৬ ডিসেম্বর ২০২১ (সোমবার)
আম্বেদকার,ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাবরি ধ্বংসের ২৯ বছর।
কাকতালীয়। ৬ ই ডিসেম্বর ১৯৫৬ থেকে ৬ ই ডিসেম্বর ১৯৯২ এর ফারাক ৩৬ বছর। তবু ৬ ই ডিসেম্বর ১৯৯২ আক্রান্ত হয়েছিল ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার গৌরব, হিন্দুত্ববাদী শক্তি গুঁড়িয়ে দিয়েছিল প্রাচীন বাবরি মসজিদ। আর তার ৩৫ বছর আগে এই দিনেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন ভারতের সংবিধানের খসড়া কমিটির চেয়ারম্যান বাবাসাহেব আম্বেদকার।
৬ ই ডিসেম্বর, তাই একাধারে আম্বেদকারের মৃত্যুদিন,অন্যদিকে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের উপর প্রকাশ্য আক্রমণের কলঙ্কিত দিন। তাই সংবিধানকে রক্ষা করার লড়াইয়ে এই দিনটির গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু ২০১৯ পরবর্তী ভারতে এই দিনটির গুরুত্ব, ঐতিহাসিক কারনে তো বটেই, দেশের সর্বোচ্চ আদালতের বিতর্কিত অযোদ্ধা মামলার বিতর্কিত রায়ের প্রেক্ষিতে অন্য মাত্রা পেয়েছে।
না,আদালতের রায়ের কারনটাই সব না,অযোদ্ধা জমি মামলার রায় প্রভাব ফেলেছে ওই ২৯ বছর আগের ওই ধ্বংসাত্মক হিংসাশ্রয়ী ঘটনার উপর চলা ফৌজদারি মামলার রায়ের উপরেও। খালাস হয়ে গেছে লাল কৃষ্ণ আদবানি সহ দাঙ্গায় মদত দেওয়া, ধ্বংসে মদত দেওয়া বিজেপি নেতারা। অর্থাৎ চোখের সামনে ধ্বংস করে দেওয়া মসজিদটি কেউ ধ্বংস করেনি! আসলে প্রশ্নটা মন্দির বা মসজিদের না। প্রশ্নটা হলো একটি ঐতিহাসিক স্থান এবং একটি ধর্মস্থান রক্ষা করার ক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের দায়।
পাকিস্তানে হয় বলে ধর্মনিরপেক্ষ ভারত তার নিজের দায় কি অস্বীকার করতে পারে! প্রশ্ন সেখানেই।২০১৯ পরবর্তী সময়ে আমাদের দেশের প্রধাণমন্ত্রীর ভূমি পূজন, প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে না কি? আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের ভবিষ্যত নিয়ে???
আসলে ধর্মনিরপেক্ষতার বিরোধী যারা তারা আজ না,মন সেই সংবিধান গৃহিত হবার আগের সংবিধান প্রণেতাদের দুষ্ট করেছিলেন মনুবাদ দ্বারা প্রভাবিত না হওয়ায়।মুখে মুখে নয় একেবারে মুখপত্রে কলাম লিখে।দ্যা অর্গানাইজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল সেই লেখা।আসলে ভারতের স্বাধীনতার সাথে বিশ্বাসঘাতকতাকরা আর এস এস কখনোই চায়নি ভারত একটি সব ধর্মের মানুষের,সব বর্ণের মানুষের, সব লিঙ্গের মানুষের জন্য সমানাধিকারের মৌলিক অধিকার নিয়ে জন্ম নিক।
গান্ধিজীর হত্যা দিয়ে যে কাজের শুরু হয়েছিল,সেই কাজ প্রথম বাস্তব রূপ পেল বাবরি মসজিদ ধ্বংসের মত অসভ্য বর্বর কাজেত মাধ্যমে।সংগঠিত মৌলবাদী সন্ত্রাসে ও উল্লাসে ধ্বংস হয়েছিল বাবরি মসজিদ।আদিম বন্য গুহার অন্ধকার থেকে বেড়িয়ে এসেছিল ধর্মান্ধতার, মৌলবাদের সরীসৃপের দল।যে দেশের মাটিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ধর্মের বেশে মোহ যারে এসে ধরে…..
আসলে স্বাধীনতার লড়াই ছিল আমাদের নিজেদের জন্য নিজেদের সংবিধান রচনা করা,গ্রহণ করা ও কার্যকরী করে তোলার সংগ্রাম।ভগত সিং যেমনটা লিখেছিলেন স্বাধীন ভারতের সংবিধান সংক্রান্ত সমকালীন একটি লিফলেটকে উদ্ধৃত করে তাঁর নোট বুকে-
” ভুলো ন, হে রাজন্যবর্গ! তোমাদের কর্মাকর্মের কড়া হিসাব চাওয়া হবে এবং নবজাগ্রত জাতি তোমাদের মুদ্রাতেই তোমাদের ঋণ শোধ করবে।যারাই জাতির সঙ্গে সক্রিয় বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, পিতৃপুরুষকে অস্বীকার করেছে, দেশমাতার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করে নিজের রক্তকে কলুষিত করেছে তাদের প্রত্যেককে গুঁড়িয়ে ধুলো ও ছাই করে দেওয়া হবে।…আমাদের আন্তরিকতায় অবিশ্বাস হচ্ছে? যদি হয়, তবে ধিংড়ার নাম শুনে স্তব্ধ থকো।এই শহীদের নামে বলছি, হে ভারতীয় রাজণ্যবর্গ, কথাগুলি গভীর ভাবে, গুরুত্বসহকারে ভেবে দেখো।বেছে নাও, জাতির জনকদের মধ্যে প্রথম সারিতে বসবে,না জাতির শেষ অত্যাচারী শাসকদের মধ্যে থাকবে।”
বহু লড়াইয়ের ফসল আমাদের সংবিধান।যে সংবিধান ছাড়া আমাদের দেশের কোনো অস্তিত্ব নেই।আমাদের স্বাধীনতার কোনো মূল্য নেই।আমাদের পরিচয়ের কোনো অহংকার নেই।আমি ভারতের নাগরিক,আমার ভারতের সংবিধান আমার ভারতীয়ত্ব রচনা করেছে।লর্ডেসের মাঠে অথবা এভারেষ্টের চূড়ায় যে পতাকা দেখলে আমার দেশাত্মবোধ জেগে ওঠে তার জন্মদিয়েছে সেই দেশের আমার, আমাদের প্রিয় ভারতের। ইন্ডিয়া দ্যাট ইজ ভারত ইজ এ ইউনিয়ন অফ স্টেটস।ইন্ডিয়া বা ভারত হল রাজ্যগুলির কেন্দ্র।রাজ্য গুলি হল কেন্দ্রের জীবন কোষ।
৬ ডিসেম্বর আম্বেদকারের মৃত্যু দিন। ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলা হয়েছিল। ওই দিন বাবরি মসজিদের ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে মূরলীমনোহর যোশী,উমা ভারতী,লাল কৃষ্ণ আদবানীরা উল্লাস করে ছিলেন তার কারন যতটা না মসজিদ ভাঙা ছিল তার অনেক বেশী ছিল ভারতের সংবিধানের মর্মবস্তুতে আঘাত করার উল্লাস।
আম্বেদকারের সংবিধানে আঘাত,ধর্মনিরপেক্ষতায় আঘাত।হিন্দু হিন্দি হিন্দুস্থান বানানোর প্রচেষ্টার শুরু।তারপরেও প্রায় তিরিশ বছর কাটতে চলল।অযোদ্ধা মামলার রায় ও কেন্দ্রে বিজেপির নিরঙ্কুষ সংখ্যাগরিষ্ঠতা শুধু সংবিধানকেই আক্রমণ করেনি আঘাত হেনেছে ভারতের ধারনার মূলকেন্দ্রেই।লিবারহান কমিশনে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে জননেতা জ্যোতি বসু এই সংকটকে সংবিধানের উপর আক্রমণ বলে বর্ণনা করেছিলেন।
আসলে সংকট আমাদের সংবিধানের মূল ধারনার উপর প্রকাশ্য আক্রমনের ফলে যতটা ঠিক ততোটাই সংবিধান সম্পর্কে,সংবিধান প্রণেতাদের সম্পর্কে অস্পষ্ট ধারনা প্রবেশ করানোর মধ্যেও।সংবিধান সম্পর্কে এই অস্পষ্ট ধারনার ফলেই ভারতের সংবিধানকে সহজেউ ভারতীয় সংবিধান বলে ফেলা যায়। সহজেই ভুলে যাওয়া যায় জাতি কোনো সংবিধান বানায় নি।সংবিধান স্বাধীনতা সংগ্রামের আদর্শ নিয়ে জাতি গঠনের কথা বলেছিল।
ঠিক এই কারনেই কেউ কেউ এখনো বলবার সাহস রাখেন আসলে আমরা স্বাধীন হয়েছি ২০১৪ সালে,কেউ আবার সরাসরি ভারতের সংবিধানের “ধর্মনিরপেক্ষ” চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলতেও দ্বিধাবোধ করেন না।এক বিখ্যাত আইনবিদ বলেছিলেন Take Constitution Seriously! আম্বেদকার বলেছিলেন যতই ভালো সংবিধান হোক না কেন খারাপ লোকেদের হাতে তার প্রয়োগ খারাপই হবে,উল্টোদিকে খারাপ সংবিধানও ভালো প্রমাণিত হতে পারে যদি তা ভালো লোকেদের হাতে থাকে।হ্যাঁ,সংবিধান দেশের রাজনৈতিক দলিল তাকে বোঝা ও তার প্রয়োগ করা সম্পর্কে আমরা দেশের নাগরিকরা যদি সচেতন না হই তাহলে কোনোদিনই সাংবিধানিক লক্ষ্যে বর্ণিত জাতি গঠনের লক্ষ্যে আমরা পৌঁছাতে পারবোনা বরং নানা ছলা কলায় আমাদের সাংবিধানিক উদ্যেশ্যকে পরিকল্পিত ভাবেই প্রতিহত করা হবে পদে পদে– যা হয়েছে বাবরি মসজিদ ধ্বংসে,যা হয়েছে নাগরিকত্ব নিয়ে,যা হয়েছে কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা অবলুপ্তি করে এবং যা হচ্ছে আজ গণতন্ত্রকে, জনগনকে কর্পোরেট অধীনতার কাছে মাথা নত করানোর মধ্যদিয়ে।তবে আম্বেদকারের দেশে এটাই শেষ কথা নয়,আম্বেদকারের সংবিধান শুরু হয়েছে যে শব্দ ত্রয় দিয়ে সেই ” We the People ” এর হাতেই সংবিধানের জন্ম।”We the people” এর হাতেই সংবিধানের বিস্তৃতি -একমাত্র রাস্তায় নেমেই তাকে বাঁচাতে হয়।দেখিয়েছে কৃষক আন্দোলন।মাথা নীচু করেছে শাসক।সংবিধান জানে যে এ পথেই তার ক্রমবিকাশ হবে।ব্রিটিশ শাসনের থেকে মুক্তি শুধু উপনিবেশবাদের হাত থেকেই মুক্তি ছিলনা মুক্তি ছিল ধর্মের নামে, জাতের নামে সমাজ ভাঙার চক্রান্তের হাত থেকে মুক্তি।একটি গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র গড়ে তোলার প্রত্যয়।
ধর্মনিরপেক্ষতা জারিত হয়েছে সমান অধিকারের মধ্যে। হ্যাঁ ধর্মের না মানুষের ধর্ম বিশ্বাসের সমান অধিকারের মধ্যে।সাত খন্ডের গণপরিষদের বিতর্কের দিকে তাকালেই দেখব লড়ছেন আম্বেদকার আমাদের সকলের সমান অধিকারের জন্য।চিন্তা,বিশ্বাস ও স্বাধীনতার জন্য।না সেখানেই শেষ না লড়েছেন অনেকেই, লড়ে চলেছেন অনেকেই।তাঁদেরই একজনের কথা দিয়েই শেষ করি- তিনি জ্যোতি বসু- সংবিধানকে প্রকৃত অর্থে পিপলস ডক্যুমেন্ট বানাতে তাঁর চেষ্টা স্মরনীয় হয়ে থাকবে চিরকাল-একবার মাদ্রাজে একটি জাতীয় সেমিনারে ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে বলতে উঠে জ্যোতিবাবু বলেছিলেন – সংবিধান,ধর্মনিরপেক্ষতা এগুলি সেমিনারের বিষয় না এগুলি মানুষের বিষয়,তাই এগুলি জনগনের কাছে তুলে ধরা দরকার।আসলে জ্যোতি বসুরা আম্বেদকারের সংবিধানের সঠিক প্রয়োগ ঘটিয়েছিলেন ৬ ই ডিসেম্বর ১৯৯২ এই বাংলায় দাঙ্গা প্রতিহত করে।
আজ আবার সেই সংবিধান আক্রান্ত।শুধু গণতন্ত্র আর ধর্মনিরপেক্ষতাই না আক্রান্ত আমাদের বেঁচে থাকার অধিকার।তাকে রক্ষা করতে না পারলে আবার পরাধীন হতে হবে কিনা জানিনা তবে স্বাধীনতার যেমন ইতিহাস থাকে স্বাধীনতা হারাবারও একটা ইতিহাস থাকে। ৬ ডিসেম্বর ২০২১ আমরা যেন সে কথা ভুলে না যাই।