উত্তরপ্রদেশে হাথরাস জেলাটি দেশের রাজধানী দিল্লি থেকে ২০০ কিলোমিটার দূরত্বে। গত কয়েকদিনে এক তরুণীর ভয়াবহ ধর্ষণ এবং মৃত্যু সংক্রান্ত ঘটনায় এই জেলার নাম সংবাদের শিরোনামে উঠে এসেছে। ১৪ সেপ্টেম্বর ১৯ বছরের ঐ তরুণীটি ক্ষেতে কাজ করার সময় আক্রান্ত হয়, তার ওরনা (দোপাট্টা) দিয়ে গলা পেঁচিয়ে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়ায় তরুণীটির স্পাইনাল কর্ড টুকরো হয়ে যায়, জিভ কেটে পড়ে। তরুণীটির আর্তচিৎকারে তার পরিবারের সদস্যরা তাকে খুঁজে পায়, থানায় অভিযোগ জানানোর চেষ্টা ব্যর্থ হয় – থানা অভিযোগ নিতে অস্বীকার করেছিল।
২০ সেপ্টেম্বর পুলিশের পক্ষ থেকে অভিযোগ নথিভুক্ত করা হয়, ২২ সেপ্টেম্বর নির্যাতিত তরুণীর বয়ান রেকর্ড করে পুলিশ। বয়ানে তরুণীটি জানায় তাকে ঠাকুর সম্প্রদায়ের (উচ্চ বর্ণের হিন্দু সম্প্রদায়) চারজন গণধর্ষণ করে – তাদের নাম সন্দীপ, রামু, লবকুশ এবং রবি। পরবর্তীকালে খোঁজখবর নিয়ে জানা যায় এরা প্রত্যেকেই এলাকার প্রভাবশালী পরিবারের সদস্য এবং বিজেপি নেতাদের ঘনিষ্ঠ।
নির্যাতিতা তরুণীর বয়ানে এদের নাম থাকা সত্বেও বিজেপি’র পক্ষ থেকে প্রচার করা শুরু হয় সব অভিযোগ ভিত্তিহীন, মৃত্যুর কারন নিয়েও তারা অপপ্রচার শুরু করেন, মৃতার পরিবারের হাতে পুলিশ পোস্টমর্টেম রিপোর্টটুকুও তুলে দেয় নি – জিজ্ঞাসা করলে বলেছে ঐ রিপোর্ট ইংরেজিতে লেখা তোমরা বুঝবে না। তরুণীর মা জানিয়েছেন অনেকদিন ধরেই সন্দীপ এবং লোবকুশ তার মেয়েকে প্রকাশ্যেই বিরক্ত করত। নির্যাতিতার পরিবার দলিত বাল্মীকি সম্প্রদায়ের।
ভয়াবহ অত্যাচারের চিহ্ন সারা শরীরে নিয়ে প্রথমে তাকে ভর্তি করা হয় আলিগরের জহরলাল নেহেরু হাসপাতালে, পরে তাকে স্থানান্তরিত করা হয় দিল্লির সফদর্যং হাসপাতালে। সেখানেই গত ২৯ সেপ্টেম্বর তরুণীর মৃত্যু হয়, পোস্টমর্টেমের রিপোর্টে লেখা রয়েছে গুরুতর আঘাতের দ্বারা সর্ভাইকল স্পাইনাল কর্ডের ভয়ংকর ক্ষতি হবার ফলেই তার মৃত্যু ঘটেছে।
শুরু হয় দেশজুড়ে এই ধর্ষনের ঘটনা এবং তরুণীর মৃত্যুর প্রতিবাদে বিক্ষোভ। প্রকাশ্যে এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় উত্তরপ্রদেশের ‘ এনকাউন্টার ম্যান ‘ মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথএর সরকারের বিরুদ্ধে মানুষ নিজেদের ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকেন। যোগী সরকারের জমানায় গোটা উত্তরপ্রদেশ জুড়েই মুসলমান এবং দলিতদের উপরে অত্যাচারের ঘটনা বেড়ে চলেছে। ক্ষমতাসীন হবার আগেই তার বক্তব্য ছিল প্রথমে উত্তরপ্রদেশ এবং পরে গোটা দেশকেই তিনি রামরাজ্য বানিয়ে ছাড়বেন, সেই কাজে কেউ প্রতিবাদ করলে, বাধা দিলে তাকে সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলা হবে। এমনিতেই উত্তরপ্রদেশ সহ গোটা উত্তর এবং মধ্য ভারতে ধর্মীয় এবং জাতি পরিচয় আজও ভয়ঙ্কর সামাজিক বিভেদের কারণ হয়ে রয়েছে, এই সব রাজ্যের শিক্ষিত অংশের মানুষও এই নিয়ে নীরব দর্শকের ভূমিকায় থাকেন। দলিত সম্প্রদায়ের উপরে প্রভাবশালী উচ্চ বর্ণের সামাজিক, অর্থনৈতিক নিপীড়ন আজও ‘ ডিজিটাল ইন্ডিয়া ‘ – তে প্রতিদিনের ঘটনা। এই তরুণীর মৃত্যুর পরে মিডিয়ার চোখ পড়ে এই ঘটনায় এবং সাথে সাথেই শুরু হলে যায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে এই ঘটনাকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা। প্রথমে নির্যাতিতার মৃতদেহ জোর করে ছিনতাই করে দাহ করে দেয় উত্তরপ্রদেশ পুলিশ। তার পরিবারের সদস্যের সেই দাহ কর্মে থাকা কিংবা মৃতার মুখ দেখার অনুমতি মেলেনি। এর পরেই পুলিশের পক্ষ থেকে পুরো এলাকা ঘিরে ফেলে তিন দিন ধরে চলে পরিবারের উপরে শারীরিক নিপীড়ন, ভয় দেখানো, উদ্দেশ্য চাপে ফেলে বয়ান বদলে দেওয়া। এই পর্বে সংবাদ মাধ্যমের কাউকেই পরিবারের সাথে দেখা করতে দেওয়া হয় নি, বলা হয়েছে উপর থেকে নির্দেশ রয়েছে কাউকেই ঐ পরিবারের সাথে কথা বলা বা দেখা করতে দেওয়া যাবে না। স্বয়ং জেলাশাসক পরিবারের প্রতি হুমকি দিয়ে জানান “এত অভিযোগ কেন?” – সংবাদমাধ্যমের ক্যামেরা ফিরে গেলে তাদের কি হবে, ইঙ্গিত দেন টাকা – পয়সা এবং চাকরির যে সুযোগ সরকারের থেকে দেওয়া হচ্ছে তাই নিয়েই যেন তারা সন্তুষ্ট থাকে, মামলা যেন আর না এগোয়।
সংবাদ মাধ্যমকে এলাকার বাইরে ব্যারিকেডে আটকে রাখার সময় পুলিশের পক্ষ থেকে যুক্তি দেওয়া হচ্ছিল প্রশাসনিক তদন্ত চলছে – SIT (Special Investigating Team) গঠন করা হয়েছে আর তাই সেখানে কারোর যাওয়া চলবে না। পরে দেশজূড়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠলে যোগী সরকারের পক্ষ থেকে এই নৃশংস হত্যাকান্ডের তদন্তে সিবিআই’কে দায়িত্ব দেবার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যদিও সিবিআই’র তরফে দোষীদের চার্জশিট প্রস্তুত করার ক্ষেত্রে বাবরি মসজিদের মামলায় যে নিদর্শন পাওয়া গেছে তাতে সঠিক তদন্ত নিয়েও অনেকের মধ্যে দ্বিধা রয়েছে। তবুও মানুষ এখনও এদেশের বিচার ব্যাবস্থার প্রতি আস্থা রাখছেন। নির্যাতিতার মা সুপ্রিম কোর্টের তত্বাবধানে তদন্তের দাবী জানিয়েছেন।
ইতিমধ্যে বিজেপি বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির প্রতিনিধিরা এবং আরও অনেক সমাজকর্মী এবং সংগঠনের লোকজন বারে বারে পরিবারের সাথে দেখা করার চেষ্টা করতে থাকেন। গতকাল পুলিশ এই ব্যারিকেড প্রত্যাহার করে, সংবাদ মাধ্যমের সামনে নির্যাতিতার পরিবারের লোকজন ভেঙে পড়েন, জানান পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের উপরে অকথ্য অত্যাচার চালান হয় – বয়ান প্রত্যাহার এবং বদল করার জন্য। তাদের স্পষ্ট দাবি তারা বিচার চান, যারা দোষী তাদের যথাবিহিত শাস্তি চান।
আজ গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি, সি আই টি ইউ এবং Agricultural Workers Union এর প্রতিনিধিরা পৌঁছে যান পরিবারটির সাথে কথা বলতে। নির্যাতিতার বাবা, মা এবং অন্যান্যদের সাথে কথা বলেন, জানিয়ে দেন সুবিচার পাওয়ার শেষ অবধি পরিবারটির পাশে থাকবেন সবাই।
এই লড়াই শুধুই সুবিচার পাওয়ার নয় – আজকের ভারতের বুকে অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার, ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং সাম্প্রদায়িকতার যে বিষ প্রতিদিন মানুষে মানুষে বিভেদ তৈরি করছে তার বিরুদ্ধেও। মহিলাদের উপর যেভাবে অত্যাচার নামিয়ে আনা হচ্ছে তা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিস্ট রাজনীতির সুস্পষ্ট রাজনৈতিক কর্মসূচি। এর বিরুদ্ধে আদালতের ভিতরে এবং বাইরে দুজায়গাতেই লড়াই করতে হবে।