কেন্দ্রীয় কমিটির বিবৃতি
২৫শে অক্টোবর, ২০২১
২২-২৪ অক্টোবর, ২০২১ নয়াদিল্লির হরকিশান সিং সুরজিত ভবনে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-এর কেন্দ্রীয় কমিটির সভা হয়েছে। এই সভা থেকে নিম্নলিখিত বিবৃতি জারী করা হয়েছে:
মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে সর্বভারতীয় স্তরে প্রতিবাদ সংগঠিত করতে হবে
পেট্রোল ও ডিজেলের দাম বৃদ্ধির তীব্র নিন্দা জানিয়েছে সিপিআই(এম)-এর কেন্দ্রীয় কমিটি। এই দাম বাড়ানোয় জনগণের উপর অভূতপূর্ব দুর্ভোগ চাপিয়ে দেওয়া চলছে। এর সাথে রান্নার গ্যাসের দামে ভয়াবহ বৃদ্ধি ঘটেছে। এর ফলে দেশের অর্থনীতিতে সামগ্রিক মুদ্রাস্ফীতির গতি ক্রমশ বাড়ছে। পরিবহন খরচ, খাদ্যসামগ্রী, শাকসবজি, দুধ এবং দৈনন্দিন ব্যবহারের অন্যান্য সামগ্রী সহ সমস্ত নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম ক্রমশ বেড়ে চলেছে।
কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রীরা অযৌক্তিক দাবি করছেন যে পেট্রোলিয়াম পণ্যের কেন্দ্রীয় আবগারি শুল্ক বৃদ্ধি করে সেই অর্থ ব্যাবহারে মোদী সরকার বিনামূল্যে টিকা এবং বিভিন্ন সামাজিক ক্ষেত্র প্রকল্প রুপায়ন করছে। এই যুক্তি হাস্যকর। মানুষকে যদি বাড়তি মূল্যই পরিশোধ করতে হয়, তার মানে হবে টিকা আদৌ বিনামূল্যে নয়। মানুষ নিজেই তার মূল্য দিচ্ছে।
বিনামূল্যে টিকা দেওয়ার জন্য বাজেট বরাদ্দে ঘোষিত ৩৫,০০০ কোটি টাকার কি হল? কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প এবং ভর্তুকি খাতে ৪ লক্ষ কোটি টাকার সংস্থানের কথা ছিল বাজেটে। এত টাকা কোথায় গেল?
মোদি সরকার নিজেদের বিলাসী খরচের অভ্যাস জারী রাখার জন্যই রাজস্ব আয়ের নামে জনগণকে লুট করছে।
সিপিআই(এম)-এর কেন্দ্রীয় কমিটি এই মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে সর্বভারতীয় স্তরে শক্তিশালী প্রতিবাদ আন্দোলনের আহ্বান জানিয়েছে। দেশের প্রতিটি গ্রাম/তালুক থেকে শুরু করে শহর অবধি এই আন্দোলন পরিচালিত হবে।
কৃষকদের ঐতিহাসিক সংগ্রাম
নয়া কৃষি আইন বাতিল করতে হবে
নয়া তিন কৃষি আইনের বিরুদ্ধে এবং ন্যুনতম সহায়ক মূল্যের আইনি অধিকারের দাবীতে কৃষকদের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের প্রতি পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি অভিবাদন জানিয়েছে।
স্বাধীন ভারতবর্ষে এখনো অবধি এই লড়াই সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রাম। প্ররোচনামূলক প্রচেষ্টা সহ কৃষকদের সংগ্রামকে ব্যাহত করার যাবতীয় অপচেষ্টা সত্ত্বেও, সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার (এসকেএম) নেতৃত্বে কৃষকরা শান্তিপূর্ণভাবেই সংগ্রাম পরিচালনা করছেন।
লখিমপুর খেরিতে কৃষকদের উপরে হিংস্র আক্রমন চালিয়েও এই সংগ্রামকে ব্যাহত করতে বিজেপির কৌশল সফল হয়নি। বরং এই নৃশংস হত্যার ঘটনায় সাধারণ মানুষের মধ্যে আরও ব্যাপক ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, যার ছেলেই এই ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত, তাকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা থেকে প্রধানমন্ত্রী মোদি এখনো সরিয়ে দেননি। এমন নৃশংস ঘটনার পরেও মন্ত্রীকে পদ থেকে না সরানো থেকেই বোঝা যায় মোদী সরকার এহেন বর্বরতায় সহায়তা যোগাচ্ছে। অভিযুক্ত কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর ছেলে এবং ঘটনায় জড়িত অন্যান্যদের বিরুদ্ধে উত্তরপ্রদেশ সরকারের দায়ের করা মামলায় বিলম্ব হওয়ার সমালোচনা করেছে শীর্ষ আদালত। এই ঘটনার দ্রুত বিচারের দাবী করছে সিপিআই(এম)।
জনসাধারনের বিভিন্ন অংশ বিশেষ করে সংগঠিত ট্রেড ইউনিয়নসমূহ এবং ক্ষেত মজুরদের কাছ থেকে এই আন্দোলন যেভাবে সংহতি লাভ করেছে তাতে কৃষকদের ন্যায্য দাবির প্রতি ব্যাপক জনসমর্থনকেই প্রতিফলিত করে।
আগামী ২৬শে নভেম্বর এই সংগ্রামের প্রথম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা এবং কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলির পক্ষ থেকে প্রতিবাদ – আন্দোলনের আহ্বানে সম্পূর্ণ সংহতি এবং সমর্থন জানাচ্ছে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি। প্রতিবাদ আন্দোলনের এই আহ্বানে সিপিআই(এম) পার্টির সমস্ত ইউনিটকে সক্রিয় সমর্থন কর্মসূচী পালনের আহ্বান জানাচ্ছে।
জাতীয় সম্পদের লুট
দেশের যাবতীয় জাতীয় সম্পদ এবং পিএসইউ’গুলিতে সর্বাত্মক বেসরকারিকরণের জন্য মরিয়া চেষ্টা করছে মোদী সরকার। ন্যাশনাল মনিটাইজেশন পাইপলাইন কার্যত দেশকেই বিক্রি করে দেবার সমতুল্য। এই প্রক্রিয়ায় যাবতীয় সরকারী পরিকাঠামো সহ সম্পদ এবং যন্ত্রপাতিসমূহ বেসরকারি মালিকানা এবং কর্পোরেটদের হাতে কার্যত বিনামূল্যে তুলে দিচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকার। সম্প্রতি টাটা গোষ্ঠীকে কার্যত বিনামূল্যে এয়ার ইন্ডিয়ার মতো সংস্থাকে উপহার দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যেই রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাংকগুলিতে বেসরকারিকরণের লক্ষ্যে ব্যাংক জাতীয়করণ আইনে সংশোধনী বিল আনার কাজে কেন্দ্রীয় সরকার অনেকটাই এগিয়েছে।
এইসব ধ্বংসাত্মক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ট্রেড ইউনিয়নগুলি আন্দোলন সংগঠিত করছে। কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন ও ফেডারেশনগুলি এর প্রতিবাদে দেশব্যাপী সংগ্রাম শুরু করার উদ্যোগ নিচ্ছে।
সারা দেশজূড়ে শ্রমিক শ্রেণীর ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানাচ্ছে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি।
কোভিড মহামারী মোকাবিলা প্রসঙ্গে
কোভিড মহামারী মোকাবিলা এবং টিকাকরনের কাজে নিজেদের বিভ্রান্তিকর পদক্ষেপ ধামাচাপা দেওয়ার জন্য মোদি সরকার একশো কোটিকে টীকা দেওয়া ‘উদযাপন’ আয়োজন করে জনগনকে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছিল। অনেক দেরি করে একশো কোটি মানুষকে টীকা দেবার কাজ শেষ হলেও এই কাজ প্রশংসনীয়, যদিও দেশের জনসংখ্যার মাত্র ২১%ই সম্পূর্ণরূপে টিকা পেয়েছেন। একথা স্পষ্ট যে চলতি বছরের শেষে গোটা দেশের মোট প্রাপ্তবয়স্ক সবাইকে টিকার দুটি ডোজ দেওয়া সম্পর্কে মোদী সরকার নিজেদের পূর্বতন আশ্বাসকে ভুলিয়ে দিতে চায়, এখন জনসংখ্যার ৬০%কে টীকা দেওয়াই সরকারের লক্ষ্য। এই কাজও সম্ভব নয় যদি না প্রতিদিন ১.৫কোটি মানুষকে টিকা দেওয়া হয়। টিকা দেওয়ার হার ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে এবং বর্তমানে দৈনিক ৪০লক্ষেরও কম মানুষ টীকা পাচ্ছেন।
নতুন করে কোভিড সংক্রমণ আবার বাড়ছে, এই পরিস্থিতি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। প্রতিদিন প্রায় ১৬০০০ নতুন সংক্রমনের রিপোর্ট পাওয়া যাচ্ছে, দৈনিক মৃত্যুহার ৬৫০-এরও বেশি।
সিপিআই(এম)’র কেন্দ্রীয় কমিটি দাবী জানাচ্ছে আগামিদিনে গুরুতর স্বাস্থ্য বিপর্যয় রোধ করতে অবিলম্বে টিকাকরণের গতি ত্বরান্বিত করা হোক।
জম্মু ও কাশ্মীর
শয়ে শয়ে মানুষকে জেলে বন্দী রেখে নিজে ব্যাপক মিলিটারি পাহারা পরিবৃত হয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জম্মু ও কাশ্মীর সফর করেছেন। সংবিধানের ৩৭০ ধারা খারিজ করে এবং জম্মু – কাশ্মীর রাজ্যকে বিশেষ মর্যাদা থেকে সরিয়ে দিয়ে সেখানকার পরিস্থিতি আগের তুলনায় উন্নত হয়েছে বলে তিনি দাবী করেছেন।
জম্মু- কাশ্মীরের নাগরিকদের লক্ষ্যবস্তু করে একের পর এক হত্যার সাম্প্রতিক ঘটনাগুলি পুনরায় ৯০’এর দশকের মতো পরিস্থিতি তৈরি করেছে। এই অবস্থা উদ্বেগজনক।
জম্মু–কাশ্মীরে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে সেখানকার গণতান্ত্রিক এবং রাজনৈতিক অবস্থার পুনরুদ্ধার করা না গেলে ক্রমবর্ধমান উগ্রপন্থী হিংসার ঘটনা মোকাবিলা করা ক্রমশ আরও কঠিন হবে।
ব্যাপকহারে গ্রেপ্তারী বন্ধ করে জম্মু-কাশ্মীরে সকল রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি দিতে হবে, বিশেষ করে সেখানকার যুববয়সীদের, একইসাথে সংবাদমাধ্যমগুলির উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে পুনরায় বিশেষ রাজ্যের মর্যাদা ফিরিয়ে দেবার দাবী জানাচ্ছে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি।
ভারতের সংবিধানের ৩৭০ নং এবং ৩৫(ক) ধারা বাতিলের সাংবিধানিক বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে সিপিআই(এম) সহ সংশ্লিষ্ট সমস্ত আবেদনে সাড়া দিয়ে দেশের শীর্ষ আদালত দ্রুত বিচারের প্রক্রিয়া শুরু করুক – কেন্দ্রীয় কমিটি সেই আবেদন জানাচ্ছে।
বিদ্যুতের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে হবে
বেসরকারি কর্পোরেট-মালিকানাধীন বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী সংস্থাসমূহ একচেটিয়াভাবে আমদানিকৃত কয়লার যোগানের উপরে নির্ভর করে উৎপাদন চলায়। এইসব সংস্থাগুলি উচ্চ হারে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম বাড়াচ্ছে, এইভাবে তারা আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার দাম বৃদ্ধি জনিত খরচের বোঝা সাধারণ গ্রাহকদের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে। দেশীয় কয়লার যোগানে কোন অভাব নেই। মোদী সরকার কর্তৃক বিদ্যুৎ/জ্বালানি খাতে বেসরকারীকরণ, নিয়ন্ত্রণহীনতা এবং সম্পূর্ণ অব্যবস্থাজনিত সংকট এহেন পরিস্থিতির জন্য দায়ী। সারা দেশ ক্রমশ ভয়াবহ বিদ্যুৎ সংকটের দিকে চলেছে। সাধারণ গ্রাহকদের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন না হওয়া নিশ্চিত করণ কেন্দ্রীয় সরকারেরই দায়িত্ব। দেশের জনগণ ইতিমধ্যেই যথেষ্ট দুর্ভোগে আক্রান্ত, তার উপরে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হবার ঘটনায় তাদের দুর্দশা আরও বাড়বে। দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডেও এমন ঘটনা বিরূপ প্রভাব ফেলবে।
জাতি ভিত্তিক জনগণনা
২০২১ সালে জনগণনার সাথেই জাতি ভিত্তিক আদমশুমারিও করতে হবে – কেন্দ্রীয় কমিটি পুনরায় সেই দাবী জানাচ্ছে।
সফলভাবে জাতিভিত্তিক আদমশুমারি পরিচালনা সুনিশ্চিত করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে দেশের সংসদে প্রয়োজনীয় যাবতীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
সিপিআই(এম) –এর ২৩ তম পার্টি কংগ্রেস
কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে কেরালার কান্নুরে ২৩তম পার্টি কংগ্রেসে পেশ হতে চলা খসড়া রাজনৈতিক প্রতিবেদনের রূপরেখা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। পার্টি কংগ্রেসে রাজনৈতিক প্রতিবেদন পেশ হবার আগে কেন্দ্রীয় কমিটিতে আলোচনা এবং অনুমোদনের জন্য সেই খসড়া প্রস্তুত করবে পার্টির পলিট ব্যুরো।