দুঃস্বপ্নের এক দশক – চন্দন দাস

১৯ নভেম্বর ,২০২০ বৃহস্পতিবার

পর্ব-২


বাংলা প্রেমী তৃণমূল কংগ্রেস?


‘জয় বাংলা’। তৃণমূল কংগ্রেসের নেতারা বক্তৃতার শেষে বলেন। তৃণমূল কংগ্রেসের নেতারা ইদানিং পাশাপাশি বলছেন, ‘‘মমতা ব্যানার্জির কথা না বললে বাংলার কথা বলা যায় না!’’
কতটা বাংলাপ্রেমী মমতা ব্যানার্জি? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের কিছুটা অতীতে যেতেই হবে।
কী হয়েছিল ২০০০-র ৬ জুলাই?


তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী কালীঘাটে মমতা ব্যানার্জির বাড়িতে মালপোয়া খেয়েছিলেন। তার আগে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির জন্মশতবর্ষের অনুষ্ঠানে, নেতাজী ইন্ডোর স্টেডিয়ামে বাজপেয়ীর উপস্থিতিতে তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী বলেছিলেন,‘‘শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জিও ‘অটল’ ছিলেন। আর অটলজীও ‘অটল’। তাই তাঁদের মধ্যে এত মিল।’’ সেদিনই নেতাজী ইন্ডোর স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠানের আগে রাজভবনে এক প্রতিনিধি দলকে মাত্র পাঁচ মিনিট সময় দিয়েছিলেন বাজপেয়ী। সেই প্রতিনিধি দলে ছিলেন রাজ্যসভার তৎকালীন সাংসদ, কমরেড দীপঙ্কর মুখার্জি। আর ছিলেন সেই চারটি কারখানার শ্রমিকরা, যেগুলি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। তার আগে, ২৩শে জুন বি জে পি-জোট সরকারের মন্ত্রীসভা দেশের অনেকগুলি রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থা বেসরকারীকরণ, বিলগ্নীকরণের সিদ্ধান্ত নেয়। দেশের কয়েকটি রাষ্ঠ্রায়ত্ব সংস্থা বন্ধের সিদ্ধান্তও সেদিন নিয়েছিল কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা। মমতা ব্যানার্জি ছিলেন সেই সিদ্ধান্তের শরিক। যে কারখানাগুলি বন্ধের সিদ্ধান্ত হয়েছিল, তার মধ্যে চারটি ছিল পশ্চিমবঙ্গে। সেগুলি হলো — ভারত প্রসেস, এম এ এম সি, ওয়েবার্ড ইন্ডিয়া এবং আর আই সি। সেই সিদ্ধান্ত ঘোষিতও হয়েছিল। বি জে পি-র জোটসঙ্গী ছিলেন রাজ্যের সংস্থা বন্ধের সিদ্ধান্তে সহমত ছিলেন মমতা ব্যানার্জি।
সেদিন বামপন্থীদের নেতৃত্বে শ্রমিকদের প্রতিনিধিরা রাষ্ঠ্রায়ত্ব সংস্থার বিলগ্নীকরণের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। আর ‘শ্যামাপ্রসাদের মত অটলজী’-কে মালপোয়া খাইয়েছিলেন মমতা ব্যানার্জি।


১৯৯৯-এ গুজরাটে ভূমিকম্প। ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি। রেলমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি ত্রাণ পৌঁছে দিবেছিলেন গুজরাটে। তখন তিনি রেলকর্মীদেরও বলেছিলেন তাঁদের বেতন থেকে গুজরাটে সাহায্য করতে। কোনও অন্যায় নেই তাতে। গুজরাটে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যেও গরিব, মধ্যবিত্ত অসহায় মানুষ ছিলেন। কিন্তু ২০০০-এ কী হলো? রাজ্যে প্রলয়ঙ্কর বন্যা। ৯টি জেলা বিধ্বস্ত। দু’ কোটির বেশি মানুষ আক্রান্ত। সেদিন মমতা ব্যানার্জি কিংবা তৃণমূল কংগ্রেসের কোনও নেতা সেই ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়াননি। বরং ঠিক সেই সময়ে রাজ্যে ৩৫৬ নং ধারা প্রয়োগের দাবি তুলেছিলেন। সেই দাবি নিয়ে, রাজ্যের সেই অবস্থার মধ্যেই চলে গেছিলেন এনডিএ-র শরিকদের কাছে। যাতে তারা বামফ্রন্ট পরিচালিত সরকার ভেঙে রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করায় তারা সাহায্য করেন তার তদ্বির করতে। সেই তদ্বির করার কাজ সেরে রাজ্যে ফিরে বন্যা সংক্রান্ত নিজের ব্যাখ্যা হাজির করেছিলেন তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী — ‘ম্যান মেড বন্যা।’ পশ্চিমবঙ্গের মানুষের দুর্দশা সেদিন তিনি পাত্তা দেননি। বন্যা বিধ্বস্ত পশ্চিমবঙ্গকে পর্যাপ্ত কেন্দ্রীয় সাহায্য দিতে হবে — এই দাবিতে ২০০০-র ৭ই ডিসেম্বর কমরেড জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে সংসদ ভবনের সামনে এই রাজ্যের বামফ্রন্ট বিধায়করা অবস্থান করেছিলেন। সেদিন মমতা ব্যানার্জিও সংসদ ভবনের সামনেই ছিলেন। তবে তিনি তার দলবল নিয়ে গান্ধীমূর্তির নিচে ধরনায় বসেছিলেন — রাজ্যে ৩৫৬ নং ধারা প্রয়োগের দাবি নিয়ে।
আরও আছে তার ‘বাংলার জন্য কাজ করার’ উদাহরণ।


মমতা ব্যানার্জি তখন বিজেপি-জোট সরকারের রেলমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে অন্যান্য মন্ত্রকে নির্দেশ গেছিল যে, রেলমন্ত্রীর মতামত ছাড়া পশ্চিমবঙ্গ সম্পর্কে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গে কেন্দ্রীয় প্রকল্প, সরকারী পদক্ষেপের যাবতীয় ভার বিজেপি তুলে দিয়েছিল মমতা ব্যানার্জির মুঠোয়। তাতে কী হয়েছিল? জেনারেল মোটরস কোম্পানি রাজ্যে বিনিয়োগের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে সমীক্ষা করতে চেয়েছিল। এনডিএ সরকার তা করতে দেয়নি। কার ইচ্ছায় তা বুঝতে অসুবিধা হয়নি। ১৯৯৮-এ পানাগড়ে শিল্প উন্নয়ন নিগম এবং একটি বেসরকারী সংস্থার যৌথ উদ্যোগে বিমান উড়ান প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের শিলান্যাস হয়। তৎকালীন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জর্জ ফার্নান্ডেজ ‘নিরাপত্তা’-র অজুহাত দেখিয়ে তা বাতিল করে দেন। মমতা ব্যানার্জি ফার্নান্ডেজের বিশেষ ঘনিষ্ট ছিলেন।
১৯৯৯-র ১০ই ফেব্রুয়ারি ব্রিগেডে তৃণমূল কংগ্রেস সভা করেছিল। সভায় ‘প্রধানমন্ত্রীর দূত’ হিসাবে হাজির ছিলেন দুই কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রমোদ মহাজন এবং ভি রামমূর্তি। অটলবিহারী বাজপেয়ী তখন প্রধানমন্ত্রী। প্রমোদ মহাজন সভায় বলেছিলেন যে, পশ্চিমবঙ্গ থেকে কোনও সরকারী অফিস সরানো হবে না। ভি রামমূর্তি বলেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গে তেল অনুসন্ধানের কাজ বন্ধ হবে না। তিনটি নতুন অঞ্চলে কাজ শুরু হবে। কোনটিই হয়নি। সেই সভার কিছুদিনের মধ্যেই স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার বৈদেশিক মুদ্রা বিভাগ কলকাতা থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল মুম্বাইয়ে। সেই বছরেরই ৬ই ডিসেম্বর তেল মন্ত্রকের মন্ত্রী রাম নায়েক ঘোষণা করে দেন যে, পশ্চিমবঙ্গে তেল অনুসন্ধানের কাজ বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। মমতা ব্যানার্জি টু শব্দটি করেননি।




আয়লায় বিধ্বস্ত হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের অনেকগুলি জেলা। বিশেষত দুই ২৪ পরগনা, পূর্ব মেদিনীপুর। ২০০৯-র জুলাইয়ের সেই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে মৃত্যু হয়েছিল ১২৫ জনের। ক্ষতিগ্রস্ত হন প্রায় ৬৪ লক্ষ মানুষের। সুন্দরবনের সাড়ে ৬লক্ষ বাড়ির ক্ষতি হয়। সুন্দরবন কিংবা দুই ২৪ পরগনার বাইরেও প্রায় দশটি জেলায় আয়লার তান্ডব তছনছ করেছিল জীবন-জীবিকা।
নয়াদিল্লিতে রাজ্যের বিধায়কদের একটি প্রতিনিধিদল কেন্দ্রীয় জলসম্পদ মন্ত্রী পবনকুমার বনসালের সঙ্গে দেখা করেন। পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি সেচ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পগুলি এবং সুন্দরবনের আয়লা পরবর্তী পুনর্গঠনের কাজে কেন্দ্রীয় আর্থিক সাহায্যের প্রশ্নে সমস্যা সম্পর্কে একটি স্মারকলিপিও দেন তাঁরা। কিন্তু ওই প্রতিনিধি দলে আমন্ত্রণ পেয়েও বয়কট করেছিল তৃণমূল।
আয়লার পর রাজ্যের সুন্দরবন উন্নয়ন মন্ত্রী কান্তি গাঙ্গুলির নেতৃত্বে প্রথমবার যখন টাকার দাবি রাজ্যের প্রতিনিধি দল নয়াদিল্লি যায়, তখনও তৃণমূল বয়কট করেছিল। কেন্দ্রীয় সরকারের সাহায্যের জন্য বারবার কেন্দ্রীয় সরকারের দপ্তরে ছোটাছুটি করেছেন রাজ্য সরকারের মন্ত্রীরা। মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য একাধিকবার কথা বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এবং কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জির সঙ্গে। রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্তও বারবার নয়াদিল্লিতে গেছেন সুন্দরবনের মানুষের দুর্দশা রোধে প্রয়োজনীয় টাকার দাবি নিয়ে। কিন্তু তৃণমূলের পক্ষ থেকে একবারও কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে এই সংক্রান্ত কোন দাবি এমনকি অনুরোধও জানানো হয়নি।
শুধু তাই নয়। সুন্দরবন এলাকার মথুরাপুর লোকসভার সাংসদ চৌধুরী মোহন জাটুয়া। তখন তৃণমূল কংগ্রেস কেন্দ্রীয় সরকারের শরিক। জাটুয়া তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী। তখন যোজনা কমিশন ছিল। জাটুয়া কমিশনকে চিঠি লিখে বলেন যে, রাজ্য সরকারকে পুনর্গঠনের কোনও টাকা দেওয়া না হয়। সেই চিঠি ফাঁসও হয়ে যায়। মমতা ব্যানার্জির নির্দেশ ছাড়া এই কাজ জাটুয়া করতে পারেন না।
কিভাবে মমতা ব্যানার্জি এবং তৃণমূল কংগ্রেস নিজেদের সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে বারবার পশ্চিমবঙ্গের মানুষ, উন্নয়নের বিরোধিতা করেছেন — তার উদাহরণ অনেক।


ধারাবাহিক চলবে….


মমতা ব্যানার্জির মায়ের সঙ্গে অটল বিহারী বাজপেয়ী
আয়লা ঘূর্ণিঝড় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দুই ২৪ পরগণা ও ২ মেদিনীপুর
১৯৯৯ গুজরাটে ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প
২০০০ সালে পশ্চিমবঙ্গে ভয়ঙ্কর বন্যা
Spread the word

Leave a Reply