“আশ্চর্য ভাতের গন্ধ রাত্রির আকাশে
কারা যেন আজও ভাত রাঁধে
ভাত বাড়ে, ভাত খায় ।
আর, আমরা সারা রাত জেগে থাকি
আশ্চর্য ভাতের গন্ধে
প্রার্থনায়, সারা রাত।”
ভাতের বদলে অন্য কোন প্রাদেশিক প্রধান খাদ্য যেমন রুটি, ইডলি,দোসা ও হতে পারত – কিন্তু চিত্রটা খুব একটা বদলায় না। ব্রিটিশ ভারতে বারবার এইভাবেই খাদ্যের আকাঙ্ক্ষায় ভারতীয়দের প্রাণ হারাতে হয়েছে। ১৭৭০(১১৭৬ বঙ্গাব্দ) এর ৭৬-এর মন্বন্তর থেকে ১৯৪৩ এর মন্বন্তর এর মাঝে আরো অনেকগুলো ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ এই উপমহাদেশে ঘটেছে। চালিশা দুর্ভিক্ষ(১৭৮৩-৮৪), দোজি বরা দুর্ভিক্ষ (১৭৯১-৯২) এবং ১৮৭৬-৭৮ এর ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ উল্লেখযোগ্য। ব্রিটিশ শাসনকালে এইসকল দুর্ভিক্ষ অন্তত ৮.৫ কোটি মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে, এটা ব্রিটিশ সরকারেরই হিসাব। তাহলে সহজেই অনুমেয় প্রকৃত সংখ্যাটা কতটা বেশি হতে পারে।
এই সব দুর্ভিক্ষের মধ্যে অন্যতম ভয়াবহ একটি হল ১৮৭৬-৭৮ সালের মহাদুর্ভিক্ষ, যা মাদ্রাজ দুর্ভিক্ষ নামেও পরিচিত, দক্ষিণ ভারতের একটি বড় অংশকে প্রভাবিত করে এবং আনুমানিক ৫৫ লক্ষ থেকে ১কোটি প্রাণ নিয়েছিল।এই দুর্ভিক্ষ ৬,৭০,০০০ বর্গ কিলোমিটার (২,৫৭,০০০ বর্গ মাইল) এলাকা জুড়ে প্রভাব বিস্তার করেছিল এবং মোট ৫.৯কোটি জনসংখ্যার জন্য দুর্ভোগ সৃষ্টি করেছিল।দাক্ষিণাত্যের মালভূমি অঞ্চলে ফসলের বিপর্যয়ের কারণ অংশত তীব্র খরা হলেও মহা দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি হয় কিন্তু, ঔপনিবেশিক সরকারের নিয়মিত শস্য রপ্তানির কারণেই। দুর্ভিক্ষের শুরুর সময়, ভাইসরয় লর্ড লিটন, ইংল্যান্ডে রেকর্ড ৩,২০,০০০টন গম রপ্তানির তত্ত্বাবধান করেছিলেন, যা এই মন্বন্তরকে আরো প্রবল করে।। মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে শুরু হলেও এর প্রভাব বম্বে প্রেসেডেন্সিতেও ছোঁয়াচে রোগের মত ছড়িয়ে পড়েছিল। এর ফলে বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক শক্তি দুর্বল হয়ে যায়। আফগানিস্থান সহ গোটা বিশ্বে ব্রিটিশ সেনা বাহিনী ও ব্রিটিশ নাগরিকদের জন্য খাদ্য রপ্তানি করতে গিয়ে সঙ্কটে পরে ভারত,অথচ এর সাথে ভারতীয়দের কোন স্বার্থই জড়িয়ে ছিল না ।ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের খেসারত দিতে হয়েছিল কোটি কোটি ভারতবাসীকে।
দুর্ভিক্ষের প্রথম দিকে, ভারতের ভাইসরয়, লর্ড লিটন, যিনি ব্যাপকভাবে সাইকোসিস এবং আফিম আসক্তিতে ভুগছিলেন বলে সন্দেহ করা হয়েছিল, লক্ষ লক্ষ ভারতীয়দের দুর্ভোগ লাঘবের জন্য প্রতিটি আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এবং সম্ভবত সবচেয়ে অমানবিক বিষয় ছিল, ভাইসরয় লর্ড লিটন, রানী ভিক্টোরিয়ার রাজ্যাভিষেকের সম্মানে দিল্লিতে ৬৮,০০০ লোকের জন্য একটি বিশাল ভোজসভার আয়োজন করেছিলেন,যা সেই সময়ের নিরিখে বিশ্বের সবথেকে এলাহী ভোজসভা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল। এই এক সপ্তাহব্যাপী মোচ্ছব চলাকালীন সময়েই মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে ১লক্ষ মানুষ না খেতে পেয়ে প্রাণ হারায়। পাশাপাশি বিকল্প অর্থকরী ফসলের চাষে বাধ্য করা, শস্যের পণ্যায়নের ঘটনাগুলি এই দুর্ভিক্ষকে বাড়াতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিল।দুর্ভিক্ষ এমন এক সময়ে ঘটেছিল যখন ঔপনিবেশিক সরকার জনকল্যাণে ব্যয় কমানোর চেষ্টা করছিল। এর আগে, ১৮৭৩-৭৪ সালের বিহারের দুর্ভিক্ষে, বার্মা থেকে চাল আমদানি করে মারাত্মক মৃত্যুর ভয়াবহতা কিছুটা এড়ানো গিয়েছিল।
যাইহোক,এই ত্রাণে “অত্যধিক ব্যয়ের” জন্য বাংলা সরকার এবং তার লেফটেন্যান্ট-গভর্নর স্যার রিচার্ড টেম্পল সমালোচিত হয়েছিল।
১৮৭৬ সালে অতিরিক্ত যেকোন নতুন অভিযোগের প্রতি সংবেদনশীল, টেম্পল, যিনি তখন ভারত সরকারের দুর্ভিক্ষ কমিশনার ছিলেন, তিনি শুধুমাত্র শস্যের বাণিজ্যের ক্ষেত্রেই নয় বরং ত্রাণের সংকোচনের উপরেও জোর দিয়েছিলেন। মানুষের জীবনের থেকে নিজের পদোন্নতির জন্য তার এই ঘৃণ্য ভূমিকা ক্ষমার অযোগ্য। এই সময় বিভিন্ন ত্রাণ শিবিরে যে পরিমাণ খাদ্য দেওয়া হত তা নাজি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প বুকুহনভ্যাল্ড(Buchenwald) এ বন্দীদের দেওয়া খাদ্যের পরিমাণের থেকেও কম! এদিকে, লিটন সারা বিশ্বের কাছে দুর্ভিক্ষ আড়াল করতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন। স্থানীয় সংবাদমাধ্যম একের পর এক সংবাদে প্রকাশ পেয়েছিল যে দুর্ভিক্ষের প্রকৃত মাত্রা আড়াল করতে অনাহারে মৃত্যুকে ইচ্ছাকৃতভাবে কলেরা বা আমাশয়ের জন্য মৃত্যু হিসাবে ভুল রিপোর্ট করা হচ্ছে।
যখন দুর্ভিক্ষ প্রচন্ড আকার ধারণ করে তখন ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদরা যুক্তি দিয়েছিলেন যে সরকারি হস্তক্ষেপ ক্ষতিকারক হবে।
একই সময়ে পুঁজিপতিদের শস্যের উপর ফাটকাবাজি করতে উৎসাহিত করা হয়েছি যার ফলে খাদ্যের দাম ভারতীয় কৃষক ও শ্রমিকদের নাগালের বাইরে চলে যায় এবং মুনাফা ফাটকাবাজদের পকেটে যায়।
কার্ল মার্কস একে “ইংরেজ মুক্ত বাণিজ্যের” জন্য “ভারতের স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম সমাজের ধ্বংস” বলে অভিহিত করেছিলেন।
গম এবং তুলার মতো রপ্তানিযোগ্য ও লাভজনক ফসল উৎপাদনের জন্য ঐতিহ্যগতভাবে গার্হস্থ্য জীবিন নির্বাহের জন্য ব্যবহৃত লক্ষ লক্ষ একর জমি জবরদখল করা হয়েছিল, যা ভারতীয়দের খাদ্য সংকটের ঝুঁকিতে ফেলেছিল।
সেই সময়ে ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ ম্যালথাসের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ তত্ত্ব (Thomas Robert Malthus, An Essay on the Principle of Population,১৭৯৮) ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী রাজনীতিবিদ ও অর্থনীতিবিদদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল, বিশেষ করে যখন তারা ভারত সহ ব্রিটিশ ও অন্যান্য ইউরোপীয় উপনিবেশগুলির মানুষের দুরবস্থার জন্য নিজেদের দায় ঝেড়ে ফেলতে চাইত। ম্যালথুসিয়ান তত্ত্ব ব্যাখ্যা করে যে দুর্ভিক্ষ, যুদ্ধ বা রোগ জনসংখ্যা হ্রাস না করা পর্যন্ত মানুষের জনসংখ্যা খাদ্য সরবরাহের চেয়ে দ্রুত বৃদ্ধি পায়।
ঠিক এই কারণেই মূলধারার আখ্যানগুলি আজ প্রায়শই দুর্ভিক্ষকে একটি “অদ্ভুত জলবায়ুজনিত ঘটনা” এবং সেই সময়ে “ভারতীয়দের অতি-প্রজননের জন্য প্রকৃতির প্রতিক্রিয়া” হিসেবে চিহ্নিত করে দায় ঝেড়ে ফেলে।
উভয়েই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের আগ্রাসী মনোভাবকে উপেক্ষা করে, যার মুক্ত-বাজার অর্থনীতির বলপূর্বক আরোপ ভারতকে ভয়াবহভাবে রূপান্তরিত করেছিল।এমনকি সাম্প্রতিক সমীক্ষা বা অমর্ত্য সেনের গবেষণালব্ধ লেখাতেও আমরা পাই যে ১৯৪৩ এর মন্বন্তর এর সময় কোন অনাবৃষ্টির পরিস্থিতিই বাংলায় ছিল না। যুদ্ধবিদ্ধস্ত ব্রিটিশ সরকারের প্রধান উইনস্টোন চার্চিল অসভ্যের মত বলেছিলেন “Indians are breeding like rabbits” । ভারতের থেকে ব্যাপক পরিমাণে চাল,গম ইউরোপে চালান করা হচ্ছিল এরফলে এদেশের খাদ্য নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়, মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে,মুজতদারি কালোবাজারি বেড়ে যায় ফলে খাদ্যের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যায়, কিন্তু চার্চিলের মন্তব্য থেকেই স্পষ্ট যে ম্যালথাসের তত্ত্ব ভারতে প্রযোজ্য কিন্তু ইউরোপে নয়। এটাই ছিল ঔপনিবেশিক মানসিকতার পরিচয়।ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজ হোক বা ব্রিটিশ রাজমুকুটের অধীনে ব্রিটিশ সরকারের রাজ, লিটন থেকে চার্চিল কেউই তাদের ঘৃণ্য মানসিকতার ঊর্দ্ধে উঠে এই দেশে শাসন করেনি, তাদের শাসনের লক্ষ্যই ছিল এই সম্পদশালী দেশকে নিঃস্ব করে দেওয়া।
তবে এই অমানবিক মানসিকতার জন্যই ভারতীয় এলিট সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্রিটিশ বিরোধীতার বীজ বপন হয়ে যায়।১৮৭৬এর মহা দুর্ভিক্ষ ভারতের ঘটনাবলীতে স্থায়ী রাজনৈতিক প্রভাব ফেলেছিল। ভারতে ব্রিটিশ প্রশাসকদের মধ্যে যারা দুর্ভিক্ষের সরকারি প্রতিক্রিয়া এবং বিশেষ করে দুর্ভিক্ষ ত্রাণের সর্বোত্তম রূপ সম্পর্কে সরকারি বিতর্কের শ্বাসরোধ করার কারণে অস্থির হয়ে পড়েছিলেন, তারা হলেন উইলিয়াম ওয়েডারবার্ন এবং এ. ও. হিউম। এই ঘটনার এক দশকেরও কম সময়ের মধ্যে , তারা ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস স্থাপন করবেন এবং ফলস্বরূপ, ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের একটি প্রজন্মকে প্রভাবিত করবেন।এই প্রজন্মের মধ্যে দাদাভাই নওরোজি এবং রমেশ চন্দ্র দত্ত ছিলেন যাদের জন্য মহাদুর্ভিক্ষ ব্রিটিশ রাজের অর্থনৈতিক সমালোচনার ভিত্তি হয়ে উঠবে।
এর পাশাপাশি দেশজুড়ে স্বদেশী আন্দোলনের সশস্ত্র ধারাও দুর্ভিক্ষের এই ভয়াবহ চেহারা দেখে প্রভাবিত হবেন এবং দেশের জন্য প্রাণ দিতে বা নিতেও পিছ পা হবেন না।দেসবাসীর মধ্যে দেশকে স্বাধীন করার একটা নতুন উৎসাহের জোয়ার তৈরি হযে যায় এই অপশাসন দেখে যার ফলস্বরূপ ১৯৪৭ এ আমরা মুক্তি লাভ করতে পারি।
ওয়েবডেস্কের পক্ষে – সরিৎ মজুমদার