শ্রেণীচিন্তা রুখতেই জাতপাতের প্রশ্ন
গৌতম রায়
গত দুটো নির্বাচনের মতো জাতপাতের প্রশ্নটা এবারের নির্বাচনে কেন উঠে এল সাম্প্রদায়িকতার পাশাপাশি, তা নিয়ে কি সত্যিই আমরা গভীর ভাবে চিন্তা কখনো করেছি? শ্রেণী সচেতনতার সম্যক বিকাশ না ঘটলে যে ধর্ম- জাতপাতের উস্কানির হাত থেকে কখনোই নিস্তার পাওয়ার উপায় নেই আমাদের, এটা কি ভারতের সবকটা রাজনৈতিক দল ঠিক মতো উপলব্ধি করতে পারে? ভারত এবং ভারতীয় সমাজ মনস্তত্ত্ব ঘিরে যাঁরা গবেষণা করেন, এই সহজ প্রশ্নটিকে তাঁরা খুব সহজেই এড়িয়ে যেতে ভালোবাসেন।ধর্মান্ধতার স্বরূপ নির্ধারণে, জাতপাতের আবর্তে দীর্ণ ভারতীয় সমাজের ক্ষতের কারন নির্ণয়ে তাঁরা বহু সন্দর্ভ নির্মাণ করলেও এই ব্যাধির মূলে যে শ্রেণী বৈষম্যের তীব্র ক্ষত আছে, প্রতিকার নির্মাণ কালে সে প্রসঙ্গটি বেশির ভাগ সমাজবিজ্ঞানীই এড়িয়ে যান। কিভাবে শ্রেণীর প্রশ্নটাকে জাতপাতের প্রশ্নে রূপান্তরিত করা হল, তার অনুসন্ধানে কতোখানি ব্রতী হয়েছেন সমাজবিজ্ঞানীদের সেই অংশ , যাঁরা এখন ধর্মান্ধতার বিভাজনের থেকেও জাতপাতের বিভাজনকে বড়ো করে দেখতে চাইছেন?
জাতপাতের বিদীর্ণতা ভারতীয় সমাজকে কিভাবে অধঃপাতে নিয়ে যাচ্ছে তা ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ হাজি মহম্মদ মহসীন থেকে শুরু করে রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, মীর মোশারফ হোসেন , নজরুল, রোকেয়া, অন্নদাশঙ্করেরা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গিয়েছেন।ধর্মান্ধতা কে অবলম্বন করে দেশভাগ হলেও জাতপাতের দীর্ণতায় দেশভাগের আগে ও পরে নিম্নবর্গের মানুষদের সামাজিক অধোগতি, তাঁদের উপর আর্থ- সামাজিক অত্যাচার কোথায় পৌঁছেছিল তা আমাদের কারো অজানা নয়।
‘লোকহিত’ প্রবন্ধে (১৩২১ বঙ্গাব্দ, ভাদ্র) রবীন্দ্রনাথ লিখছেন;” আমরা লোকহিতের জন্য যখন মাতি তখন অনেক স্থলে সেই মত্ততার মূলে একটি আত্মাভিমানের মদ থাকে।আমরা লোকসাধারণের চেয়ে সকল বিষয়ে বড়ো, এই কথাটাই রাজকীয় চালে সম্ভোগ করিবার উপায় উহাদের হিত করিবার আয়োজন।এমন স্থলে উহাদেরও অহিত করি, নিজেদেরও হিত করি না।”
‘পার্টি সোসাইটি ‘ছেড়ে বাঙালি সমাজ এখন ‘কাস্ট পলিটিক্সের দিকে এগোচ্ছে’ এই আক্ষেপ যখন সমাজবিজ্ঞানীরা করেন , তখন মনে হয়, আজ থেকে মাত্র পনের বছর আগে এঁদের সব লেখাগুলি যদি একবার ফিরে পড়তাম আমরা।এইসব সমাজবিজ্ঞানীরাই আজ থেকে মাত্র পনের বছর আগে, যখন বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় ছিল ,তখন কাগজ, কলম, নিউজপ্রিন্ট ভরিয়ে দিতেন বামপন্থীদের এই পার্টি সোসাইটির বিরুদ্ধে। পার্টি সোসাইটি সমাজের পক্ষে একটা অভিশাপ- এটাই ছিল এইসমস্ত সমাজবিজ্ঞানীদের মূল অনুধ্যান।পার্টি সোসাইটি বলতে যেটা ওঁরা বলতে চাইতেন, তার সত্যতা না থাকলেও তরাকের খাতিরে সেই কথাটা যদি আমরা মেনেও নিই, তাহলে বলতে হয়, সেই ধরণের সামাজিক বিন্যাসে কিছু সীমাবদ্ধতা অবশ্য ই ছিল।কারন ,সেই সামাজিক বিন্যাসটি রচিত হয়েছিল চলতি বুর্জোয়া পরিকাঠামোর ভিতরে।বিশেষ করে নয়া উদার অর্থনীতির প্রভাব আমাদের কারো পক্ষেই একদম এড়িয়ে যাওয়া পরিপূর্ণ ভাবে সম্ভবপর হয় নি।
রবীন্দ্রনাথ যে ‘আত্মাভিমানের মদে’র কথা ফলেছিলেন, সেটা পানের প্রতিই কি একাংশের বুদ্ধিবৃত্তিকারীদের প্রবলতর আকাঙ্খা?শ্রেণী ভিত্তি টিকে যখন নানা পর্যায়ে টলিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তখন তা নিয়ে এইসব সমাজবিজ্ঞানীদের কি আমরা একটিবারের জন্যেও সোচ্চার হতে দেখি? শ্রেণী ভিত্তিকে বিফলে পরিচলিত করতে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার পরই মরিচঝাঁপি নিয়ে যে মিথ্যাচার, যেটিকে সংগঠিত করতে আর এস এস এবং তাদের নেতা হরিপদ ভারতী একটা বড়ো ভূমিকা নিয়েছিলেন, সেই পর্যায় টিকে ঘিরে ইতিহাসবেত্তারা সত্যের সামনে কেন দাঁড়ান না? মরিচঝাঁপি কে কেন্দ্র করে শ্রেণীভিত্তিকে দুর্বল করতে সাম্প্রদায়িক এবং প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির যে সন্মিলিত উদ্যোগ, সারস্বত সমাজের প্রতিনিধি হিশেবে এইসব সমাজবিজ্ঞানীরা সে নিয়ে কি একটি বারের জন্যেও কোনো শব্দ উচ্চারণ করেছেন? আজ যে জাতপাতের দীর্ণতার কথা তুলছেন একাংশের বুদ্ধিজীবী, এই জাতপাতের বিষয়টি কি ভাবে ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক শক্তিকে সাহায্য করছে, তা নিয়ে কিন্তু কোনো কথাই এঁরা বলেন না।আর জাতপাতের ভিত্তির পাশাপাশি প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার আমদানি ঘটিয়ে ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িকতাকে কিভাবে শক্তিশালী করে তোলা হচ্ছে, তা নিয়েও কিন্তু বৃহত্তর প্রচার মাধ্যম এবং শেকড় না থাকা বুদ্ধিজীবীকূল কখনো সোচ্চার হয়েছেন?
‘লোকহিতে’র সূচনায় রবীন্দ্রনাথ বলেছেন;” লোকসাধারণ বলিয়া একটা পদার্থ আমাদের দেশে আছে এটা আমরা কিছুদিন হইতে আন্দাজ করিতেছি এবং ‘ এই লোকসাধারণের জন্য কিছু করা উচিত’ হঠাৎ এই ভাবনা আমাদের মাথায় চাপিয়াছে।যাদৃশী ভাবনা যস্য সিদ্ধির্ভবতি তাদৃশী।এই কারণে ভাবনার জন্য ই ভাবনা হয়।”
এই ভোটের মুখে একাংশের বুদ্ধিজীবীদের অতি সক্রিয়তা , যা কার্যত রাজ্যের শাসক শক্তির প্রত্যাবর্তনের প্রত্যাশার উদ্দেশেই একপ্রকার আত্মনিবেদন, সেই প্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথ বর্ণিত ‘ লোকসাধারণের জন্যে কিছু করা উচিতে’ র উদগ্র তাড়ণার কথা।আজ যাঁরা বহুজনসমাজকে ঘিরে এতো চিন্তিত, জাতপাতের দীর্ণতার কথা বলতে গিয়ে ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িকতাকে মেলে ধরতে, সেই দৃষ্টিভঙ্গির রাজনীতিকদের শাসন ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করতে প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িক শক্তির ভূমিকা এবং অবদান সম্পর্কে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মেট্রোপলিটন মনকে বিপথে চালিত করতে চান, তাঁদের উদ্দেশ্য কি প্রকারের , তা সহজেই বুঝতে পারা যায়।কেন সাম্প্রদায়িকতাকে এই লাগামহীন পর্যায়ে পৌঁছে দিতে নিশ্চুপ দরূশকের ভৃমিকা পালন করলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তা নিয়ে বহুল প্রচলিত কোনো খবরের কাগজে তাঁদের পছন্দমতো একজন ও সমাজবিজ্ঞানীর লেখা কি আমরা পড়েছি? না।মুসলমান সমাজের উপর কি ধরণের ছলনার রাজনীতি করে আর এস এস এবং তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপিকে এই রাজ্যে ক্ষমতায় আসার মৌতাতপ্রাপ্ত দশায় পৌঁছে দেওয়া হয়েছে, সে সম্পর্কে কোনো বিশ্লেষণ কি আমরা দেখেছি বিধানসভা ভোটের চলতি(২০২১) আলাপ আলোচনার সময়ে এইসব বিদেশে বসবাস করা ভারততত্ত্ববিদদের কলমের ভিতর দিয়ে? অমর্ত্য সেন ও বিদেশেই বসবাস করেন। কিন্তু ভারত সম্পর্কে , বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ সম্পর্কে তাঁর বিশ্লেষণ এবং মূল্যায়ণের ক্ষেত্রে তো কই আমরা এইরকম ভাবের ঘরে চুরি দেখি না। মাটির সঙ্গে নিবিড় সংযোগের ভিত্তিতে অধ্যাপক সেন যেমন তাঁর সঠিক পর্যবেক্ষণ গুলিকে ফুটিয়ে তোলেন , তেমনিই তাঁর প্রকৃত নিরপেক্ষ বুদ্ধিদীপ্ত বিভাষা কখনো কোনো রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তির প্রতি তাঁবেদারি করে না। সেই কারনে তাঁর বিচার বিশ্লেষণের থেকে প্রণব বর্ধন, শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়, রণবীর সমাদ্দার দের মূল্যায়ণের ভিতরে এতোটা ফারাক।
ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িকতার প্রসারে প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকদের ভূমিকাকে আড়াল করতেই জাতপাতের রাজনীতি, যাকে পার্টি সোসাইটি থেকে বদলে যাওয়া একটা সময়ক্ষেপন বলতে চাইছেন একাংশৃর বুদ্ধিজীবীরা, তাঁরা স্বভাবসুলভ ভাবেই জাতপাতের সমীকরণটা বোঝাতে মতুয়াদের কথা বলছেন।ওলাইকান্দির কথা ফলছেন।হরিচাঁদ ঠাকুর থেকে পি এন ঠাকুর সকলের ই কথা বলছেন।কিন্তু বলছেন না ১৯২৩ সালে এই ওলাইকান্দি, স্থানীয় উচ্চারণে ওড়াকান্দি তে ভয়ঙ্কর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কথা। পদ্মবিলে মুসলমান জেলেদের মাছধরা কে কেন্দ্র করে মতুয়া দের ভিতর থেকে পিছিয়ে পড়া মানুষদের কি বর্ণহিন্দু সমাজ ক্ষেপিয়ে তুলেছিল? কেন গরীব তপশিলি জাতির মানুষেরা, বিভিন্ন পর্যায়ংর দলিতেরা সঙ্গবদ্ধ হয়ে স্থানীয় মুসলমান মৎসজীবীদের উপর আক্রমণ শানিয়েছিল, তা নিয়ে কিন্তু এই বহুজন রাজনীতি ঘিরে জাতপাতের রাজনীতি কেই চলতি নির্বাচনে প্রধান বিষয় হিশেবে দেখা বুদ্ধিজীবী রা একটি শব্দ ও উচ্চারণ করেন না। গত শতকের বিশের দশকের সূচনা পর্বে অবিভক্ত ফরিদপুর জেলার এই দাঙ্গা পরবর্তীতে তিনের দশকের শেষ প্রান্তে গোটা পূর্ববঙ্গ জুড়েই হিন্দু – মুসলমান সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে একটি হৃদয়বিদারক ঘটনা হয়ে উঠেছিল- তা নিয়ে কিন্তু বেশিরভাগ ইতিহাসবিদ ই পালন করে চলেন আশ্চর্যজনক নীরবতা।দেশভাগের পরেও সেই দাঙ্গার রেশ যে দুটি সম্প্রদায়ের বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে অনেক ধরণের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে, তা নিয়ে কিন্তু বেশিরভাগ সমাজবিজ্ঞানীই নীরব।
এখানেও সেই শ্রেণীর প্রশ্নটাই উঠে আসে।ওড়াকান্দিতে পদ্মবিলে মাছ ধরা কে কেন্দ্র করে ‘২৩ সালের বারুণী মেলার সময়ে যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, তার সবথেকে বড়ো বৈশিষ্ট্য ছিল , যারা দাঙ্গা করেছে আর যাদের উপরে দাঙ্গা করা হয়েছে, উভয়ের ই শ্রেণীগত অবস্থান এক।শ্রেণী সাম্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বর্ণবাদী সমাজের দলিত মানুষদের মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে দেওয়ার এটি ষড়যন্ত্র ছিল কি না- তা নিয়ে কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো গবেষণা হয় নি।দেশভাগের পর মুসলিম জাতীয়তার দৃষ্টিতে একাংশের মানুষ এই ঘটনাকে দেখে ,এর পিছনে হিন্দু দের মুসলিম বিদ্বেষ খুঁজতে চেষ্টা করলেও ,গরিব দলিত হিন্দুদের ধনী,বর্ণহিন্দু সমাজ মুসলমানদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে কি না বর্ণস্বার্থ রক্ষার্থে- এই প্রশ্নের ধারপাশ দিয়ে কিন্তু হাঁটা হয় নি।
দীনেশ চন্দ্র রায়ের ‘সোনাপদ্মা’ উপন্যাসে পূর্ববঙ্গের একটা বিস্তীর্ণ অঞ্চলে চারের দশকে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তির সামাজিক বিষ ছড়ানোর বস্তুনিষ্ঠ বিবরণ আছে। সেই উপন্যাসগত উপাদানের অন্যতম ভিত্তি ভূমি হিশেবে বিশের দশকের সূচনায় ওড়াকান্দির ঘটনা কোনো অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছিল কি না, সেই প্রশ্ন যদি ইতিহাসবিদেরা না তোলেন, তবে কারা তুলবেন? জাতপাতের দীর্ণতার পরিবেশ রচনার ক্ষেত্রে কায়েমী শক্তি চিরদিন ই সক্রিয়।এভাবেই তারা শ্রেণী প্রশ্নটাকে গুলিয়ে দিতে চায়।ঠিক যেভাবে শ্রেণীচিন্তাটাকে গুলিয়ে দিতেই একটা সময়ে একাংশের সংবাদমাধ্যম ধারাবাহিক ভাবে প্রচার করতো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের টালির চালের বাড়ি, মুড়ি খাওয়া, হরিণগাটার দুধের ডিপোতে দুধ বিক্রি করে পড়াশুনা করার মতো গল্পগুলি।এই সংবাদমাধ্যম গুলি কিন্তু এখন একটি বারের জন্যেও মুখ্যমন্ত্রী মমতার নিত্য হেলিকপ্টারে করে এপাড়া থেকে ওপাড়া যাওয়া আসার ঘটনাগুলির কথা বলেই না।