ওয়েবডেস্ক প্রতিবেদন
বাবরি মসজিদ এবং রাম জন্মভূমি সম্পর্কিত বিতর্ক প্রসঙ্গে সুপ্রিমকোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চের ঐক্যমতের ভিত্তিতে ঘোষিত রায়ের ফলে বিতর্কের অবসান হওয়ার বদলে নতুন করে আরো অনেক প্রশ্ন মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। যে জমিতে বাবরি মসজিদের কাঠামো ছিল সেখানেই মন্দির গড়ে তোলার নির্দেশ দেওয়া হলেও সংশ্লিষ্ট রায় ঘোষণার ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে কিছু একপেশে ঐতিহাসিক তথ্য প্রমাণ ও এক নির্দিষ্ট মতের আস্থা। যদিও দীর্ঘকাল পুরাতাত্বিক এবং মধ্য যুগের ভারতের ইতিহাস সম্পর্কে বিশেষভাবে গবেষণা চালিয়ে যাওয়া ঐতিহাসিকরা এই রায়ের ভিত্তি এবং সিদ্ধান্ত সম্পর্কে সমালোচনা করেছেন। ২০১০ সালে এই বিতর্ক সম্পর্কে এলাহাবাদ হাই কোর্টের লখনৌ বেঞ্চ যখন আর্কিয়োলোজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার মতামতের উপরে ভিত্তি করে নির্দেশনামা জারী করে তখন আলীগড় ইতিহাস সংসদের তরফে ASI (Archiological Society of India) এর সেই মতামতের খণ্ডন করা হয়। এই ইতিহাস সংসদের উদ্দেশ্য হল ইতিহাস চর্চায় যাবতীয় উৎকট দেশপ্রেমের সংশ্রব দূরে রেখে দেশে বিজ্ঞানসম্মত ইতিহাস চেতনার প্রসার ঘটানো। অধ্যাপক ইরফান হাবিব সেই বছর আলীগড় ইতিহাস সংসদের সভাপতি ছিলেন। তিনি আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের ইমেরিটাস অধ্যাপক এবং ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ হিস্টরিকাল রিসার্চ এর প্রাক্তন চেয়ারম্যান। পুরাতাত্ত্বিক এবং মধ্যযুগের ভারতের ইতিহাস নিয়ে তার লেখা একাধিক বই এবং বিশিষ্ট প্রকরণগ্রন্থ রয়েছে। এইসব গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো পুরাতাত্ত্বিক যুগের ভারতের ইতিহাসের মানচিত্রাবলী (ফইজ হাবিবের সাথে যৌথভাবে লিখিত) , কিংবা মধ্যযুগে ভারতীয় সভ্যতার ইতিহাস, মুঘল যুগের ভারতে কৃষি ব্যবস্থা, মুঘল সাম্রাজ্যের মানচিত্রসহ এক মার্কসীয় উপলব্ধি সম্পর্কিত প্রবন্ধাবলী।
ফ্রন্টলাইন পত্রিকার তরফ থেকে সুপ্রিম কোর্টের রায় সম্পর্কে অধ্যাপক ইরফান হাবিব এর সঙ্গে কথা বলা হয়। এই প্রসঙ্গে তিনি তার মতামত জানান এবং কেন এই রায়কে তিনি ত্রুটিপূর্ণ মনে করেন তা ব্যক্ত করেন। সেই কথোপকথনে তিনি যা বলেছেন তার সারাংশ এখানে তুলে ধরা হলো।
সুপ্রিম কোর্টের রায় সম্পর্কে আপনার কী মতামত? ১৯৪৯ সালের অশুভ কর্মকাণ্ড এবং ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদের বেআইনি ধ্বংসকার্যের স্বীকৃতি দেওয়া সত্ত্বেও যেভাবে এই আয়াত দ্বারা দুপক্ষের মধ্যে মীমাংসার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে তা যথেষ্ট ন্যায় হিসাবে প্রতিভাত হচ্ছে না।
বাবরি মসজিদের ইমারতটি কে যেভাবে ধ্বংস করা হয়েছিল তা যে শুধুমাত্র মুসলমানদের বিরুদ্ধেই এক অপরাধ ছিল তা নয় বরং একে গোটা দেশের বিরুদ্ধে এক অপরাধমূলক কাজ হিসেবে দেখতে হবে। ১৬২৮ সালে গড়ে ওঠা এই ইমারতটি ছিল শার্কি – মুঘল স্থাপত্যের একটি উৎকৃষ্ট নিদর্শন, যে কোনো সভ্য দেশেই এ ধরনের একটি স্থাপত্য কে সম্পূর্ণ সুরক্ষা ব্যবস্থা সমেত সংরক্ষণ করে রাখা হয়, অথচ এদেশে এ ধরনের একটি ইমারত কে যথেচ্ছাপূর্বক ধ্বংস করা হয়েছিল। ধ্বংস করার গোটা প্রক্রিয়াকে দুদিন ধরে চলতে দেওয়া হল, এবং এই কাজে দোষীদের একজনের ও শাস্তির ব্যবস্থা হলো না। যা সবচেয়ে দুঃখের তা হল ১৯৯২ সালে মসজিদ ধ্বংস করার ফলেই আজ দেশের সুপ্রিমকোর্টের পক্ষে বিবেকবর্জিত অবস্থান নিয়ে এরকম একটি রায় ঘোষণা করা সম্ভব হল। ১৫২৮ পূর্ব স্থাপত্যের যে সমস্ত সন্দেহজনক পুরাতাত্বীক নিদর্শনের (আদালতে সাক্ষ্য প্রমাণ হিসাবে পেশ করা নিদর্শনগুলোর ক্ষেত্রে এমন দাবীই জানানো হয়) উপর ভিত্তি করে রায় ঘোষণা করা সম্ভব হল তার কারণ মসজিদ ধ্বংস না করা গেলে মাটি খনন করে এইসব নিদর্শন যোগাড় করা যাচ্ছিল না। গুন্ডামি এবং সাম্প্রদায়িক শক্তির সামনে রাষ্ট্রের আত্মসমর্পণ করার যে নিদর্শন তৈরি করা হলো তার কোনদিনই কোন ক্ষতিপূরণ সম্ভব হবে না।
জমির স্বত্বাধিকার সংক্রান্ত বিতর্ককে সরিয়ে দেখে বৃহত্তর পরিসরে বা নির্দিষ্ট করে বললে একাডেমিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এই রায়ের প্রভাবকে কিভাবে বিচার করা হবে? ইতিহাস ও পুরাতত্ত্বের মত বিষয়ের সাথে তুলনামূলক বিচারে এই রায় কতদূর ন্যায্য?
সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা কেউই ইতিহাসবিদ নন। তাদের দেওয়া রায় আমি যা পড়েছি তাতে এই বিষয়ে তাদের দুর্বলতা অবশ্যম্ভাবী। তাদের ঘোষিত রায় থেকেই এটা স্পষ্ট যে তারা অযোধ্যা বলে যে জায়গা কে চিহ্নিত করছেন যা সেসময় অওয়ধ নামে পরিচিত ছিল সে সম্পর্কে তাদের কোন ধারনাই নেই, এই অওয়ধ ছিল মুঘল পর্বে এক বিশাল এলাকার প্রধান কেন্দ্রীয় দপ্তর বা রাজধানী, সেই বিশাল এলাকার একটি বড় অংশেই ছিল মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস। তাই মুঘল জমানায় বাবরি মসজিদ কোন মুসলমানই প্রার্থনার জন্য ব্যবহার করতেন না, এ ধরনের মন্তব্য বস্তুত বিচার ব্যবস্থার মনোজগতে গড়ে ওঠা এক স্থূলকল্পনা বৈ আর কিছুই নয়। পুরাতত্ত্বের বিষয়কে আলোচনার মধ্যে আনলে সুপ্রিমকোর্টের পক্ষে উচিত হত পুরাতত্ত্ব বিভাগের কর্মচারীদের যোগ্যতা বিচার করে নেওয়া যারা বাবরি মসজিদ কে একটি মসজিদের কাঠামো হিসেবে চিহ্নিত করতেও ব্যর্থ হন। তারা একে সবসময়ই একটি বিতর্কিত কাঠামো হিসেবে চিহ্নিত করে এসেছেন, যে কাঠামোয় নাকি ৫০ টি পীলার ছিল – অথচ একটি পিলারের হদিস পাওয়া যায়নি এমনকি সেই ৫০ টি পিলারের উপযুক্ত শক্ত-সমর্থ কোন ভিতেরও সন্ধান মেলেনি, এমন একটি অংশেরও সন্ধান পাওয়া যায়নি যার সাহায্যে তাদের কল্পনামত কাঠামোর দেওয়াল বা ছাদের গঠন হওয়া সম্ভব।
বিতর্কিত কাঠামোকে নিজেদের সম্পত্তি হিসাবে ঘোষনা সম্পর্কে সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডের তরফে যে দাবি করা হয়েছিল তা খারিজ করে দেওয়ার প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে যে ১৮৫৬-৫৭ সময় কালে বাবরি মসজিদের ভিতরে নামাজ প্রার্থনা করা হতো এরকম কোন প্রমাণ মেলেনি, বড় এক এক দীর্ঘ সময় ধরে সেখানে হিন্দুদের তরফে পূজা-অর্চনার প্রমাণ পাওয়া গেছে। একে কি একুশ শতকের ভারতে মধ্যযুগের ভারতীয় স্থাপত্যের ক্ষেত্রে চিহ্নিতকরণের কাজের একটি ভিত্তি প্রমাণ হিসাবে ধরা যায়?
যেরকমটা আমি ইতিপূর্বেই উল্লেখ করেছি এটা সম্পূর্ণ ভাবেই কোর্টের তরফে একটি স্থূলকল্পনা যে মুঘল জমানায় বাবরি মসজিদের ভিতরের অংশ মুসলমানদের প্রথনার জন্য ব্যবহৃত হতো না। অওয়ধ অথবা অযোধ্যা ছিল সেই সময়ের এক প্রশাসনিক সদরকেন্দ্র, যেখানে বহু মুসলমান বসবাস করতেন। ১৮৫৬-৫৭ সময়কালের পূর্বে ঐ মসজিদ মুসলমানদের প্রার্থনার জন্য ব্যবহৃত হতো না বলে যে দুজন বিদেশি পর্যটকদের সাক্ষ্য পাওয়া গেছে তাদের মধ্যে একজন ছিলেন জোসেফ টাইফেন্থালার যিনি ১৭৪০ থেকে ১৭৬৫ এর সময়কালে ভারতে আসেন, আরেকজন হলেন বিখ্যাত সর্ভেয়র ফ্রান্সিস বুকানন যিনি ১৮০৪ থেকে ১৮১২ এই সময়ে এদেশে এসেছিলেন। এরা দুজনেই ঐ মসজিদ কাঠামোটি মুসলমানেরা ব্যবহার করেনা কিংবা সেখানে কোনো নামাজ প্রার্থনা হয় না বলে যে মন্তব্য করেছেন তাতে তারা কোনরকম তথ্যাপ্রমান যুক্ত করেন নি।
সুপ্রিম কোর্টের রায়ের সাথে সংযুক্তি হিসাবে যা জুড়ে দেওয়া হয়েছে, যা পাঁচজন বিচারকের মধ্যে একজনই লিখেছেন তাতে তুলসিদাসের রচিত “বালঃ কান্ড” এবং আইন – ই – আকবরী থেকে বিভিন্ন উক্তি সমূহের উল্লেখ রয়েছে এবং সেইসব কিছুকেই ত্রেতা যুগে ভগবান রামের জন্মের প্রমাণপত্র হিসাবে ধরা হয়েছে।
সেই সংযুক্তিতে একথা উল্লেখ করা আছে যে “মসজিদের গঠন হবার অনেক আগে থেকেই হিন্দুদের মধ্যে এই বিশ্বাস রয়ে গেছে যে বাবরি মসজিদ যে জমির উপর গড়ে তোলা হয়েছিল সেই জায়গাটিই হল ভগবান রামের জন্মস্থান, মসজিদ গড়ে তোলার পরেও সেই আস্থা টিকে রয়েছে”। ভবিষ্যতের ঐতিহাসিক গবেষণা এবং পুরাতাত্ত্বিক প্রমাণসমূহ সম্পর্কে আপনি কি বলবেন যখন আস্থার মর্যাদা এই দুইয়ের তুলনায় বেশি ভরসা যোগ্য প্রমাণ হিসেবে দেখা হয়?
সুপ্রিম কোর্টে তরফে যে রায় দেওয়া হয়েছে তাতে সংযুক্তি হিসেবে যা কিছুর উল্লেখ রয়েছে তাতে বলা হয়েছে বাবরি মসজিদ যে জায়গায় ছিল সেটাই হল ভগবান রামের জন্মস্থান এবং এ হলো “হিন্দুদের এক বিশ্বাস ও আস্থা”, একে খুব বেশি হলে একটি কল্পনাপ্রসূত দাবিই বলা চলে। ভগবান রামের জন্মস্থান হিসেবে অযোধ্যা কে ধরিয়ে দেওয়া হয় কোন নির্দিষ্ট জমি বা জায়গাকে নয়। রাম জন্ম সম্পর্কে যা কিছু উল্লেখ তা রয়েছে কেবল মাত্র স্কন্দপুরাণে যদিও সেখানে কোনো নির্দিষ্ট স্থানের উল্লেখ নেই এবং এই প্রসঙ্গে স্মরণে রাখতে হবে স্কন্দপুরাণে এ ধরনের মন্তব্যের সংযুক্তি করন করা হয়েছে বাবরি মসজিদ গড়ে ওঠার অনেক পরে। এ বিষয়ে প্রথম স্বীকৃতি মেলে লিপিকার ওর সংস্কৃতজ্ঞ অধ্যাপক টি পি বর্মার পক্ষ থেকে, যখন বিশ্ব হিন্দু পরিষদের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি এ কথা মেনে নেন যে স্কন্দপুরাণ 400 বছরের বেশি পুরানো গ্রন্থ নয়, এবং এই গ্রন্থকে সংকলিত করা হয়েছে ১৬০০ শতাব্দীর সময়কালে। স্কন্দপুরাণ এই ধরনের কোন মন্তব্য নেই যাতে ধরে নেওয়া যায় রামের জন্মস্থান এর জায়গাটিকে কোন মসজিদ দখল করেছিল, সুতরাং সেধরনের কোনোরকম দাবি বাবরি মসজিদ ছাড়া অন্যান্য যে কোন কাঠামো র ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হত।
তাহলে কি ধরে নেওয়া যাবে ইতিহাস এবং পুরাতত্ত্ব বিষয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে কার্বন ডেটিং পদ্ধতি বাতিল হয়ে গেল, কারণ আস্থা এবং কিংবদন্তি কেই ঐতিহাসিক গবেষণা ও অনুসন্ধানের জন্য যথেষ্ট মেনে নেওয়া হলো?
আমি নিশ্চিত কোনদিনই নিজস্ব বিষয়ে কোন ঐকান্তিক ঐতিহাসিক কিংবা পুরাতাত্ত্বিকই কিভাবে ইতিহাস লেখা হবে সে সম্পর্কে পরামর্শ করতে কোর্টের দ্বারস্থ হবেন না। পাণ্ডিত্যের বিশুদ্ধতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে আস্থা এবং কিংবদন্তি এদুটিই হল অত্যন্ত অমঙ্গলসুচক।