কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্তসমূহ
তারিখঃ ৩১শে জানুয়ারি, ২০২১
৩০ এবং ৩১শে জানুয়ারি,২০২১ অনলাইনে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) – এর কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক হয়েছে। কেন্দ্রীয় কমিটি নিম্নলিখিত বিবৃতি জারী করেছে –
কৃষকদের আন্দোলন প্রসঙ্গেঃ
পশ্চাদপদ কৃষি আইন বাতিল এবং সারা ভারতের কৃষকদের জন্য ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে ফসল বিক্রির ব্যবস্থাকে আইনি বৈধতা দেবার দাবীতে কৃষকদের ঐতিহাসিক সংগ্রামের প্রতি সিপিআই(এম)-এর কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে অভিনন্দন জানাচ্ছে।
পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি এই সংগ্রামের প্রতি সম্পূর্ণ সংহতি এবং সমর্থন জানাচ্ছে।
দেশের সাধারণতন্ত্র দিবসে কৃষকদের পক্ষ থেকে যে বিশাল ট্র্যাক্টর প্যারেডের আয়োজন করা হয়েছিল তাতে এক লাখেরও বেশী ট্র্যাক্টর এবং লক্ষ লক্ষ কৃষক অংশগ্রহন করেছিল। এই ট্র্যাক্টর প্যারেড সুব পক্ষের সাথে আলোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পূর্বঘোষিত পথেই এগিয়েছে। দেশের সব রাজ্যেই এই প্যারেডের সমর্থনে বড় আকারের অনুরুপ আয়োজন অনুষ্ঠিত হয়।
সাধারণতন্ত্র দিবসে কৃষকদের ন্যায্য দাবীসমূহের থেকে নজর ঘোরাতে কতিপয় অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটে। এই ঘটনাগুলি প্ররোচকদের উস্কানিমূলক চক্রান্তের ফলে ঘটে, এদের কয়েকজনকে বিজেপি’র ঘনিষ্ঠ হিসাবে ইতিমধ্যেই চিহ্নিত করা হয়েছে এবং এইসকল অনভিপ্রেত ঘটনায় আন্দোলনকারী কৃষক সংগঠন এবং সারা দেশেই জনসাধারনের পক্ষ থেকে নিন্দা করা হয়েছে।
কৃষকদের বিরুদ্ধে নিপীড়নের প্রসঙ্গেঃ
সিএএ বিরোধী আন্দোলনের সময় আরএসএস এবং বিজেপি’র পক্ষ থেকে আন্দোলনকারীদের উপরে গুন্ডাদের লেলিয়ে দেওয়া হয়েছিল, সেই কায়দাতেই দিল্লী সীমান্তে আন্দোলনরত কৃষকদের আন্দোলনের উপরে দিল্লী পুলিশের সহায়তায় সশস্ত্র দুষ্কৃতিদের মাধ্যমে হামলা চালানো হয়েছে। যদিও এধরনের হামলায় কৃষক এবং জনসাধারনের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ সংগঠিত হয়, প্রচুর মানুষ এসে কৃষকদের লড়াইয়ের সমর্থনে এসে জড়ো হওয়ায় দুষ্কৃতকারীরা এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
দিল্লী পুলিশ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীনস্থ হওয়ায় এই হিংসাত্মক আক্রমনের ঘটনায় যুক্ত অপরাধীদের গ্রেফতার না করে আক্রান্তদের বিরুদ্ধেই অপরাধে যুক্ত থাকার অভিযোগে মামলা রজু করা হয়েছে। কৃষকদের সংগঠনের প্রতিনিধি হিসাবে যে ৩০ জন কৃষকনেতা সরকারের সাথে আলোচনায় ব্যাস্ত ছিলেন তাদের উপরেই দাঙ্গা ছড়ানো, অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রে শামিল থাকা, খুনের চেষ্টা এবং ডাকাতির অভিযোগে মোট ২৫টি মামলা নথিবদ্ধ করা হয়। দিল্লী পুলিশ এবং বিজেপি সরকারের পক্ষ থেকে কৃষকন্তাদের উপরে এমন মিথ্যা অভিযোগে মামলার নামে নিপীড়নকে ধিক্কার জানাচ্ছে এবং দাবী করছে অবিলম্বে এইসব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহৃত হোক।
সাংবাদিকদের নিশানা করার প্রসঙ্গেঃ
উত্তরপ্রদেশ, মধ্য প্রদেশ, হরিয়ানা, কর্ণাটকে রাজ্য সরকারের সাহায্যে এবং দিল্লিতে পুলিশ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীনস্থ হবার সুবাদে কৃষক আন্দোলনের সঠিক খবর সংগ্রহ এবং প্রচার করার কাজে নিযুক্ত সাংবাদিকদের উপরে তীব্র আক্রমন নামিয়ে আনা হয়েছে। ভীতিপ্রদর্শনের মাধ্যমে সাংবাদিকদের সন্ত্রস্থ করার এমন ঘটনা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। গত ২৮শে জানুয়ারি দেশদ্রোহিতার অভিযোগসহ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের চেষ্টা, অন্যের ধর্মীয় আবেগে আঘাত এবং জাতীয় ঐক্য নষ্টে সক্রিয়তা ইত্যাদি বিভিন্ন অভিযোগে নয়জন সাংবাদিকদের নামে এফআইআর দায়ের করা হয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশিত ট্যুইটের ভিত্তিতে বর্ষীয়ান, প্রখ্যাত সাংবাদিকদের বিরুদ্ধেও এধরনের অভিযোগ তোলা হয়েছে। ভয় দেখিয়ে গনমাধ্যমকে হেয় করার উদ্দেশ্যেই এভাবে চোখ রাঙ্গিয়ে শাসন করার নির্লজ্জ চেষ্টা চলছে।
এধরনের কাজের প্রতি কেন্দ্রীয় কমিটি তীব্র ধিক্কার জানাচ্ছে এবং মিথ্যা অভিযোগে দায়ের করা এফআইআর প্রত্যাহার করার দাবী করছে।
এইসব নিন্দনীয় কাজের সমালোচনা করার সাথে কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে আবার একবার দাবী জানানো হচ্ছে যাতে সংসদে চলতি বাজেট অধিবেশনেই যেন কৃষি আইন বাতিলের ঘোষণা করা হয়। প্রথাবদ্ধ বিভিন্ন সংসদীয় কমিটির মাধ্যমেই কৃষি বিষয়ক সংস্কারের সিদ্ধান্ত হোক। সেই লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় কমিটির বক্তব্য সংসদে এবং কৃষিক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সাথেই যথাযথ আলোচনার ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় কোন আর্থিক সংস্কারের নতুন প্রস্তাব আনা হোক।
সংসদে পার্টির প্রতিনিধি (এম পি)-দের জন্য কেন্দ্রীয় কমিটি এই নির্দেশ জারি করছে তারা যেন চলতি বাজেট অধিবেশনেই কৃষি আইন বাতিলের উদ্দেশ্যে যথাযথ ভূমিকা পালন করেন।
জনগণের দুর্দশাবৃদ্ধির প্রসঙ্গেঃ
বাড়তে থাকা বেকারত্বঃ সিএমআইই (সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমি) – এর প্রতিবেদনে স্পষ্ট দেশের সংগঠিত ক্ষেত্রে খুব কম করে হলেও প্রায় ১৫০ লক্ষ মানুষ কর্মহীন হয়েছেন। এর মধ্যে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর মানুষের সংখ্যাই প্রায় ১০০ লক্ষ। এর থেকেই অনুমেয় কি পরিমানে অসংগঠিত ক্ষেত্র ধ্বংস হয়েছে এবং কোটি কোটি মানুষের জীবন – জীবিকার প্রশ্নে গুরুতর সংকট তৈরি হয়েছে।
অস্বাভাবিক মুল্যবৃদ্ধি – অর্থনৈতিক মন্দায় যখন বেকারত্বের জ্বালা বাড়িয়ে চলেছে সেই সময়েই অত্যাবশ্যকীয় পণ্যসামগ্রী, পেট্রোল, ডিজেল এবং রান্নার গ্যাসের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি জনগণের দুর্দশা বহুগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। নির্বিচারে জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়া বর্তমানে এক রোজকার ঘটনায় পরিণত হয়েছে। পেট্রোলিয়ম পণ্যের উপরে সরকারী করের পরিমান সারা পৃথিবীতে আমাদের দেশেই সর্বোচ্চ।
এই সবকিছুর বিরুদ্ধেই কেন্দ্রীয় কমিটি পার্টির সব ইউনিটকে প্রতিবাদ সংগঠিত করার আহ্বান দিচ্ছে।
অর্থনৈতিক পরিস্থিতির জরিপ প্রসঙ্গে –
অর্থনৈতিক জরিপের সাম্প্রতিক প্রকাশিত সংখ্যা যত বড় চেহারা নিয়েছে এই জরিপ সেই অনুপাতেই নিজের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্যের থেকে দূরে সরে গেছে। পরিসংখ্যানবিজ্ঞানের কারিকুরির সাহায্যে আর্থিক মন্দা এবং অতিমারির ধাক্কায় বেসামাল আর্থিক অবস্থার চেহারা ঢেকে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। জনগণের জীবন জীবিকা রক্ষা করার ক্ষেত্রে সরকারের অদূরদর্শিতা এবং শোচনীয় ব্যার্থতাকেই যেভাবে এই প্রতিবেদনে অভিনন্দিত করা হয়েছে তা অত্যন্ত অসঙ্গতিমূলক আচরণ। সরকারী নীতিসমূহের নেতিবাচক প্রভাবে জীবন-জীবিকা ধ্বংস হওয়াকে আড়াল করতেই এইধরনের প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে যাতে জনগণের নজর ঘুরিয়ে দেওয়া যায় এবং সেই সুযোগে সরকার নিজেই নিজের ঢাক পেটানো চালিয়ে যেতে পারে।
ভি (V) – আকৃতির লেখচিত্রের সাহায্যে অত্যন্ত নির্লজ্জের ন্যায় ভারতে অর্থনীতির পুনরুজ্জীবন ব্যাখ্যা করা হয়েছে ২০২০-২১ আর্থিক বর্ষের প্রথম ভাগে ২৩.৯ শতাংশ হারে, এবং দ্বিতীয় পর্বে ৭.৫ শতাংশ হারে দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের হার সংকোচনের উপর ভিত্তি করে। এই পর্বে আমাদের দেশে যদি কোন আর্থিক উন্নতি হয়েও থাকে তবে তাকে একমাত্র কে (K) – আকৃতির লেখচিত্রেই ব্যাখ্যা করা সম্ভব যেখানে ধনীরা আরও সম্পদ বাড়িয়ে নিয়েছে এবং গরীব মানুষ আরও দুর্দশাগ্রস্থ হয়েছে। একথাই “অসাম্যের জীবানু” শিরোনামে অক্সফ্যামের প্রতিবেদনে প্রকাশ পেয়েছে। ভারতে সবচেয়ে ধনীব্যক্তিবর্গেরা এই পর্বেই নিজেদের সম্পদ বাড়িয়ে নিয়েছে ৩৫ শতাংশ, উল্টোদিকে লক্ষ লক্ষ গরীব মানুষের কাজ চলে গেছে, তারা ক্ষুধা, অপুষ্টি এবং বঞ্চনার শিকার হয়েছে। অর্থনৈতিক জরিপ-এর শেষ সংখ্যায় ঢাক পিটিয়ে প্রকাশিত আর্থিক সংস্কারের প্রকৃত চেহারা এটাই।
আসন্ন বাজেট প্রসঙ্গেঃ
আর্থিক মন্দা কাটিয়ে উঠতে বিপুল আকারে সরকারী ব্যায়বরাদ্দ বৃদ্ধিই সারা পৃথিবীতে সঠিক নীতি হিসাবে স্বীকৃত। আর্থিক উন্নতি এবং জনগণের কল্যানার্থে যেকোনো সরকারকেই সময়ের দাবী মেনে পরিকাঠামোগত উন্নতিসাধনে জনস্বার্থে খরচ বাড়াতে হয় কারন এর ফলে বিশাল আকারে কাজের সুযোগ তৈরি হয়। সেইসব কাজে নিযুক্ত যুবসমাজ যখন বাজার থেকে নিজেদের বেতন হিসাবে পাওয়া অর্থের বিনিময়ে প্রয়োজনের সামগ্রি কিনতে শুরু করে তখন সহজেই আর্থিক প্রগতির দরজা খুলে যায়।
এটাই দেশের জনগণের দাবী কিন্তু কেন্দ্রের বিজেপি সরকার সেই রাস্তার বিপরীতে চলছে এবং ক্ষমতায় আসীন হবার পর থেকেই নিজেদের পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী দেশের জাতীয় সম্পদ লুট করতে ধান্দাবাজ কর্পোরেটদের উৎসাহ যুগিয়ে যাচ্ছে।
সিপিআই(এম)-এর ২৩-তম কংগ্রেস প্রসঙ্গেঃ
মূলগত সংগঠন হিসাবে পার্টি ব্রাঞ্চ থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় কমিটি অবধি আন্তঃপার্টি কর্মসূচীসমূহ যা পার্টি কংগ্রেসে শেষ হবে, ইতিমধ্যেই সেই কাজ শুরু হয়েছে। আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনগুলি মিটে গেলেই এবছরের জুলাই মাস থেকে ব্রাঞ্চ সম্মেলন শুরু হবে। করোনা অতিমারির পরিস্থিতি এবং কেরালা, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম এবং তামিলনাড়ুতে বিধানসভা নির্বাচনের কারনে ২০২১ সালের এপ্রিল মাসে পার্টি কংগ্রেস আয়োজিত হবার সিদ্ধান্তকে পরিবর্তন করা হয়েছে। ২০২২ সালের প্রথম পর্বে, ফেব্রুয়ারি মাসের শেষদিকে কেন্দ্রীয় কমিটি ২৩-তম পার্টি কংগ্রেস আয়োজনের লক্ষ্য স্থির করেছে।
কেন্দ্রীয় কমিটির আহবানঃ
কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্তমতো ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় ভাগে পার্টির সকল ইউনিটেই পনেরো দিনের ধারাবাহিক প্রচার আন্দোলন সংগঠিত হবে। সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের তীব্রতা বৃদ্ধি করে ভারতের সাংবিধানিক কাঠামো এবং অর্থনৈতিক ভিত্তিগুলি ধ্বংস করা, জাতীয় সম্পদের লুট, বেসরকারিকরণের বিস্তার, মূল্যবৃদ্ধি, শ্রম আইন বাতিল, বাড়তে থাকা বেকারত্ব ইত্যাদির বিরুদ্ধে এবং একই সাথে কৃষক আন্দোলনের প্রতি সংহতিকে আরও মজবুত করার লক্ষ্যে এই আন্দোলন প্রসঙ্গে আরএসএস এবং বিজেপি’র মিথ্যাপ্রচারের মুখোশ খুলে দেওয়াই হবে আগামী প্রচারাভিযানের প্রধান ইস্যু।
শ্রমিকশ্রেণী এবং কৃষকদের লড়াই আন্দোলনের সাথে দেশের জনগণের অন্যান্য অংশের মানুষের আরও ব্যাপক আকারে সংযুক্তিকরণই পার্টির লক্ষ্য।
কেন্দ্রীয় কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে আগামী দিনে প্রচারের মূল লক্ষ্যই হবে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনগুলিতে বিজেপি-কে পরাস্থ করা এবং কেরালায় সিপিআই(এম)-এর নেতৃত্বে বাম গনতান্ত্রিক সরকারের পুনঃপ্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করা, পশ্চিমবঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষ, গনতান্ত্রিক বিকল্প বামপন্থী সরকারের প্রতিষ্ঠা, তামিলনাড়ুতে বিজেপি – এআইএডিএমকে জোটকে পরাস্থ করে ডিএমকে’র নেতৃত্বে ফ্রন্টের জয় এবং আসাম বিধানসভায় আরও বেশী পার্টির প্রভাব বিস্তার করা।