সৌভিক ঘোষ
মেধাবী ছাত্র
যশোর তখনো বাংলারই অংশ, সেই জেলার রাডুলি গ্রামে রায় পরিবার সম্ভ্রান্ত বলেই পরিচিত ছিল। পিতা হরিশচন্দ্র রায় স্বভাবরুগ্ন ছেলেটিকে সাথে নিয়ে কলকাতায় চলে আসেন। ১৩২, আমহার্স্ট স্ট্রিটের ভাড়া বাড়িই হয়ে ওঠে ঠিকানা, ক্যালেন্ডারে সেই বছরটি ১৮৭০।
এর উনিশ বছর পর মোহনবাগান অ্যাথলেটিক ক্লাবের প্রতিষ্ঠা। আজকের প্রজন্মের জেনে রাখা ভালো কলকাতায় পড়তে আসা সেই ছেলেটিকে হেয়ার স্কুলের সহপাঠীরা কখনো ‘বাঙাল’, কখনো ‘যশুরে’ বলেই অভ্যর্থনা জানিয়েছিল। ঘটি পরিচয়জনিত অহমিকা শুধুই ময়দানের ব্যাপার না, এমন ভেদরুচির শিকড় আরও অনেক গভীরে।
হেয়ার স্কুলে ভর্তির কিছুদিনের মধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়ার কারণে স্কুলে যাওয়া বন্ধ হল। স্বাস্থ্যদ্ধারে গ্রামের বাড়িতে থেকেই কেটে গেল দেড় বছর। সেরে ওঠার পর কলকাতায় ফিরে কেশবচন্দ্র সেন’র অ্যালবার্ট স্কুলে পড়াশোনা শুরু। পুনরায় হেয়ার স্কুলে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলেও ততদিনে মেধাবী বলে সুপরিচিত হয়ে যাওয়ায় নতুন স্কুল তাকে ট্র্যান্সফার সার্টিফিকেট দেয়নি। ১৮৭৮ সালে সেই স্কুলের ছাত্র হিসাবেই এন্ট্রান্স পাশ করেন প্রফুল্লচন্দ্র। মাইনে কম, আবার ইংরেজি শিক্ষার সুব্যবস্থাও রয়েছে, তাই এফএ ক্লাশে ভর্তি হলেন বিদ্যাসাগরের হাতে গড়া মেট্রোপলিটন ইন্সটিটিউশনে। তখন থেকেই রসায়নের প্রতি তার গভীর আকর্ষণ জন্মায়। বিএ কোর্সে পদার্থবিদ্যা ও রসায়ন দুইই তার প্রধান বিষয় ছিল, যদিও ভবিষ্যতের জন্য রসায়নকেই বেছে নিলেন। পিতার একান্ত ইচ্ছা ছেলেকে বিলেতে পাঠানোর, কিন্তু আর্থিক সংস্থান প্রধান বাধা। গ্রামের বাড়িতে ইংরেজি শিক্ষার চল ছিল, হরিশচন্দ্র নিজেদের মেয়েদেরও ইংরেজি স্কুলে পড়িয়েছেন। মা ভূবনমোহিনীও ছিলেন মুক্তমনা মানুষ, তার প্রভাবে প্রফুল্লচন্দ্র ছোট থাকতেই কুসংস্কার, সংকীর্ণ মতামতের প্রভাব কাটিয়ে উঠেছিলেন।
পিতার মনের কথাটি বুঝতে পেরে বিএ পড়ার সময় নিজের চেষ্টায় গিলক্রাইস্ট বৃত্তি পরীক্ষার জন্যও তৈরি হলেন। এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় সেই বৃত্তি দিত। ১৮৮২ সালের পরীক্ষায় ভারত থেকে মাত্র দুজনই সফল হন, প্রফুল্লচন্দ্র তাদেরই একজন। ১৮৮৫ সালে এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএসসি, ১৮৮৭’তে সাতাশ বছর বয়সে ডক্টরেট- ডিএসসি। পিতা যতদূর কল্পনা করেছিলেন তার চাইতেও এগিয়ে গেলেন প্রফুল্লচন্দ্র রায়।
শিক্ষকতার কাজ, গবেষণার ফলাফল
এডিনবার্গে বিজ্ঞান গবেষণায় সুখ্যাতি অর্জনের পাশাপাশি ইংরেজি অসভ্যতার চোখে চোখ রেখে প্রত্যুত্তর দেওয়ার জন্যও বিশেষ পরিচিতি পান। প্রবন্ধ প্রতিযোগিতায় সিপাহী বিদ্রোহের আগে ও পরে দেশের অবস্থা প্রসঙ্গে ইংরেজ শাসনের সমালোচনায় কলম ধরেছিলেন। ইংরেজদের দেশে বসে তাদেরই শাসনের সমালোচনা লিখে পুরস্কার পাওয়া যাবে না- এটুকু বোধ তার ছিলই, তবু লিখেছিলেন। তখনো কেউ ভাবতে পারত না বিজ্ঞান সাধনায় ব্যস্ত মেধা কেমন করে ইতিহাসেও বুৎপত্তি রাখে। ১৯২৪ সালে মহাত্মা গান্ধী অসহযোগ আন্দোলনের আহবান জানালেন। প্রফুল্লচন্দ্র লিখলেন ‘সায়েন্স ক্যান অ্যাফর্ড টু ওয়েট, স্বরাজ ক্যাননট’। এইবার বোঝা গেল ইংলন্ডে থাকতে সেই প্রবন্ধ রচনাটি ছিল ঝড়ের পূর্বলক্ষণ, সেই ঝড় কখনো থেমে থাকেনি।
দেশে ফিরে প্রেসিডেন্সি কলেজে আড়াইশ টাকা বেতনের অস্থায়ী অধ্যাপক হলেন। এদেশের বহু কৃতি, মেধাবী ছাত্রই তার শিক্ষকতার ফসল। পড়ানোর পাশাপাশি চালিয়েছেন নিবিড় গবেষণা। ১৮৯৫ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজের ল্যাবরেটরিতেই আবিস্কার করেছিলেন মারকিউরাস নাইট্রাইট। সমসাময়িক বৈজ্ঞানিকদের মধ্যে এই যৌগ সম্পর্কে কোনও ধারনা ছিল না এমন নয়। কিন্তু অতি-অস্থায়ী গঠন বৈশিষ্টের জন্য সকলেই ভাবতেন একে তৈরি করা অসম্ভব। প্রফুল্লচন্দ্র তখন পারদের সাথে অ্যাসিডের প্রতিক্রিয়া পর্যালোচনা করছেন। একদিনের পরীক্ষা শেষে আচমকাই হলুদরঙের দানাদার এক অবশেষ পাওয়া গেল। এই ফলাফলকে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় সাধারণভাবে প্রাপ্ত বেসিক সল্ট ভেবে তাঁর নিজেরও প্রথমটায় ভুল হয়, পরে বুঝলেন সেই অবশেষই মারকিউরাস নাইট্রাইট।
এই আবিষ্কারের জন্যই তাকে ‘মাস্টার অফ নাইট্রাইটস’ বলা হয়।
বিজ্ঞান চর্চার সাধারণ অভ্যাসে আবিষ্কারের মর্যাদাই অন্য সবকিছুর চাইতে বেশি। ফলিত রসায়নের মত বিষয়ে গবেষণার ফলাফল সর্বদাই নতুন কিছু খুঁজে পাওয়ায় পূর্ণতা পায়। তাই অনেকেই ভাবেন প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের বিজ্ঞান সাধনার আসল কথাটি হল ঐ নাইট্রাইট খুঁজে বের করা। তাঁর লেখা আত্মচরিত পড়লে বোঝা যায় সেই আবিষ্কারকে অকস্মাৎ ঘটনা বলেই তিনি বিবেচনা করেছেন, আবিস্কারের আনন্দে অহেতুক অহংবোধে ভেসে যাননি। অতীত ভারতে বিজ্ঞান সাধনার অসামান্য ঐতিহ্য থাকা সত্ত্বেও ইতিহাসের কোন বাঁকের মুখোমুখি হয়ে আমাদের দেশ অন্ধকারে মুখ লুকোতে শুরু করল তাকেই খুঁজে বের করেছিলেন তিনি- তাই তিনি আচার্য।
বিজ্ঞানের চর্চায়, ইতিহাসের খোঁজে
১৯০২ সাল। লন্ডনের সংস্থা উইলিয়ামস অ্যান্ড নরগেট থেকে প্রকাশিত হল আ হিস্টরি অফ হিন্দু কেমিস্ট্রি’র প্রথম খণ্ড। এর সাত বছর পরে দ্বিতীয় খণ্ডটি প্রকাশিত হয়।
আজকের ভারতে এমন নামে কোনও বই প্রকাশিত হলে বিজ্ঞান মহলের উৎসাহই সবচাইতে কম হবে। হিন্দুত্বের রাজনীতি আমাদের শেখাতে চাইছে পৃথিবীর যাবতীয় বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারই নাকি প্রাচীন ভারতের কৃতিত্ব। ক্ষমতার এহেন নির্লজ্জ আস্ফালন প্রফুল্লচন্দ্র’দের দেখতে হয়নি, এমনকি ব্রিটিশ শাসনেও নয়। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে প্রফুল্লচন্দ্র রায় বাল্যকাল থেকেই কুসংস্কার, সংকীর্ণতা, কূপমণ্ডূকতার প্রভাব থেকে মুক্ত ছিলেন। তবে তাঁর লেখা বইয়ের নামে ‘হিন্দু’ শব্দটির গুরুত্ব কোথায়? আসলে ‘হিন্দু’ বলতে তিনি প্রাচীন যুগ হতে ষোড়শ শতকের মধ্যভাগ অবধি ইতিহাসের এক নির্দিষ্ট পর্বকে চিহ্নিত করেছেন- তাঁর লেখায় ব্যবহৃত ‘হিন্দু’ শব্দটি ধর্মীয় পরিচিতির পরিসর ছাপিয়ে সামাজিক ইতিহাসের চিহ্ন বহন করছে।
এ হল সেই সভ্যতা যার ঊষালগ্নে অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান ও দক্ষতার উপরে ভিত্তি করেই সামাজিক শ্রমবিভাজন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ধাতু নিষ্কাশন থেকে শুরু করে চামড়ার কাজ অবধি, অলংকার নির্মাণকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া থেকে ঘরের কাজে ব্যবহার হয় এমন মাটির পাত্রের গায়ে কাঁচের ন্যায় প্রলেপ বসিয়ে তাকে সুন্দর করে তোলা পর্যন্ত কম অথবা শ্রমসাধ্য সমস্ত কাজই একসময় আমাদের দেশে সবাই মিলে ভাগ করেই করতেন। শ্রমের চড়া অথবা কমা পরিমানের সাথে কাজে নিযুক্ত ব্যক্তির সামাজিক মর্যাদার হ্রাস-বৃদ্ধি হত না। হ্যাঁ, জাতিভেদ, বর্ণব্যবস্থার ন্যায় অন্যায্য বন্দোবস্তগুলি ভারতের চিরায়ত বৈশিস্ট নয়। ইতিহাসের এক নির্দিষ্ট পর্বে অন্যের শ্রমজাত ফলাফলে নিজেদের অধিকার, মালিকানাকে কায়েম করতেই মনুস্মৃতির মতো অযৌক্তিক ও অমানবিক নিয়মাবলীকে সামাজিক বিধি বলে চাপিয়ে দেওয়া হয়।
প্রাচীন ভারতে পারমাণবিক বোমা ছিল না, নিউক্লীয় পদার্থবিদ্যা কেউ জানত না, অতিআধুনিক শল্যচিকিৎসার ধারা হিসাবে প্লাস্টিক সার্জারির মাধ্যমে মুখের রদবদল ঘটানো যেত না ঠিকই, কিন্তু সমসাময়িক দুনিয়ায় লভ্য জ্ঞানের বিচারে গর্ব করার মতো অনেক কিছুই ছিল। অতীতের অবস্থাকে গায়ের জোরে স্বর্ণযুগ বলে ঢাক পেটালে ক্ষণিকের আত্মরতি অনুভব হতে পারে, তাতে জাতির (পড়ুন দেশের) উন্নতি হয় না- প্রফুল্লচন্দ্র রায়ে’রা এই সত্য জানতেন। তাঁরা ইতিহাসের বস্তুনিষ্ঠ আখরগুলি খুঁজেছেন। অতীতে আমরা বিজ্ঞান সাধনায় বেশ কিছুদূর এগিয়েও কেন থমকে গেলাম? কেনই বা আমাদের দেশে বিজ্ঞান চর্চার প্রসার অবরুদ্ধ হল? কেন আমাদের মতো দেশে নিউটনের মতো বিজ্ঞানীর আবির্ভাব ঘটল না? এসব নিয়ে অর্বাচীনের মতো বুক চাপড়েই হতাশাক্রান্ত রাজনীতির জন্ম হয় যা ‘অতীতে আমাদের সবই ছিল’- বলে মিথ্যা প্রচার চালায়। অমন আজগুবি ভাবনার জোরে দেশ আদৌ এগোয় না, ইতিহাসের বিজ্ঞানসম্মত বিশ্লেষণের প্রয়োজন পড়ে। সাহিত্য, দর্শন, পাটিগণিত, বীজগণিত, জ্যামিতি, ত্রিকোণমিতি এমনকি চিকিৎসাশাস্ত্রের ক্ষেত্রেও প্রাচীন ভারতের অবদান প্রসঙ্গে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা ততদিনে হয়েছিল। কিন্তু ঐ একই পর্বে এদেশে রসায়ন শাস্ত্রের বিকাশ সম্পর্কে সেভাবে কিছু লেখা হয়নি। সেই ফাঁক মেরামত করতেই বিজ্ঞানী প্রফুল্লচন্দ্র রায় ইতিহাস রচনায় কলম ধরেন।
জরুরী সব উপাদান হাতের কাছে ছিল না। প্রাচীন পুস্তক ও পুঁথির সংগ্রহে দেশের বিভিন্ন পাঠাগার এমনকি লণ্ডনের ইণ্ডিয়া অফিসের লাইব্রেরীতেও খোঁজ শুরু হল। ভাণ্ডারকর, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, এবং হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর সংস্কৃত, পুঁথি সম্পর্কিত বিবরণ পড়লেন। সংস্কৃত ভাষ্যের পাঠোদ্ধারে তাঁকে সাহায্য করতেন পণ্ডিত নবকান্ত কবিভূষণ। পুরনো পুঁথির সংগ্রহের জন্য তিনি কাশী অবধি যান। নেপাল থেকে তেঙ্গুর নামে পুঁথি সংগৃহীত হল। পুণার ডেকান কলেজ থেকেও প্রাচীন পুঁথি পাওয়া গেল।
ইতিহাসকে বিন্যস্ত করা হল চারটি পর্যায়ে।
প্রথমটি আয়ুর্বেদ পর্যায় (Vedic age or Pre-Buddhistic Era to circa 800 AD)
দ্বিতীয়, রুপান্তরের পর্যায় (800 AD to circa 1100 AD)
তৃতীয়, তন্ত্রচর্চার পর্যায় (700 AD to circa 1300 AD)
এবং চতুর্থ, রসায়নবিজ্ঞানের পর্ব (1300 AD to circa 1550 AD)
এই প্রসঙ্গে একটি কথার উল্লেখ জরুরী। বিজ্ঞানমনস্কতা ব্যাপারটা কেমন এ হল তারই উদাহরন। প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের পাতা উল্টাতে গিয়ে চরক, শ্রুশ্রুত’দের কৃতিত্ব সম্পর্কে প্রফুল্লচন্দ্র যত বেশি জেনেছিলেন ততই নিশ্চিত হয়েছিলেন সমসাময়িক যুগে রসায়নের জ্ঞানে ন্যুনতম অগ্রগতি ছাড়া চিকিৎসাশাস্ত্রের ঐ উন্নতি ঘটত না। যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গীতে বিবেচনা করেছিলেন বলেই নিজের কাজের সাফল্য সম্পর্কে অনেকটাই নিশ্চিত ছিলেন।
সেই দুরন্ত অগ্রগতি থমকে গেল কিভাবে? এখানেই প্রফুল্লচন্দ্রের বিশেষ কৃতিত্ব। তাঁর জাতিয়তাবোধে কোনও ফাঁকি ছিল না। তাই বুঝেছিলেন ইতিহাসকে নির্মোহ চোখেই যাচাই করে নিতে হবে, এই যে নির্মোহের শিক্ষা সেটিই বিজ্ঞানমনস্কতার পরিচয়। তাই ঐ প্রশ্নের উত্তরটি তিনি শুধু খুঁজে পেয়েছিলেন বললে কম বলা হয়, হাজার বছরের ইতিহাসকে বস্তুনিষ্ঠ পর্যালোচনায় পরখ করেছিলেন বলেই তিনি কার্যত ঐ উত্তরটি নির্মাণ করেছিলেন।
তিনি লিখছেন- ‘The very touch of corpse, according to Manu, is enough to bring contamination to the sacred person of Brahmin… Anatomy and Surgery fell into disuse and became to all intents and purposes lost science to the Hindus. It was considered equally undignified to sweat away at the forge line a Cyclops. …..The intellectual portion of the community being thus withdrawn from active participation in the arts, the how and why of phenomena- The condition of cause and effect-were lost light of- the spirit of enquiry died out…and India for once bade adieu to experimental and inductive sciences. Her soil was rendered morally unfit for birth of a Boyle, a Descartes or a Newton and her very name was all but expunged from the map of the scientific world.” Secondly, “the Vedanta philosophy as modified and expounded by Sankara, which teaches the unreality of the material world is also to a large extent responsible for bringing the study of physical science into disrepute.’
বিজ্ঞানমনস্কতার বদলে কুসংস্কারাচ্ছন্ন মনোভাব, বস্তুকে প্রকৃত অর্থে জানার চেষ্টায় এগোনর বদলে রহস্যের প্রতি মনোযোগী হয়ে মুর্খের স্বর্গে বসবাসের কামনা এসবই আমাদের পেছিয়ে দিয়েছে। মনুস্মৃতি, শংকরাচার্যের মায়াবাদ এগুলিই আমাদের বিজ্ঞান চর্চার অগ্রগতিকে রুদ্ধ করেছে। বর্ণাশ্রম, জাতিভেদের ন্যায় বিধিনিষেধগুলি আমাদের সমাজে স্থায়ী বন্দোবস্ত হওয়ার পর থেকেই আমরা শ্রমসাধ্য কাজকে মেধার বিপরীত কর্তব্য বলে বুঝতে শিখলাম। যাবতীয় শ্রমসাধ্য বৃত্তিই বংশানুক্রমিক পেশার পরিচয়ে আচ্ছন্ন হল, ক্রমে সেই পরিচিতি সামাজিক মর্যাদাকে কুলীন ও কামীনে ভেঙ্গে দিল। ইন্দ্রিয়াতীত বিষয়সমুহের সুক্ষ জ্ঞানের আতিশয্যে আমরা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুজগতকে অপ্রয়োজনীয় বিবেচনা করলাম। কি হয় থেকে কেমন করে হয়- অবধি পৌঁছানই হল বিজ্ঞানের স্বাভাবিক পরিণতি। যে মুহূর্তে আমরা মস্তিস্ক প্রসুত বিশুদ্ধ জ্ঞানের অনুভবে মজে গেলাম, তখনই যাচাই করে নেওয়ার তাগিদটুকু চলে গেল। যাচাই করে নেওয়ার মধ্যেই থাকে ফলিত জ্ঞানের ভ্রূণ, তা অকালে নষ্ট হল। যে ভেদপন্থা শ্রমকে ঘৃণা করতে শেখাল, সেই উপলব্ধি পরবর্তীকালে মেহনতের কাজ যারা করে তাদের প্রতি অবহেলার শিক্ষাও দিল। এসবের মিলিত প্রভাবেই আমাদের দেশে বিজ্ঞান চর্চায় পরিশ্রমকে ক্রমাগত নিরুৎসাহিত করা শুরু হয়। বস্তু থেকে সরে আসার ফলেই অজ্ঞেয়, অবস্তু অস্তিত্বের প্রতি আমাদের ভয়ানক আকর্ষণ। তাই এদেশে বিজ্ঞান সাধনা ফলিত চর্চার পথে এগোতে পারেনি, রহস্যবাদ-অজ্ঞেয়বাদের প্রভাবে ক্রমশ বস্তুবাদী চেতনা থেকে সরে এসে মেধার নামে আধ্যাত্মবাদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। ভারতের ইতিহাসে অভিশাপ বলে যদি কিছু থাকে তা আসলে এই।
কেন স্মরণ ?
বিলেতে গিয়ে কৃতি ছাত্রসুলভ পরিচিতি লাভ করেছিলেন বলে, মারকিউরাস নাইট্রাইট আবিষ্কার করেছিলেন বলে কিংবা বেঙ্গল কেমিক্যাল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বলেই আমরা প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের জন্মদিবস পালন করি এমন ভাবলে তাঁর অবদানের সবটা বোঝা যাবে না।
ধারাবাহিক ইতিহাস বিকৃতি, সাম্প্রদায়িক ঘৃণার নিরন্তর প্রচারের জোরে আমাদের দেশে আজ যে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তার গোড়ায় রয়েছে বিজ্ঞানমনস্কতার অভাব, ইতিহাসবোধের ফাঁকিবাজি। প্রফুল্লচন্দ্র রায় বড় চাকরির লোভে বিজ্ঞান পড়েননি, পুরস্কারের আশায় ইতিহাসের নামে বুজরুকি লেখেননি, মুনাফার লক্ষ্যে কারখানা প্রতিষ্ঠা করেননি- তবু ঐ সমস্ত ক্ষেত্রেই তিনি কৃতি হয়েছিলেন, সফল হয়েছিলেন।
দেশের গৌরব, জাতির উন্নতি ও জ্ঞানের চর্চা সবেতেই মূল কথা হল সত্যানুসন্ধান। বিজ্ঞানই হোক আর ইতিহাসই হোক, বস্তুনিষ্ঠ হওয়াই কর্তব্য। মনগড়া নির্মাণে সেই কাজ হয় না।
বিজ্ঞানের কৃতি শিক্ষার্থী হিসাবে দেশে ও বিদেশে পরিচিত হওয়ার অর্থ শুধুই ক্যারিয়ার না, নিরলস বিজ্ঞান সাধনা এক সচেতন জীবন চর্চাও।
মৌলিক আবিষ্কার মানেই বড় সংস্থার সাথে চড়া দামে পেটেন্টের বিনিময় না। আবিষ্কার হল মানবিক দক্ষতার, উৎকর্ষের প্রমাণ। আমাদের মতো দেশে মৌলিক আবিষ্কার সেই প্রমাণেরই আরও বড় উদাহরণ যা দেখায় দক্ষতা, উৎকর্ষ ভূগোল মানে না, চামড়ার রং মানে না- মেধার জগতে জমিদারী নেই। এখানেই ইতিহাস ও বিজ্ঞানের সংযোগ।
বেঙ্গল কেমিক্যাল শুধুই কোম্পানি না, মুনাফা লুটের কারখানা না- নিজেদের অর্থনৈতিক কাঠামোয় নিজেদেরই জোরে উৎপাদিকা শক্তির যোগান। যেন-তেন-প্রকারেণ পুঁজির পাহাড় তোলা না, আদানিরা যে হিম্মৎ জীবনেও দেখাতে পারবেন না।
প্রকৃত আচার্যের মতো প্রফুল্লচন্দ্র রায় সেই শিক্ষাকেই তার জীবন দিয়ে তুলে ধরেছেন। তাই তিনি এক মহাজীবন, আর তাই জন্মদিবসে তাঁকে স্মরণ।
তথ্যসুত্রঃ
১. আত্মচরিত, প্রফুল্লচন্দ্র রায়- দেজ পাবলিশিং, জানুয়ারি ২০১০
২. A History of Hindu Chemistry: from the Earliest Times to the Middle of the Sixteenth Century A.D., Prafulla Chandra Ray- Cosmo Publications, জানুয়ারি ২০১০
৩. India: Before and After the Mutiny, Prafulla Chandra Ray – Publications Division, M/O Information & Broadcasting, Govt. of India, January 2012
৪. Debiprasad Chattopadhyaya and his Understanding of the Science and Society in Ancient India, ARUNABHA MISRA- Marxist, October-December 2018