দেবাঞ্জন দে
কোনো এক অবিন্যস্ত দুপুরে ধর্মতলার গ্রান্ড হোটেলের নীচে জড়ো হওয়া একদল ছেলেমেয়ে পছন্দ করলো টিশার্ট’টা। কালো টিশার্টের ওপর গ্রাফিক ডিজাইনে ফুটিয়ে তোলা একটা মুখ! মাথার ওপর টুপিটার মাঝে জ্বলন্ত একটা তারা, দু’ঠোঁটের মধ্যিখানে সদ্য জ্বালানো একটা হাভানা চুরুট, গালভর্তি দাড়ি আর নির্ভীক, অতলান্ত, অন্তর্ভেদী দু’টো চোখ! পছন্দ করে দরদামের ফাঁকে পাশ থেকে আসা “চেনো একে?”, প্রশ্নের উত্তরে খানিক বিরক্ত এক ছোকরা বলল, “বাইকার, রাইটার, রোম্যান্টিক, বোহেমিয়ান, গ্লোব ট্রডার!” বলিভিয়ার লাপ্লাতার জঙ্গলে সিআইএ’র একের পর বুলেট যে মানুষটাকে নতজানু করতে পারেনি, সেই মানুষটাই আজকের বিশ্বায়িত দুনিয়ায় রোম্যান্টিকতার বিজ্ঞাপন! এখানেই আজকের সাম্রাজ্যবাদের অনন্যতা- তাঁর সবচেয়ে বিপজ্জনক শত্রুকেও সে ব্রান্ডিং করেছে নিজের বাজার দখল, পরিচালনা, নিয়ন্ত্রণ করবার লক্ষ্যে। পরিকল্পিতভাবেই এই ব্রান্ড জেনারেট করার সময় মুছে দেওয়া হয়েছে ‘বিপ্লবী’ শব্দটা! মাঝেমধ্যে তবু মাথার মধ্যে এই শব্দটা উঁকিঝুঁকি দিলেও, তার ঠিক আগে জুড়ে দেওয়া হয়েছে “বিদেশী” শব্দটা! যেন বিপ্লবীদের দেশ, কাল, সময়ের সীমানায় বন্দি রাখতে পারলেই তাঁদের ব্যপ্তি রুখে দেওয়া যাবে!
সময়ের অনিবার্যতায় গড়ে ওঠা অগ্নিশুদ্ধ এক বিপ্লবী! হ্যাঁ, চে গেভারা’কে দুনিয়ার তাবড় বড়লোকের দল ভয় পেয়ে এসেছে, ঠিক এই একটা কারণে। এই কারণেই আজকের সাম্রাজ্যবাদ চে’র নামের থেকে মুছে দিতে চেয়েছে “বিপ্লবী” ট্যাগ! আগুনের খোঁজে বন্ধুর বাইকে গোটা লাতিন আমেরিকা চষে বেড়ানো চে গেভারা শুধু প্রকৃতি দেখতে চায়নি, শুধু পাহাড়, নদী, সমুদ্রের গভীরতা মাপতে চায়নি, চেয়েছে সেই গভীরতার মধ্যের মানুষের ব্যপ্তিকে খুঁজে নিতে। খুঁজেছে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্কযুক্ত হওয়ার এক একটা স্তর। খুঁজেছে সেই প্রতিটি স্তরে কীভাবে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ নিজেকে জুড়ে নিয়েছে মুনাফার রাজত্ব কায়েম করে শোষণের বুলডোজারকে স্বাভাবিকতা দিতে। খুঁজেছে দারিদ্র্যের শেষ সীমা পৌঁছনো মানুষ কেন মনে করে নেয়, তাঁর ওপর বর্ষিত প্রতিটা চাবুক আসলে তাঁরই কর্মফল। খুঁজেছে কেন নিঃসহায় মানুষ উদয়াস্ত খেটে যখন তার জীবনকে উন্নত করতে পারে না, তখন সামান্য রিলিফও তার কাছে অসামান্য গুরুত্বের। খুঁজেছে কেন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মানুষও মুক্তির স্বপ্ন দেখে ভূখা পেটের ঘুমে।
ডাক্তারি পড়ুয়া চে’র এই খোঁজ লাতিন আমেরিকার রক্তপ্রবাহের মধ্যে জুড়ে নিয়েছিলো এক সদ্য তরুণ মনকে। জীবন, যুগ, যুগযন্ত্রণার এই অনুসন্ধান চে’কে সাহায্য করেছিলো বিপ্লবী হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে। একাত্ম করেছিলো মাটির সাথে। চিনতে শিখিয়েছিলো ভূমিস্তর। মার্তির লাতিন আমেরিকার বিপ্লবী প্রবাহের সলতে আগুনের খোঁজে গড়ে নিয়েছিলো বারুদ আস্তানার দেশলাই। স্পর্ধার চলাচলে পাহাড় ডিঙানো জেদ শিখিয়েছিলো একা এবং মোটরসাইকেলে বিপ্লব ঘটানো যায় না! চাই বিপ্লবের পরিস্থিতি, বিপ্লবী সংগঠন। সময়ের গায়ে লেগে থাকা বিপ্লবী উপাদান, আর সেই সময়ের মূল বাহক মানুষের মনে থাকা বিপ্লবী উপাদানকে একমুখী করাই একজন বিপ্লবীর কর্তব্য। মানবসভ্যতার প্রতিটা স্তরেই মানুষের মননে, চিন্তায় বিপ্লবী উপাদান থেকেছে- সেই উপাদানে ভর করেই মানুষ খুঁজে পেয়েছে হাতিয়ার, চাকা, আগুন, কৃষি, জ্ঞান বিজ্ঞান! সেই উপাদানকে সমাজবদলের লক্ষ্যে পরিণত করাই চে’র শিক্ষা।
অপেক্ষা আর উপেক্ষার বিনিময়েই সেই কাজ সম্পন্ন হয়েছিলো কিউবার বুকে। মনকাডা ব্যারাক আক্রমণের ছ’বছর পর গ্রানমা ভিড়েছিলো হাভানার বন্দরে। উপেক্ষিত ফিদেল আর অপেক্ষারত চে মিশেছিলো কিউবার মানবমুক্তির সংগ্রামে। সিয়েরা মায়েস্ত্রার পাহাড় পেরোতে পেরোতে রাইফেল আর বারুদের বন্ধুত্বে গড়ে উঠেছিলো আগামীর স্বপ্নের বুনিয়াদ। যে বুনিয়াদের ওপর দাঁড়িয়ে আমেরিকার নাকের ডগায় বসে থাকা সমাজতান্ত্রিক কিউবা চ্যালেঞ্জ ছুড়েছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে। বছরের পর বছর অর্থনৈতিক অবরোধের মধ্যে দাঁড়িয়েও থমকায়নি সমাজতান্ত্রিক নির্মাণ।
এই বুনিয়াদ রোম্যান্টিকতা দিয়ে তৈরী হয় না! মতাদর্শের বুনিয়াদি ভিত্তি গড়ে তুলতে লাগে বিপ্লবী অনুশীলন। লাগে মানুষের হৃৎস্পন্দনের সাথে আত্মিক যোগাযোগ। লাগে বয়ে চলা সময়টাকে অনুভব করতে পারার ধৈর্য। লাগে সাম্রাজ্যবাদের নিত্যনতুন শোষণ পদ্ধতির প্রতি সীমাহীন ঘৃণা, লাগে প্রতি মিনিটে রিয়েলিটি চেক! হ্যাঁ, সময়ের বাস্তবতায়, মানুষের যন্ত্রণার কোটর থেকে বেরিয়ে আসা ফুলকি হয়েই চে গেভারা জন্মেছে, বেঁচেছে, মরেছে, ফের বেঁচে থেকেছে।
আরেকটি অবিন্যস্ত দুপুরে, হাভানা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে এক সাংবাদিকের মুখোমুখি ফিদেল কাস্ত্রো! সাংবাদিক ফিদেলের কাছে জানতে চাইলেন চে’র সম্পর্কে। লম্বা স্মৃতিচারণা মিটিয়ে ফিদেল শেষ করলেন এই তিনটে শব্দ দিয়ে- “Marxist By Conviction”! সময়ের অনিবার্যতায় এক আদ্যোপান্ত মার্কসবাদী। যে সমাজকে পড়ে নিয়ে থেমে থাকেনি, সদা পরিবর্তনশীল সমাজটাকে অনুভব করেছে, আত্মস্থ করেছে আর জীবনের শেষ নিশ্বাসটুকু পর্যন্ত সেই সমাজের স্টিয়ারিং ঘোরাতে চেয়েছে শোষণমুক্তির দিকে, বিপ্লবের দিকে, সমাজতন্ত্রের দিকে।