তন্ময় ভট্টাচার্য
আজ ১২ জুলাই ২০২৫। ১২১ বছর আগের এই ১২ জুলাইতেই লাতিন আমেরিকার চিলির পারাল ভূখণ্ডে জন্ম নিয়েছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রভাবশালী কবি পাবলো নেরুদা। আসল নাম সে দেশের সাংস্কৃতিক প্রথা অনুযায়ী বাবা এবং মায়ের নামের মিশ্রণে রিকার্ডো এলিয়েজার নেফতালি রেইস বাসোয়ালতো। বাবা জোসে দেল কারমেনি রেইস এবং মা রোজা বাসোয়ালতো ওপেসো। বাবা ছিলেন রেলকর্মী। নেরুদার দু বছর বয়সে তিনি পরিবার নিয়ে চলে যান দক্ষিণ চিলির সীমান্তবর্তী শহর টেমুকোয়। সেখানেই কেটেছিল নেরুদার শৈশব। টেমুকো শহর ছিল আরাউকো প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত। এর আরাউ শব্দের অর্থ মাটি আর কো শব্দের অর্থ জল। গোটা আমেরিকা মহাদেশ জুড়ে যাদের ইন্ডিয়ান বা রেড ইন্ডিয়ান বলা হতো তাদের বাসভূমি। এই ইন্ডিয়ানদের সাথে চুক্তি করেই বনজঙ্গল কেটে বসতি স্থাপনকারীদের মধ্যে ছিলেন নেরুদার বাবা।
১৯৪৫ সালে চিলির আইনসভা সিনেটের সদস্য হন পাবলো নেরুদা। যোগ দেন কমিউনিস্ট পার্টিতে। ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে যুক্ত হন শ্রমিক এবং সাধারণ জনতার সাথে। ১৯৪৮ সালে চিলির প্রেসিডেন্ট ভিদেলা পূর্ব ইউরোপের তৎকালীন সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির প্রায় সবার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করেন সাম্রাজ্যবাদী পরামর্শে। দেশের মানুষের স্বার্থবিরোধী এই পদক্ষেপের কড়া সমালোচনা করেন নেরুদা। তাকে গ্রেপ্তারের পরিকল্পনা করেন ভিদেলা। নেরুদা আত্মগোপন করেন। এইসময় তার লেখা অনেক ছড়া প্রতিবাদী শ্লোগান এবং পোস্টার হয়ে লোকের মুখেমুখে ছড়িয়ে পড়ে এবং প্রাচীরপত্রে জায়গা করে নেয়। এই পর্বটিকে তিনি ধরে রেখেছেন ‘পলাতক’ কবিতায়।

স্পেন থেকে দেশে ফিরে নেরুদা বিভিন্ন জনসভায় কবিতা পড়তে শুরু করেন। এই প্রক্রিয়া এতটাই জনপ্রিয়তা অর্জন করে যে বিভিন্ন খনির মজুররা তাদের ডিউটি শুরু বা শেষের সময় নেরুদাকে কবিতা পড়তে আমন্ত্রণ জানান। এভাবেই সাহিত্য বা কবিতাপ্রেমী মানুষের গন্ডি ছাড়িয়ে নেরুদা হয়ে ওঠেন মেহনতি জনতার কবি। আটপৌড়ে একঘেয়ে কাব্যভাষা ছেড়ে উচ্চকন্ঠে উচ্চারণের সহজ সরল ভাষা লাগে তার কবিতার শরীরে। প্রকৃতি আর ইতিহাস, স্বৈরাচারের হাতে দেশবাসীর লাঞ্ছনা আর আমেরিকার মানুষের সত্যিকারের আত্মকথায় ভরা এই কবিতাগুলো স্হান পায় ‘কান্ড সর্বময়’ মহাকাব্যে। এর জনগ্রাহিতা তাকে করে তোলে আরও সহজ আর ঋজু। ১৯৫৪ সালে প্রকাশিত ‘পঞ্চভূতের স্ত্রোত্র’ সাধারণ মানুষের জীবনের ছাঁচে গড়া গান হয়ে জাহাজের খালাসী, রাজমিস্ত্রী, ছুতোর, মুচি, খনিমজুর আর রুটির কারিগরদের মুখে মুখে ঘুরতে থাকে।
পাবলো নেরুদা তখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। ১৯৭০ সালে চিলির কমিউনিস্ট পার্টি প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসাবে তার নাম ঘোষণা করে দেয়। কিন্তু বিভিন্ন বামপন্থী ও সোস্যালিস্ট গ্রুপ ও রাজনৈতিক দল সম্মিলিত ভাবে সালভাদর আলেন্দেকে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী করতে চাইলে কমিউনিস্ট পার্টি এবং স্বয়ং নেরুদা তাতে সম্মত হন এবং আলেন্দের নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে চিলির ইতিহাস নতুনভাবে লেখার পথ প্রস্তুত হয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের কৃতী ছাত্র আলেন্দে তার ছাত্রজীবনে চিলির স্বাস্থ্য পরিষেবা বিষয়ক গবেষণাপত্র তৈরির সময় ক্ষুধাজনিত অসুখকে প্রধান সমস্যা হিসাবে চিহ্নিত করেন এবং অর্থনৈতিক পরনির্ভরতাকে তার কারণ হিসাবে ঘোষণা করেন। পুঁজিবাদের আস্ফালনের বিরুদ্ধে আত্মনির্ভরতার সংগ্রামকে সামনে এনে রাজনৈতিক লড়াইকে নতুনতর ধারায় পরিচালনাই ছিল পপুলার ইউনিটি গভর্নমেন্ট এর ভিত্তি। ব্যক্তি নিয়ন্ত্রিত শিল্প প্রতিষ্ঠান, অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের জাতীয়করণ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে কিউবার পরে একেবারে নাকের ডগায় দ্বিতীয় সমাজতান্ত্রিক দেশের জেগে ওঠার ভয়ে ভীত করে তোলে। পরবর্তী সময়ের নিষ্ঠুরতার ইতিহাস এখানে আলোচ্য নয়। শুধু নেরুদার কথাটা প্রণিধানযোগ্য। এই হত্যালীলা কেন, তার উত্তর খুজতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘যারা হোয়াইট হাউসে বসে গণহত্যার অনুশীলন করে তাদের একজন ভিলেন প্রয়োজন হয়।’ এখানেই থামেননি। আরও বলেছিলেন, ‘আগামীকালটা আমাদেরই, আগামীকালটা শ্রমিকদের।’
নির্বাচনের অব্যনহিত পরেই নেরুদাকে প্যারীতে চিলির রাষ্ট্রদূত করে পাঠানো হয়। প্যারীতে থাকার সময়ই ১৯৭১ সালে পাবলো নেরুদা সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। নোবেল পুরস্কার গ্রহণের মঞ্চে ১৯৭১-এর ১৩ ডিসেম্বর স্টকহোমে নেরুদা যে বক্তৃতাটি করেছিলেন নানান কারণে তা ইতিহাস হয়ে আছে। সেই বক্তৃতার কয়েকটি অংশ এখানে তুলে দেওয়ার লোভ সামলাতে পারছি না।
— আমি লাতিন আমেরিকার কবি। বড় হয়েছি দেশের ভৌগোলিক শূন্যতা দেখে। লেখায় চেষ্টা করেছি রক্তমাংস দিয়ে কিছু শূন্যতাকে ভরাট করতে। এই শূন্যতার মধ্যে অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার, যন্ত্রণা মিলেমিশে আছে……..
আমরা আমাদের শূন্য দেশকে কথায় ভরে দিতে চাই।….. তাই আমার প্রতিটি গান রাস্তার ধারে লাগানো কাঠের পথনির্দেশক ফলক, যাতে পরে অন্য কেউ পথনির্দেশ খোদাই করতে পারে।….. লাতিন আমেরিকার যন্ত্রণাবিদ্ধ ইতিহাসের পথে হাঁটা মানবসাগরের এক মানুষ আমি। এই বিশাল জনগণের ভীড়েই কবি পেয়ে যায় তার কবিতার উপাদান, দেশ পেয়ে যায় তার ঘুরে দাঁড়ানোর পথ।’
পাবলো নেরুদা ভারতে এসেছিলেন দু’বার। একবার পরাধীন ভারতে। জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনেও যোগ দিয়েছিলেন। মহাত্মা গান্ধী এবং মতিলাল নেহরুর সাথে তার কথা হয়েছিল।
দ্বিতীয়বার এসেছিলেন ১৯৫০ সালে। তাকে পাঠিয়েছিলেন জোলিও ক্যুরি। ক্যুরি তখন বিশ্বশান্তি মহাসভার ফ্রান্স শাখার সভাপতি। তিনি নেরুদাকে দিল্লিতে পাঠিয়েছিলেন বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃত্বের সাথে কথা বলে ভারতবর্ষে বিশ্বশান্তি আন্দোলনকে আরও জোরদার করার পরিকল্পনা করতে। নেরুদা এবং ভারত একটি স্বতন্ত্র রচনার দাবি রাখে।
আজ ১২ জুলাই ২০২৫-এ নেরুদাকে শ্রদ্ধা জানাব তারই লেখা একটি কবিতাংশ দিয়ে যা কার্ল মার্কস’র ‘পৃথিবীকে পালটে দাও’ এর সমার্থক।
— ‘আর এত কিছু ব্যথার উপরে
উড়ছে যে নি:শ্বাস
সে আমার কবিতা ;
সবাইকে ডাকছে নিশান
সাদরে জানাচ্ছে অভ্যর্থনা, হাত নেড়ে
ভাগ্যহত আবিষ্কারকের উত্তরাধিকারীকে,
সেই দূরের মা আমার
যিনি আমাকে দিয়েছেন রক্ত
আর আমার কন্ঠ।’
লেখার সঙ্গে ব্যবহৃত ছবি আর্টিফিশিয়াল ইমেজ দ্বারা নির্মিত