২১ শে ফেব্রুয়ারী ,২৩ (মঙ্গলবার)
কমিউনিস্ট ইস্তেহারের এখন একশ পঁচাত্তর বছর। পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার উচ্ছেদ ঘটিয়ে শ্রেণিহীন সমাজের দিকে যাত্রার যে স্বপ্ন ইস্তেহার ঘোষণা করেছিল, চড়াই-উৎরাই উত্থান-পতনের এই দীর্ঘ সময়ে তার গুরুত্ব একটুও কমেনি। বরং প্রতিদিন তা আরও অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। ইস্তেহারের ভাষায় একশ পঁচাত্তর বছর আগে ‘কমিউনিজমের ভূত’ এ আতঙ্কিত হয়েছিল ইউরোপ। আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজির চূড়ান্ত আধিপত্যবাদী পৃথিবীতে আজও সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদ কে ‘কমিউনিজমের ভুত’ই তাড়া করে বেড়ায়।
ইস্তেহারের প্রকাশকালে ইউরোপে ধনতন্ত্র বিকাশের পর্যায়ে ছিল। এশিয়া-আফ্রিকা-লাতিন আমেরিকার উপনিবেশ থেকে ব্যাপক লুণ্ঠনের ফলে ইউরোপের ‘সাম্রাজ্যলোভী’ দেশগুলিতে ধনতন্ত্রের বিকাশ তখন গতিলাভ করেছে। তবে তখনও ইউরোপের সব দেশে ধনতন্ত্র সম্পূর্ণরূপে বিকশিত হয়নি। এমনকি জার্মানিতেও তখন গণতন্ত্রের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে নি। কিন্তু সর্বত্র নতুন ‘বিপ্লবী শ্রেণি’ শ্রমিক ও শ্রমজীবীদের মরণ লড়াই শুরু হয়েছে। শ্রমিকশ্রেণির যে কোনো আন্দোলন নিষ্ঠুরভাবে স্বৈরাচারী কায়দায় দমন করাটাও দস্তুর হয়ে উঠেছিল। অর্থাৎ ইউরোপে ইতিমধ্যেই শ্রমজীবী মানুষ ও শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলন যথেষ্ট শক্তি অর্জন করেছে। শ্রমিকশ্রেণি ও শ্রমজীবী মানুষদের মধ্যে কমিউনিজমের ধারণার বিকাশ শুরু হয়েছে। এবং কমিউনিস্টরা একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে সামনে সারিতে চলে আসছে। ইশতেহার প্রকাশের কয়েক মাসের মধ্যেই ফ্রান্সে শ্রমিকশ্রেণি বিপ্লবী প্রচেষ্টায় পথে নেমেছে।
১৮৪৮ থেকে ১৮৫০ ফ্রান্সের শ্রমিক বিপ্লব সাফল্য লাভ করতে না পারলেও ভবিষ্যতের ইঙ্গিতটা স্পষ্ট করতে পেরেছিল। ফলে বুর্জোয়া ও পুরনো সমাজের অবশিষ্ট শ্রেণিগুলি মিলিতভাবে কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল। ইস্তেহারের ভাষায় ‘এই ভূত ছাড়াবার জন্য এক পবিত্র জোটের মধ্যে এসে ঢুকেছে সাবেকি ইউরোপের সকল শক্তি- পোপ এবং জার, মেট্টেরনিখ ও গিজো,ফরাসী র্যাডিকালেরা আর জার্মান পুলিশগোয়েন্দারা।’ সমকালীন ইউরোপে রাষ্ট্রকে ব্যবহার করে শ্রমিকশ্রেণি ও শ্রমজীবীদের আন্দোলন গুলিকে দমন করার পাশাপাশি, বুর্জোয়া ও পুরনো সমাজের অবশিষ্ট শ্রেণিগুলি কমিউনিজমের আদর্শের বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ শুরু করেছিল। ইস্তেহার দৃঢ়তার সঙ্গে কমিউনিস্টদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং বুর্জোদের পতন ও প্রলেতারিয়েতের বিজয় ঘোষণা করেছেন। প্রলেতারিয়েতের বিজয় কিভাবে সম্ভব, সংগ্রামে কমিউনিস্টদের ভূমিকা কি ? ইস্তেহারের দ্বিতীয় অধ্যায়ে দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করা হয়েছে, ‘.…প্রলেতারিয়েত কে শ্রেণি হিসেবে গঠন করা, বুর্জোয়া আধিপত্যের উচ্ছেদ, প্রলেতারিয়েত কর্তৃক রাজনৈতিক ক্ষমতা অধিকার।’ অর্থাৎ প্রলেতারিয়েতকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন ও সংগঠিত করে ক্ষমতা দখলের সংগ্রামে যুক্ত করার কাজে কমিউনিস্টদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ইস্তেহারের এই দিক নির্দেশ আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক।
ইস্তেহারের প্রকাশকাল শতবর্ষ অতিক্রান্তকালীন সময়ের মধ্যেই রুশ ও চীন বিপ্লব সফল হয়েছে। দুর্দমনীয় ফ্যাসিবাদকে প্রতিহত করে পৃথিবীর সভ্যতা ও গণতন্ত্রকে রক্ষা করেছে শ্রমিকশ্রেণির নিজস্ব রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ন। এই সময়ের মধ্যেই ১৮৭১’র প্যারিস কমিউন এবং ১৯০৫’র রুশদেশ দেশে বিপ্লব প্রচেষ্টা সংগঠিত হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ উত্তর পৃথিবীতে কিউবা, ভিয়েতনাম, কোরিয়া সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সমাজতন্ত্রের পথে পা বাড়িয়েছে। উপনিবেশিকতা থেকে মুক্ত স্বাধীন দেশগুলির বড় অংশ জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন গড়ে তুলে সাম্রাজ্যবাদের সামনে বাধা সৃষ্টি করেছে। ১৮৪৮ থেকে একশো পঁচাত্তর বছরের মধ্যে আমরা একটা অন্য পৃথিবীতে পৌঁছেছি। ১৯৯১ থেকে নয়া উদারবাদের মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদ গোটা পৃথিবী জুড়ে নতুন ভাবে আগ্রাসী আধিপত্য বিস্তার করেছে। এই সময়ের মধ্যেই সোভিয়েত ইউনিয়ন সহ পূর্ব ইউরোপের সমাজতন্ত্রের বিপর্যয় ঘটেছে। প্রতিকূল বিশ্বে চীন সমাজতন্ত্রকে রক্ষা ও উন্নত করার সংগ্রামে রয়েছে। কিউবা, ভিয়েতনাম, কোরিয়াও একই পথে লড়াই চালাচ্ছে। লাতিন আমেরিকায় নয়া উদারবাদের বিরুদ্ধে গণমুখী বিকল্পের আন্দোলন প্রবাহমান রয়েছে। তবুও এটাই বাস্তব আজকের পৃথিবীর শ্রেণি ভারসাম্য শ্রমিকশ্রেণি ও শ্রমজীবী মানুষের বিপক্ষে, সাম্রাজ্যবাদের অনুকূলে। বিজ্ঞান প্রযুক্তির অসম্ভবের সম্ভব সাধনে উৎপাদিকা শক্তি ও উৎপাদন ব্যবস্থায় নিয়ত গুনগত পরিবর্তন ঘটে চলেছে। শ্রমিক ও শ্রমজীবী মানুষদের শ্রেণি চরিত্র ও বোধের মধ্যে পরিবর্তন আসছে। তখন কি কমিউনিস্ট ইস্তেহারের প্রাসঙ্গিকতা কিংবা ইস্তেহার ঘোষিত বুর্জোয়াদের পতন ও প্রলেতারিয়েতের বিজয়,দুইই সমান অনিবার্য ? সম্ভব কি শ্রেণীহীন সমাজ গঠনের স্বপ্ন দেখা ?
যে তত্ত্বগত ভিত্তিতে কমিউনিস্ট ইস্তেহার রচিত হয়েছে তা হলো ঐতিহাসিক বস্তুবাদ। ইতিহাসের ধারায় আধুনিক বুর্জোয়া সমাজের বিকাশ এবং শ্রমিকশ্রেণির রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের মধ্য দিয়ে শ্রেণিহীন স্বাধীন সমাজে পৌঁছানোর রূপরেখা ইস্তেহারে তুলে ধরা হয়েছে। ইস্তেহার ঘোষণা করেছে মানব সমাজের বিকাশের ইতিহাস শ্রেণি সংগ্রামের ইতিহাস। তা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত। আজকে ক্ষমতার ভারসাম্য সাম্রাজ্যবাদের অনুকূলে থাকলেও এই পৃথিবীতে শ্রেণি সংগ্রামের অস্তিত্ব শত চেষ্টা করেও আড়াল করা যাচ্ছে না।
পুঁজিবাদের বিকাশের সূচনা পর্বেই কমিউনিস্ট ইস্তেহার চিহ্নিত করেছিল উৎপাদিকা শক্তির অবিরাম বৈপ্লবিক পরিবর্তন করেই পুঁজিবাদ টিকে থাকে। সংকটগ্রস্থ পুঁজিবাদী দুনিয়ায় প্রযুক্তির বিপ্লবকে হাতিয়ার করে উৎপাদিকা শক্তির উচ্চতম অগ্রগতি ঘটিয়েই পুঁজিবাদ টিকে থাকতে চেয়েছে। আজকের সংকটের চেহারাটা অন্যরকম। উৎপাদনের ক্ষেত্রকে সংকুচিত করার মধ্য দিয়েই নয়া উদারবাদের যাত্রা। আজ উৎপাদন ক্ষেত্রে পুঁজি বিনিয়োগ অপেক্ষা কেবলমাত্র আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে পুঁজির কেন্দ্রীভবন ঘটছে। ফলে সংকটের মাত্রা আরও গভীর। অব্যবহৃত মজুদ শ্রম তার আগের সীমাকে অতিক্রম করে চলেছে। পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তন ব্যতীত পুঁজিবাদ কখনোই টিকে থাকতে পারে না। আজকের উন্নত প্রযুক্তি নির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থায় উৎপাদিকা শক্তির উচ্চতম বিকাশ ঘটলেও তার সঙ্গে মানুষের শ্রমের সম্পর্ক সমানুপাতিক হচ্ছে না। বিপুল পরিমাণ সক্ষম শ্রমশক্তি অব্যবহৃত অবস্থায় থেকে যাচ্ছে। এই ব্যবধান আজকের পুঁজিবাদ মেটাবে কেমন করে ? উচ্চ বিকশিত উৎপাদিকা শক্তি এবং বিপুল পরিমাণে অব্যবহৃত শ্রমশক্তি আজকের পুঁজিবাদী সমাজের উৎপাদিকা শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের দ্বন্দ্বের তীব্রতা তীক্ষ্ণ করতে বাধ্য। উৎপাদিকা শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের অমীমাংসিত দ্বন্দ্বই সমাজ পরিবর্তন ঘটায়।
উৎপাদিকা শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্ক মিলেই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হল সমাজের ভিত্তি। অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় মানুষের বৈষয়িক উৎপাদন ও পুনরুৎপাদনের প্রক্রিয়ার উপরেই দাঁড়িয়ে থাকে সমাজের উপরিকাঠামো। রাষ্ট্র, রাজনীতি, সংস্কৃতি, মতাদর্শ ইত্যাদি হলো অর্থনৈতিক ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে থাকা উপরিকাঠামো। উৎপাদন ব্যবস্থা উৎপাদিকা শক্তির সীমাহীন পরিবর্তনে পরেও পুরনো উৎপাদন সম্পর্ক অর্থাৎ বন্টন ও ভোগ যদি একই জায়গায় থেকে থাকে তবে তা অনিবার্যভাবেই বর্তমান পুঁজিবাদী সমাজের রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে পরিবর্তন ঘটাবেই। শ্রমিকশ্রেণির রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের সম্ভবনা বাড়িয়ে তোলে। তবে তা সহজ নয়। সেদিনও সহজ ছিল না, আজও নেই।
মার্কস এঙ্গেলসের মতে নিজ শ্রেণির দুর্দশাগ্রস্থ অবস্থা বদলের জন্য প্রলেতারিয়েতকে উৎপাদন শক্তির নিয়ন্ত্রক হতে হবেই। একশ পঁচাত্তর বছর আগের মতোই আজও তা সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। ইস্তেহারে উল্লেখ করা হয়েছে,’প্রলেতারিয়েত তাদের দখলির নিজস্ব পূর্বতন পদ্ধতি উচ্ছেদ না করে এবং তার দ্বারা দখলির প্রত্যেকটি ভূতপূর্ব পদ্ধতির অবসান না ঘটিয়ে, উৎপাদন-শক্তির কর্তা হতে পারেনা। তাদের নিজস্ব বলতে এমন কিছু নেই যাকে আয়ত্তে এনে নিশ্চিত এবং দৃঢ়তর করতে হবে; ব্যক্তিগত মালিকানার সব রকমের পূর্বতন নিরাপত্তা ও নিশ্চিতি নির্মূল করে দেওয়াই তাদের ব্রত।’ আজকের উৎপাদন পদ্ধতিতে প্রলেতারিয়েতের পক্ষে উৎপাদন শক্তির কর্তা হওয়ার উপাদান কিংবা শক্তি রয়েছে কি ? পুঁজিবাদের বিকাশের যুগে কলকারখানার ব্যাপক প্রসারের জন্য প্রলেতারিয়েতের উপস্থিতি ছাড়া উৎপাদন ব্যবস্থা কার্যত অচল ছিল। শ্রমিকরা সেখানে তীব্র শোষোনের শিকার ছিল,ছিল মজুরি দাস। কিন্তু উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে শ্রমের সম্পর্কে জড়িয়ে ছিল। আজ ম্যানুফ্যাকচারিং ক্ষেত্রের দ্রুত ও তীব্র সংকোচন সংগঠিত শ্রমিকদের অস্তিত্ব কে বিপন্ন করেছে। পৃথিবীব্যাপী সংগঠিত শিল্পের শ্রমিকের সংখ্যা দিন-প্রতিদিন কমছে। যতটুকু সংখ্যায় এই সংগঠিত শিল্পের শ্রমিক রয়েছে, আজ তাদের ঘরে হারাবার মতো অনেক কিছুই রয়েছে। পাশাপাশি অসংগঠিত শ্রমিকের সংখ্যা বিপুল পরিমাণে বেড়ে চলেছে। উৎপাদন ব্যবস্থার সংগঠিত চেহারার পরিবর্তে ইনফরমাল সেক্টরের বৃদ্ধি ক্রমবর্ধমান। পুরনো পদ্ধতির উৎপাদন ব্যবস্থার পুরনো চেহারার শ্রমিকের পরিবর্তে সার্ভিস সেক্টরে হোয়াইট কালার জব করতে অভ্যস্ত কর্মীর সংখ্যা বিপুল পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। তাহলে কিভাবে সম্ভব প্রলেতারিয়েতের পক্ষে উৎপাদন শক্তির কর্তা হয়ে ওঠার ক্ষমতা অর্জন করা ?
মার্কস-এঙ্গেলস আধুনিক বুর্জোয়া সমাজের পরিবর্তনের সংগ্রামে শ্রমিকশ্রেণিকে বিপ্লবী শ্রেণি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। শ্রমিক শ্রেণি কেন বিপ্লবী, কেন সে এই বুর্জোয়া সমাজের পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম তার ব্যাখ্যা রয়েছে কমিউনিস্ট ইস্তেহার সহ মার্কস-এঙ্গেলসের বিভিন্ন রচনায়। ইস্তেহারে বলা হয়েছে, ‘…. বুর্জোয়া শ্রেণির মুখোমুখি যেসব শ্রেণি দাঁড়িয়ে আছে তার মধ্যে শুধু প্রলেতারিয়েতই প্রকৃত বিপ্লবী শ্রেণি। অপর শ্রেণিগুলি আধুনিক যন্ত্রশিল্পের সামনে ক্ষয় হতে হতে লোপ পায়; প্রলেতারিয়েত হলো সেই যন্ত্রশিল্পের বিশিষ্ট ও অপরিহার্য সৃষ্টি।’ অর্থাৎ সমাজ বদলের সংগ্রামে শুধুমাত্র বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে শ্রমিকশ্রেণির জয়লাভের সম্ভাবনা রয়েছে তাই নয়। কারণ আগের সমাজ বিপ্লব গুলির ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি, মুক্তির ঠিকানা খুঁজে পায়নি। সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রলেতারিয়েতের শক্তির অবশ্যই একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কিন্তু তার সঙ্গে বস্তুগত নির্ধারক উপাদানটি হলো প্রলেতারিয়েত এই ব্যবস্থার ভিতরে আছে। এই উৎপাদন পদ্ধতির যান্ত্রিক দক্ষতায় সে দক্ষ। পরিকাঠামো গড়ে তুলেও যন্ত্র চালানোর জন্য শ্রমিককেই প্রয়োজন। শ্রমিক ছাড়া এই উৎপাদন পদ্ধতি এক মুহূর্ত টিকে থাকতে পারে না। দক্ষ শ্রমিকের শ্রম ব্যতীত এক কণাও উদ্বৃত্তমূল্য সৃষ্টি হয় না। পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় আজকের সংগঠিত শিল্পের প্রযুক্তি চালানোয় দক্ষ শ্রমিক, পরিষেবা ক্ষেত্রে লেটেস্ট জেনারেশন প্রযুক্তি নির্ভর কর্মীরাও আসলে শ্রমিক। উৎপাদন পদ্ধতির প্রযুক্তিগত দক্ষতায় তারা সমৃদ্ধ। তাদের বাদ দিয়ে এই ব্যবস্থা চলবে না। ফলে আজও বিপ্লবী শ্রেণি হিসেবে শ্রমিক শ্রেণির গড়ে ওঠার বস্তুগত উপাদানটি বজায় রয়েছে। সেই কারণেই সংগঠিত শিল্পের বিপুল পরিমাণ ক্রমবর্ধমান ঠিকা শ্রমিকদের সংগঠিত করা স্হায়ী শ্রমিকদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিপ্লবীদের তো বটেই। এরই সঙ্গে অর্থনীতিতে বিপুল পরিমাণ অসংগঠিত ও ক্রমবর্ধমান ইনফরমাল সেক্টরের শ্রমজীবীদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। শুধুমাত্র বস্তুগত উপাদানের ভিত্তিতেই বিপ্লবী শ্রেণি হিসেবে শ্রমিকশ্রেণী রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করতে পারে না। চেতনা গড়ে তোলা ও সংগঠিত হবার গুণ, ভেদক্ষমতা ও শক্তির উপরেও তা নির্ভর করে। শ্রমিকশ্রেণির সংগঠন এবং রাজনৈতিক চেতনা আজকের পরিবর্তিত পৃথিবীতে বস্তুগতভাবে বিপ্লবী উপাদানে পরিপূর্ণ শ্রমিকশ্রেণি এবং শ্রমজীবীদের অন্যান্য অংশগুলিকে একসূত্রে গাঁথতে পারে। সংগঠন ও রাজনৈতিক সচেতনতার উপাদানটি সবসময় গুরুত্বপূর্ণ। বিপ্লবের ইতিহাসে সাফল্য ও ব্যর্থতার ঘটনাগুলিকে খুঁটিয়ে দেখলে বিভ্রান্তির অবকাশ থাকেনা।
মার্কস কখনও বলেননি সার্ভিস সেক্টরে যারা কাজ করেন সেই ‘ধরনের’ শ্রমজীবীরা শ্রমিক শ্রেণির অংশ নয়। বরং একথাই বলেছিলেন যে শ্রমিক শ্রেণির একটা অংশ বুর্জোয়া চরিত্র গ্রহণ করতে পারে, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার পক্ষে দাঁড়িয়ে যেতে পারে, সমাজের নিচু তলার একটা অংশ লুম্পেন হয়ে যেতে পারে, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার রক্ষকের ভূমিকায় চলে যেতে পারে। কিন্তু পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় ক্রমেই অন্যান্য শ্রেণির বেশি বেশি মানুষ শ্রমিকশ্রেণীর দলে যোগ দিতে থাকবে এবং এই প্রবণতায় বৃদ্ধি পাবে। আজ তো এটাই ঘটছে। পৃথিবীব্যাপী বড় বড় সার্ভিস সেক্টরের কর্পোরেশন গুলিতে শ্রমিক-কর্মচারীরা ট্রেড ইউনিয়নে সংগঠিত হতে চাইছেন। সংগঠিত ক্ষেত্রে শ্রমিকেরা পৃথিবীব্যাপী বড় বড় ধর্মঘটে সামিল হচ্ছেন। আমাদের দেশেও ব্যাংক বীমা অর্ডিন্যান্স কয়লা ইস্পাত টেলিকম ইত্যাদি রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে শ্রমিক-কর্মচারীরা ধারাবাহিক আন্দোলনের মধ্যে রয়েছেন। সমস্যা হলো সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যের যে মতাদর্শ তার সঙ্গে আজকের রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের উল্লেখযোগ্য অংশের শ্রমিক-কর্মচারীদের উপলব্ধির সংযোগ ঘটানো যাচ্ছে না। একটা মিসিং লিংক থেকে যাচ্ছে । এটা ঠিকই যে আজ সংগঠিত ক্ষেত্রে শ্রমিকদের অনেক কিছুই হারাবার আছে। তার ফলে তাদের অনেকের মধ্যেই চূড়ান্ত আত্মত্যাগের দোদুল্যমানতা রয়েছে। কিন্তু এটা অনস্বীকার্য যে এরা সকলেই উদ্বৃত্তমূল্যের স্রষ্টা। সার্ভিস সেক্টরে হোয়াইট কলার জবে নিযুক্ত কর্মীরাও সারপ্লাস প্রোডিউসার। অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক, ইনফরমাল সেক্টরের শ্রমজীবী থেকে শুরু করে খেতমজুর, দিনমজুরের মতো গ্রামীণ সর্বহারারা সকলেই উদ্বৃত্ত মূল্যের স্রষ্টা। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার শোষণ ও সংকটের আওতার মধ্যেই তাদের জীবন। এখানে ইস্তেহারের কয়েকটা বাক্য উল্লেখ করা হলো , ‘যে পরিমাণে বুর্জোয়া শ্রেণি অর্থাৎ পুঁজি বেড়ে চলে ঠিক সেই অনুপাতে বিকাশ পায় প্রলেতারিয়েত, আধুনিক শ্রমিক শ্রেণি; মেহনতিদের এ শ্রেণিটি বাঁচতে পারে যতক্ষণ কাজ জোটে, আর কাজ জোটে শুধু ততক্ষণ যতক্ষণ তাদের পরিশ্রমে পুঁজি বাড়তে থাকে। এই মেহনতিদের নিজেদের টুকরো টুকরো করে বেচতে হয়; বাণিজ্যের অন্য সামগ্রীর মতোই তারা পণ্যদ্রব্যের শামিল আর সেই হেতু নিয়তই প্রতিযোগিতার সবকিছু ঝড়-ঝাপটা, বাজারের সবরকম ওঠানামার অধীন তারা।’ এই নির্মম কথাগুলি আজও সারা পৃথিবীতে সব ধরনের শ্রমজীবী মানুষের জন্য প্রযোজ্য। ক্ষুদ্রতম কাজের ক্ষেত্র, ছোট বড় মাঝারি কারখানা, কর্পোরেট ফার্মিং, অতিকায় দেশি বিদেশি কর্পোরেশন, সব ক্ষেত্রেই মালিক শ্রমিকের সম্পর্কে এই নির্মেদ কথাগুলি নির্মম সত্য। এখানেই ইস্তেহারের প্রাসঙ্গিকতা। রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র, বেসরকারি ক্ষেত্রে, পরিষেবা ক্ষেত্র, অসংগঠিত ক্ষেত্র সহ সমস্ত ক্ষেত্রে আজ ক্রমবর্ধমান ছাঁটাই এই লাইনগুলির মর্মবস্তু কে তুলে ধরছে। কারণ নয়া উদারবাদের বর্তমান পর্বে ম্যানুফ্যাকচারিং ক্ষেত্রের পরিবর্তে আর্থিক লেনদেনকেই মুনাফা সংগ্রহের মাধ্যম করা হয়েছে।
বুর্জোয়া অর্থনীতির মৌলিক এবং সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো মুনাফার জন্য শ্রমিক কর্মচারীদের উদ্বৃত্ত শ্রম চুরি করা অপরিহার্য। উল্টো ভাবে বলা যায় শ্রমজীবী মানুষের উদ্বৃত্ত শ্রম, যার মূল্য সে পায় না তাই দিয়েই উদ্বৃত্ত মূল্য সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ এই উৎপাদন ব্যবস্থা টিকেই থাকে শ্রমজীবী মানুষের উদ্বৃত্ত আত্মসাতের উপর ভর করে। এখন প্রশ্ন হল বর্তমান সময়ে শ্রম দেওয়ার মতো জায়গায় কমে যাচ্ছে। ম্যানুফ্যাকচারিং এরিয়া দিন-প্রতিদিন সংকুচিত হচ্ছে। শ্রমিক শ্রেণির অস্তিত্বই বিপন্ন। অবশ্যই এটা বিপ্লবী প্রচেষ্টার সামনে একটা অন্যতম চ্যালেঞ্জ। আবার ইনফরমাল সেক্টর, অসংগঠিত ক্ষেত্র কিংবা সংগঠিত ক্ষেত্রে ঠিকা শ্রমিক তারাও ভয়ঙ্কর শোষিত। এই শোষণের উপায়টিও কিন্তু উদ্বৃত্ত শ্রম চুরি। যে ধরনের শ্রমিকই হোক না কেন তার উদ্বৃত্তশ্রমেই উদ্বৃত্ত মূল্য সৃষ্টি ও সঞ্চিত হয়, পুঁজির স্ফিতি ঘটে। যেহেতু উৎপাদনের ক্ষেত্র ক্রমবর্ধমান ভাবে সংকুচিত সেহেতু শ্রমিকের উদ্বৃত্ত শ্রমে উদ্বৃত্ত মূল্য সৃষ্টির সম্ভাবনাও হ্রাস পায়। আজকের পুঁজিবাদের দুর্বলতার অন্যতম একটি জায়গা এইটা। এরই সঙ্গে যেহেতু মানুষ কাজের বাজার থেকে সরে যাচ্ছে, ফলে ক্রয় ক্ষমতা সম্পন্ন মানুষের বাজারে উপস্থিতির হার নিম্নগামী হতে বাধ্য। বাজারের সংকোচন এবং সর্বগ্রাসী মন্দার এটাও একটা মৌলিক কারণ।
ইস্তেহারে পুঁজির কেন্দ্রীভবন, ক্রমবর্ধমান শোষণ ও বৈষম্যের কথা স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। আজকের অভিজ্ঞতাও প্রমাণ করছে কি বিপুল পরিমাণে পুঁজির কেন্দ্রীভবন ঘটেছে নয়া উদারবাদী পর্বে। বিশেষত কোভিড পর্বে উৎপাদন কার্যত স্তব্ধ থাকা সত্ত্বেও বিপুল পরিমাণ মুনাফা ও পুঁজির কেন্দ্রীভবন ঘটেছে মুষ্টিমেয় কিছু অতিকায় কর্পোরেশনের হাতে। ভারতের ক্ষেত্রে আম্বানি আদানীর কথা উল্লেখ করা যায়। শোষণ ও বঞ্চনার মাত্রা অতীতের সমস্ত সীমাকে অতিক্রম করেছে। অর্থনীতির পণ্ডিতরা বলছেন আজকের নয়া উদারবাদী পৃথিবীতে ফিন্যান্স নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজির আদিম সঞ্চয়ন প্রক্রিয়ার চরিত্র সর্বব্যাপী লুণ্ঠন ও জোরজবস্তি মূলক। পৃথিবীর দেশে দেশে অতিকায় কর্পোরেশন গুলি রাষ্ট্রকে ব্যবহার করে প্রাকৃতিক সম্পদ ও জাতীয় সম্পদ কে বেপরোয়া গতিতে লুট করে চলেছে। কমিউনিস্ট ইস্তেহার রচনাকালে কিংবা মার্কস-এঙ্গেলসের জীবদ্দশায় পুঁজিবাদের সাম্রাজ্যবাদে পৌঁছানোর অভিজ্ঞতা ছিল না। বিশ শতকের শুরুতে লেনিন সহ বেশ কয়েকজন মার্কসবাদী পুঁজিবাদের সাম্রাজ্যবাদে পৌঁছানোর দিকটি চিহ্নিত করেছিলেন। ‘সাম্রাজ্যবাদ পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায়’ রচনায় লেনিন যেভাবে সাম্রাজ্যবাদের চরিত্র চিহ্নিত করেছিলেন আজ তার মধ্যেও পরিবর্তন এসেছে। আজকের দিনে কমিউনিস্ট ইস্তেহার চর্চায় বা তার মর্মবস্তুর প্রয়োগে এই পরিবর্তনকে খেয়াল রাখতে হয় সমস্ত মার্কসবাদীদেরই। জীবদ্দশায় সাম্রাজ্যবাদের কোনো ইঙ্গিত না থাকলেও পুঁজির আগ্রাসী বিস্তার ও লুণ্ঠনের প্রবণতাকে কমিউনিস্ট ইস্তেহারে চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন মার্কস-এঙ্গেলস। ভাবলে অবাক হতে হয় আজকের সাম্রাজ্যবাদের এই অমানবিকতা একশ পঁচাত্তর বছর আগের পৃথিবীতে মার্কস এঙ্গেলস অনুধাবন করতে পেরেছিলেন, খানিকটা হলেও দিক নির্দেশ করতে সক্ষম হয়েছিল।
বিপুল পরিমাণ উদ্বৃত্তের কেন্দ্রীভবন ও মুনাফা এবং পুঁজির কেন্দ্রীভবনে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। প্রযুক্তির উন্নয়ন উৎপাদিকা শক্তির বিকাশকে উচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে। অথচ সেই প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রক পুঁজি হওয়ার কারণে তা শ্রমজীবী মানুষের উৎপাদিকা শক্তির সার্বিক বিকাশে ব্যবহারের পরিবর্তে শোষণের কাজেই ব্যবহৃত হচ্ছে। বুর্জোয়া শ্রেণি সব সময়ই প্রযুক্তির ব্যবহার মুনাফা সংগ্রহে কাজে লাগায়। কিন্তু বর্তমান সময়ে উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ আর উৎপাদন সম্পর্কের ব্যবধান ক্রমবর্ধমান হারে বেড়েই চলেছে। সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের দিন-প্রতিদিনের জীবন ধারণে তার ভয়ংকর নেতিবাচক প্রভাব দেখা যাচ্ছে। এই ব্যবধানই ইস্তেহার বর্ণিত সমাজ পরিবর্তনের সম্ভাবনাকে বাঁচিয়ে রাখছে। তবে কি প্রযুক্তির অগ্রগতি থামিয়ে দিতে হবে ? কোনো মার্কসবাদী কোনো বিপ্লবী তা কখনোই বলবে না। কিন্তু সেই প্রযুক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করবে কে ? মুনাফা-লোভীরা না শ্রমজীবী মানুষ, বিপ্লবীদের কাছে এটাই বিবেচ্য বিষয়। প্রযুক্তির অগ্রগতি বিপুল পরিমাণ মানুষকে কর্মহীন করছে এবং করবে। ২০০৮ সালে শুরু হওয়া নয়া উদারবাদের সংকট মেটার কোনো লক্ষ্যণ দেখা যাচ্ছে না। এমনিতেই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সংকট হলো আসলে ব্যবস্থার অভ্যন্তরের সংকট, সিস্টেমিক ক্রাইসিস। উৎপাদনের ক্ষেত্র সংকুচিত হয়ে আর্থিক লেনদেন এখন প্রধান হয়ে উঠেছে। ফলে এই সিস্টেমিক ক্রাইসিস অতিক্রম করার কোনো পথ আজকের নয়া উদারবাদে নেই বলেই অর্থনীতির পণ্ডিতরা মনে করছেন। কোভিদ উত্তর পৃথিবীতে বিশ্ব অর্থনীতি বর্তমান বছরেই মন্দার কবলে পড়তে চলেছে। ইতিমধ্যে বড় বড় কর্পোরেশন গুলি থেকে বিপুল পরিমাণ ছাঁটাই শুরু হয়েছে। অর্থনীতির পন্ডিতের আশঙ্কা করছেন এই ছাঁটাই বন্ধ হওয়ার লক্ষণ অদূর ভবিষ্যতে নেই।
ক্লাসিক্যাল পুঁজিবাদে সংকট বলতে বোঝায় অতি উৎপাদনের সংকট। তিন দশকের নয়া উদারবাদী পৃথিবী উৎপাদনের ক্ষেত্রকে কমিয়ে দিয়ে বাজার থেকে বিপুল পরিমাণ মানুষকে ছিটকে দিয়েছে। উৎপাদনের পদ্ধতি যাই হোক না কেন পুঁজিবাদী অর্থনীতি টিকে থাকতে পারে না যদি বাজার শক্তিশালী না হয়। বর্তমান সময়ের এটাই বোধহয় সবচাইতে বড় স্ববিরোধিতা, যে বাজার সর্বস্বতার নাম করে নয়া উদারবাদ পুঁজিবাদী অর্থনীতিকে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ মুক্ত করতে চেয়েছিল, তিন দশকের মধ্যে সেই বাজারকেই ভঙ্গুর ও কার্যত ধ্বংস করে দিয়েছে। বুর্জোয়া অর্থনীতির পণ্ডিতেরা বলছেন এই সংকট থেকে পরিত্রাণের জন্য সর্বগ্রাসী বাজার সর্বস্বতার পরিবর্তে রাষ্ট্রের ভূমিকার কথা ভাবতে হবে। মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধিতে রাষ্ট্র সরকারকে ভূমিকা নিতে হবে। কিন্তু ফিন্যান্স নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক লগ্নিপুজি এই রাস্তায় যেতে নারাজ। ইস্তেহারে মার্কস-এঙ্গেলস উল্লেখ করেছিলেন পুঁজিবাদ তার সংকট থেকে বেরিয়ে আসার জন্য যা করা দরকার তা না করে সংকটকেই শক্তিশালী করে তোলে। আজকের পৃথিবীতে এর থেকে বড় উদাহরণ বোধহয় আর কিছু হতে পারে না। ছাঁটাই, কর্মহীনতা বিপুল পরিমাণে উদ্বৃত্ত শ্রমের পাহাড় গড়ে তুলবে। উদ্বৃত্তমূল্য সৃষ্টি করতে না পারলে শ্রমের কি মূল্য ? শ্রমশক্তির এই অবনমন কি ভবিতব্য ? মানুষ কি মেনে নেবেন এই বিপুল পরিমাণ উদ্বৃত্ত শ্রমের পাহাড় ? যে প্রযুক্তি উৎপাদিকা শক্তি বিকাশে সাহায্য করে সেই প্রযুক্তি যখন শ্রমশক্তিকে পঙ্গু করে রাখে, তখন আবার কি পুঁজিবাদের সূচনা লগ্নের মতো মেশিন ভাঙ্গার আন্দোলন দেখবে একুশ শতকের পৃথিবী ? শাসকশ্রেণি তাই চায়। শ্রমজীবীদের ক্ষোভ বিপথে পরিচালিত করতে নৈরাজ্যের পথে কখনও শ্রমিকশ্রেণি ও শ্রমজীবীদের জীবন যন্ত্রণার অবসান ঘটে না বরং তা সমাজ বদলের বিপ্লবী প্রচেষ্টা কে বিপথগামী করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ উত্তর পৃথিবীতে রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের দিনে পৃথিবীর উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলিতেও গণতন্ত্র, শ্রমজীবী মানুষের অধিকার ও পৃথিবীকে আপন করে নেওয়ার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য প্রসার ঘটেছিল। আজ আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজির স্বার্থে জোরজবরদস্তি মুলক আদিম সঞ্চয়নের মাধ্যমে পুঁজির সীমাহীন কেন্দ্রীভবন শোষণ ও বঞ্চনাকে আরও বিভৎস ও সীমাহীন করে চলেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে পৃথিবীব্যাপী বুর্জোয়া গণতন্ত্র সংকটে পড়েছে। পুঁজিবাদী অর্থনীতির আজকের এই সিস্টেমিক ক্রাইসিস অর্থনৈতিকভাবে সমাধান করতে না পেরে আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজি রাজনৈতিকভাবে এই সংকট ও সংকটগ্রস্থ মানুষদের মোকাবিলা করতে চাইছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বুর্জোয়া গণতন্ত্র প্রতিস্থাপিত হচ্ছে ও হতে চলেছে স্বৈরাচারী, আধিপত্যবাদী কিংবা নয়া ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র গড়ে তোলার প্রবণতা দিয়ে। ‘জনসমষ্টিকে এরা পুঞ্জীভূত করেছে, উৎপাদনের উপকরণ গুলি করেছে কেন্দ্রীভূত, সম্পত্তিকে জড়ো করেছে অল্প লোকের হাতে। এরই অবশ্যম্ভাবী ফল হলো রাজনৈতিক কেন্দ্রীভবন।’ বছর আগে ইস্তেহারে উল্লেখিত এই কথাগুলোকে মনে হবে আমাদের বর্তমান সময়কে দেখেই লেখা।
লুট, লোভ-লালসা, পরিবেশ ধ্বংসের শিকার হবে মানুষের ভবিষ্যৎ ? মানুষ কি মেনে নেবেন পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী বীভৎসার অমানবিককতা কে ? উৎপাদন ব্যবস্থা, সমাজ ও রাজনীতিতে ভারসাম্য নিজের পক্ষে রাখার জন্য পুঁজি সবসময়ই শ্রমজীবী মানুষদের মগজ দখলের চেষ্টা করে। মগজ দখলের এই প্রক্রিয়া জনসমাজে চলমান থাকে। মার্কসের মতে জনসমাজ হল উৎপাদন ব্যবস্থায় শ্রেণি সম্পর্ক গুলির সামাজিক মনস্তাত্ত্বিক প্রতিফলন। রাষ্ট্র জনসমাজ থেকে পুষ্টি সংগ্রহ করে জনসমাজের উপর আধিপত্য বিস্তার করে। আজকের আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজির স্বার্থে অবদমিত শোষিত মানুষ যাদের শ্রম থেকে উদ্বৃত্তের সৃষ্টি যাদের শ্রম থেকে যাবতীয় বৈভবের নির্মাণ, তাদের চেতনাকেই নিয়ন্ত্রণ, বলা ভালো শোষিত অবদমিত মানুষের সম্মতি আদায় করে শোষণ ব্যবস্থা কে অটুট রাখছে। শ্রমজীবী মানুষের চেতনা থেকে সরিয়ে দিতে সক্ষম হচ্ছে যে, পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সমস্ত শ্রমজীবী মানুষ আসলে শেষ পর্যন্ত মজুরি দাস। ইস্তেহারে উল্লেখ রয়েছে। ‘মজুরেরা কেবলমাত্র বুর্জোয়া শ্রেণির ও বুর্জোয়া রাষ্ট্রের দাস নয়; দিনে দিনে ক্ষণে ক্ষণে তাদের করা হচ্ছে যন্ত্রের দাস, পরিদর্শকের দাস, সর্বোপরি খাস বুর্জোয়া মালিকটির দাস। যথেচ্ছাচার যত খোলাখুলিভাবে মুনাফা লাভকেই নিজের লক্ষ্য ও আদর্শ হিসেবে ঘোষণা করে ততই তা হয়ে ওঠে আরও হীন, আরও ঘৃণ্য, আরও তিক্ত।’
মানুষ ‘মানুষ’ বলেই হীন, ঘৃণ্য, তিক্ত পরিবেশ থেকে মুক্তির জন্য লড়াই করবেই ; মানুষ বলেই সে বাঁধন ছিঁড়বে। মানুষই সমাজ পরিবর্তনের জীবন্ত উপাদান। ইস্তেহারে আরও উল্লেখ করা হয়েছে বুর্জোয়া শ্রেণি তাদের বিরুদ্ধে যারা অস্ত্র ধরবে সেই আধুনিক শ্রমিকশ্রেণী প্রলেতারিয়েতদের সৃষ্টি করেছে। এরাই বুর্জোয়াদের কবর খোঁড়ার কাজ করে। ইস্তেহারে বলা হয়েছে শ্রেণি বিভক্ত বুর্জোয়া সমাজের অবসানে এমন একটি সমাজ তৈরি হবে যেখানে প্রত্যেক মানুষের স্বাধীন বিকাশ হবে সকলের স্বাধীন বিকাশের শর্ত। শ্রমিকশ্রেণির বিপ্লবী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শ্রেণিহীন একটা পৃথিবী সম্ভব। ইস্তেহার দেখিয়েছে সমাজ বিকাশের একটা নির্দিষ্ট পর্বে উদ্বৃত্ত সম্পত্তির সৃষ্টি এবং তার ভোগ-দখলকে কেন্দ্র করে সমাজে শ্রেণিবিভাগের সৃষ্টি, শ্রেণি শোষণের সৃষ্টি, শ্রেণী আধিপত্যের হাতিয়ার রাষ্ট্রের সৃষ্টি। শ্রেণিহীন সমাজের বাস্তব চিত্র এখনও দেখা যায়নি, অথবা দিগন্তে তার ইঙ্গিতটাও আজকে খুব একটা স্পষ্ট নয়। কিন্তু মানুষের সমাজের শুরুতে সমাজটা যে শ্রেণিহীন, রাষ্ট্রহীন সমাজ ছিল তা ঐতিহাসিক ও বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত।
পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী বীভৎস অমানবিকতার বাঁধন ছিড়ে মুক্ত স্বাধীন সমাজের জন্য মানুষের স্বপ্ন এখনও অমলিন। সমাজ অর্থনীতিতে যতক্ষণ শ্রম ও পুঁজির দ্বন্দ্ব অমীমাংসিত ততক্ষণ পর্যন্ত শ্রমিকশ্রেণির মুক্তির জন্য সংগ্রাম অটুট থাকবে। আধুনিক মানুষ আধুনিক ও উন্নত শ্রেণিহীন সমাজে পৌঁছানোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে। আজ একশ পঁচাত্তর বছরে পৌঁছে এই হলো কমিউনিস্ট ইস্তেহারের মর্মবস্তু ও প্রাসঙ্গিকতা।