কৃষিবিলসমূহ এবং খাদ্য নিরাপত্তা প্রসঙ্গে প্রভাত পট্টনায়েক
মূল নিবন্ধটি দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকার ১৪ই অগাস্ট, ২০২০ সংখ্যায় প্রকাশিত
মোদী সরকার তাদের প্রস্তাবিত তিনটি নয়া কৃষি বিল অস্বাভাবিক দ্রুততায় সংসদে পেশ করেছে এবং আইন হিসাবে পাশ করিয়েছে। এই বিলসমূহের সাহায্যে সরকারের ইচ্ছা ফসল উৎপাদনকারী এবং তার ক্রেতা হিসাবে কর্পোরেটদের মাঝে যেন কেউ হস্তক্ষেপ করতে না পারে, এমনকি রাষ্ট্র বা তার প্রতিনিধি হিসাবে সরকারও নয়। সরকারের তরফে জানানো হয়েছে ফসলের বিপণনের ক্ষেত্রে সরকারি ব্যাবস্থাপনা হিসাবে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের বন্দোবস্ত যেমন ছিল তা বজায় থাকবে। সরকারের তরফে এই ঘোষণাতেই একটি কপট উদ্দেশ্যের আশংকা তৈরি হচ্ছে – যদি ন্যূনতম সহায়ক মুল্যের ব্যাবস্থা কায়েম রাখাই সরকারের ইচ্ছা হয় তবে এই বিলগুলিতে তার উল্লেখ করা হল না কেন? এছাড়াও উল্লেখ্য, ন্যূনতম সহায়ক মূল্যব্যাবস্থা যথাবিহিত কাজ করছে কিনা তা নজরদারি করতে সরকারের তরফে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যাক্তি কিষান মাণ্ডিগুলিতে কর্মরত থাকেন, যদি কিষান মান্ডিগুলিই তাদের গুরুত্ব হারায় তবে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের গোটা ব্যাপারটাই অবাস্তব হয়ে যাবে।
নয়া কৃষি আইনগুলির প্রয়োগে দেশের কৃষিব্যাবস্থায় যে পরিবর্তনগুলি ঘটবে তার মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হল, এতে শক্তিশালী বেসরকারি একচেটিয়া মালিকানার অধীনস্থ হতে দেশের কৃষিজীবীদের বাধ্য করা হবে এবং তার ফলে উৎপাদিত ফসলের বেপরোয়া জংলি ধরনের মূল্যবৃদ্ধি হবার সমূহ সম্ভাবনা তৈরি হবে। একদিকে ফসলের চাহিদা বাড়লে বাজারে চড়া দামের সুফল উৎপাদনকারী চাষিরা পাবেন না, অন্যদিকে যখন চাহিদা কমে যাবে তখন তাদের দেনার দায়ে চরম দারিদ্রের শিকার হতে হবে। দ্বিতীয় ক্ষেত্রের সংকট মোকাবিলায় ন্যুনতম সহায়ক মূল্যের যে সরকারি বন্দোবস্ত রয়েছে তাকেই নয়া কৃষি আইনের সাহায্যে বাতিল করে দেওয়া হচ্ছে।
উল্লিখিত সমস্যাগুলি ছাড়াও এই আইনগুলির ফলাফলে আরও এক সংকটের উদ্ভব হতে পারে, যদিও সেই নিয়ে প্রতিবাদের স্বর খুব বেশী নয়, তা হল দেশের খাদ্য নিরাপত্তা। আমাদের দেশে কৃষিযোগ্য জমির পরিমান সীমাবদ্ধ, আর তাই কৃষিজমির কার্যকরী ব্যবহারের প্রশ্নে সেচের ব্যাবস্থা ( যাতে জমির বহুফসলী চরিত্র গড়ে ওঠে) এবং কৃষিপদ্ধতির উন্নতিসাধন ( যার ফলে প্রতি একর জমিতে ফলন বৃদ্ধি পায়) এই দুই পথেরও বাস্তবিক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সেকারনেই অধিক ক্রয়ক্ষমতাযুক্ত পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধের চাহিদা অনুসারে দেশের কৃষিজমি ব্যবহার করতে দেবার নীতি আসলে তাদের নিজেদের প্রয়োজনের ফসল উৎপাদনের ছাড়পত্র যা কার্যত ভারতের জাতীয় খাদ্যভান্ডারে অনটন সৃষ্টি করবে।
নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যতদিন আমাদের দেশে গণবন্টন ব্যাবস্থা চালু রয়েছে ততদিন উৎপাদিত ফসলের একটি বড় অংশই সরকারি ভান্ডার সংগ্রহ করতে বাধ্য থাকে; সেইকথা মাথায় রেখেই দেশের কৃষিপণ্য উৎপাদিত হয় – এখন নয়া আইনের বলে ফসল উৎপাদনের গোটা ব্যাবস্থাটাই এধরনের কোন বাধ্যতামূলক সরকারি গনবন্টন ব্যাবস্থার দায়মুক্ত হয়ে যাবে ফলে উৎপাদনের অভিমুখ হবে মূলত বানিজ্য, দেশের জনগণের চাহিদা মেটানো নয়। এতে ভারতের কৃষিব্যাবস্থার উপরে উত্তর গোলার্ধের বাজারে চাহিদার প্রভাব দেশের জমিতে খাদ্যশস্য উৎপাদনের বদলে সেখানকার বাজারে বিক্রয়যোগ্য কৃষিজাতপণ্য উৎপাদনের উৎসাহ যোগাবে।
বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার (WTO) দোহা সম্মেলনে ঠিক এই উদ্দেশ্যেই (নিজেদের কৃষিজমিতে খাদ্যশস্য উৎপাদন কমিয়ে ফেলে) ভারতের উপরে প্রভুত চাপ তৈরি করার প্রচেষ্টা হয়েছিল, কিন্তু তৎকালীন ভারতের সরকার দেশের কৃষককূল এবং শহরে বসবাসকারী মানুষের খাদ্যশস্যের প্রয়োজনের কথা মাথায় রেখে সেই চাপের সামনে মাথা নুইয়ে দেয় নি (বর্তমান সরকারের আমলে যেমন ঘটছে) এবং সেকারনেই সেবারের দোহা সম্মেলন মীমাংসাহীন রয়ে যায়।
উন্নত দেশগুলি বহুবছর ধরেই ভারতকে খাদ্যশস্য আমদানি করতে চাপ দিয়ে আসছে, বিশেষ করে সেইসব খাদ্যশস্য যেগুলি তারা উদ্বৃত্ত উৎপাদন করে, আবার যেসব খাদ্যশস্য উৎপাদনে তারা অভাবী সেক্ষেত্রে তাদের চাপ থাকে রপ্তানি বাড়ানোয়। ভারত পঞ্চাশের দশকের শেষার্ধে এবং ষাটের দশকের শুরুর দিকে পাবলিক ল ৪৮০ ধারার ভিত্তিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে খাদ্যশস্য আমদানি করত। ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে দুবার ফসল উৎপাদনে বিপর্যয় ঘটে যার ফলে বিহারে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এই অবস্থায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বলা চলে ভারতের হাত মুচড়ে ধরে খাদ্যশস্যের রপ্তানি চালায় এবং কার্যত আমাদের অবস্থা হয় জাহাজ থেকে মানুষের মুখে খাদ্য পৌঁছানোর। ঐ অবস্থাকে খাদ্য সাম্রাজ্যবাদের একটি প্রকৃষ্ট উদাহরন বলা চলে। অবস্থা এতটাই সংকটের ছিল যে দেশের তৎকালীন খাদ্য এবং কৃষিমন্ত্রী জগজীবন রামকে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী “সবুজ বিপ্লব”-এর আয়োজন করার নির্দেশ দেন।
খাদ্যশস্য উৎপাদনের খরচ এবং তার বিনিময় মূল্যের মাঝের ব্যাবধান মেটাতে খাদ্যে ভর্তুকি, গনবন্টন ব্যাবস্থা, খাদ্যশস্য সংগ্রহের পদ্ধতি-প্রকরন এবং ন্যূনতম সহায়ক মুল্যের বন্দোবস্ত করা হয় সেই সময় থেকেই। যদিও নয়া উদারবাদী জমানায় এই সবকিছুরই ব্যাপ্তির ক্রমাবনমন ঘটেছে তবু এখনও এই বন্দোবস্তের এক বিরাট বাস্তব প্রেক্ষিত রয়ে গেছে কারন এর আগে কোনো কেন্দ্রীয় সরকার বন্দোবস্তগুলিকে বাতিল করার মতো পাগলামির পরিচয় দেয় নি। সবুজ বিপ্লব নিয়ে কারোর ব্যাক্তিগত মূল্যায়ন যাই হোক না কেন, একথা মানতেই হবে যে বিবিধ পরিবেশগত প্রভাব সত্ত্বেও সবুজ বিপ্লবের কারনেই আমাদের দেশ খাদ্য সাম্রাজ্যবাদের জোয়াল থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছে এবং খাদ্যে আত্মনির্ভরতা অর্জন করেছে যদিও এর ফলে জনগণের এক বড় অংশের মধ্যেই খাদ্যের পরিমান ও আয়ের অস্বাভাবিকতা তৈরি হয়েছে।
অতীতের শিক্ষা এই যে আর কোনভাবেই আমাদের যেন খাদ্য সাম্রাজ্যবাদের খপ্পরে না পড়তে হয়। যদিও কেউ প্রশ্ন তুলতেই পারেন আন্তর্জাতিক বাজার থেকে অন্যান্য বহুবিধ পণ্যের আমদানি করার মতো ভারতে খাদ্যই বা কেন আমদানি করা হবে না? এই একটি প্রশ্নের অনেকগুলি জবাব হয়। প্রথম কথা, বহির্বিশ্বের কথামতো তাদের প্রয়োজনের খাদ্যশস্য (যা দেশীয় ফসলের বদলী হিসাবে উৎপন্ন করা হবে আমাদের জমিতে) উৎপাদন এবং রপ্তানির যে পন্থা তাতে উৎপাদিত পণ্যের মূল্যমানের ওঠানামার এক বিরাট ঝুঁকি থেকে যায় যেমনটি বৈদেশিক মুদ্রাভান্ডারের ক্ষেত্রেও থাকে। আর তাই, কিছু বছর বাদে আমাদের দেশের হাতে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে খাদ্যপন্য আমদানি করার মতো যথেষ্ট বৈদেশিক মুদ্রার যোগান না থাকার সম্ভাবনা প্রবল।
দ্বিতীয় কথা, বিনিয়োগের বহির্গমন বেড়ে গেলেও একই অবস্থা হবে। একথা ঠিক, এই মুহূর্তে আমাদের দেশে বৈদেশিক মুদ্রা ভান্ডারে মজুত যথেষ্টই, কিন্তু সেই মজুতের উপরে চিরকালের জন্য ভরসা করা চলে না। বিনিয়োগের বহির্গমন হবে না এবং আমরা এক দীর্ঘ সময় ধরে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে খাদ্য আমদানি করতে পারব এমন প্রকল্পনার অর্থ কোটি কোটি মানুষের ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে একগোছা বিনিয়োগ সংক্রান্ত ফাটকাবাজের খেয়ালখুশির উপরে।
তৃতীয়ত, ভারতের মতো এত বড় একটি দেশ যদি আচমকাই আন্তর্জাতিক বাজার থেকে খাদ্য আমদানির পরিমান বাড়িয়ে দেয় তবে সেই বাজারে খাদ্যের দামও হঠাৎ করেই অনেকটা বেড়ে যাবে। কিছু বছর বাদে যখন আমাদের দেশে আভ্যন্তরীণ খাদ্য উৎপাদন কমবে নিশ্চিতভাবেই আমাদের অনেক অনেক বেশী দাম দিয়ে আমদানি খরচ ব্যায় করে খাদ্যের চাহিদা মেটাতে বাধ্য হতে হবে।
চতুর্থত, যদি আমাদের হাতে বিশ্ববাজার থেকে খাদ্য আমদানি করার উপযুক্ত বৈদেশিক মুদ্রাভান্ডার মজুতও থাকে তা সত্বেও যখন আমাদের রপ্তানি করা ফসলের দাম পড়ে যাবে তখন দেশের উৎপাদনকারী জনগণের আয় কমবে ফলে তাদের ক্রয়ক্ষমতাও কমবে এবং তারা আমদানি করা খাদ্যশস্য কিনতে পারবেন না। সেই অবস্থায় দেশে যথেষ্ট পরিমান আমদানিকৃত খাদ্যের মুজুত সত্বেও মানুষ অনাহারে দিন কাটাতে বাধ্য হবেন।
সবশেষে, খাদ্যভান্ডারে জরুরী অবস্থা জারি হবার সম্ভাবনার কথা বাদ দিলেও যে সম্ভাবনা থেকেই যায় তা হল, দেশের জমিতে নিজেদের প্রয়োজনে খাদ্যশস্য উৎপাদন না করে যদি বহির্বিশ্বের সাথে চুক্তিমত তাদের প্রয়োজনের ফসল ফলানো হয় তবে সেই ব্যাবস্থায় নিশ্চিতভাবেই প্রতি একরে কর্মসংস্থানের সূচক নিচে নামবে। একরের পরে একর জমিতে যদি খাদ্যশস্যের বদলী হিসাবে খাদ্য নয় এমন ফসল ফলানো চলতে থাকে তবে কৃষিকার্যের শ্রমে নিযুক্ত হয়ে রোজগারের এবং সামগ্রিকভাবে কৃষিতে কর্মসংস্থানের সুযোগ কম হতে বাধ্য। আরেকদিকে খাদ্য নয় এমন ফসল উৎপাদনের কাজে খাদ্যশস্য উৎপাদনের কাজের তুলনায় প্রতি একর জমিতে অনেক কম মজুরি দিতে হবে বলে এই কাজে পাওনা মুনাফা অর্থনীতির অন্য কোন ক্ষেত্রেও কাজের সুযোগ তৈরি করবে না, এই মুনাফা কার্যত বাইরের দেশে কর্মসংস্থান তৈরি করবে। খাদ্যশস্য উৎপাদনের বদলী হিসাবে ফুল, ফলের উৎপাদন বৃদ্ধি করা হলে আসলে যা হবে তা হলে সার্বিক কর্মসংস্থানের চিত্রে অধোগতিপ্রাপ্তি এবং জনগণের আরও বেশী দারিদ্রের কবলে চলে যাওয়াই শুধু নয় ক্রয়ক্ষমতা হ্রাসের ফলে অনাহারেও দিন কাটানো।
এই গোটা পর্বের আলোচনার নৈতিক সারাংশটি হল এই যে ভারতের মতো বিরাট দেশে খাদ্য নিরাপত্তার মানে হবে উৎপাদনের সর্বোচ্চ শিখরে নিজেকে বজায় রাখা, কোনভাবেই কৃষিজমি ব্যাবহারের বিষয়টিকে বাজারের একাধিপত্যে ছেড়ে দেওয়া যাবে না। কৃষিজমির পরিমাণ সীমাবদ্ধ বলেই অভ্যন্তরীণ খাদ্য উৎপাদন এবং কৃষিজমি ব্যাবহার সামাজিক নিয়ন্ত্রনাধীন রাখতে হবে।
সমগ্র তৃতীয় বিশ্বে কেরালা এমন একটি জায়গা যেখানে ২০০৮ সালে এমন একটি আইন প্রনয়ন করা হয়েছে যার বলে ধান জমিকে অন্য কোনো উদ্দেশ্যে ব্যাবহার বন্ধ করা যায়। যদিও ছোট রাজ্য হওয়ায় কেরালায় কৃষিজমির পরিমান এতটাই কম যে খাদ্যশস্য উৎপাদনে তারা স্বনির্ভর হতে পারেনি তবু এই আইনের ফলে ধান জমিকে যথেচ্ছভাবে নির্মাণকার্যে ব্যাবহার করা রোধ করা গেছে। দেশের অন্যান্য প্রান্তে এবং তৃতীয় বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলিতেও যদি কেরালার অনুকরনে এমন কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয় তবে তার ফল ভালই হবে।
দেশের কৃষিজমিকে খাদ্যশস্য উৎপাদনের কাজে ব্যাবহার না করে রপ্তানির উদ্দেশ্যে ফসল ফলানর কাজে ব্যাহার করতে দেওয়া হলে তার ফলাফল সম্পর্কে বুঝতে আফ্রিকার সাহারা অঞ্চলের উদাহরণটিই সর্বোৎকৃষ্ট। খাদ্যপণ্যের আমদানি উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ার পরে একের পর এক দুর্ভিক্ষ ঐ জায়গাকে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত করে দেয়। ভারতে কৃষিজমির ব্যাবহার সম্পর্কে কোন নিয়ন্ত্রক আইন না থাকলেও কৃষিকার্যের পুরানো চেহারা, ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের বন্দোবস্ত এবং গনবন্টন ব্যাবস্থা ঘুরপথে দেশের অভ্যন্তরে খাদ্যশস্য উৎপাদনের নিশ্চয়তা দেয়। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় মোদী সরকার সেই ব্যাবস্থাকে ধ্বংস করছে, একে রুখে দিতেই হবে।
মূল লেখার অনুবাদ – ওয়েবডেস্কের পক্ষে সৌভিক ঘোষ