দেবব্রত ঘোষ
পশ্চিমবঙ্গে শিল্পে এগিয়ে থাকা জেলাগুলির মধ্যে হুগলী জেলা ছিল অন্যতম। ২০১১সালে তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার পর তা শ্মশানে পরিণত হয়েছে। হুগলী জেলায় দিল্লী রোডের পাশ দিয়ে যেসকল বড় বড় শেড দেখা যায় তার ১০০শতাংশই গুদামঘর যার পোশাকি নাম লজিস্টিক হাব। বাইরের রাজ্যে উৎপাদিত পন্য এখানে গুদামজাত হয়। এর আগে চিত্র ছিল অন্যরকম, হুগলী জেলার উৎপাদিত পন্য বাইরের রাজ্যে গুদামজাত হত। হাসির বিষয় নয়, মশকরার বিষয় নয়, খুবই বেদনাদায়ক যে হুগলী লোকসভা কেন্দ্রের তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী তিনি যাতায়াতের পথে শুধু কারখানার ধোয়া দেখছেন! এই মন্তব্য কি হুগলী জেলার বেকারত্বের যন্ত্রণায় দিশেহারা হওয়া যুব সমাজের কাছে অপমানজনক নয় ? হুগলী জেলার মানুষের কাছে অমর্যাদার নয় ? এরা হবেন সাংসদ ? ওর নেত্রী অবশ্য গত শনিবার বলে গেছেন ওর সাংসদ হওয়ার আসল উদ্দেশ্য হল দিদি নং-১ এ আরও বেশী গ্রামের মহিলাদের পাওয়া। গতবার ঠিক এরকম একজন সেলিব্রেটি বিজেপির টিকিতে সাংসদ হয়েছিলেন, কিন্তু বিগত ৫বছর তাকে কেউ এলাকার কোথাও দেখতে পায়নি। এত ব্যর্থ সাংসদ হুগলীতে অতীতে কখনও দেখা যায় নি। মাঝে মাঝে মিডিয়াতে প্রচারের জন্য নাটক ছাড়া অন্য কি কিছু তিনি মানুষকে দিতে পারেন নি। অন্যদিকে শাসক তৃণমূলের পঞ্চায়েত থেকে পৌরসভা চারিদিকে শুধু লুঠ আর তোলাবাজী। লুঠের কারণে হুগলীর দাপুটে তৃণমূল নেতা শান্তনু, কুন্তলরা এখন জেল খাটছে, এরকম শান্তনু, কুন্তলরা হুগলী জেলার প্রতিটি প্রান্তে রয়েছে।
এবারের হুগলী লোকসভা কেন্দ্রে বামফ্রন্ট মনোনীত এবং জাতীয় কংগ্রেস সমর্থিত সি.পি.আই.(এম) প্রার্থী পার্টির রাজ্য কমিটির সদস্য, জেলার প্রাক্তন ছাত্র নেতা মনোদীপ ঘোষ। নির্বাচনে যেমন রুটি-রুজির ইস্যু , জীবন-জীবিকার সমস্যা, দেশের বিপদ সম্পর্কে একমাত্র বাম-কংগ্রেস ইস্যু করেছে ঠিক তেমনই হুগলী কেন্দ্রে তিন প্রার্থীর মধ্যে একমাত্র মনোদীপ ঘোষই রাজনৈতিক বিষয়গুলি সে বেকারত্ব থেকে দুর্নীতি, মূল্যবৃদ্ধি সব বিষয়গুলি নিয়ে লড়াই করছেন। শুধু নির্বাচন বলে নয়, ছাত্র রাজনীতির সময় থেকেই প্রতিদিন এই লড়াই করে যাচ্ছেন। হুগলী কেন্দ্রে শিল্প কারখানা গড়ে তোলার পাশাপাশি কৃষকের সমস্যা, ফসলের ন্যায্য দাম, খেতমজুরের মজুরী বৃদ্ধির ইস্যুগুলিই তাঁর প্রচারের প্রধান বিষয় করে তুলেছেন। মানুষ তাঁর কথা শুনছেন, বাম-কংগ্রেসের প্রচারে প্রতিদিন বেশী বেশী মানুষ সমবেত হচ্ছেন। বামপন্থী প্রার্থীর জয় আটকাতে তৃণমূল ও বিজেপি বাইনারি তৈরিতে মরীয়া প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু মানুষ এবার ওদের চালাকি ধরে ফেলেছেন, ফলে এই কেন্দ্রে বাম প্রার্থীর লড়াই যত সময় যাচ্ছে, তত ধারালো আকার নিচ্ছে।
শ্রীরামপুর লোকসভা কেন্দ্রের অবস্থাও হুগলীর মত। রাজ্যের মধ্যে এগিয়ে থাকা একটি শিল্পাঞ্চল ধ্বংস হয়ে গেল। ১৫বছর ধরে এখানে একজন তৃণমূলের সাংসদ আছেন, তাঁর আমলে শ্রীরামপুর লোকসভা কেন্দ্রে একটা কারখানা হয়েছে দেখাতে পারবেন না। অথচ বহু কারখানা এখানে বন্ধ হয়ে গেছে তার রেকর্ড আমরা দেখাতে পারি। সব শুধু ধ্বংসের কাহিনী, নতুন একটা কিছু গড়ে তুলতে পেরেছেন ? না একটা স্কুল, না একটা কলেজ না একটা হাসপাতাল ? কিছুই দেখাতে পারবেন না। যা আছে সব বামফ্রন্ট সরকারের আমলের। সাংসদের নেতৃত্বে সমগ্র লোকসভা এলাকা জুড়ে চালু হয়েছে শুধু তোলাবাজী, পঞ্চায়েত প্রধান থেকে পৌর কাউন্সিলার, বিধায়করা টাকার গরমে ফুলে ফেপে ঢোল হয়ে গেছে। সাংসদরা নির্বাচিত হন শুধু রাস্তা, ঘাট নির্মাণ করা বা অ্যাম্বুলেন্স প্রদান করার জন্য নয়, তাদের প্রধান কাজ হল শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান সহ এলাকার মৌলিক সমস্যার সমাধান করা এবং দেশের নীতি নির্ধারণে প্রধান ভূমিকা পালন করা। এক্ষেত্রে শ্রীরামপুরের তৃণমূল সাংসদ ভূমিকা পালন তো দুরের কথা, বরং বিজেপি সরকারের এই সময়কালে সমস্ত জনবিরোধী বিল পাশ হওয়ার সময় কখনও ভোটদানে বিরত থেকে কখনও সংসদে অনুপস্থিত থেকে সাহায্য করেছেন। উনি জনপ্রতিনিধি কিন্তু জনগণের সাথে উনি দেখা করতে পারেন না, শুধু বসন্তের কোকিলের মত ভোটের সময় দেখা যায়, তারপর উধাও। বিজেপি প্রার্থীর সাথে তাঁর গোপন বোঝাপড়ার কথা নানান ভাবে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার হচ্ছে। এর সত্যতা যাচাই না করলেও সারা রাজ্য জুড়ে বিজেপি এবং তৃণমূলের মধ্যে যে বোঝাপড়া আছে সেভাবেই ওরা বিভিন্ন আসনের নির্বাচনী কৌশল ঠিক করেছে এটা বলা যায়। তবে কোনো কৌশলই এবার শ্রীরামপুরে কাজ করবে না।
সমগ্র শ্রীরামপুর জুড়ে আওয়াজ উঠেছে পরিবর্তন চাই। বামফ্রন্ট মনোনীত এবং জাতীয় কংগ্রেস সমর্থিত শ্রীরামপুরে এবার সি.পি.আই(এম) প্রার্থী কৃতি ছাত্রী, ছাত্র আন্দোলনের সর্বভারতীয় নেত্রী দীপ্সিতা ধর। দিল্লীর জে.এন.ইউ.-এর শুধু নেত্রী নয়, বর্তমানে সাড়া দেশে ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী। ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ে আর.এস.এস.-বিজেপির বিরুদ্ধে সাহসী লড়াই করেছেন, জিতেছেন, মিথ্যা মামলা এবং আক্রমণের শিকার হয়েছেন। প্রতিদিন তিনি তার প্রচার ধারার মধ্যে দিয়ে বিপুল মানুষকে কাছে টেনে নিচ্ছেন। যাদের দূরবীন দিয়ে দেখতে হত, তাদেরকে এখন ভীষণ ভয়ে পেয়ে তৃণমূলের প্রার্থী থেকে কর্মীরা পর্যন্ত পার্টির বিরুদ্ধে শুধু কুৎসা করে যাচ্ছে, আর যত কুৎসা করছে তত তৃণমূলের পায়ের তলার মাটি সরে যাচ্ছে।
২০১১সালের পর রাজ্যে তৃণমূল কগ্রেসের ব্যাপক সন্ত্রাস তৃণমূল এবং পুলিশ প্রশাসনের যৌথ অভিযানে রাজ্যে যে কয়টি কেন্দ্র ছিল অত্যাচারের শীর্ষে তার মধ্যে আরামবাগ লোকসভা কেন্দ্র অন্যতম।
শতশত বামপন্থী কর্মীদের ঘরছাড়া করা, হাজার হাজার মিথ্যা মামলা, জেল, জরিমানা, খুন, পার্টি অফিস দখল করে নেওয়া- কোনো কিছুই বাকী ছিল না। কিন্তু এত অত্যাচারের পরেও একজন পার্টি নেতাও ওদের কাছে আত্মসমর্পণ করে নি। ভোট তো দুরের কথা, দীর্ঘ সময় পার্টি মিটিং, মিছিল একটা বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে নিষিদ্ধ ছিল। তিল তিল করে আমাদের পার্টি ওখানে আবার নিজেদেরকে সোজা করে দাড় করাতে পেরেছে। প্রায় সব পার্টি অফিস দখল মুক্ত করা গেছে। বর্তমানে এই লোকসভা এলাকায় এমন একটি বুথ নেই যেখানে আমরা কাজ করতে পারছি না।
সর্বশেষ পঞ্চায়েত নির্বাচনে প্রায় ৮০শতাংশ প্রার্থী নিয়ে লড়াই হয়েছে। এবারের লোকসভা নির্বাচনে সমগ্র আরামবাগ জুড়ে আমাদের পার্টি কর্মীরা ঝাপিয়ে পরেছেন। এখানে বিগত ১৫বছর যিনি তৃণমূলের সাংসদ ছিলেন তিনিও এই এলাকার মূল ইস্যুগুলি যেমন কৃষকের সমস্যা, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, কোনো কিছু করেন নি। একই রকম ভাবে রাজ্যের সাথে হুগলী জেলাতেও সর্বত্র কাজের হাহাকার – এই মূল সমস্যাকে তিনি উপেক্ষা করে গেছেন। আরামবাগের ক্ষেত্রে এই কথাটা বেশী প্রযোজ্য একারণেই যে, জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশী পরিযায়ী শ্রমিক আছেন এই এলাকায়। প্রতিদিন সংখ্যা বাড়ছে্, এক একটা গ্রাম পুরুষ শূন্য হয়ে যাচ্ছে। এখানকার সাংসদ বিগত ১৫বছর শুধু নিজের এবং নিজের দলের লোকেদের আখের গোছানোর কাজেই ব্যস্ত ছিলেন। বিগত ২০২১সালের বিধানসভা নির্বাচনে এই লোকসভা কেন্দ্রে চার জন বিজেপি বিধায়ক হয়েছেন। এই তিন বছরে এই চার জন বিধায়কের কোনো কাজ মানুষ দেখতে পাননি। এরা মানুষের কোনো সমস্যাতেও নেই, বিপদে আপদেও নেই। এদের বিপরীতে বামফ্রন্ট মনোনীত এবং জাতীয় কংগ্রেস সমর্থিত সি.পি.আই(এম) প্রার্থী, জেলার শিক্ষক আন্দোলনের নেতা বিপ্লব কুমার মৈত্র। সন্ত্রাসের সময় তিনিও অত্যাচার থেকে বাদ যান নি, সাতটি মিথ্যা মামলা চলছে। তরুণ এই প্রার্থী ইতিমধ্যেই প্রচারে নজর কেড়েছেন, পার্টি কর্মীরাও জানকবুল লড়াই করছেন। লড়াই আরামবাগেও জমে গেছে।
হুগলী জেলায় তিনটি কেন্দ্র শ্রীরামপুর, হুগলী এবং আরামবাগ বামফ্রন্ট এবং জাতীয় কংগ্রেস ঐক্যবদ্ধ ভাবে লড়াই করছে, মিছিল-মিটিং-এ মানুষের সংখ্যা বিপুল আকার নিচ্ছে। সব অংশের মধ্যেই এই ঘটনা লক্ষ্য করা গেলেও সবচেয়ে বেশী এবার তরুণ প্রজন্মের ভোটারদের আকর্ষণ, সরাসরি অংশগ্রহণ ঘটছে।
সি.পি.আই(এম) নেতৃত্ব থেকে কর্মীরা শুধু বিজেপি-তৃণমূলের নেতিবাচক বিষয়কে নিয়ে মানুষের কাছে যাচ্ছেন না, দেশকে আর.এস.এস.-বিজেপির হাত থেকে রক্ষা করতে বিকল্প ধর্মনিরপেক্ষ সরকার গড়ে তুলে তার প্রধান কর্মসূচি কি হবে যা পার্টি এবং রাজ্য বামফ্রন্টের ইশতেহারে বলা হয়েছে সেইসব ইতিবাচক বিষয়গুলিই প্রচারে প্রাধান্য দিচ্ছেন, মানুষের কাছে গিয়ে বলছেন।
মিলছে দারুন সাড়া, যা গত কয়েকটি নির্বাচনে দেখা যায় নি, তাই এখন প্রধান কাজ হল ভোটের দিন বুথকে রক্ষা করা, মানুষ যাতে অবাধে ভোট দিতে পারে তার ব্যবস্থা করা। এটাই এখন একমাত্র অগ্রাধিকার। সেই কাজেই এখন পার্টি কর্মীরা মনোনিবেশ করেছেন। মাটি কামড়ে থেকে বুথকে রক্ষা করার সবরকম প্রস্তুতি চূড়ান্ত হয়েছে।
এই নির্বাচন শুধু লড়াই করার জন্য নয়, জানকবুল লড়াই করে জয়কে ছিনিয়ে আনার নির্বাচন।
সেটাই চ্যালেঞ্জ।