সৌভিক ঘোষ
বিপ্লবই তো আসল উৎসব।
নিপীড়িত মানুষের উৎসবই হল সর্বহারা বিপ্লব। লেনিনের কথা। ছোটবেলাতেই শিখে নিতে হয় পার্টিকর্মীদের।
আমরা যারা বড় জোর গোটা কয়েক বই-টই পড়ে লেনিন’কে শিখি, তাদের জন্য লেনিনের এই কথাটি প্রায় আখর।
তবু চে গুয়েভারা। যিনি ‘নাকি’ দুনিয়াজুড়ে স্বতস্ফুর্ততার প্রতীক।
কেন?
কারণ চে’ই সেই মানুষ যিনি ফিদেল কাস্ত্রোর থেকে হাজারবার সাবধানবানী শুনেও জেলে বন্দী অবস্থায় কারাগারের রক্ষীকে বলেই চলেন তিনি আসলে স্তালিনের অনুগামী। একটা গোটা বই লিখে ফেলা যায় সেই নিয়ে।
কারণ চে’ই সেই মানুষ যিনি জনগণকে মনে করিয়ে দেন বিপ্লবী হতে চাও? বিপ্লবের প্রথম শর্ত শিক্ষিত হও।
এমন শিক্ষাকে যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কামারা সংশাপত্র ভাবেন তারা আজও শিশুসুলভ- ওটা আসলে বিপ্লবী শিক্ষার প্রসঙ্গে ইঙ্গিত। সমাজ বদলের লক্ষ্যে যা কিছু শিখে নেওয়া দরকার তার প্রতি একনিষ্ঠ থাকার ইশারা।
লেনিন বলেছিলেন গণসংগ্রামের আশু অর্থনৈতিক লক্ষ্যের দিকটি জনগণ নিজেরাই চিনে নেন, তার ভিত্তিতেই তারা প্রাথমিকভাবে একজোট হয়ে যান। কিন্তু ওখানেই আটকে থাকলে চলে না। সংগ্রামের পরবর্তী ধাপ অর্থাৎ রাজনৈতিক লক্ষ্যে উন্নীত হতে হবে জনসাধারণকে। সেই রাজনীতি বাইরে থেকে বল হিসাবেই প্রয়োগ করতে হয়। অর্থাৎ- রাজনীতিটি শিখতে হয়।
তাই চে।
কিউবা’তে সফল হয়েছিলেন। বিপ্লব পরবর্তী কিউবায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বেও ছিলেন। তারপরে সেই কাজ ছেড়ে চলে যান না, আসলে এগিয়ে যান। যার মাথায় ‘If you are capable of trembling with indignation each time that an injustice is committed anywhere in the world, we are comrades.’- গিজগিজ করছে, সেই লোক কিছুতেই দপ্তরে বসে থাকতে পারে না যে। ফিদেল কাস্ত্রো এমন অনুভূতিকে মর্যাদা দিয়েছিলেন। এক বিপ্লবীর পক্ষেই আরেক বিপ্লবীকে এমন মর্যাদা দেওয়া যায়।
সকলেই আরেকবার মনে রাখুক তিনি মার্কসবাদী কিনা সেই প্রশ্নের উত্তরে চে গুয়েভারার উত্তর ছিল- ‘আমরা মার্কসবাদী কিনা প্রশ্নটি ঠিক তেমনই যেমন কোনও পদার্থবিদকে তিনি নিউটনের কথা মেনে চলেন কিনা কিংবা কোনও জীববিজ্ঞানীকে পাস্তুরের অনুগামী বলে প্রমাণ দিতে বলা।’
তাই চে।
তারই কন্যা অ্যালেইদা গুয়েভারা এবং নাতনী (অ্যালেইদারই মেয়ে) এস্তেফানিয়া এসেছেন কলকাতায়। বাংলা সিদ্ধান্ত নিয়েছে কিউবার পাশে থাকার বার্তা সহ গুয়েভারা পরিবারের সদস্যদের সংবর্ধিত করা হবে। কেন? কারণ এটা বাংলা- আহারে বাংলা, আহা রে বাংলা কোনটাই নয়- তাই।
হাতে ধরা কলম আর কাঁধে ঝোলানো ক্যামেরা নিয়ে রাজ্য ওয়েবসাইটের টিম যখন সেখানে পৌঁছায়, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপেন এয়ার থিয়েটারের চত্বরটি তখনও তৈরি হচ্ছে। রিহার্শাল চলছে। কেউ ব্যানার বাঁধছেন, কেউ লিফলেট বিলি করছেন আবার কেউ অনেকের সাথে এক হয়ে গান গাইছেন।
রিহার্শাল এমনই যার সাথে একাত্ম হতে হয় না, সেই সুর এমনিই কাছে ডেকে হাত ধরে নেয়। সেভাবেই চা, কফি আরও যা সব, হাতে এল।
গ্যালারির এক প্রান্তে নিজেদের জায়গা পাকা করে চারপাশটা দেখার শুরু।
অজস্র মুহূর্ত, আরও বেশি আবেগ। রোমান্টিকতা? ঠিকই তো- ‘ দুঃখে কাঁদতে কিংবা আনন্দে হাসতে জানে না যে, সে তো বিপ্লবীই নয়’!
গোটা চত্বর জুড়ে আসলে সেই আনন্দের উৎসব। ভাষা, সংস্কৃতি, দেশের সীমানা পেরিয়ে সেই আনন্দই ততক্ষণে ক্যারিবিয়ান সাগর প্রান্তের একচিলতে ভূখণ্ড হাভানা’কে নিজেদের পড়শি করে নিয়েছে।
খবরের চ্যানেল কিংবা ইউটিউবের পর্দায় স্টক মার্কেটের বিনিয়োগকেই বিশ্বায়নের মানে বলে শিখছি আমরা, আমাদের একের পরে এক প্রজন্ম। তখনই এমন আয়োজন এক চিরায়ত সত্যকে মনে করিয়ে দেয়! বইয়ের পাতায় ছোট্ট অলিভারের দুঃখ সম্পর্কে পড়ে, অনুভব করে এদেশের শৈশব বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে যাওয়া স্বপ্নে যবে থেকে নিজেকে অলিভারের বন্ধু করে তুলেছে- আসল বিশ্বায়ন ঘটেছিল তখনই। প্রযুক্তি, ইন্টারনেট এসবের অজুহাতে বাকি যা কিছু, স্রেফ ধান্দা- আর কিছুই না।
সাড়ে তিনটেয় গেটের দিক থেকে আওয়াজ এলো- ইনকিলাব জিন্দাবাদ। আশেপাশে ক্যামেরা নিয়ে যারা, সকলেই ছুটলেন- বুঝলাম অ্যালেইদা এসে উপস্থিত হয়েছেন। পরিচালক কমলেশ্বর মুখার্জি ও রঙ্গন চক্রবর্তী দুজনেই অনুষ্ঠানের পরিচালনা সামলেছেন। আচমকা মাইক ধরে ছাত্র ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ময়ুখ বিশ্বাস ইংরেজি ও স্প্যানিশ ভাষায় স্লোগান তুলে জানিয়ে দিলেন আমরা তৈরি।
অর্ক মুখার্জি মঞ্চে গান গাইতে গিয়ে যা করেছেন তাকে শ্রাব্য আর্টের দৃশ্যকল্প বলা চলে। এহেন চর্চার স্বাদ সম্পর্কে ব্যাক্তিগত দ্বিধা কিছু ছিল, সেসব কেটে গেল। একটা সময় অর্কর গলা থেমে গেছে অথচ গান শোনা যাচ্ছে। গোটা গ্যালারি গাইছে-
‘অ্যাক্যুই সে ক্যুয়েদা লা ক্লারা
লা এনত্রানেবল ট্রান্সপারেন্সিয়া
দে ত্যু ক্যুয়েরিদা প্রেজেন্সিয়া
কমান্দান্তে চে গ্যেভারা…’
অ্যালেইদা নিজেও একজন চিকিৎসক, তার বাবার মতোই। সেবার ব্রতকে কিঞ্চিত টেরা চোখে বিবেচনার অভ্যাস যাদের, তারা ফেসবুকে কি সব লেখেন চে’র কন্যা সেসব পড়েন কিনা জিজ্ঞাসার উপায় নেই। তার বাবা আদৌ কোনও স্মৃতি নন, আজও তিনি রয়েছেন। সেই আঁচ তিনি কলকাতায় বসেও পেয়েছেন। ‘যারা শিক্ষার সুযোগ পেয়েছ, আরও এগিয়ে যাও- অন্যদেরও এগিয়ে যেতে সাহায্য করো। সমাজ বদলের কাজে ভালো মানুষ হওয়া প্রয়োজন, তেমনই হতে হবে তোমাদের। মানুষের সংগ্রামের সাথী হয়েই কাজ করতে হবে’ বলে নিজের সংক্ষিপ্ত বক্তব্য শেষ করলেন। গোটা গ্যালারি উঠে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে বাংলায় কি বলছে অ্যালেইদা তার সবটাই বুঝেছেন। কারণ সেই ভাষা শব্দের বাধা অতিক্রম করে, সেই ভাষা জানান দেয়- আমরা সবাই মানুষ।
চে গুয়েভারা’কে গুলি করাই যায়, কিন্তু সেই গুলিতে মরে শুধু মানুষটাকেই- তার চিন্তাটি নয়। হাত মুঠো করে ইনলিকাব উচ্চারণের সময় কলকাতা সেই কথাই আরেকবার গেয়ে ওঠে।
একে একে সকলেই মঞ্চ থেকে নেমে আসছেন, আমরাও দ্রুত ব্যাগপত্তর গুছিয়ে নিচ্ছি। মাথায় ঘুরছে একটা হেডলাইন তো চাই। এমন একটা মুহূর্ত চাই যা মনে থেকে যাবে চিরকাল।
গেটের দিকে যেতে ভীষণ ভিড়- একটু আটকেই গেছি আমরা তখন।
তখনও মাথায় ঘুরছে- কি লিখে শেষ করা যায়।
একটা ধাক্কা খেলাম। তিনজন হেঁটে যাচ্ছে। দুজন সামনে, একজন একটু পিছনে। ছাত্র সব, দেখেই বোঝা যায়।
চলার ভঙ্গিতেই চোখটা চলে যায় সেদিকে এবং যার অপেক্ষায় ছিলাম সেই মুহূর্তের সাক্ষী হওয়া গেল।
সন্ধ্যেবেলা চোখে কালো চশমা পরে দুজনের পিছনে যিনি হাঁটছেন, আলো দেখতে পান না। তারই হাত ধরে সামনে এগিয়ে চলেছেন সামনের দুজন। সবারই মুখে তখন ‘কমান্দান্তে চে গ্যেভারা…’
কি বলবো এমন দৃশ্যকে?
থ্রি কমরেডস? নাকি নতুন মলাটের উপরে ছাপা হাল ফ্যাশনের ‘তিন বন্ধু’? এরিখ মারিয়া রেমার্ক হলে কি বলতেন?
সেই বিবেচনার ভার পাঠকদের দিকেই ঠেলে দিলাম আমরা।
ওপেন থিয়েটার চত্বর ছেড়ে বেরিয়ে চলেছি চার নম্বর গেটের দিকে, আমাদের কানেও একটা গান বাজছে। হাজার পায়ের চোটে তখন ধুলো উড়তে শুরু করেছে সবে…
দুপুরবেলা উকেলেলে হাতে নিয়ে মঞ্চে বসে মাইক টেস্টিং করতে গিয়ে সাত্যকি ব্যানার্জি গাইছিলেন-
‘ভাঙ্গাচোরা পৃথিবীর কতকাল… কতকাল
আজ তোমার জন্মদিনে.. লালে লাল
ধুলো বালি জঞ্জাল
ওড়ে লাল… ওড়ে লাল…
আজ তোমার জন্মদিনে…’
মঞ্চের ঠিক সামনে ঝুলিয়ে রাখা ব্যানারে ঠিকই লেখা ছিল।
এই তো বিপ্লবের উদযাপন- সেলিব্রেশন অফ রেভোলিউশন।
তবু মনে রাখতে হয়, হবে- সেলিব্রেশনেরই রিহার্শাল হয়, বিপ্লবের না।
সর্বহারার জন্য রেভোলিউশনই হল সেলিব্রেশন।