৃষক,শ্রমিক আর সাধারণ মানুষের ওপরে অত্যাচার করে । অতিরিক্ত কর দিতে গিয়ে মানুষ অনাহারে, অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে। লেনিন দাবি করলেন : রুটি চাই।
রাশিয়ার ইতিহাস আর তলস্তয়ের উপন্যাস পড়ে লেনিন জেনেছিলেন কীভাবে জার (রাজা) ,জারিনা ও সামন্ত প্রভুরা শতাব্দীর পর শতাব্দী কৃষকদের এক এক টুকরো জমি কেড়ে নিয়েছে। তাই লেনিন স্লোগান দিলেন : জমি চাই। এভাবেই শান্তি,রুটি আর জমির স্লোগানের মধ্য দিয়ে সেদেশের অধিকাংশ মানুষ বুঝতে পারল তাদের না বলতে পারা, অব্যক্ত কথাগুলোই বলশেভিকরা স্লোগানের মাধ্যমে তুলে ধরেছে। তাই এই স্লোগান এখন তাদের স্লোগান। এভাবেই লেনিন পার্টির স্লোগানকে জনগণের স্লোগানে পরিণত করেছিলেন।
এরকম অসংখ্য প্রশ্নের নিরসন করতে করতে তিনি সৃষ্টি করেছেন নতুন নতুন তত্ত্ব আর উপহার দিয়েছেন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। তাই তাঁর মৃত্যুর পর কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক সিদ্ধান্ত নেয়, এখন থেকে সর্বহারার মতবাদ আর শুধু মার্কসবাদ নয় ; মার্কসবাদ-লেনিনবাদ।
পৃথিবীতে যতদিন শোষণ থাকবে, ততদিন থাকবে শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার সংগ্রাম। আর সেই লড়াইয়ে পথ দেখাবেন বিশ্বের প্রথম শোষণহীন সমাজ গড়ার মহানায়ক কমরেড লেনিন।