নিরাপদ সর্দার
খেতমজুর আন্দোলন মাথা উঁচু করে বাঁচতে শেখায়।
গ্রামীন শ্রমজীবী, সর্বহারা, আধা সর্বহারা এরাই খেতমজুর।খেতে খামারে কাজ যখন কমে যায় পেটের জ্বালা মেটাতে এরাই পরিযায়ী শ্রমিক, গ্রামের ঠেলা চালক, রিকশা চালক, ছোট্ট মাছ ব্যবসায়ী, সব্জী ব্যাবসায়ী, রাজমিস্ত্রির জোগাড়ে, ইট ভাঁটার শ্রমিক, কাজের ফাঁকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের রান্নার কাজ এরাই করে।
অনিশ্চিত কাজ, নিশ্চিত জীবন গড়ে তুলতে লড়াইয়ের পথ খোঁজে এরা। কোন কাজ যখন জোটাতে পারে না তখন রাজ্যে রাজ্যে ঘুরে বেড়ায় কাজের সন্ধানে। ঐ সময় কাজ পাওয়া টা যে তার কাছে কত গুরত্ব সেটা কেউ বুঝতে পারে না। গতর বিক্রি না হলে কদিন বাড়ির বৌ বাচ্চা না খেয়ে থাকবে। শেষ মেশ কম দামে গতর বেচতে হয়,কোন উপায় থাকে না।
মজুরি আন্দোলন – দেশের অনেক রাজ্য আছে যেখানে হাজার হাজার বিঘা জমির মালিক আছে।খামার বাড়িতে ফসল তোলার ব্যবস্থা আছে। খামার বাড়ির দেওয়ালের গায় তাবু খাটিয়ে শয় শয় পরিবারের বাস। মালিকের কাজ শেষ হলে কাজের সন্ধানে অন্য মালিকের খামারে যায়। এদের বাসস্থানের স্থায়ী কোনো ব্যবস্থা নেই। যাযাবরের জীবন বেছে নিতে বাধ্য হয়। এদের মজুরি মালিক ঠিক করে দেয়। গতরের মূল্য চাইবার অধিকার নেই। মজুরি দাবি করলে খামার বাড়ির দেওয়ালের গায় তাঁবু থেকে তাকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে। বাসস্থানের একমাত্র সম্বল তাঁবু কেড়ে নিলে ছেলে মেয়েদের নিয়ে কোথায় যাবে? ফলে লেখাপড়া শেখার সুযোগ নেই।

মজুরি আন্দোলনে পশ্চিমবঙ্গ
মজুরি আন্দোলনে পশ্চিমবঙ্গ অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় একটু ভিন্ন। নারী পুরুষের সম কাজে সম মজুরির কথা বারে বারে উচ্চারিত হয়েছে। জিনিস পত্রের দাম আকাশছোঁয়া।গরীব মানুষের গতরেই একমাত্র সম্বল। কাজের কোন নিশ্চয়তা নেই ।আজ আছে তো কাল নেই। প্রতি দিন কাজ পাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। জমিতে দিন দিন কাজ কমছে। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার সাংঘাতিক ভাবে বেড়েছে। বীজতলা তৈরি করায় যন্ত্র,ধান গাড়ার জন্য যন্ত্র,ধান কাটা,ঝাড়াই, মাড়াইয়ের জন্য যন্ত্র।এ যেন যন্ত্র বনাম মানুষের গতরের প্রতিযোগিতা চলছে। জমিতে যতটা কাজ জুটতো তাও যন্ত্র ব্যাবহারের ফলে কমে গেল। জিনিসের দাম বাড়ে কিন্তু গতরের দাম বাড়ে না। সরকার যে মজুরি ঘোষণা করে সেটাও বর্তমান জিনিস পত্রের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য থাকে না। বছরের শেষে কিছু বাড়াতে হবে,তাই দু দশ টাকা বাড়িয়ে ঘোষণা করে দেয়। গতবছরের অদক্ষ শ্রমিক কৃষিতে মজুরি ছিল ৩২৩ টাকা। এবার ঘোষণা করেছে ৩৩০ টাকা। বিজ্ঞান ভিত্তিক কোন যুক্তি নেই। আট ঘণ্টা কাজ করার মতো এখন পরিস্থিতি নেই। তাপমাত্রা দিন দিন বাড়ছে, সেই তাপ প্রবাহ সরাসরি শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের শরীর গ্রহণ করছে।এরাতো খোলা আকাশের নিচে মাঠে ময়দানে কাজ করছে উপায় নেই, বিশ্রামের কোন ব্যবস্থা থাকে না। যাবে কোথায়। ফলে মানুষের শ্রমশক্তি ধীরে ধীরে কমছে। আর দিল্লিতে বসে কর্পোরেট ও মুনাফাখোর দের স্বার্থ পুরন করতে শ্রম আইন পরিবর্তন করে ১২ ঘন্টা কাজের আইন আনা হচ্ছে।এই সময়কালে গতর সর্বস্ব শ্রমজীবী মানুষের উপর এটাই সবচেয়ে বড় আক্রমণ।
পশ্চিমবঙ্গের ভৌগলিক অবস্থান অনুযায়ী পাহাড় থেকে সুন্দরবন পর্যন্ত সর্বত্রই বারোমাস ফসল হয় না। আবার আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে বৃষ্টিপাত ও বিভিন্ন জেলায় বিভিন্ন সময়ে হচ্ছে। ফলে চাষের পদ্ধতি দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। সুতরাং মজুরি আন্দোলন ও ক্রোপ ভিত্তিক গড়ে উঠছে। এ রাজ্যে চাষের সময় এবং ধান কাটার সময় মজুরি আন্দোলন সংগঠিত হতো। এখন তার কিছু পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। ধান,পাট,আলু, ভুট্টা,তামাক, সব্জী চাষের মজুরির ভিন্নতা রয়েছে।
চাষের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে গাঁয়ের খেতমজুররা চাষ ভিত্তিক আন্দোলন গড়ে তুলছে। আবার আন্দোলন গড়ে তোলার গ্রাম বাছাই করা হচ্ছে। সর্বত্রই আন্দোলন নয়,যে গ্রামে গতর কিনতে পাওয়া যায়,সেই গ্রামের গতর বিক্রেতারা বলছে এবার চাষে গতরের দাম ৫০ টাকা বেশি দিতে হবে।না দিলে কাজে যাবে না। হুগলী জেলার বহু গ্রামের শ্রমজীবী মানুষ এবার জোট বেঁধে জমিতে ধর্মঘট করেছে। প্রথম দিন চাষীরা এসে খেতমজুর দের সঙ্গে আলোচনায় বসেছে। মজুরি বৃদ্ধির জন্য আলোচনা হয়েছে,দর কষাকষি হয়েছে । সব গ্রামে সমস্যা সমাধান হলো না।পরের দিন থেকে লাগাতার ধর্মঘট চলেছে। হুগলীর ধনিয়া খালি ব্লকের মান্দারা গ্রামে ৫ দিন ,ভান্ডার হাটি গ্রামে ৫ দিন ,পান্ডুয়ার বেলমুড়ি কুনুই বাঁকা গ্রামে ৬ দিন ধর্মঘট চলেছে। এই আন্দোলনে ৩০-৫০ টাকা মজুরি বৃদ্ধি হয়েছে। এই ধর্মঘট এ শত শত মহিলাদের অংশগ্রহণ দেখা গেছে। এই আন্দোলন করতে গিয়ে বেশ কয়েক দিন কাজ বন্ধ হতে পারে তার আগাম আভাস পেয়ে নিজেদের খাবার ১০ দিনের জন্য মজুত করেছিলেন মহিলারা। বর্ধমানের ৬ টি গ্রামে ধর্মঘট চলেছে। কালনা ব্লকের মেদ গাছি গ্রামে টানা ৮ দিন ধর্মঘট এ অংশগ্রহণ করেছেন মানুষ। পশ্চিম মেদিনীপুরের শালবনি ব্লকের সারস ভেদিয়া গ্রাম এবং আসনাসুরি গ্রামে ধর্মঘট করে চাষীদের সঙ্গে আলোচনা করে ২০-৩০ টাকা মজুরি বৃদ্ধি করেছে। মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলনে মহিলাদের অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখযোগ্য। রাজ্যের সর্বত্রই ধীরে ধীরে মজুরি আন্দোলন সংগঠিত হচ্ছে।
উত্তর বঙ্গের কয়েকটি জেলার চিত্র একটু আলাদা।
সকালবেলা বিভিন্ন জায়গায় লেবার হাট বসে। লেবার হাট নামে পরিচিত। এখান থেকে চাষীরা দরদাম যাচাই করে খেতমজুর দের নিয়ে যায়। এখানে বেশিরভাগ ঠিকা প্রথা। ঠিকা বা ফুরন প্রথায় কাজ করতে গিয়ে সকাল ৬ টায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে হাটে যেতে হবে। গতর বিক্রি হলো ১৫-২০ কিমি দূরে,কাজ করে ফিরতে রাত ৯ টা।
পরের দিন আবার হাটে যেতে হবে। গতর বিক্রির জন্য প্রতিদিন হাটে যেতে হবে। না গেলে কাজ পাবে না।ফুরন প্রথায় অনেক বেশি শ্রম দিতে হয়, রোদ বৃষ্টি, বিশ্রামের কোন ব্যবস্থা নেই , অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্রায় ১৬ ঘন্টা ঘরের বাইরে থাকতে হয়। আধুনিক সভ্য সমাজে এই ব্যবস্থা সুস্বাস্থ্যের লক্ষন নয়। কৃষক খেতমজুরদের সঙ্গে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে এই প্রথা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। গ্রামের খেতমজুর দের ঐক্যবদ্ধ মজুরি আন্দোলন শ্রেনী চেতনার দিক নির্দেশ করছে।
পূনঃদখল জমির আন্দোলনে গরীবের ভূমিকা
বাম আমলে গরীব মানুষ যারা ভুমিহীন তারা জমি পেয়ছিল, পাট্টা পেয়েছিল। গরীবের হাতে জমি থাকায় উৎপাদন বাড়তে থাকে। খাদ্যে পিছিয়ে থাকা বাংলা ধীরে ধীরে চাষবাসে এগোতে থাকে। শেষমেশ ভারতের ইতিহাসে খাদ্য উৎপাদনে প্রথম পাতায় উঠে আসে। তৃনমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার পর গরীব মানুষ ধীরে ধীরে জমি হারাতে থাকে।জমি চলে যায় তৃনমূলের আশ্রিত দুষ্কৃতি দের হাতে। পাট্টা জমি গরীবদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হলো। তৃনমূলের এই অন্যায় মানতে পারছিল না গরীবরা। সারা ভারত খেতমজুর ইউনিয়নের কর্মি সমর্থক রা ধারাবাহিক ভাবে গরীবদের মাঝে জমির অধিকার নিয়ে চর্চা বাড়িয়েছে। অবশেষে মানুষ ধীরে ধীরে অন্যায়ের প্রতিবাদে এক জায়গায় হয়েছে। জোট বেঁধেছে।
শুরু হলো জমির পূনঃদখলের লড়াই। হুগলীর মূল গ্রামের পাট্টা চাষীরা জীবন বাজি রেখে স্বৈরাচারী সরকারের পুলিশের সঙ্গে লড়াই করে পুলিশ কে পিছু হটতে বাধ্য করেছে। জমি দখলে রাখল চাষীরা ই। পূর্ব বর্ধমানের বিভিন্ন গ্রামে পাট্টা জমি লুট করেছিল তৃনমূলের দুষ্কৃতকারীরা। সেই জমি পুনর্দখলের আন্দোলনে গরীব মানুষ পিছু হটে নি। জমি দখল করেছে। জমির আন্দোলনে গরীব মানুষের আবেগ সাতাত্তর কে মনে করিয়ে দেয়। জমি তে একটি আন্দোলনের স্ফূলঙ্গ তৈরী হচ্ছে।
স্থানীয় আদায়যোগ্য দাবি নিয়ে জোরদার আন্দোলন
ব্রীগেডের পরের কাজ কি হবে,তা ঘোষনা করা হয়েছিল ব্রীগেডের সমাবেশ থেকে। সেই কাজ শুরু হয়েছে। গ্রামে গ্রামে শুরু হয়েছে স্থানীয় গুরুত্বপূর্ণ দাবি গুলো চিহ্নিত করনের কাজ। তারিই একটা অংশ আছড়ে পড়ছে বিভিন্ন পঞ্চায়েত ও বিডিও অফিস গুলোতে। গরীব মানুষের ভিড় জমছে। পঞ্চায়েতের প্রধান ও ব্লকের বিডিও রা ভয় পেয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। মানুষের মুখোমুখি হতে সাহস পাচ্ছে না। কি উত্তর দেবে, মানুষ কাজ চায়,চায় বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য যার সবটাই চুরি দুর্নীতিতে মোড়া। রাস্তাঘাট, পানীয় জল, বিদ্যুৎ, স্মার্ট মিটার ইত্যাদি বিষয় নিয়ে গায়ের গরীব মানুষের আন্দোলন মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। যা আগামী দিনে ভবিষ্যতের আন্দোলন কে পুষ্ট করছে। ধীরে ধীরে সমস্ত পঞ্চায়েত ও ব্লকে অবস্থান বিক্ষোভ চলতে থাকবে।
প্রকল্প চালু হয়েছিল বামফ্রন্ট সরকারের আমলে। খেতমজুররা ১০ টাকা, সরকার ১০ টাকা মোট ২০ টাকার প্রকল্প।৬০ বছর বয়সে মাঠে ময়দানে কাজ করতে পারবে না। সুদ সহ এই টাকা ফেরত পাবে। এই প্রকল্প মমতা ব্যানার্জি তুলে দিয়ে সব টাকা আত্মসাৎ করেছে। এটা গরীবের টাকা ফেরৎ চাই। মায়েরা বলছে সব গরীব মহিলারা লক্ষী ভান্ডার পাচ্ছে না। রেশনের মাল পাচ্ছে না।ব্যায়োমেট্রিক ছাপ মিলছে না। সেই মাল কোথায়। গরীবের ঘরের টাকা নেই। খোলা আকাশের নিচে আর কতদিন। আই সি ডি এস এ খাবার কম, প্রাইমারি স্কুল বন্ধ, কল আছে জল নেই, এসব প্রশ্ন মানুষের মনে সাহস জুগিয়েছে।
রেগা প্রকল্প বাঁচার বিকল্প
১০০ দিনের কাজের আইন কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার অমান্য করে চলেছে। সারাদেশে শ্রমজীবী মানুষের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প। জনপ্রিয় করার দায়িত্ব ছিল সরকারের। সেই কাজ না করে চুরি দুর্নীতি করে রাজ্যের মানুষকে কাজ থেকে বঞ্চিত করেছে। দিল্লির তদন্তে ধরা পড়েছে। রাজ্য কে তিরস্কার করা হয়েছে। চারটি জেলায় তদন্তের রিপোর্ট কোটি কোটি টাকার তছরুপ। রাজ্যের দুর্নীতি,লুট সম্পর্কে রেগা শ্রমিকরা সচেতন ছিল। তারাই বলল টাকা লুট হচ্ছে। কাজের টাকা মাসের পর মাস মিলছে না। তদন্তে তা প্রমাণ হলো। কিন্তু এ সবই তো লোক দেখানো হলো,কোন ব্যবস্থা নেওয়া হলো না।আইন বলছে তিন মাসের মধ্যে সমস্যা মিটিয়ে কাজ শুরু করতে হবে। কিন্তু বাস্তবে উল্টো। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এর আশ্রিত দুষ্কৃতি, ও চোরেরা বহাল তবিয়তে আছে। গরীব মানুষ তিন বছরের বেশি কাজ থেকে বঞ্চিত। নরেন্দ্র মোদীর এই প্রকল্প পছন্দের না। কিন্তু বাদ দিতে পারবেন না। খেতমজুর সংগঠন গুলোর মামলা নরেন্দ্র মোদী ও মমতা ব্যানার্জির মুখে ঝামা ঘষে দিয়েছে। আসলে এঁরা দুজনেই কান কাটা। কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশ ১ লা আগস্ট ১০০ দিনের কাজ শুরু করতে হবে। এ নিয়ে মোদী ও মমতা ব্যানার্জির কোন হেলদোল নেই। ওরা ব্যাস্ত এস আই আর, হিন্দু মুসলমান বিভাজন নিয়ে। কাজ শুরু না হলে সারা রাজ্যের ব্লক গুলো ঘেরাও হবে। এর পর বিডিও রা অফিসে ঢুকতে পারবে না। আগামী ৪ঠা আগস্ট ২০২৫ খেতমজুর ইউনিয়নের কর্মীরা যাবে বিডিও র কাছে। একটা স্মারকলিপি দেওয়া হবে। ১-১৫ আগস্টের মধ্যে কাজ শুরু না হলে গ্রামের শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের ঠিকানা হবে বিডিও অফিস।
হয় কাজ দাও নাহলে ভাতা চালু করতে হবে,যত দিন না কাজ চালু হচ্ছে।
এটাই ১০০ দিনের কাজের আইন।
সরকারের অন্ততঃ সরকারী আইনটুকু মানা উচিত।