কমরেড জ্যোতি বসুর ১০৯তম জন্মদিবস ছিল গতকাল, ৮ জুলাই ২০২২।
জ্যোতি বসু সেন্টার ফর সোশ্যাল স্টাডিজ অ্যান্ড রিসার্চ’র পক্ষে আয়োজিত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)র কলকাতা জেলা কমিটির দপ্তর প্রমোদ দাশগুপ্ত ভবনে জ্যোতি বসু স্মারক বক্তৃতার বিষয় ছিল ‘ভারতের স্বাধিনতাঃ ৭৫’।
এই অনুষ্ঠানে প্রধান বক্তা ছিলেন পার্টির সাধারণ সম্পাদক কমরেড সীতারাম ইয়েচুরি।
ইংরেজি, হিন্দি এবং কিছুক্ষেত্রে বাংলায় তিনি নিজের বক্তব্য পেশ করেন।
বাংলায় সেই বক্তব্যেরই একটি সংক্ষিপ্ত অনুবাদ রাজ্য ওয়েবডেস্কের তরফে প্রকাশ করা হল।
কমরেড জ্যোতি বসু সম্পর্কে স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে প্রথমেই আমার মনে একজন অনন্যসাধারণ গুণসমৃদ্ধ কমরেডের ছবি ফুটে ওঠে। এমন ভাবনার কারণ স্বাধীনতার আগে এবং পরে তিনি এবং ঐ সময়ে আমাদের পার্টি নেতৃত্বেরা একটি অসামান্য সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন। গোটা পৃথিবীর সমাজতান্ত্রিক শিবির তখন দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়েছে – একদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন আরেকদিকে সমাজতান্ত্রিক চীন। আমাদের পার্টি এহেন দুই শিবিরেরই সীমাবদ্ধতা চিহ্নিত করেছিল, তাদের অভ্যন্তরীণ মতপার্থক্যের ক্ষেত্রে চোখ বন্ধ রেখে কাউকে সমর্থনের পথে না চলে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ সম্মত স্বতন্ত্র অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। এই সাহস দেখিয়েছিলেন যারা, কমরেড জ্যোতি বসু তাদেরই অন্যতম একজন। মার্কসবাদ-লেনিনবাদের প্রতি যথার্থ দায়বদ্ধতা ব্যাতিত এমন অবস্থান গ্রহণ করা যায় না।
কোন পথে এগোবে আমাদের দেশ? স্বাধীনতার ৭৫তম বর্ষে পৌঁছে আমাদের আরেকবার স্মরণ করতে হবে ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পরেই যে প্রশ্নে গোটা দেশ উত্তাল হয়ে ওঠে তার মূল কথা ছিল এটাই। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইতে দেশের বৃহত্তম অংশের জনগণ নিজেদের নিয়োজিত করেছিলেন, একাধিক রাজনৈতিক পক্ষ নানাবিধ রাজনৈতিক লক্ষ্যের ঘোষণা করেছিল। ভবিষ্যত ভারতের চরিত্র ব্যখ্যায় যেমন মহাত্মা গান্ধী ছিলেন, তেমনই ছিলেন ভগত সিংহের মতো নেতারা, আবার মহম্মদ আলি জিন্নাহ এবং বিনায়ক দামোদর সাভারকরের মতো মানুষও ছিলেন, আরেকদিকে ছিল কমিউনিস্ট পার্টি। সবশেষে তিনটি মতামতের ভিতরে আদর্শের সংগ্রাম চলেছিল।
প্রথমটি ছিল জাতীয় কংগ্রেস অনুসৃত সামন্ত-জমিদারদের সাথে বুর্জোয়াদের সমঝোতার পথ। দ্বিতীয় মতামত ছিল ধর্মের ভিত্তিতে দ্বিজাতি তত্ত্বের পক্ষে স্বীকৃতি আদায় করার – জিন্নাহ এবং সাভারকর উভয়েই সেই প্রশ্নে একজোট ছিলেন। তৃতীয় পথটি নেয় কমিউনিস্টরা। সেই সময় কমিউনিস্ট পার্টি ঘোষণা করেছিল অর্জিত রাজনৈতিক স্বাধীনতা যদি ভবিষ্যতে প্রত্যেক ভারতীয়ের অর্থনৈতিক স্বাধীনতায় রূপান্তরিত না হয় তবে তার ফলে জনমানসে এক ভয়ানক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। এই তিন মত ও পথের সংগ্রাম আজও ভারতে বিবদমান। তখনকার মতো সেই সংগ্রাম স্বাধীন ভারতের চরিত্র নির্ধারণ করেছিল ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক এবং সাধারণতান্ত্রিক।
আমি সবাইকে অনুরোধ করব মনে রাখুন, ১৯২৫ সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ প্রতিষ্ঠার অনেক আগেই সাভারকর ব্রিটেনে থাকাকালীন ‘হিন্দুত্ব’র রাজনৈতিক কর্মসূচি প্রকাশ করেছিলেন। ভারতকে হতে হবে কেবলমাত্র তাদেরই দেশ যাদের মাতৃভূমি, কর্মভূমি এবং পুণ্যভূমি তিনটিই হল ভারত, এই ছিল সাভারকরের পরিকল্পনা। অর্থাৎ মুসলমান এবং খৃষ্টানদের নিজেদের দেশ ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেতে হবে। সাভারকর স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছিলেন ‘হিন্দুত্ব’ হল জাতিবিদ্বেষ সম্বলিত সংকীর্ণতা দীর্ণ ফ্যাসিবাদী প্রবণতায় দেশ গঠনের রাজনৈতিক লক্ষ্য, হিন্দুধর্মের সাথে এর কোন সম্পর্কই নেই। আজ বিজেপি সেই কথাই বলছে, সেই কাজই করছে। আমরা, কমিউনিস্টরা সেদিনও এমন রাজনীতির বিরোধিতা করেছিলাম, মোকাবিলা করেছিলাম – এখনও সেই সংগ্রাম জারী রয়েছে। ধর্মীয় সংকীর্ণতা দীর্ণ কর্তৃত্ববাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে কমিউনিস্টদের সংগ্রাম সক্রিয় ছিল, আছে – থাকবে।
মৌলবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়াইতে মূল সমস্যা কোথায় হল? জাতীয় কংগ্রেসের আপোষপন্থাই সেই সমস্যার কারণ। সেই আপোষ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং ঐতিহাসিক। আমরা, কমিউনিস্টরা সঠিকভাবেই বলেছিলাম রাজনৈতিক স্বাধীনতার সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতেই হবে, জনগণের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনে অবহেলা হলে অচিরেই দেশে নানবিধ সংকট উদ্ভুত হবে। আমাদের সেই কথা আজকের ভারতে একশো শতাংশ সঠিক বলে প্রমানিত হচ্ছে। একদিকে জাতিভেদের ন্যায় জঘন্য সামাজিক সমস্যাকে জিইয়ে রাখা, আরেকদিকে কর্পোরেট-সাম্প্রদায়িক শক্তির আঁতাতে সরকারী সীলমোহর জুটিয়ে নেওয়া লুঠেরা ব্যবস্থা জনজীবনকে অশেষ দুর্দশাগ্রস্থ করে তুলেছে। এই উদ্দেশ্যেই ভারতের প্রকৃত ইতিহাসকে পাল্টে দিয়ে পৌরাণিক কাহিনীকেই ইতিহাস বলে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা হচ্ছে, আমাদের দার্শনিক ঐতিহ্যকে হিন্দু ধর্মতত্ত্বে বদলে দেওয়ার চক্রান্ত চলছে। মনে রাখবেন, ১৯২১ সালে আমেদাবাদে কংগ্রেসের অধিবেশনে দুজন ব্যাক্তি একত্রে পূর্ণ স্বাধীনতার দাবী তুলেছিলেন – একজন ছিলেন স্বামী কুমারানন্দ, আরেকজন মৌলানা হসরত মোহানি। এরা দুজনেই সেই অধিবেশনে কমিউনিস্টদের প্রতিনিধি ছিলেন, ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার পক্ষে প্রথম দাবী কমিউনিস্টরাই তুলেছিল। তখন মহাত্মা গান্ধী সেই দাবী অগ্রাহ্য করলেন।
গান্ধীজীর মনে হয়েছিল পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য আমাদের দেশ তখনও প্রস্তুত নয় – এমন মনোভাবের ফল কি হয়েছিল? তার নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রতি দেশের যুবসমাজ হতাশ হল, ভগৎ সিংহেরা আলাদা হয়ে গেলেন। এই অবস্থায় জাতীয় কংগ্রেসে নিজেদের আরও ভালো করে গুছিয়ে নেওয়ার সুযোগ পেল বুর্জোয়ারা। দেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে প্রাথমিক পর্বের সংগ্রামে সামান্য কিছু ভূমিকা পালন করলেও স্বাধীন ভারতের চরিত্র হিসাবে ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতান্ত্রিকতা এবং সাধারণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হতে এরা ভয় পেল। নিজেদের সামাজিক কর্তৃত্ব বজায় রাখার উদ্দেশ্যে তারাই হাত মেলাল ভারতের সামন্তপ্রভু-জমিদারদের সাথে। যেভাবেই হোক, ভোটে জিতে ক্ষমতা ধরে রাখতে এছাড়া আর কোন রাস্তা ছিল না।
সমাজব্যবস্থার শিকড় থেকে সামন্তবাদকে উৎখাত করেই বুর্জোয়া গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হয়েছে, সারা পৃথিবীতেই সেই ইতিহাস একই। অথচ আমাদের দেশে সেই ঐতিহাসিক-সামাজিক সংগ্রামের ক্ষেত্রে এক উৎকট সমঝোতা দেখা গেল, দেশের ক্ষমতায় নিজেদের সিংহাসন বজায় রাখতেই এহেন সমঝোতা, এহেন সহযোগীর ভূমিকা পালন করতে বাধ্য হল বুর্জোয়ারা। আমার প্রজন্মে আমরা যখন পার্টির কাজে যুক্ত হয়েছি, তাদের এই বিষয়টি বুঝতে আমাদের সাহায্য করেছিলেন কমরেড জ্যোতি বসু। তারা ছিলেন আমাদের পার্টির সেই সময়কার নেতা যারা লড়াইয়ের সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে প্রথমে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ, পরে বুর্জোয়া-জমিদার শাসন এবং আরও পরে নতুন করে ‘হিন্দুত্ব’ নামের সাম্প্রদায়িক শক্তির মোকাবিলা করেছিলেন।
ভারতের বুকে বুর্জোয়া-জমিদার শাসনের ফলে এক নতুন দ্বন্দ্বের সূচনা হল। এই শাসন সমাজের বুকে চেপে বসা সামন্তবাদী সংস্কৃতিকে জিইইয়ে রেখেই পুঁজিবাদের বিকাশের পথে এগিয়েছে। এহেন পথে চলার ফলে পুঁজিবাদী বিকাশ আদৌ সম্পূর্ণ হল না, বিপরীতে সমাজের ভিতর থেকে নতুন করে সাম্প্রদায়িকতার বিপদ মাথাচাড়া দিল। এমনটা হল কারণ চলতি শাসনের ফলে জনজীবনের উপরে যেসকল উৎপীড়ন,নিপীড়ন, শোষণ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে তার মীমাংসায় সমাজচেতনার এক বিরাট অংশই প্রগতির পথে না এগিয়ে অতীতদিনের পশ্চাদপদতা আঁকড়ে ধরেছে। এই হল বুর্জোয়া-জমিদার সমঝোতার অভিশাপ। স্বাধীনতার আগে এবং পরে আমরা এই বিপদের কথাই উল্লেখ করেছিলাম। জনগণের অসন্তোষকে কাজে লাগিয়ে সমাজকে পিছনের দিকে টেনে নিয়ে যাওয়াই ফ্যাসিবাদী রাজনীতির প্রধান প্রবণতা – লাভ জিহাদ প্রতিরোধের নামে, সংবাদমাধ্যমের অধিকার হরণ করে, মানবাধিকার এবং সমাজকর্মীদের উপরে আক্রমণের ঘটনায় আজকের ভারত আসলে সেই রাজনীতিরই শিকার। বিজেপি শাসিত রাজ্যে বিশেষ আইন প্রণয়ন করে কার্যত বিবিধ অংশের মানুষকে একে অন্যের সাথে সহজ-সাধারণ মেলামেশায় বাধা দেওয়া হচ্ছে, অন্যথায় পুলিশি নিপীড়ন নামিয়ে এনে ভয় দেখানো হচ্ছে। স্বাধীনতার ৭৫ বছরে আমাদের উপলব্ধিতে এই অনুভব থাকতেই হবে, নাহলে উদ্ভুত বিপদের মোকাবিলা করা যাবে না।
এহেন রাজনৈতিক সংগ্রামের রণকৌশল কি হবে? এমন না যে এই পরিস্থিতি আচমকা তৈরি হয়েছে। এর আগেও একবার অটল বিহারি বাজপেয়ির নেতৃত্বে তেরো দিনের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারে এনডিএ জোট ক্ষমতায় এসেছিল। তখন আমরা কি করেছিলাম? এই প্রসঙ্গেই আমি কমরেড জ্যোতি বসুর ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে চাইব। তিনি আমাদের বলেছিলেন এই মুহূর্তের কর্তব্য হল প্রতিটি রাজ্যে সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী রাজনৈতিক জোটকে মজবুত করে তোলা, তাকে যাচাই করে নেওয়া। আমাদের দেশের ইতিহাসে কখনো সারা দেশে নির্বাচন পূর্ববর্তী কোন প্রগতিবাদী জোট গড়ে ওঠেনি, একথা ভুললে চলে না। আমাদের ইতিহাসের বৈশিষ্ট হল দেশের প্রতিটি রাজ্যে সাম্প্রয়ায়িকতা বিরোধী বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তিকে একজোট করে সংগ্রামের সূচনা হয়, পরে সেইসব শক্তি একসাথে কেন্দ্রের ক্ষমতায় জোট সরকার গঠন করেছে।
৭৫সালে জরুরী অবস্থার অবসানে জনতা সরকার গঠনেও আমরা সেই ভূমিকা পালন করেছিলাম, পরে বাজপেয়ির নেতৃত্বে এনডিএ সরকারকে পরাজিত করতে একই কৌশল অনুসরণ করা হয়। পশ্চিমবঙ্গে প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকার, পরে দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকার গড়ে তুলতে আমাদের ভূমিকা মনে রাখতে হবে। ১৯৭৫ সালের জরুরী অবস্থার অবসান না হলে পশ্চিমবঙ্গে ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠাই করা যেত না।
২০০৪ সালে ইউপিএ সরকারের জন্যেও নির্বাচন পরবর্তী প্রগতিশীল জোটই কার্যকরী হয়েছিল, ইতিহাসের এই শিক্ষা মনে রাখতেই হবে। কাদের অথবা কাকে সমর্থন দেওয়া হচ্ছে এই প্রশ্নের চাইতে বেশি গুরুত্বপুর্ন হল সেই নির্দিষ্ট সমর্থনের প্রেক্ষিত, সময়ের দাবীকে সঠিকভাবে চিনে নেওয়া এবং সেই অনুযায়ী সঠিক সিদ্ধান্ত কার্যকর করা। কমরেড জ্যোতি বসু এই রণকৌশল আমাদের সামনে ব্যখ্যা করেছেন, তাকে প্রয়োগ করে অতীতে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির মোকাবিলা করেছেন। কমিউনিস্ট রাজনীতির বৃত্তের বাইরেও তার ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা বিস্তৃত হয়েছিল ঠিক এই কারনেই। তিনিই ছিলেন ইউনাইটেড ফ্রন্ট তত্ত্বের রুপকার। সেই তত্ত্ব নিজের রাজনৈতিক জীবনে তিনি প্রয়োগও করেছিলেন, সফলও হয়েছিলেন।
আমরা বলছি হিন্দুত্বের মোকাবিলায় ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক শক্তির ব্যাপকতম এবং কার্যকরী ঐক্য।
এই হল স্বাধীনতার ৭৫ বছরে আমাদের সামনে রাজনৈতিক কর্তব্য। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রতিরোধ রাজনীতির এই শিক্ষা, এই ঐতিহ্যই কমরেড জ্যোতি বসুর উত্তরাধিকার। আজকের পরিস্থিতিতে আমাদের সেই উত্তরাধিকার সম্পাদনায় সফল হতেই হবে।
ওয়েবডেস্কের পক্ষে অনুবাদঃ সৌভিক ঘোষ
ছবিঃ রাজ্য সোশ্যাল মিডিয়া