তাপস সিনহা
মেদিনীপুর শহর থেকে কয়েক কিলোমিটার দুরে, রাণীগঞ্জ রোড থেকে একটু এগোলেই ভাদুতলা নামে একেবারে ছোট একটি গঞ্জ, ডানদিকে রাস্তা—রাস্তার দুদিকে শাল, মহুয়া, ইউক্যালিপ্টাস গাছ। অবশ্য ধান ক্ষেতও আছে-একটু এগোলেই পারাং- ছোট নদী, সারাবছর জল থাকে না। বর্ষায় এরই দাপট খবরের কাগজে নিজের জায়গা করে নেয়। পারাং এর পাড়ে বাবলা আর লজ্জাবতীর জঙ্গল পেরোলেই কর্ণগড়ের ধ্বংসস্তুপ। ইতিহাসে উপেক্ষার অন্ধকারে লুকিয়ে রয়েছে কর্ণগড়, রয়েছেন রাণী শিরোমণী। লুকিয়ে রয়েছে পরাধীন ভারতবর্ষের ঊষা লগ্নে বাংলার বুকে ২২৫ বছর আগে ঘটে যাওয়া এক ভয়ঙ্কর ইতিহাস, বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ যখনই চেষ্টা করেছে দখলদারির- তখনই জেহাদ হয়েছে বাংলার বুকে। মেদিনীপুরকে কেন্দ্র করে জঙ্গলমহলে নানা ঘটনা, বীরের লড়াই। সংগ্রামের নেতৃত্বে এক নারী। ঝাঁসির রাণী লক্ষ্মীবাই-র বিদ্রোহের অর্দ্ধ শতক আগে বিদ্রোহিনী রাণী শিরোমণি; চুয়াড় পাইকদের সঙ্গে নিয়ে ব্রিটিশ বিরোধী লড়াই। ১৭৯৯ সালে লড়াই, তারই ২২৫ বছর। ২২৫ বছর আগের সেই অধ্যায়েই লুকিয়ে রয়েছে বাংলার ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামের জ্বলন্ত বারুদ। অত্যাচার, শোষণ, প্রতিবাদ, বিদ্রোহের রক্তাক্ত ইতিহাসের সঙ্গে জীবন কাহিনী বিস্ময়করভাবে মিলে মিশে ভরিয়ে রেখেছে লুপ্তপ্রায় দলিলের পাতাগুলি।
পলাশীর যুদ্ধে (১৭৫৭) জয়লাভের পর ভারতে ব্রিটিশ শাসনের গোড়াপত্তন। নবাব মীরকাশিম মসনদে বসার বিনিময়ে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীকে বর্ধমান ও চট্টগ্রামের সঙ্গে মেদিনীপুর জেলার রাজস্ব সংগ্রহ করার ভার তুলে দিয়েছিল। মুনাফালোভী কোম্পানী প্রতিনিধিরা যেন তেন প্রকারেন রাজস্ব সংগ্রহের পরিমানকে বৃদ্ধি করার জন্য এই তিন জেলায় তীব্র শোষণ নামিয়ে আনে। পরে বিহার, উড়িষ্যা এবং বঙ্গ দেশের দেওয়ানী লাভ কোম্পানীকে একই শোষণ কায়েম করতে একচ্ছত্র আধিপত্য এনে দেয়। ১৭৯৩ সালে এই অতিরিক্ত রাজস্ব সংগ্রহের সর্বগ্রাসী ক্ষুধা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে প্রবর্তিত হয় সূর্যাস্ত আইন। বাড়তি রাজস্ব আদায়কে সুনিশ্চিত করতে হুলিয়া জারি করা হয়। নির্দিষ্ট দিনে সূর্যাস্তের আগে খাজনা পরিশোধ না করতে পারলে জমিদারী নীলামে উঠবে। দীর্ঘদিনের অনেক জমিদারই এতে উৎখাৎ হলেন। প্রাক্ ব্রিটিশ যুগের যে সামন্ততান্ত্রিক অচলায়তন ভারত তথা বঙ্গ দেশের সমাজে বিদ্যমান ছিল, তা ভেঙে চুরে ছত্রখান হতে শুরু করলো। ঔপনিবেশিক লুটেরা অর্থনীতির উপযোগী পরিকাঠামো গড়ে উঠতে লাগলো।
যে সময় ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ভারতে এই রাজস্ব সংগ্রহের নামে সম্পদ কেন্দ্রীভূত করছিল, ঠিক তখনই ইংল্যান্ডে প্রস্তুতি চলছিল শিল্প বিপ্লবের। কোম্পানী এই রাজস্বকে রূপায়িত করেছিল বাণিজ্যিক পুঁজিতে। রপ্তানির নামে কাঁচামাল খরিদ করে এই রাজস্বের সবটাই পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছিল ইংল্যান্ডে। দেশীয় অর্থনীতিতে এই রাজস্ব কোন কাজেই লাগানো হয়নি। পুরোপুরি ঔপনিবেশিক শোষণের সম্পদ নির্গমণের প্রক্রিয়ায় এটি অংশীভূত হয়েছিল। কার্ল মার্কস এই ঘটনাকে বিশ্লেষণ করে বলেছিলেন, শিল্প বিপ্লবের প্রাথমিক প্রয়োজনেই পুঁজি জড়ো করা হয়েছিল।
শুধু যে জমিদাররাই অনেকে তাদের জমিদারী হারালেন তাই নয়, রাজস্ব সংগ্রহের পরিধি বাড়াবার জন্য ব্রিটিশরা নিষ্কর জমি জঙ্গলমহলকেও করদ জমিতে পরিণত করতে উদ্যোগী হয়। চুয়াড়রা প্রধানত বাঁকুড়া জেলার দক্ষিণ-পশ্চিম, মেদিনীপুর জেলার উত্তর পশ্চিম এবং মানভূম জেলার পূর্বাঞ্চলে জঙ্গলাকীর্ণ এলাকার আদিম অধিবাসী ছিলেন। মাল পাহাড়িয়া, সাঁওতালদের মত এরাও মুক্ত স্বাধীন জীবনযাপন করত। ব্রিটিশরা এই আদিবাসীদের জীবনে আক্রমণ নামিয়ে আনলো, তাদের জমি কেড়ে নিয়ে। জঙ্গলমহলের সমস্ত জমি চড়া হারে জমিদারদের কাছে বিক্রয় এবং ইজারা দেওয়া হলো। চুয়াড়দের স্বাভাবিক উগ্রতা এবং সাহসিকতার কারণে এই জাতির মানুষদের জমিদাররা পাইক বরকন্দাজের কাজে নিযুক্ত করতো। এই পাইকরা জমিদারদের দেওয়া নিস্কর জমি ভোগ করতো তাকে বলা হতো পাইকান জমি। ইংরেজরা প্রথমেই পাইকানদের কর্মচ্যুত করে এবং তাদের জমি কেড়ে নেয় নিজস্ব পুলিশ বাহিনীর সাহায্যে। এর ফলে প্রায় ২৫ হাজার পাইক ঘর, বাড়ি, জমি হারিয়ে সম্পূর্ণ নিঃস্ব হয়ে পড়ে। সর্বস্বান্ত মানুষের ক্ষোভ ক্রমশ তীব্র রূপ নেয়। কিছু জমিদারদের সঙ্গেও মত পার্থক্য বেড়ে যায় বিটিশদের। তাদের সর্বগ্রাসী ক্ষুধা শহর, গ্রাম ছেড়ে দক্ষিণবঙ্গের আদিবাসী প্রধান জঙ্গল মহলে প্রবেশ করতে থাকে। এই প্রেক্ষাপটে গড়ে উঠতে থাকে সর্বহারা মানুষের প্রতিবাদ। বহু অত্যাচার শোষণ নিপীড়নের পর সংঘাত। কোন ক্ষেত্রে দখলদারির হাত প্রতিহত করার সংঘাত। কখনও বিদ্রোহ সাধারণ মানুষের, কখনও বিদ্রোহের সঙ্গী রাজা জমিদারও। চোয়াড়দের ধূমায়িত বিক্ষোভে পাইকদের অংশগ্রহন
আগুনে ঘৃতাহুতির সঞ্চার করে। সামাজিক, অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত এবং বিভ্রান্ত পরিকাঠামোর মধ্যে দাঁড়িয়ে আত্মপ্রকাশ ঘটে বিদ্রোহী বাংলার।
চোয়াড় বিদ্রোহের মূল প্রেক্ষাপট অন্বেষণ করতে হলে সেই ঐতিহাসিক ঘটনাগুলির দিকে দৃষ্টিপাত প্রয়োজন, যেগুলি নানাভাবে পূর্বভারতে বিশেষতঃ বাংলাদেশে ব্রিটিশদের সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য সম্প্রসারণের ক্ষুধা বৃদ্ধি করেছিল। পাশাপাশি নিম্নবর্গের বঞ্চিত মানুষের তীব্র অসন্তোষ জনিত বহিঃপ্রকাশের বাতাবরন করেছিল। মেদিনীপুরে ইংরেজ অধিকারের সূত্রপাত ১৭৬০ সালে। যে বছর বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার নবাব মীরকাশিম তার নবাবী প্রাপ্তির মূল্য হিসাবে চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীকে বর্ধমান, চট্টগ্রাম ও মেদিনীপুরের দেওয়ানী বা রাজস্ব আদায়ের ভার দিয়েছিলেন। এর ফলে মেদিনীপুর বিহার ওড়িশার জঙ্গ লাকীর্ণ অঞ্চল্যে ১৮০৫ সালে যা জঙ্গল মহল নামে একটি নতুন জেলা হিসেবে পরিচিত হয়েছিল, ইংরেজের প্রত্যক্ষ শাসনের সূত্রপাত ঘটে। এরপর রবার্ট ক্লাইভ দ্বিতীয়বার ভারতে আসার পর ইংরেজ কোম্পানী দিল্লীর মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের কাছ থেকে বাংলা, বিহার, ওড়িশার দেওয়ানী লাভ করে। পরের বৎসর ১৭৬৬ সালে সিদ্ধান্ত হয় জঙ্গল মহলের জমিদারের অধীনে নিষ্কর জমি চুয়াড়রা ভোগ করে সেগুলি কেড়ে নিয়েই রাজস্ব আদায় করা হবে। এর ফলে ১৭৬৭ সালেই মেদিনীপুরে আগুন জ্বলে ওঠে এবং ধলভূমগড়ের জগন্নাথ বল সেই বিদ্রোহ পরিচালনা করেন। এইভাবেই কোম্পানীর রাজত্বের প্রথমদিকে লক্ষ্য করা যায় এক চূড়ান্ত অরাজকতা। একদিকে কোম্পানীর স্বার্থ উপেক্ষা করে ইংরেজ কর্মচারীরা ব্যক্তিগত ব্যবসা চালাতে থাকেন, অপরদিকে স্বাধীনচেতা জমিদার ও ভূস্বামীরা নিজেদের জমির ওপর দখল ছাড়তে ও ইংরেজদের অধীনতা মানতে অস্বীকার করায় দু পক্ষের মধ্যে দীর্ঘ মেয়াদী সামরিক সংঘর্ষের অবতারনা ঘটে। ১৭৭২ সালে ওয়ারেন হেষ্টিংসের বাংলার গভর্নর হিসাবে নিযুক্তির পর প্রধানতঃ উত্তর বাংলায় ব্রিটিশ বিরোধী বিখ্যাত সন্ন্যাসী বিদ্রোহ দেখা দেয়। মূলতঃ উত্তর ভারত ও মধ্য ভারতের অধিবাসী ও নানা অঞ্চল লুঠতরাজকারী নাগা গোঁসাই সম্প্রদায়ের এই সন্ন্যাসী যোদ্ধারা ১৭৭৩ সালে মেদিনীপুরে ব্রিটিশ সৈন্যধ্যক্ষ ক্যাপ্টেন এঞ্জওয়ার্ডসকে পরাজিত করেন।
১৭৯৩ সালে লর্ড কর্ণওয়ালিস কর্তৃক চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে জমির ওপর জমিদারদের পাইকদের সামান্য অধিকারেরও অবলুপ্তি ঘটে। কারণ অভ্যন্তরীণ শাসন ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী অধিগ্রহণ করায় জমিদারদের পাইক রাখা নিষিদ্ধ হয় এবং সমস্ত জমিজমা কোম্পানীর অধিকারের অন্তর্ভূক্ত হয়। এর ফলে স্থানীয় জমিদারেরা বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সমগ্র ভূমি ব্যবস্থার চরিত্রকেই আমূল বদলে দিয়ে মারাত্মক পরিণাম ডেকে আনে। চুয়াড় বিদ্রোহ সেই পরিণামেরই একটি সূচীমূখ। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী কৃষকদের সশস্ত্র সামরিক সংঘর্ষের ধারাবাহিক ঘটনা সমূহের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো চুয়াড় বা পাইক বিদ্রোহ, যা ১৭৯৯ সালে সংগঠিত হয়। এই বিদ্রোহের আগে গ্রামীণ কৃষি-অর্থনীতিতে বাঙালী অবাঙালী শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অনুপ্রবেশ ও রায়তদের জমি হারিয়ে ভূমিহীন মজুরে পরিণত হওয়ার মতো শোচনীয় ঘটনাও ঘটেছিল যাকে অবকৃষকায়ণ বা দারিদ্রায়ণ বলে ইতিহাস বিশেষজ্ঞরা জানেন। এই ঘটনার ফলে ঐ শতাব্দীর শেষ দিকে জঙ্গলমহলের ভূস্বামীবর্গ ইংরেজদের অর্থনৈতিক শোষণ ও সামরিক আধিপত্য স্থাপনের প্রয়াসের বিরুদ্ধে বার বার সশস্ত্র বিদ্রোহে ফেটে পড়েছিলেন। সংগ্রামের উল্লেখযোগ্য কেন্দ্রগুলির মধ্যে কয়েকটি ছিল ঝাড়গ্রাম, ফুলকুসমা, ধারেন্দা, কর্ণগড়, চন্দ্রকোণা, বগড়ি (ঘাটাল), শিলদা, বিষ্ণুপুর, ঘাটশিলা, শিংভুম, ময়ূরভঞ্জ ইত্যাদি। চুয়াড় বিদ্রোহে বিশেষ সক্রিয় ভূমিকা পালনকারী জমিদারদের অধীনস্থ পাইক বরকন্দাজেরা ছিল অধিকাংশ ক্ষেত্রে নানা উপজাতির মানুষ। যেমন-বাগদী, কুর্মী, মাঝি, কোড়া, লোধা, কুর্মালি মুন্ডারী ইত্যাদি। জঙ্গলমহলের জমিদারদের অধীনস্থ গ্রামাঞ্চলে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা ও খাজনা আদায়ের ভারপ্রাপ্ত পাইক বাহিনী ও তাদের সর্দার তহশীলদারগন তাদের সেবার বিনিময়ে ভোগ করতো ‘পাইকান’ বা ‘চাকরান’ জমি। ভূস্বামী কর্তৃক প্রদত্ত জমিতে চাষ করার পাশাপাশি যুদ্ধ ও লুঠতরাজের মাধ্যমেও এরা জীবিকা নির্বাহ করতো। কারণ এদের কোন বাঁধাধরা মাসোহারা ছিল না। এই ভূস্বামী বর্গের অন্যতম কর্ণগড়ের রাণী শিরোমণির কথা উল্লেখযোগ্য। যিনি একজন মহিলা হয়েও ইংরেজদের বিরুদ্ধে অসম সাহসিকতা দেখিয়েছিলেন। নাড়াজোলের জমিদার অযোধ্যা রাম ইংরেজকে খাজনা দিতে অস্বীকার করায় রাণী তাঁকে আশ্রয় দেন। তাছাড়া ইংরেজদের অনুগত কর্মচারীরা খাজনা আদায়ে এসে অত্যাচার করে গণরোষে ঞ্ছিত হলে শিরোমণি তাঁর তহশিলদারদের রক্ষায় এগিয়ে আসেন। এইসব কারণে রাণীকে আবাসগড় দূর্গে বন্দী করে রাখা হয়েছিল। রাণীর জমিদারীর অনেকাংশ কোম্পানি দখল করে নেওয়ায় মেদিনীপুর ও তার চারপাশে পাইকদের প্রবল বিদ্রোহ দিয়েছিল, যাতে রাণী শিরোমণিকে যোগ্য সহযোগিতা দিয়েছিলেন নাড়াজোলের জমিদার চুনীলাল কান এবং অন্যান্যরা।
এই বিদ্রোহ ব্যাপক রূপ ধারণ করে মেদিনীপুর জেলার রায়পুর পরগনা থেকে এখানকার জমিদার দুর্জন সিংহ সূর্যাস্ত আইনের ফলে তাঁর জমিদারী হারান এবং তাঁর জমি নিলাম হয়ে যায়। এর প্রতিবাদে দুর্জন সিংহ পাইক চোয়াড়দের সাহায্যে রায়পুরের নতুন জমিদারকে বিতাড়ন করে নিজের অধিকার পুনঃ প্রতিষ্ঠা করেন। রায়পুরে বিদ্রোহীদের সঙ্গে কোম্পানীর সৈন্যদের বারংবার খণ্ডযুদ্ধ হয়। দুর্জন সিংহের নেতৃত্বে দেড় হাজার বিদ্রোহী রায়পুরের ৩০ টি গ্রাম দখল করে। পরে দুর্জন সিংহকে গ্রেপ্তারও করা হয় কিন্তু প্রমাণের অভাবে সরকার তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
দুর্জন সিংহের মুক্তিদান বিদ্রোহীদের উৎসাহিত করে এবং মেদিনীপুরের তিনটি জায়গা-বাহাদুরপুর, শালবনী ও কর্ণগড় কার্যত বিদ্রোহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। কর্ণগড়ের জমিদারের পত্নী ছিলেন রাণী শিরোমণি। জঙ্গলমহলের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় কর্ণগড় ছিল অর্থনৈতিক দিক থেকে অনেকটা উন্নত। কর্ণগড়ে অবস্থিত ছিল নুনের গোলা ও কোম্পানীর তুলা ও শিল্পের কারখানা। সাধারণ চোয়াড় পরিবারের কন্যা বলে শিরোমণি চোয়াড়দের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। কিন্তু যখন রাণী শিরোমণির জমিও খাস জমিতে পরিণত হল এবং সাধারণ কৃষকদের ওপর করের বোঝা বৃদ্ধি পেল, তখন কর্ণগড় অঞ্চলে ব্যাপক বিদ্রোহ ঘটলো আর স্বয়ং রাণী শিরোমণিই এই বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিলেন। এরপর ১৭৯৮ এর জুলাই মাসে গোবর্ধন দিকপতির নেতৃত্বে প্রায় চারশত বাহিনী হুগলী জেলার চন্দ্রকোণা পরগনা দখল করতে সমর্থ হয়।
১৭৯৮-এর শেষ ভাগের মধ্যে বাসুদেবপুর, বলরামপুর, মেদিনীপুরের কাশীজোড়া, তমলুক, তুর্কাচর, জলেশ্বর, দুবাজল, রামগড় প্রভৃতি অঞ্চলে বিদ্রোহীদের তৎপরতা বৃদ্ধি পায়। বিদ্রোহীরা ধনী ব্যক্তিদের সম্পত্তি ও মজুত শস্য লুন্ঠন করে এবং কাছারী, সরকারী অফিস ও সৈন্য ব্যারাক আক্রমণ করে। অনেক জায়গায় জমিদারী সংক্রান্ত সমস্ত দলিল পত্রের ‘বহ্নি উৎসব’ করা হয়। শালবনী শহরে বিপ্লবীরা দুজন উচ্চ পদস্থ সরকারী কর্মচারীকে টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলে। বাহাদুরদের ইজারাদার কৃষ্ণ ভূঞাকেও হত্যা করা হয়।
বিদ্রোহীদের বাস্তববোধ ও দূরদর্শিতার বড় পরিচয় পাওয়া যায় তাদের সরকারী বাহিনীকে খাদ্যের অভাবে ফেলার মধ্যে দিয়ে। তারা কোম্পানীর সমর্থক ইজারাদার, বানিয়া ও জমিদারদের ব্রিটিশদের সরকারী বাহিনীকে খাদ্য ইত্যাদি সরবরাহ না করার | হুমকি দেয়। এটিকে তারা রাণী শিরোমণির নির্দেশ বলে প্রচার করে। তাদের এই কৌশল অনেকটা সাফল্য পায়। বিদ্রোহীদের আরেকটা দিক হলো বিদ্রোহীরা আধুনিক অস্ত্র সস্ত্রে সজ্জিত ব্রিটিশ বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ সমরে না গিয়ে-চোরা গোপ্তা আক্রমণের মাধ্যমে কাজ হাসিল করতে থাকে। আধুনিক গেরিলা যুদ্ধের সঙ্গে এর অনেকটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
বিদ্রোহীদের অভ্যুত্থানের ফলে জঙ্গলমহল এলাকায় রাজস্ব আদায় সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। জমিদারদের নিয়ে আসা নতুন প্রজারাও ভীত হয়ে পালিয়ে যায়। সমগ্র এলাকায় চাষ আবাদ ও রাজস্ব আদায়ে যথেষ্ট প্রতিবন্ধকতা তৈরী হয়। চোয়াড়দের বিপ্লবী কার্যকলাপের মোকাবিলাতে ব্যর্থ হওয়ায় মেদিনীপুর জেলার কালেক্টর যথেষ্ট বিব্রতবোধ করেন। গভীর উদ্বেগের মধ্যে তিনি দিন কাটান। তার এই মানসিকতার প্রতিফলন পাওয়া যায় তার নিজের লেখা চিঠিতে-“সমগ্র জেলার অধিবাসীগণ পলায়ন করিয়া যেন মেদিনীপুর শহরে ভীড় করিয়াছে। তাহারা নিজেদের প্রাণ রক্ষার জন্য অধীর হইয়া উঠিয়াছে…. সহস্র সহস্র লোক শহরের মধ্যে আবদ্ধ হইয়া রহিয়াছে, তাহারা শহরের বাহিরে যাইতে পায় না। সকল মফঃস্বল অঞ্চলের সহিত শহরের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হইয়া গিয়াছে।” বিদ্রোহের ব্যাপকতা সম্পর্কে তার লেখাতেই দেখা যায়। ‘সমগ্র জেলায় রাজস্ব আদায় সম্পূর্ণ বন্ধ আছে, সর্বত্র ভয়ঙ্কর অরাজক অবস্থা চলছে, কোন জমিতে এখনও পর্যন্ত লাঙলের একটি আঁচড়ও পড়ে নাই।’
তখনকার মেদিনীপুরের ব্রিটিশ কর্তা গ্রাহামের নির্দেশে লেফটেনান্ট ফার্গুসন বিশাল বাহিনী নিয়ে জঙ্গল মহল অধিকারে নামেন। একের পর এক সংঘাত হয়। কিন্তু বিদ্রোহীরা তখন ব্রিটিশ বাহিনীর সঙ্গে পাল্লা দিতে পারেনি। জাম্বনী, লালগড়, রামগড়সহ একে একে বহু জমিদার কোম্পানীর বশ্যতা মেনে নেন। ইংরেজ পক্ষের বহু সেনা নিহত হলেও এসব এলাকা কোম্পানী দখল করে। সবচেয়ে শক্তিশালী ঘাটশিলার জমিদারও তুমুল সংঘাতের পর পরাজিত হন। জঙ্গল মহলের এসব অঞ্চলে মোটামুটি শান্তি স্থাপন হলে রেভিনিউ বোর্ড জমিদারদের সঙ্গে মোকররী ব্যবস্থা করেন।
প্রথম পর্যায় এখানে থেমে গেলেও ১৭৯৮-৯৯ সালে আরও ভয়ানক চেহারা নিয়ে দাঁড়ায় চোয়াড় বিদ্রোহ। সঙ্গে পাইকরাও। মেদিনীপুরের উত্তর অংশ এবং বাঁকুড়ার দক্ষিণ অংশ জুড়ে এর ব্যাপ্তি। চোয়াড়, পাইকরা বহু এলাকা দখল করে। ইংরেজরা পালাতে বাধ্য হয়। থানার দারোগাও পালাতে থাকেন। আমলারাও ভীত হয়ে আশ্রয় নেয় অন্যত্র। লুঠ, অগ্নিসংযোগ, হামলা হয়ে ওঠে নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ইংরেজ কর্তারা আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন। বড় সৈন্য দল পাঠিয়েও এদের বাগে আনা যায় নি। বিদ্রোহের ব্যাপকতা বা ভয়াবহতা দেখে মেদিনীপুরের তৎকালীন কালেক্টর রেভিনিউ বোর্ডকে একটি চিঠি লিখে দেন যেপ্রাচীনকাল থেকে যারা জমি ভোগ করছিল, বিনা অপরাধে ও বিনা কারণে তাদের অধিকার হারানোর পর এবং আবেদন নিবেদনও ব্যর্থ হওয়ার পর তারা যে অস্ত্র ধারণ করবে, এতে বিস্ময়ের কিছু থাকতে পারে না। পরে মেদিনীপুরের সেট্লমেন্ট অফিসার জে.সি.প্রাইসও সবদিক খোঁজ খবরের পরে লিখে গেছেন…. ‘এটি সাধারণ লুঠ বা অরাজকতার ঘটনা নয়। আমি মনে করি এবং বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণও আছে যে মেদিনীপুরের রাণীর জমিদারীর দখল নেওয়ার জন্যই বিদ্রোহ হয়। পাইকরা মিশে যায় চুয়াড়দের সঙ্গে।’
– প্রাইস সাহেবের লেখায় উল্লেখিত এই মেদিনীপুরের রাণীই হলেন রাণী শিরোমণি। ইংরেজ বিরোধী সংগ্রামের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়েই রাণী শিরোমণির গুরুত্ব।
কর্ণগড়ের জমিদারীর অধিকারিণী ছিলেন অজিত সিংহের বিধবা পত্নী রাণী শিরোমণি। তিনি যেমন সুন্দরী, তেমনি তীক্ষ্ণ বুদ্ধি সম্পন্না রমণী ছিলেন। দয়া-দাক্ষিণ্যে, দক্ষতার বলে তিনি প্রজাদের মন জয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। রাণীর ব্যক্তিত্বের জন্যই হোক বা তার মধুর ব্যবহারের জন্যই হোক তার সমর্থনে স্থানীয় মানুষেরা বিদ্রোহে সোচ্চার হয়ে ওঠে। রাণীর গড়ের চারিদিক বিদ্রোহীদের দূর্গে পরিণত হয়। দেশ থেকে ইংরেজ শত্রুদের বিতাড়িত করাই ছিল রাণী শিরোমণির লক্ষ্য। এই বিদ্রোহে রাণী শিরোমণির সঙ্গে নাড়াজোল, লালগড়, রামগড়, ঝাড়গ্রাম, শিলদা, জাম্বনী অঞ্চলের রাজারাও মিলিত হয়েছিলেন।
এই বিদ্রোহের সূচনার সঙ্গে সঙ্গে রাণী ও তার কর্মচারীদের কাছ থেকে ভাল ব্যবহার পাওয়া যাচ্ছে না— এই অজুহাতে এবং তাকে অযোগ্য জমিদার ঘোষণা করে তার জমিদারি কোর্ট অব ওয়ার্ডস-র অধীনে নিয়ে এসে রাণীর জমিদারী বাজেয়াপ্ত করা হয়। রাণীর প্রভাব প্রতিপত্তি খর্ব করার জন্য অতি দ্রুত তার রাজ্য বাজেয়াপ্ত করা হয়। এছাড়া রাণী বাগদী সর্দার গোবর্ধন দিকপতি প্রমুখ চোয়াড় নেতাদের সহায়তা দান করেছিলেন। রাণী শিরোমণি অন্যান্য জঙ্গল জমিদারদের একত্র করে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার জন্য আহ্বান জানান। ব্রিটিশরা তাঁর উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে ১৭৯৯ খ্রীষ্টাব্দের ৬ এপ্রিল রাণীকে বন্দি করেন। ইংরেজরা তাঁকে প্রথম রাজনৈতিক বন্দিনী করে এবং তাঁর সমস্ত সম্পদ লুঠ করে। অবশেষে নাড়াজোলের জমিদার সীতারাম খানের পুত্র আনন্দ লাল খানের মধ্যস্থতায় কোম্পানী রাণীকে মুক্তি দেয়। ১৮১২ খ্রীষ্টাব্দের ১৭ সেপ্টেম্বর (বাংলা ১২২০ সালের 8 আশ্বিন) আবাসগড়ে রাণী শিরোমণির মৃত্যু হয়।
রাণী শিরোমণির ভূমিকা নিয়ে নানা বিতর্ক থাকলেও একথা স্বীকার করতেই হয় যে তৎকালীন সময়ে বাংলার এক রমণী ইংরেজ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তীব্র লড়াই-এ সামিল মেদিনীপুরের হয়েছিলেন। অফিসার সেটেলমেন্ট জে.সি.প্রাইস তাঁর রিপোর্টে বলেছেন ১৭৯৮-৯৯ খ্রীষ্টাব্দে কর্ণগড়ের রাণী শিরোমণি অসীম বীরত্বের সঙ্গে ভয়ঙ্কর চোয়াড় বিদ্রোহকে পরিচালনা মেদিনীপুর করেছিলেন। দীর্ঘ সংগ্রামের পর ১৭৯৯ খ্রীষ্টাব্দের শেষের দিকে জেলায় আংশিক শান্তি ফিরে এসেছিল। সরকারী রিপোর্টে পাওয়া যায়……
“The resumption of the paikan lands of the Rani of Karnagarh, a place in the Vicinity of Midnapur precipitated a crisis which kindled the flame of rebellion throughout the district.” ১৭৯৯ খ্রীষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারী থেকে ১৮০০ খ্রীষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারী মাস পর্যন্ত যাবতীয় পত্র বিনিময় ও বিবরণী থেকে জানা যায়। “It was alleged that the Rani Shiromoni of Karnagarh was indulging the menaces of the most hostile description by seltering the chuars who were incited to carry on furtive depredations in which these disaffected masses received open support from many other refractory chieftains of Midnapur.”
J.C. Price বলেছেন, শিরোমণির নেতৃত্বে পরিচালিত ১৭৯৯ খ্রীঃ বিদ্রোহ মেদিনীপুরে এমন জায়গায় পৌঁছেছিল যে, তৎকালীন Collector Mr. Miholi Judge-Magistrate Robert Gragory প্রমুখ সরকারী কোষাগারের সমস্ত মজুত তহবিল, মূল্যবান দলিলপত্রসহ সমস্ত কিছুই সেনাবাহিনীর অস্তাগারে রাখাকেই নিরাপদ বলে মনে করেছিলেন।
তাঁর কৃতিত্ব এজন্য যে শিরোমণি শুধু নিজের রাজ্য রক্ষার জন্য বিদ্রোহ করেননি, অগ্রসর ও দলিত সমাজের মানুষের অধিকারের লড়াইতে তিনি তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি ইংরাজদের বশ্যতা স্বীকার করেননি, বরং একক নেতৃত্বে তিনি চোয়াড় ও পাইকদের নিয়ে বিদ্রোহ করে গেছেন। তিনি ইচ্ছা করলেই ইংরেজদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নিজের জমিদারী রক্ষা করতে পারতেন। চোয়াড় বিদ্রোহ ও রাণী শিরোমণির প্রকৃত মূল্যায়ণ হওয়া দরকার। আজকের ঐতিহাসিক ও গবেষকদের একাজ করতে হবে। এখনও আছেন গোবর্ধন দিকপতির বংশধর। এই সেদিনও কর্ণগড়ের বহু বাড়িতে ঘোড়া ছিল। মাটির বাড়ি কিন্তু ঘোড়ার খুরের শব্দ ভেসে আসত। গড়ের পাথর খুলে নিয়ে গেছে—এখন ধ্বংস স্তপ—লজ্জাবতীর জঙ্গল আর কাঁটাগাছের ভেতরে এখনও আমাদের অপেক্ষায় সাক্ষী আছে–—টেরাকোটার কাজের পাথরগুলো, বিশাল দিঘীর মাঝে বিশ্রামগৃহ।
গুপ্তধনের লোভে হানাদাররা আজও তৎপর। প্রহরী কর্ণগড়ের মহামায়ার বিখ্যাত মন্দির।
মহামায়ার ২০০ বছর আগে ব্রিটিশের আগ্রাসী পদক্ষেপ প্রতিহত করতে যখন উত্তাল জঙ্গল মহল, তখন তার নেতৃত্বে এক বঙ্গনারী। নিঃসন্তান এবং বিধবা সেই নারীর ঐতিহাসিক ভূমিকা বুকভরা অভিমান নিয়ে লুকিয়ে আছে চুয়াড় বিদ্রোহের পাতায় পাতায়।
স্বাধীনতার পরেও দেশের শাসক শ্রেণী এই বিদ্রোহকে স্মরণ করার উদ্যোগ নেয়নি।
সেই সংগ্রামের উত্তরসূরী হিসাবে বামপন্থী গণতান্ত্রিক শক্তি এগিয়ে আসতে হবে।
বীরাঙ্গনা রাণী শিরোমণি ও ঐতিহাসিক বিদ্রোহকে স্মরণ করতে হবে। তরুণ প্রজন্মের কাছে সেই সংগ্রামের আত্মত্যাগ, দেশপ্রেম, বিদ্রোহের রোমাঞ্চকর দিকগুলি তুলে ধরতে হবে আমাদের।
মানুষের অধিকারের আগামীর লড়াইকে শানিত করতে।
বিদ্রোহের অমর শহীদদের জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।