Remembering Jalianwala Bagh Massacre

১৩ এপ্রিল, ১৯১৯। আজ থেকে ঠিক ১০১ বছর আগে এই দিনে জালিয়ানওয়ালা বাগে বিশ্বের ইতিহাসের অন্যতম নৃশংস এক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। এতে নিহত হয়েছিলেন ৪০০ নিরস্ত্র মুক্তিকামী ভারতীয় নাগরিক, মতান্তরে সংখ্যাটি সহস্রাধিক। ২০১৯ সালে জালিয়ানওয়ালা বাগ হত্যাকান্ডের শতবর্ষের প্রাক্কালে তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডকে ভারতে ব্রিটিশ ইতিহাসের একটি ‘লজ্জাজনক ক্ষত’  (“shameful scar” on the British Indian history”) বলে উল্লেখ করেন। তবে তিনি ব্রিটিশ পার্লামেন্টারিয়ানদের আগের বিতর্ক অনুযায়ী একটি ছোট্ট আনুষ্ঠানিক ক্ষমাপ্রার্থনার দাবিকে নাকচ করে দিয়েছিলেন। 

ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া ‘জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড’ ঘটে পাঞ্জাব প্রদেশের অমৃতসরের ৬-৭ হেক্টর এলাকাজুড়ে জালিয়ানওয়ালাবাগ নামের একটি বাগানে।

রাওলাট আইন
১৯১৯-এর ১০ মার্চ যখন রাওলাট অ্যাক্ট চালু হল, তখন গান্ধি প্রথম বুঝলেন, ব্রিটিশরা ভারতীয়দের ঠকাচ্ছে। বিচারপতি স্যর সিডনি রাওলাট-এর মস্তিষ্কপ্রসূত ওই আইনে পুলিশকে যে-ক্ষমতা দেওয়া হল, তা পড়লে এখনো হাড় হিম হয়ে যাবে। খবরের কাগজের ওপর নিষেধাজ্ঞা, বিনা-পরোয়ানায় গ্রেফতার, বিনা বিচারে দীর্ঘকাল কারাবাস, গোপনে ‘বিচার’— এ সব তো ছিলই, উপরন্তু অভিযুক্তরা জানতে পারত না কে অভিযোগকারী, কী সাক্ষ্যপ্রমাণ তাদের বিরুদ্ধে হাজির করা হয়েছে। মুক্তি পেলে তাদের জামানত দিয়ে মুচলেকা দিতে হত যে তারা কোনও রাজনৈতিক, শিক্ষাগত বা ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকবে না।  শোনা যায়, স্যর সিডনির প্রপৌত্র ভারতে এসে জালিয়ানওয়ালাবাগের চত্বর দেখে নাকি কেঁদে ফেলেছিলেন। তাঁর প্রপিতামহই তো ওই হত্যাকাণ্ডর আসল কাণ্ডারী।

কী ঘটেছিল সেই দিন
১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল জালিয়ানওয়ালাবাগে জড়ো হন প্রায় ১৫-২০ হাজার ভারতীয়। তাঁদের অধিকাংশই শিখ সম্প্রদায়ের। ভারতীয়রা সেখানে একত্র হয়েছিলেন পাঞ্জাবি নববর্ষ বৈশাখী উদযাপন করতে। পাঞ্জাবের নবান্ন উৎসব পালনের পাশাপাশি তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল দমন-নিপীড়নমূলক রাওলাট আইনের বিপক্ষে প্রতিবাদ জানানো। এই আইনের ফলে খর্ব হয়েছিল গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, শুরু হয় বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার এবং অনির্দিষ্টকালের জন্য যেকোন ভারতীয়কে কারাগারের বন্দী করে রাখা ।  একই সঙ্গে তাদের উদ্দেশ্য ছিল দুইজন গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় নেতা সত্যপাল এবং ডক্টর সইফুদ্দিন কিচলুর গ্রেফতারের বিরুদ্ধেও ক্ষোভ জানানো। কিন্তু বৈশাখী উদযাপন করতে জমায়েত হওয়া নিরস্ত্র মানুষেরা জানতেন না, সে দিন তাদের জন্য কি অপেক্ষা করে রয়েছে।

হঠাৎ করেই বাগানে ঢুকে পড়েন ৫০ জন ব্রিটিশ ভারতীয় সেনা। কর্নেল রেজিনাল্ড ডায়ারের নির্দেশে সাধারণ নাগরিকদের বাগান থেকে বের হওয়ার সব পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়। তার আদেশে এলোপাতাড়ি গুলি চালানো শুরু করে সৈনিকেরা। টানা ১০ মিনিটে প্রায় ১৬৫০ রাউন্ড গুলিবর্ষণ করে তারা। কী হচ্ছে তা বুঝে ওঠার আগেই প্রাণ হারায় উপস্থিত জনতার একাংশ। পালানোর পথ না পেয়ে দেয়াল বেয়ে ওপরে উঠে অন্য পাশে যাওয়ার চেষ্টা করে অনেকে। কেউ সফল হয়ে কোনোমতে প্রাণ নিয়ে বেঁচে যান, কেউ ব্যর্থ হয়ে প্রাণ হারান। বুলেটের আঘাত থেকে বাঁচতে অনেকে কুয়ায় ঝাঁপ দেওয়াকেই শ্রেয় মনে করেন।

জালিয়ানওয়ালা বাগের দেওয়ালে গুলির দাগ

ঐ ঘটনা সম্পর্কে যে রিপোর্ট কর্নেল রেজিনাল্ড ডায়ার ব্রিটিশ সরকারকে দিয়েছিল তার ছত্রে ছত্রে রয়েছে ভারতীয়দের প্রতি নৃশংশতার বর্ণনা । কোনরকম আলাপ-আলোচনার বিন্দু মাত্র সুযোগ না দিয়েই এই হত্যাকান্ড কার্যকরী করেছিল ডায়ার।

“সরু একটি গলির ভেতর দিয়ে আমি উদ্যানে ঢুকলাম। রাস্তা সরু হওয়ায় আমাকে আমার সাঁজোয়া গাড়ি রেখে আসতে হয়েছিল। পার্কে ঢুকে দেখলাম হাজার পাঁচেক মানুষ। একজন মানুষ একটি উঁচু বেদিতে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে নেড়ে ভাষণ দিচ্ছে। আমি সাথে সাথে বুঝলাম মানুষের তুলনায় আমার সাথে সৈন্যদের সংখ্যা অনেক কম। আমি গুলির নির্দেশ দিলাম। দু’শ থেকে তিনশ লোক মারা যায়। এক হাজার ছশ পঞ্চাশ রাউন্ড গুলি চালানো হয়। সন্ধ্যে ছয়টার দিকে আমি সেনা সদর দপ্তরে ফিরে যাই।”

 ব্রিগেডিয়ার ডায়ারের জীবনী-গ্রন্থ বুচার অব দি অমৃতসর লিখেছেন নাইজেল কলেট। তিনি লেখেন – “ব্রিটিশ শাসকদের মধ্যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল মহাত্মা গান্ধির নেতৃত্বে ভারতে যে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন জন্ম নিয়েছে তা ৬০ বছরে আগের সিপাহী বিদ্রোহের মত কোনো বিদ্রোহী তৎপরতার জন্ম দিতে পারে। গণহত্যার ঐ ঘটনার আগ থেকেই অনেক মানুষ বালিশের নীচে পিস্তল রেখে ঘুমোতে শুরু করেছিলো। তাদের ভেতর ভয় ঢুকেছিলো খারাপ কিছু হতে যাচ্ছে। তারা ভয় পাচ্ছিলো ভারতীয়রা তাদের অজান্তেই বিদ্রোহ শুরু করবে এবং ব্রিটিশ পরিবারগুলো হুমকিতে পড়বে, ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যও ধসে পড়তে পারে। এবং সে সময়েই গান্ধী দেশে এসে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করলেন। ব্রিটিশরা এই ধরণের প্রতিবাদের ব্যাপারে অভ্যস্ত ছিলনা। পরিস্থিতি তাদের আয়ত্বের বাইরে চলে যেতে থাকে। তারা এটাকে আর রাজনীতি ভাবতে পারছিলো না। তাদের মনে আরেকটি বিদ্রোহের ভয় ঢুকে গিয়েছিলো।”

অমৃতসরের পরিস্থিতি সামাল দিতেই ব্রিগেডিয়ার ডায়ারকে নিয়ে আসা হয়েছিলো। তিনি এসেই শহরে যে কোন ধরণের সমাবেশ নিষিদ্ধ করে দিলেন। কিন্তু অনেক মানুষ এই সিদ্ধান্তের কথা জানতো না। সার্জেন্ট উইলিয়াম এন্ডারসন ব্রিগেডিয়ার ডায়ারের অধীনে কাজ করতেন। তার বক্তব্য থেকেও স্পষ্ট ঐদিন জালিয়ানওয়ালা বাগে উপস্থিত জনতা কোন ধরণের হিংসাত্মক কর্মসূচী পালন করছিলেন না। ঐ ঘটনা সম্পর্কে পরে তিনি লিখেছিলেন, “যখন গুলি শুরু হলো, মানুষ মাটিতে শুয়ে পড়তে লাগলো। কেউ কেউ উঁচু দেয়াল বেয়ে উঠে পালানোর চেষ্টা করছিলো। তারা যে আমাদের দিকে তেড়ে আসবে, সেই ভয় তখন আমার হয়নি।”

ঐ হত্যাকাণ্ড নিয়ে পরে ব্রিটিশ সরকার একটি তদন্ত করে। রিপোর্টে নিহতের সংখ্যা বলা হয় ৩৭৯। কিন্তু ভারতের করা তদন্তে এই সংখ্যা প্রায় এক হাজার।

রতন দেবী নামে এক মহিলার স্বামী সেদিন ঐ গণহত্যার শিকার হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তার স্বামীর মৃতদেহ নিয়ে যেতে পারেননি। কারণ ব্রিটিশ সরকার ঘটনার পরপরই শহরে কারফিউ জারি করেছিলো।

রতন দেবীর স্মৃতিচারণ ছিল এরকম, “পুরো মাঠ জুড়ে শুধু রক্ত আর রক্ত। আমি আমার মৃত স্বামীর পাশে বসে ছিলাম। কুকুরের হাত থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছিলাম। সারারাত একা এভাবে বসেছিলাম। কানে আসছিলো কুকুরের ঘেউ ঘেউ, মাঝে মধ্যে গাধার চিৎকার এবং অসংখ্য আহত মানুষের কাতরানি।”

নাইজেল কলেট লিখেছিলেন, “ঘটনার পুরো চিত্র যখন পরিষ্কার হলো, ভারতে প্রচণ্ড ক্ষোভ তৈরি হলো। ডায়ারের বিচার দাবি শুরু হলো। কিন্তু ইংল্যান্ডে এই সেনাকর্তা জোরালো সমর্থন পাচ্ছিলেন। ইংল্যান্ডের মানুষজন এটা দেখছিলো এভাবে যে ডায়ার তার দায়িত্ব পালন করেছেন। অনেক বলছিলেন ডায়ার পরিস্থিতির শিকার।”

ডায়ারের সমর্থনে তহবিল সংগ্রহ শুরু হয়েছিলো। ২৬ হাজার পাউন্ড সংগ্রহ করা হয়েছিল। ব্রিটেনে ফিরে আসার পরে তাকে দামি পাথর খচিত তরবারি উপহার দেয়া হয়েছিলো যাতে খোদাই করা ছিল – Saviour of Punjab অর্থাৎ পাঞ্জাবের রক্ষাকর্তা।

ব্রিটিশ সরকার একটি তদন্ত কমিশন গঠন করেছিলো। কমিশন ব্রিগেডিয়ার ডায়ারের সাথে কথা বলে। কমিশনকে তিনি বলেছিলেন, সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা ভাঙ্গার শিক্ষা দিতে চেয়েছিলেন তিনি। “আমি মনে করি যা করেছি ভালো করেছি। দ্বিতীয়বার স্পর্ধা দেখানোর আগে তারা একবার ভাববে।”

ডায়ারকেও তাঁর পদ থেকে অপসারিত করা হয়েছিল। ১৯২২ সালে শঙ্করণ নায়ার যখন একটি বইতে ডায়ারকে ওই ঘটনার জন্য দায়ী করেন, অনুশোচনাহীন সাম্রাজ্যবাদী ডায়ার তখন মানহানির মামলা করে, এবং, আশ্চর্য, সে-মামলা জেতে। পাঁচশো পাউন্ড জরিমানা দিতে হয়েছিল শঙ্করণ নায়ারকে! তবে পাওনাগণ্ডা চুকিয়ে দেওয়ার কতকগুলো নিজস্ব পথ আছে ইতিহাসের। ১৩ মার্চ ১৯৪০ শহিদ উধম সিংহ লন্ডনে ডায়ারকে গুলি করে মারেন। অমর হয়ে আছে বিচারকালে উধম সিংহের উক্তি: ‘এটা ওঁর প্রাপ্য ছিল। আসল অপরাধী তো উনিই। উনি আমাদের দেশের মানুষের মনোবল গুঁড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন, তাই আমিই ওঁকে গুঁড়িয়ে দিলাম। পাক্কা ২১ বছর ধরে আমি বদলা নেবার অপেক্ষায় ছিলাম। আজ সে কাজ করতে পেরে আমি খুশি। মরতে আমি ভয় পাই না। আমি তো দেশের জন্য মরছি। আমি তো দেখেছি ব্রিটিশ শাসনে আমার দেশের মানুষ কী ভাবে না-খেয়ে কাটিয়েছে।’

জালিয়ানওয়ালাবাগের ঐ গণহত্যা ভারতের জাতীয়তাবাদকে আরো তীব্র করে তুলেছিল। গান্ধি লিখেছিলেন আমরা ডায়ারের শাস্তি চাইনা, যে ব্যবস্থা ডায়ারের মত মানুষ তৈরি করে, আমরা তার পরিবর্তন চাই।

নাইজেল কলেট লিখেছেন প্রকৃতপক্ষে ঐ ঘটনার পরই গান্ধির স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হয়। ঐ ঘটনার আগে গান্ধি কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্রিটিশদের কাছ থেকে ছাড় দাবি করছিলেন । কিন্তু এরপর তিনি পুরোপুরি ব্রিটিশ বিরোধী হয়ে যান। ভারতের মুক্তি আন্দোলনের যে প্রক্রিয়া তখনই চলছিলো, তাতে গতি বাড়ে।

এই হত্যাযজ্ঞের প্রতি নিন্দা জানাতেই ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া রাজকীয় সম্মাননা ‘নাইট উপাধি’ প্রত্যাখান করেছিলেন বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর প্রতিবাদপত্রটিতে ফুটে উঠেছিল সেদিনের ভারতের সম্মিলীত ঘৃণা ও প্রতিবাদের ভাষ্য -‘অবমাননার এই অসংগত প্রেক্ষাপটে সম্মানের তকমাগুলি আমাদের লজ্জাকেই আরো প্রকট করে তোলে। আমার তরফ থেকে সকল বিশিষ্টতার চিহ্ন ছেঁটে ফেলে আমি গিয়ে দাঁড়াতে চাই আমার সেইসব তথাকথিত অকিঞ্চিৎকর দেশবাসীর পাশে, অকিঞ্চিৎকরতার মূল্য হিসেবে যাদের এমন অসম্মানের শিকার হতে হল যা মানুষের অযোগ্য’। (The time has come when badges of honour make our shame glaring in the incongruous context of humiliation, and I for my part wish to stand, shorn of all special distinctions, by the side of those of my countrymen, who, for their so-called insignificance, are liable to suffer degradation not fit for human beings.)


Spread the word

Leave a Reply