সৌভিক ঘোষ
‘আমার ও নিজের পরিবারের কথা ভেবে এবার অন্তত এটুকু মেনে নাও, যা হয় হোক- আগে সুস্থ হও। তোমার কিছু একটা হয়ে গেলে গোটা আন্দোলনের কি হবে ভেবেছ কি? তুমি যে কায়দায় চলছ তাতে আমার আশংকা চরম পরিণতিতেই এর শেষ হবে। তোমার ঐ কাজ শেষ না হওয়া অবধি আমি এক মুহূর্ত শান্তি পাচ্ছি না, দিন-রাত শুধু ভাবছি চিঠি বা টেলিগ্রাম কিছু একটা আসবে এবং আমি শুনব তোমার অবস্থা আগের চাইতে আরও খারাপ হয়েছে। যদি ধরেও নিই কার্বাংকলের বিষাক্ত ফোঁড়া কেটে ফেলা ছাড়া আর উপায় নেই তা হলেও সে কাজ তুমি নিজে কখনো করতে যাবে না। যন্ত্রণা কমাতে এমন কিছু ভাবাও বিপজ্জনক’।
২২শে ফেব্রুয়ারি, ১৮৬৬। ফ্রেডরিক এঙ্গেলসের লেখা চিঠির অংশ বিশেষ। আসলে ডাক্তার গুম্পার্ট’কে একেবারেই পছন্দ করতেন না। আর্সেনিকের ইনজেকশন নিতে মার্কসের বিশেষ আপত্তি ছিল, যদিও চিকিৎসক আদৌ সেসব পাত্তা দিতেন না। সেই গুম্পার্টকে এড়িয়ে যেতেই বুকের বাঁদিকে গজিয়ে ওঠা দুটি বিরাট আকারের বিষফোঁড়ার একটিতে মার্কস নিজেই ক্ষুর হাতে ‘অপারেশন’ চালিয়েছিলেন! সেই কথা এঙ্গেলসকে চিঠি লিখে জানিয়েওছিলেন। তারই প্রতিক্রিয়ায় এঙ্গেলসের এই চিঠি। কার্বাংকলের বিষ ফোঁড়াই একমাত্র যন্ত্রণা এমন না, পুঁজি লিখতে বসে মার্কস’কে একসাথে অনেক বাধার মুখোমুখি লড়াই করতে হয়েছিল। নিদারুণ দারিদ্র্য তার মধ্যে অন্যতম। বাড়িওয়ালার তাগাদা, পরে সরাসরি হুমকি; মাসকাবারি ও অন্যান্য বকেয়ার পাওনা বুঝে নিতে সকাল সকাল সদর দরজায় ধাক্কা এবং নিজের জামাকাপড়, লেখার কলম সহ ঘটিবাটি অবধি বন্ধক রাখতে বাধ্য হওয়া- এই ছিল তাঁর স্বাভাবিক রোজনামচা। এর সাথে যুক্ত হয়েছিল ফুলে ওঠা পাকস্থলীর দুর্বিষহ ব্যাথা।
প্রতিবার কিছুটা সামলে ওঠেন এবং মহানন্দে কখনো এঙ্গেলস, কখনো ক্যুগেলম্যান আবার কখনো সরাসরি প্রকাশকের কাছে চিঠি লিখে জানান ‘এবার অনেকটাই সুস্থ বধ করছি। খুব দ্রুত কাজটা শেষ করতে পারব’। সেই কাজ যখন শেষ হল ততদিনে স্ত্রী জেনি, কটি সন্তান এবং মার্কসের জীবনীশক্তির প্রায় নব্বইভাগ ধ্বংস হয়ে গেছে।
মার্কস নিজেও বুঝতে পারছিলেন সময়, শক্তি সবই ফুরিয়ে আসছে। তার ভরসা বলতে কেবল দুটি, এক তার মগজ যা কোনোদিন অকেজো হয়নি, আরেকদিকে জেনি ও এঙ্গেলস। তাকে বাঁচিয়ে রাখতে এরা দুজন শেষ অবধি লড়াই চালিয়ে গেছেন। নিজে ক্যান্সার আক্রান্ত হয়েও জেনি মার্কসের কাজে ব্যাঘাত ঘটাতে চাননি, পাশের ঘরে চুপ করে শুয়ে থাকতেন। ১৮৮১-র ২রা ডিসেম্বর, জেনি শেষ লড়াইটুকু হেরে গেলেন। লন্ডনের হাইগেট সমাধিক্ষেত্রে মাটির নিচে চাপা পড়ার সময়ও কার্ল নিজের স্ত্রীর পাশে থাকতে পারলেন না, গুরুতর অসুস্থ শরীর তাকে এতটাই অকেজো করে রেখেছিল। এঙ্গেলস নিজের ডায়েরিতে লিখলেন ‘জেনির সাথেই মার্কসও আজ থেকে ফুরিয়ে গেলেন’।
১৮৪৯-র আগস্ট মাসে মার্কস ইউরোপ ছেড়ে ইংলন্ডের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। লন্ডনে বসেই তিনি পুঁজি লিখেছিলেন, যদিও অর্থশাস্ত্র সম্পর্কিত তার পড়াশোনা, গবেষণা এর অনেক আগেই শুরু হয়। ১৮৪২-এ সাংবাদিক হিসাবে নিউ রাইনিশে জাইতুং পত্রিকায় কাজ করতে গিয়েই তিনি উপলব্ধি করেন ‘সমাজব্যবস্থার গঠন বুঝতে গেলে রাজনৈতিক অর্থনীতি ব্যতীত এগোনো যায় না’। লন্ডনের ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরীতে বসে মার্কস অর্থশাস্ত্রের পড়াশোনাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যান। ১৮৫৯ সালে প্রকাশিত হল ‘আ কন্ট্রিবিউশন টু দ্য ক্রিটিক অফ পলিটিক্যাল ইকনমি’, এই বইটিই মার্কসের অর্থশাস্ত্র চর্চার ভ্রুন। ১৮৬১-৬৩ নাগাদ বেরোল ‘থিওরিজ অফ সারপ্লাস ভ্যালু’। ততদিনে তাঁর শরীরে বিবিধ সমস্যা শুরু হয়েছে। দুর্বল লিভার, গোটা পরিবারকে প্রায়ই অর্ধাহার নাহলে অনাহারে কাটাতে হচ্ছে।
১৮৫৩ থেকে ১৮৫৯ সাল অবধি পরিবারের সংস্থানে জেরবার মার্কস নিউ ইয়র্ক ট্রিবিউনে সাংবাদিক হিসাবে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। এশিয় সমাজের নির্দিষ্ট উৎপাদন ব্যবস্থা সম্পর্কে তার বিখ্যাত সুত্রায়ন (এশিয়াটিক মোড অফ প্রোডাকশন) ততদিনে প্রকাশিত হয়েছে। এশিয়া তথা ভারতীয় সমাজব্যবস্থায় জমির উপরে ব্যক্তিগত মালিকানা যে প্রধানত অনুপস্থিত লিখেছিলেন মার্কস ও এঙ্গেলস দুজনেই। ‘আ কনট্রিবিউশন টু দ্য ক্রিটিক অফ পলিটিক্যাল ইকোনমি’-তে মার্কস লিখলেন – ‘Mankind thus inevitably sets itself only such tasks as it is able to solve, since closer examination will always show that the problem itself arises only when the material conditions for its solution are already present or at least in the course of formation. In broad outline, the Asiatic, ancient, feudal and modern bourgeois modes of production may be designated as epochs marking progress in the economic development of society. The bourgeois mode of production is the last antagonistic form of the social process of production – antagonistic not in the sense of individual antagonism but of an antagonism that emanates from the individuals’ social conditions of existence – but the productive forces developing within bourgeois society create also the material conditions for a solution of this antagonism. The prehistory of human society accordingly closes with this social formation.’ ভারতে স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামগুলি থেকে বিধিপূর্বক পূর্বনির্দিষ্ট হারে কর আদায় করেই শহর ভিত্তিক শাসনব্যবস্থা কায়েম রয়েছে- এই ছিল তাদের মত। শহরাঞ্চলগুলিতে প্রাথমিক পর্যায়ের পুঁজিবাদী বাজারের অস্তিত্বও তাদের ঐ পর্বের লেখায় পাওয়া যায়।
প্রকৃতি বিজ্ঞান যেভাবে ‘কেন এমন হয়?’- এই বুনিয়াদী প্রশ্নকে আলোচনার কেন্দ্রে রেখে প্রথমে গ্যালিলিও, পরে নিউটনীয় বলবিদ্যার পরিসর পেরিয়ে কোয়ান্টাম মেক্যানিক্সের স্তরে উন্নীত হয়েছে ঠিক সেভাবেই ‘সমান সুযোগের সমাজব্যবস্থা’র পক্ষে যুক্তিসঙ্গত রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং সমাজবিজ্ঞানের অন্যান্য ধারাসমূহ সময়োপযোগী কলেবরে বৃদ্ধি পেয়েছে। পৃথিবীর মাটি ছাড়িয়ে মহাকাশে পাড়ি দেবার কিংবা বস্তুকে ভাঙতে ভাঙতে আনবিক জগতে প্রবেশ করার পরেও যেমন প্রকৃতি বিজ্ঞানের মূল প্রশ্ন ‘কেন এমন হয়?’- রয়ে গেছে তেমনই যেকোনো সমাজবিজ্ঞানের মূল সমস্যা আজও ‘কেন এমন হল?’-কে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়। প্রকৃতি বিজ্ঞান এবং সমাজ বিজ্ঞানের মিল এবং অমিলের জায়গা এটাই।
‘কেন এমন হল’- ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে এই প্রশ্ন করার হিম্মত দেখিয়েছিলেন কার্ল মার্কস। এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার পথেই ধারণাসম্মত জ্ঞান এবং বিজ্ঞান-যুক্তি-প্রতিযুক্তিসম্মত জ্ঞানের যথাযথ সংশ্লেষে নির্মিত হল ইতিহাসের বিজ্ঞান – ঐতিহাসিক বস্তুবাদ। পুঁজি গ্রন্থের সার কথা যদি হয় ‘উদ্বৃত্তের নির্মাণ ও তার অধিকার সম্পর্কে ধারণা’ তবে সেই উপলব্ধির সবচেয়ে উপযোগী প্রয়োগ হল ইতিহাসের সত্যকে প্রকাশ করায়। মার্কস সেই কাজ নিজেই শুরু করেছেন, আমাদের সেই ধারা মেনেই কাজে এগোতে হয়।
মার্কসের হাতে পূঁজির রহস্য উন্মোচনের পরে একটা নতুন ধাঁধার জন্ম হল। বিজ্ঞানসম্মত অর্থশাস্ত্রের নতুন সীমাবদ্ধতা সামনে চলে এল। সেই ধাঁধার জোরেই আজও পুঁজিবাদ করেকম্মে খাচ্ছে! দেখা যাক সেই ধাঁধাটি কেমন এবং মার্কস কীভাবে সেই প্রশ্নেরও সমাধান করলেন।
কিছুটা ধীর কিন্তু নিরবিচ্ছিন্ন পথে ক্রমশ একটা বিশ্বব্যবস্থায় পরিণত হবার সময়েই একটা প্রকল্পনা (হাইপোথিসিস)-কে পুঁজিবাদ নিজের জন্মরহস্যের সাথে জড়িয়ে রেখেছে। অথচ লোকঠকানো ব্যবসার গোড়াতেই সেই বিরাট গলদটি রয়ে গেছে। মার্কস দেখালেন পুঁজি কীভাবে উদ্বৃত্ত মূল্য সৃষ্টি করে, সেই উদ্বৃত্ত মূল্য পুনরায় কীভাবে পুঁজি হিসাবে ব্যবহৃত হয়- আগের (অর্থাৎ বিনিময় চক্রের প্রথমার্ধের পর্বে) তুলনায় পুঁজি কলেবরে অনেকটাই বাড়ে। সেই পথে এগিয়েই সম্পদের নামে মুনাফার পাহাড় নির্মিত হয়। এই অবধি কোথাও কোনো সমস্যা নেই, পাটিগণিত বোঝেন এমন যে কেউ পূঁজির চক্র এবং চক্রান্ত দুইই বুঝতে পারবেন। চক্রাকার পরিচলনের পথে যেটা সহজে ব্যাখ্যা করা যায়না তা হল- প্রথমে কার জন্ম, পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা নাকি পুঁজি নিজেই? কারন, পুঁজি, পুঁজির বিনিয়োগ এবং জমি ও শ্রমশক্তি সম্বলিত পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যাবস্থা না থাকলে উদ্বৃত্ত মূল্য (যা পরে নিজেই পুঁজি হয়ে ওঠে) সৃষ্টি হতে পারে না আবার পুঁজি বিনিয়োগ না করা হলে সবার প্রথম ধনতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থাটা গড়ে ওঠে কীভাবে? এই চক্রাকার চরিত্রের ঘূর্ণাবর্তে জনসাধারণের মাথাটা গুলিয়ে দিতে পারছে বলেই পুঁজিবাদ নিজেকে বহুবিধ সংকট সত্ত্বেও একটা বিশ্বব্যবস্থা হিসাবে টিকিয়ে রাখতে পারছে। মানুষের মনে কিছুটা হলেও এই ধারণা ঢুকিয়ে দিতে পারছে পুঁজি, মুনাফা এসব নাকি মানুষের চেতনায় শুরু থেকেই রয়েছে! মুনাফার লোভ, ভোগবাদী সংস্কৃতি এসবই আমাদের অস্তিত্বের সাথেই জায়েজ! অন্যের প্রাপ্য চুরি করে নিজে ভালো থাকার ভাবনা নাকি মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। মার্কস উপলব্ধি করেছিলেন পুঁজিবাদ শুধুই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা না, পুঁজিবাদ একটা সংস্কৃতি- একটা দর্শন। তাই তাকে ভাঙবার, বদলে দেবার লড়াইটাও শুধু অর্থশাস্ত্র সম্মত পথে করলে চলবে না, দুনিয়া বদলের নিজস্ব দর্শন নির্মাণ করতে হবে, নতুন সমাজের উপযুক্ত নতুন মানুষের জন্য প্রয়োজন হবে নতুন সংস্কৃতির। আর তাই ক্যাপিটাল গ্রন্থের পাতায় পাতায় গ্যেটে থেকে শুরু করে শেক্সপিয়রের রচনাংশের আধিক্য, ফুটনোটের অসাধারণ ব্যবহার দেখা যায়। এসব বাড়তি বলে ভাবলে ভুল হবে, ঐ ফুটনোট আসলে সহায়ক পাঠ যাতে সত্যের আরও কাছাকাছি আসা যায়।
মুনাফাকে জায়েজ প্রতিপন্ন করতে পুঁজিবাদের নিজস্ব যুক্তির পুরোটাই আগাগোড়া একটা বিরাট মিথ্যা। পুঁজি আছে এবং পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার সাহায্যে সেই পূঁজির চক্রাকার সঞ্চালনায় আজকের সভ্যতার মেরুদণ্ড অর্থাৎ মুনাফার পাহাড় গড়ে তুলতে ধনতন্ত্রের রৈখিক পথকে মার্কস অবরোহী যুক্তির (Step Down Approach) সাহায্যে ব্যাখ্যা করলেন। কিন্তু বিনিয়োগযোগ্য সেই প্রথম পুঁজি কোথা থেকে এল? এখানেই মার্কসের দার্শনিক অনন্যতা – ইতিহাসের বস্তুবাদী ধারনার সাথে অর্থশাস্ত্রের যুক্তির অমোঘ শরচালনার যৌথ আক্রমন। পুঁজিবাদ নিজেকে সমাজের গতিধারায় অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হিসাবে তুলে ধরতে চায়, ঈশ্বরের ইচ্ছানুযায়ী পৃথিবীর বেশিরভাগ সম্পদের অধিকারী কতিপয় ধনীর মুঠোয় অথবা যোগ্যতমের প্রাপ্য এসব বলে তারা আসলে মুনাফা নির্ভর মানুষখেকো ব্যবস্থাটাকেই কায়েম রাখতে চায়। এমন মহান ইচ্ছাকেই রাজনীতির ভাষায় কায়েমি স্বার্থ (Vested Interest) বলে। ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই বেশিরভাগ মানুষের নরকভোগ- একথা কার্ল মার্কস মেনে নিতে পারেননি। তাঁর আবিস্কারের সাফল্য সেখানেই। বিনিময়যোগ্য পুঁজি থেকে উদ্বৃত্ত মূল্য আহরন যে আসলে বহুজনের শ্রমশক্তির ন্যায্য বিনিময় মূল্য চুরি করে গড়ে ওঠে শুধু এটুকু বুঝলেই মার্কস পুরোটা বোঝা যাবে না। মার্কস ওখানেই থেমে থাকেন নি, তেমনটা হলে তার নাম শুধু এক মহান পন্ডিত হিসাবেই চিহ্নিত হত। তার শিক্ষা পণ্ডিতম্মন্যতার সিমানা পেরিয়ে বিপ্লবী স্তরে পৌঁছে যায় যখন তিনি দেখিয়ে দেন পুঁজি সঞ্চয়ের প্রাথমিক প্রক্রিয়াই হল দুনিয়াজূড়ে রক্তস্নাত লুটতরাজ। এখানেই মার্কসীয় প্রজ্ঞায় আরোহী যুক্তির (Step Up Approach) প্রয়োগ। ধনতন্ত্রের মুখোশ টেনে ছিড়ে ফেলে তিনি প্রমাণ করলেন দুনিয়াজূড়ে সম্পদ লুঠ করেছে প্রাক পুঁজিবাদী সমাজের লুঠেরা নেতৃবর্গ এবং দুহাতে রক্তমেখে সেই লুটের টাকাতেই পুনিবাদের ভিত্তি নির্মাণ করা হয়েছে। তিনি প্রমাণ করলেন পূঁজির আদিমতম সঞ্চয় কোন পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার ফলা না বরং ঠিক তার উল্টো- পুঁজি ছিল বলেই ধনতন্ত্র নির্মিত হতে পেরেছে। সেই নির্মাণের ভিত দুনিয়াজূড়ে অসংখ্য অসহায় মানুষের মৃত্যুর বিনিময়ে পোক্ত হয়েছে। এই মহাপাপ থেকে পুঁজি এবং পুঁজিবাদ কারোরই মুক্তি নেই- কখনো হবে না। যে ব্যবস্থাটা নিজেই নিজের নামে ঢাক পিটিয়ে প্রচার করছে ‘There is no alternative’- সম্পদ সৃষ্টির মহান ও পবিত্র কর্তব্য সম্পর্কে নিজেদের উপরওয়ালার প্রেরিত দূত বলে বিজ্ঞাপন দিয়েছে। আগে যারা ছিল খুনি লুঠেরা- তারাই এখনকার চোর।
প্রথমে ভেবেছিলেন ১৮৬৬-তেই পুঁজি প্রকাশনার কাজ শেষ হবে। মার্কসের একান্ত ইচ্ছা ছিল পরিকল্পনামাফিক সমস্ত খণ্ডগুলিই একসাথে ছেপে বেরোক। লেখা সম্পর্কে তাঁর বিশেষ খুঁতখুঁতানির কথা জানতেন বলেই এঙ্গেলস শুরুর দিকে খুব একটা তাগাদা দেননি। হ্যমবুর্গের প্রকাশকও উল্লেখযোগ্য কোন হস্তক্ষেপ করতেন না। মার্কসের শরীর তখন প্রায়শই ভেঙ্গে পড়ছে, এইবার এঙ্গেলসের দুশ্চিন্তা শুরু হল। বইয়ের সমস্ত খণ্ডের কাজ শেষ হলে তবে ছাপতে দেওয়া হবে- এমন ভাবনায় তিনি আর নিশ্চিন্ত হতে পারলেন না। এঙ্গেলসই প্রথম মার্কস’কে পুঁজির প্রথম খন্ড আগে ছাপানোর প্রস্তাব দেন। শুরুর দিকে মার্কস সেকথায় খুব একটা আমল দেননি, পরে শারীরিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে কিছুটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও মেনে নিলেন। ঐ পর্বের ইতিহাস দেখলে আজ ফ্রেডরিক এঙ্গেলসকেই পুঁজি প্রকাশের মূল কৃতিত্ব দিতে ইচ্ছা হয়। প্রাথমিক খসড়ায় মার্কস প্রায় ৫২টি নোটবুক জুড়ে নিজের লেখাটি সাজিয়েছিলেন। ঐ বছর অক্টোবর মাস নাগাদ এঙ্গেলসকে চিঠি লিখলেন- ‘শারীরিক ও মানসিক সবদিক থেকে অনন্ত বাধা পেরোতে হল। দুখণ্ডে পুরো লেখাটা শেষ করতে পারব বলে প্রথমে যেমনটা চেয়েছিলাম তা আর সম্ভব নয়। আমার পরিস্থিতি আমাকে মেনে নিতে বাধ্য করছে, পুঁজির প্রথম খণ্ডটিই প্রথমে ছেপে বেরোক। যা বুঝছি, বইটির চারটি অংশ মোট তিন খণ্ডে শেষ হবে। ১ম অংশ- পুঁজি গঠনের প্রক্রিয়া (দ্য প্রসেস অফ প্রোডাকশন অফ ক্যাপিটাল), ২য় অংশ- পুঁজি সঞ্চরণের প্রক্রিয়া (দ্য প্রসেস অফ সার্কুলেশন অফ ক্যাপিটাল), ৩য় অংশ- প্রক্রিয়ারূপে পুঁজিবাদী উৎপাদন কাঠামোর বিশ্লেষণ ( স্ট্রাকচার অফ দ্য প্রসেস অ্যাজ আ হোল) এবং ৪র্থ অংশটি হল- রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্রের ইতিহাস (অন দ্য হিস্ট্রি অফ দ্য থিওরি)। প্রথম দুটি অংশ থাকবে বইয়ের প্রথম খণ্ডে, ৩-য় অংশটি ২য় খণ্ডের অন্তর্গত হবে এবং ৪-র্থ অংশটি পুরোটাই যাবে ৩-য় খণ্ডে’।
যদিও এই পরিকল্পনাও শেষ অবধি টেকেনি। প্রথম প্রকাশের পরে মার্কস নিজেও বহু সংশোধন, সংযোজন করেছেন। পরের দুটি খণ্ড আর তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশ হয়নি।
১৮৬৭ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বর পুঁজির প্রথম খণ্ড ছেপে বেরোয়। জার্মান ভাষায় হাজারখানেক কপি’ই ছাপা হয়েছিল। মার্কসের কথায় সেই বই ‘আজ অবধি বুর্জোয়াদের মাথা লক্ষ্য করে ছোঁড়া সবচাইতে বড় মিশাইল’। বইয়ের প্রতিটি পাতার প্রুফ দেখেছিলেন মার্কস নিজেই। সেকাজ শেষ হয়েছিল ১লা আগস্ট, রাত দুটোয়। শেষ করেই এঙ্গেলস’কে চিঠি লিখতে বসলেন- ‘শেষ পাতার প্রুফ দেখা এই সবে মিটল। অতএব, প্রথম খণ্ডটি ছাপা হচ্ছে… এ কাজ শেষ করার জন্য যদি সত্যিই কাউকে ধন্যবাদ দিতে হয় তবে তা একান্তই তোমার প্রাপ্য, আর কারোর না’।
পুঁজি এক অর্থে মার্কসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার। মানবিক জীবনীশক্তির অপূর্ব ও সর্বোচ্চ ব্যবহার করেই বইটি লেখা হয়। এমন কাজের শেষেও মার্কস ভোলেননি, তাঁর কাজ শুধুই তাঁর কৃতিত্ব না। জেনি’র প্রতি কৃতজ্ঞতা ছিল একান্ত ব্যক্তিগত, বাকি সবই এঙ্গেলসের জন্য। ফ্রেডরিক ছিলেন কার্লের সেই বন্ধু ও সহযোদ্ধা যিনি তাঁকে বাঁচিয়ে রাখতে সর্বদা যেকোনো ত্যাগ করতে তৈরি ছিলেন। তাই পুঁজি শুধু চলতি সমাজব্যবস্থার আকর সমালোচনাই নয়, মার্কসকে উপলব্ধি করতেও শেষ অবধি ওটাই ক্যাপিটাল।