ডিসেম্বর ৭,২০২০ সোমবার
করবিন হেরেছেন, হারেনি তাঁর বিকল্প
পুঁজি তাঁর বিরুদ্ধে।
তিনি নিজেও সেকথা বলেছেন: ‘এস্টাব্লিশমেন্ট চায় না লেবার জিতুক। তারা চায় না এমন লেবার সরকার, যারা থাকবে মানুষের পাশে। আশার জন্য ভোট দিয়ে মানুষকেই তাই এস্টাব্লিশমেন্টে আঘাত হানতে হবে।’
স্বাভাবিক।
গত ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে জেরেমি করবিনের ইশ্তেহারের অভিমুখ ছিল ‘ফর দ্য মেনি, নট দ্য ফিউ’। অধিকাংশের জন্য, অল্প কয়েকজনের জন্য নয়।
২০১৬, ম্যাকিনসের যে প্রতিবেদন শুনিয়েছিল সঙ্কটের আট বছরে মার্কিন জনগণের ৮১ শতাংশের আয় হয় একই থেকেছে, নতুবা কমেছে, সেখানে ব্রিটেনে এই হার ছিল ৭০ শতাংশ।
পরের বছর সাধারণ নির্বাচনে করবিনের নেতৃত্বে লেবারের দুরন্ত সাফল্য। লেবার জেতে অতিরিক্ত ৩০টি আসনে। আসন সংখ্যা বেড়ে ২৬২। সঙ্গে ৪০ শতাংশের সমর্থন। একক বৃহত্তম দল হলেও সার্বিক গরিষ্ঠতা হারায় থেরিসা মে’র কনজারভেটিভ পার্টি। হারায় তেরোটি আসন। শুধু তাই নয়, প্রায় ধুয়ে মুছে সাফ উগ্র দক্ষিণপন্থী দল নাইজেল ফারাজের ইউকিপ। জিততে পারেনি একটি আসনেও। সমর্থনের হার ১২.৬ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ১.৮ শতাংশে। তাৎপর্যপূর্ণ হলো, ইউকিপের ভোট ১১ শতাংশ পড়লেও, লেবারের বাড়ে সাড়ে ৯ শতাংশ।
কেন, কীভাবে এই সাফল্য? কী বলেছিলেন করবিন তাঁর প্রচারে?
রেল, ডাক, শক্তি সংস্থাগুলির পুনর্জাতীয়করণ। ধনীদের উপর কর আরোপ, ব্যয়সংকোচের অবসান।
কর্মসংস্থান ও ট্রেড ইউনিয়নের প্রসার। ন্যূনতম মজুরি প্রতি ঘণ্টায় ১০ পাউন্ড বাড়ানো। বিশ্ববিদ্যালয়ের ফি মকুব। শ্রমজীবী জনগণের জন্য সামাজিক কর্মসূচীতে ব্যয়বরাদ্দ বৃদ্ধি এবং বেসরকারিকরণ বন্ধের কর্মসূচী। ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া-সহ অন্যত্র ব্রিটিশ ও মার্কিন আগ্রাসনের ঘোর বিরোধী করবিন।
করবিন নয়া উদারবাদের বিরোধিতা করেছেন। পুঁজিবাদের নয়। পুঁজিবাদের মধ্যেই নয়া উদারবাদের বিকল্প তুলে ধরেছেন। আর তাতেই তাক লাগিয়ে দেওয়া সাফল্য।
এরপর পুঁজি কেন চাইবে তাঁকে? কেনই বা তাঁর জন্য উতলা হবে এস্টাব্লিশমেন্ট? বরং তাঁকে নিকেশ করাই হবে পুঁজির অগ্রাধিকার।
সেনা অফিসারেরা তাঁর বিরুদ্ধে। যেমন ছিল ২০১৫ সালের ব্রিফিং, শুনিয়েছিল হুমকি: করবিন জিতলে ‘বিদ্রোহ’ হবে। তাঁদের দাবি, করবিন ‘জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি।’
২০১৯, নির্বাচনে লেবার হেরেছে। আসলে পুঁজির সঙ্গে লড়াইয়ে হেরেছে। ব্রিটেনের ১৫১ জন বিলওনেয়ারের তিনভাগের একভাগ আর্থিক সাহায্য করেছিল কনজারভেটিভ পার্টিকে। বিবিসি থেকে তাবৎ মিডিয়া ছিল তাঁর বিরুদ্ধে। একতরফা আগ্রাসন। সরকারি কর্তাদের প্রচার ছিল, লেবার নেতা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য যথেষ্ট বুড়ো। ওয়াশিংটন সরাসরি নেমেছিল করবিনের বিরুদ্ধে। মার্কিন বিদেশসচিব মাইক পম্পেও যেমন প্রকাশ্যে বলেছিলেন, করবিনের জয় ঠেকাতে কাজ করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
পরাজয়ের দায়িত্ব স্বীকার করে দলের নেতৃত্ব ছেড়েছেন কররিন। পুঁজি, এস্টাব্লিশমেন্ট তাতেও খুশি নয়। তারা চায় লেবার পার্টি থেকে তাঁর বহিষ্কার। শেষে ক’দিন আগে করবিনকে ‘সাসপেন্ড’ করেছে লেবার পার্টি। করবিন জানিয়েছেন, ‘সাসপেন্ড করার রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে লড়ে যাবেন।’
এমনই করবিন। হেরেও যিনি হারেন না। গতবছর নির্বাচনে তাঁর নেতৃত্বে লেবার হেরেছে। তিনি হারেননি। হারিয়ে যায়নি তাঁর তোলা বিকল্প।
কানাগলিতে নয়া উদারবাদ।
উগ্র দক্ষিণপন্থা পথ দেখাতে ব্যর্থ। বিকল্প আছে।
অন্যরকম ভবিষ্যৎ সম্ভব। ‘বিকল্প জরুরি’ বলাই শুধু নয়। বিকল্পের নির্দিষ্ট দিশা দেখিয়েছেন করবিন।
লেবারের নির্বাচনী ইশ্তেহার ছিল ‘আশার ইশ্তেহার’। পুঁজির শক্তি, কর্পোরেট মিডিয়ার প্রচারে সেদিন হেরেছিলেন মানুষ। কিন্তু, আশা হারেনি।
কী বলেছিলেন করবিন তাঁর প্রচারে, তাঁর ইশ্তেহারে?
বাড়তি কর আরোপ করে ‘প্রকৃত পরিবর্তনের’ জন্য ৮,৩০০ কোটি পাউন্ড তোলার কথা বলেছিল লেবার। নির্বিচারে বেসরকারিকরণের জমানায় লেবার চেয়েছিল রেল, ডাক, ব্রডব্যান্ড পরিষেবা, ৬টি বড় শক্তি সংস্থা সহ জল সরবরাহ ব্যবস্থার জাতীয়করণ।
ব্রডব্যান্ডের জাতীয়করণ বিবিসি’র ভাষায় ‘ব্রডব্যান্ড কমিউনিজম’, যা আরও বেশি মানুষকে টেনে আনবে অনলাইনে, বাড়তি খরচের দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি।
রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের বিনিময়ে ব্যয়সঙ্কোচের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তে লেবার দিয়েছিল রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রে বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি, সঙ্গে কর্মীদের ৫ শতাংশ বেতন বৃদ্ধি।
গত কয়েক বছর ধরে সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার বেপরোয়া বেসরকারিকরণের পর লেবার বলেছিল বিপুল সংখ্যায় স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগের কথা। বেসরকারিকরণের অবসান, প্রেসক্রিপশন চার্জ বাতিলের সঙ্গেই দিয়েছিল ফ্রি ডেন্টাল চেকআপের প্রতিশ্রুতি। জাতীয় স্বাস্থ্য পরিষেবায় সেই মুহূর্তে শূন্য পদের সংখ্যা ১,০০,০০০। ছিল ৪৩,০০০ নার্সের ঘাটতি। লেবার বলেছিল, স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বরাদ্দ বাড়ানো হবে ৪.৩ শতাংশ। বিনিয়োগ করা হবে ২,৬০০ কোটি পাউন্ড।
ইশ্তেহার ছিল বস্তুতই শ্রমিকমুখী। বলা হয়েছিল শ্রমিক বিরোধী আইন বাতিলের কথা। ফিরিয়ে আনা হবে যৌথ দর কষাকষির অধিকার।
সেইসঙ্গেই কর্মীদের হাতে থাকবে সংস্থার ১০ শতাংশের মালিকানা, যাতে বোর্ড-রুমে থাকতে পারে তাঁদের প্রতিনিধিত্ব। ইশ্তেহার এভাবেই কিছুটা হলেও ক্ষমতা তুলে দিতে চেয়েছিল শ্রমিকদের হাতে।
নিয়োগের প্রথম দিন থেকেই থাকবে কাজের পূর্ণ অধিকার।
ইশ্তেহার বলেছিল, শ্রমসপ্তাহ কমিয়ে করা হবে ৩০ ঘণ্টা। সপ্তাহে দু’দিন ছুটি ধরে নিলেও দিনে সাত-ঘণ্টার কম। ন্যূনতম মজুরি বাড়িয়ে করা হবে ঘণ্টায় ১০ পাউন্ড। লেবার জিতলে থাকবে কর্মসংস্থানের অধিকার নিয়ে নতুন মন্ত্রক।
লেবার বলেছিল, মকুব করা হবে ৯,০০০ পাউন্ড টিউশন ফি। চালু করা হবে সর্বজনীন বিনামূল্যে স্কুল মিল, স্কুলগুলিতে আরও বিনিয়োগ করা হবে। ইশ্তেহারে জোর দেওয়া হয়েছিল জীবনভর শিক্ষার উপর। স্কুল শেষ মানেই শিক্ষা শেষ নয়। নতুন শিক্ষা পরিষেবায় প্রত্যেকের জন্য থাকছে কিছু নির্দিষ্ট প্রস্তাব।
পুঁজির সঙ্গে লড়াইয়ে সেদিন করবিনের লেবার হেরেছিল। হারেনি আশা।
ভোটদানের প্রবণতাতেই সেই লক্ষণ ছিল স্পষ্ট:
এক) ১৮-২৪ বছর:
লেবার ৫৭ শতাংশ/ টোরি ১৯ শতাংশ
দুই) ২৫-৩৪ বছর:
লেবার ৫৫ শতাংশ/ টোরি ২৩ শতাংশ
তিন) ৩৫-৪৪ বছর:
লেবার ৪৫ শতাংশ/ টোরি ৩০ শতাংশ
চার) ৬৫ এবং তার উপরে
লেবার ১৮ শতাংশ/ টোরি ৬২ শতাংশ।
- * * * * * * * * * * * * *
ধারাবাহিক চলবে….
আগামী পর্ব : বিকল্পের লড়াইয়ে, প্রয়োগে বলিভিয়া