general-strike-2025

9 July: The Darkness under the Glowing Laptop

তিতাস

তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রের মতো বৈচিত্রময় জগৎ এইমুহুর্তে বোধ হয় আর দু’টি নেই। এই ক্ষেত্রে কাজ করছেন এমন দুজন মানুষের সামাজিক অর্থনৈতিক পরিসর এত চূড়ান্ত  আলাদা সেটা হয়তো কল্পনাও করতে পারা যায়না যতক্ষন না এদের সামনাসামনি বসিয়ে কথা বলানো হচ্ছে। কেউ ২০,০০০ মাস মাইনের জন্য লড়াই করছে কেউ ২,০০,০০০ পাচ্ছে।

IT Workers

সাদা কলারের এই চাকরিজীবীদের প্রতিনিয়ত যে যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যেতে হয় তা অস্বাভাবিক। যেকোনো কলকারখানার শ্রমিক, প্রকল্প শ্রমিকের সাথে তুলনা করলে দেখা যাবে, চাকরির ময়দানে এরাও একইভাবে শোষিত, কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বেতনের এবং সমাজের তাদের দিকে তাকানোর দৃষ্টিভঙ্গির  তারতম্যের জন্য এদের শোষণ আঁচ পাওয়া যায়না। আমরা তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী ও তথ্যপ্রযুক্তি সহায়ক শ্রমিকদের নিয়ে তৈরি হওয়া CITU  অনুমোদিত একটি ইউনিয়নের সদস্যরা সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আসন্ন ৯ই জুলাইয়ের সাধারণ ধর্মঘটের সমর্থন করি এবং চাই ৯ই জুলাই কর্পোরেটদের ক্রমাগত চলমান মুনাফার চাকা স্তব্ধ হয়ে যাক এই একটি দিন হলেও। কেন?

কারণ, একটু গভীরে ভাবলে শুধু তথ্যপ্রযুক্তি কর্মীরা একা নয়, সাধারণ মানুষ, গিগ কর্মী, চাষী, কলকারখানার শ্রমিক, প্রকল্প-শ্রমিক আমরা প্রত্যেকে  একটা বিরাট চক্রব্যুহতে আটকে আছি, একসাথে।

১০মিনিটে খাবার, ১০মিনিটে মাসকাবারি, ১০মিনিটে প্রয়োজনীয় সব কিছু, যারা আমাদের সামনে হাজির করছে, তারা গিগ শ্রমিক। নব্যপুঁজিবাদের নতুন গিনিপিগ।

নূন্যতম বেতন নেই, কাজের ঘণ্টার হিসেব নেই, সেফটিনেট নেই, স্থায়ী নিয়োগ নেই। বোনাস, মাইনে বাড়া ইত্যাদি তো স্বপ্ন।

এদের কাজ দৌড়ে বেড়ানো। এদের ইনসেনটিভ নির্ধারিত হবে আমি আপনি কত গুলো তারায় ফোনে আঙুল ছোঁয়াচ্ছি তার উপর। কাস্টমারের আঙুলের এদিক ওদিক হলে কাজ যাওয়ার ভয় রয়েছে।

কোম্পানী ভুল কিছু পাঠালে আপনি যাকে গালাগালি করছেন সে এই গিনিপিগ, গিগ শ্রমিক।

আবার বহু তথ্যপ্রযুক্তির কর্মীরা নিৰ্দিষ্ট কোম্পানিতে চাকরি না করে ফ্রিল্যান্সে কাজ করেন। গিগ অর্থনীতিতে  এদেরও  গিগ শ্রমিক বলা হয়।

আমার আপনার কনজ্যুমারিসমে বুঁদ হয়ে থাকা মাথা এই  খোঁজই রাখছি না ১০ মিনিটে ওই জিনিস আমার কাছে পৌঁছে যাচ্ছে কিভাবে!

আমরা খোঁজ রাখছি না ৫০০টাকার জিনিস ঠিক কী কারণে আমি ৩০০টাকায় পাচ্ছি। একটি প্ল্যাটফর্মে ৩০০টাকা, আবার আর একটি প্ল্যাটফর্মে সেটাই ২৫০টাকা। অ্যাপ বদলালে বদলে যাচ্ছে জিনিসটি আমার হাতে আসার নির্ধারিত সময়, বদলে যাচ্ছে তার দাম।

আমরা খেয়াল করছি না ব্লিংকইট, অ্যামাজন, সুইগি, জেপ্টো, ইনস্টামার্টের ক্রমাগত বদলে যাওয়া ক্যারাওসেলের পিছনে লক্ষ লক্ষ তথ্যপ্রযুক্তি শ্রমিক তার নিজের জীবনের ১৫-১৬ ঘণ্টা হারাচ্ছেন প্রত্যেকদিন। ৮ঘণ্টার কাজের হিসেব প্রায় ভুলে গিয়েছেন বেশিরভাগ তথ্যপ্রযুক্তি কর্মীই।  কোভিড পূর্ববর্তী সময়ে একজন কর্মী অফিসে ১০-১১ঘণ্টা কাজ করতেন, বাড়ি ফিরতেন । প্রয়োজন হলে ফোন বা মাঝে মধ্যে খুলে বসতেন ল্যাপটপ। COVID পরবর্তী সময়ে আর পাঁচটা ‘নিউ নরম্যালের’ মতো দিনে যখন তখন যতক্ষন খুশি কাজটাও তথ্যপ্রযুক্তির বা তার সহায়ক কর্মীদের কাছে অত্যন্ত স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। অজুহাত হয়েছে বাড়ি থেকে অফিস বা ওয়ার্ক ফ্রম হোম। কার্যত অলিখিত ভাবেই ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে কাজের নির্দিষ্ট সময়। যদিও কয়েকদিন আগেই নতুন শ্রম কোডের নির্যাসকে মাথায় রেখেই কর্ণাটক সরকার কোনোরকম বেতনবৃদ্ধি ছাড়াই দৈনিক ১২ঘন্টা কাজের নিদান দিয়েছে। 

এদের বেশিরভাগেরই পিঠের শিরদাঁড়া বেঁকে যাচ্ছে, বদহজম, মাথা যন্ত্রণা, স্পন্ডায়োলাইটিস বাড়ছে প্রতিনিয়ত, অথচ এই শ্রমিকরা ঘাড় ঘোরানোর সময় পাচ্ছেন না। কাজের চাপে বাড়ছে মানসিক অবসাদ।কয়েক মাস আগেই দেশের বৃহৎ কর্পোরেটের একটি নামকরা সংস্থায় এক কর্মী অফিসের ভিতরেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।

তাঁর বাড়ির লোক জানিয়েছিল  শরীর খারাপের জন্য দীর্ঘদিন ছুটি চেয়েও তা পাননি তো বটেই, উল্টে চেপেছে অমানবিক কাজের চাপ। কাজের চাপে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন অনেকেই।

বললে অত্যুক্তি হবে না  যে, যে টাটা গোষ্ঠী জনমানসে বেসরকারী ক্ষেত্রে সবচেয়ে ‘সুরক্ষিত এবং কর্মীবান্ধব কোম্পানি’ হিসেবে পরিচিত, ভারতে ‘পিঙ্ক স্লিপ’ কে প্রচলিত  করে এই টাটা গোষ্ঠীই(২০১৪ সালে )। কাজেই কর্পোরেটের মানবিকতা যে কেবলমাত্র নিজের স্বার্থনির্ভর এই নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই। তাই কর্মীদের শারীরিক অবনতি, অবসাদ এমন কি মৃত্যু  অব্দি কর্পোরেটের মুনাফার অপরিসীম লোভ কে কাবু করতে পারছেনা। 

এই ভয়ঙ্কর কাজের চাপেও যেটা স্বাভাবিক হয়ে ওঠেনি সেটা হলো অতিরিক্ত কাজের ঘন্টার হিসেবে অতিরিক্ত মজুরী। কাজের চাপ সামলাতে না পারলে রয়েছে যখন খুশি চাকরি চলে যাওয়ার ভয়।  আপনি অফিসে দাঁড়িয়ে, আরো কিছু কলিগকে জুটিয়ে  জোর গলায় বলবেন যে অতিরিক্ত মজুরি না দিলে অতিরিক্ত শ্রমও ব্যয় হবে না? সাথে সাথে আপনার জন্য তৈরী হয়ে যাবে ছাঁটাই-চিঠি।

মিল পাচ্ছেন কলকারখানার আর ৫জন শ্রমিকের সাথে? কিন্তু অমিলটা হলো একজন তথাকথিত শ্রমিক যেইভাবে তাঁর কাজের পরিসরে ইউনিয়ন করার জোর পান, আপাতভাবে সমাজের উচ্চবিত্ত তথ্যপ্রযুক্তিকর্মী সেই সাহস অর্জন করতে পারেন না অনেকসময়ই। এর একটা বড়  কারণ হলো, এরা বেশিরভাগই জড়িয়ে আছেন EMI  বা মাসিক কিস্তির বেড়াজালে। ফলে চাকরি হারানোর সামর্থ্য বা সাহস কোনোটাই এদের নেই।   তাই  অন্যায় শোষণ ইত্যাদি মুখ বুঁজে মেনে কাজ করে যাওয়াটাকেও এরা সাধারণ বিষয় হিসেবেই মেনে নিয়েছেন।

এই চূড়ান্ত  চাপের সাথে বাড়ছে নিত্যনৈমিত্তিক নতুন প্রযুক্তি শেখার চাপ। কোম্পানী চাপ দিয়ে কাজ করিয়ে নিচ্ছে, চাকরি চলে যাওয়ার ভয় দেখিয়ে সার্টিফিকেট করাচ্ছে, চাপে চাপে সবই হচ্ছে কিন্তু প্রতিবছর ইনফ্লেশন রেট মেনে বেতন বাড়ছে না। বোনাসের বা বেতন বৃদ্ধির  সময় এলেই কমে যাচ্ছে কোম্পানির মুনাফা! অথচ কোম্পানির বিভিন্ন পোর্টাল বা স্টক পারফরমেন্স দেখলে বোঝাই যাচ্ছে যে মুনাফা কমেনি উল্টে বেড়েছে। কিন্তু টুঁ শব্দ করলে রইলো চাকরি চলে যাওয়ার ভয়।

একটু আগে যে চক্রব্যূহর কথা লিখছিলাম তারই আরেক শিকার হলো ITES  অর্থাৎ তথ্যপ্রযুক্তি সহায়করা। অনলাইনে কেনা জিনিসপত্র একটু উনিশ বিশ হলে আমরা ফোন করছি যে কাস্টমার কেয়ারে তার তথ্যপ্রযুক্তি সহায়ক শ্রমিক (ITES) আমার ভর্ৎসনা শুনছে কেনো জিনিস এদিক ওদিক হলো। যে  জিনিসের উৎপাদন বা সরবরাহ কিছুতেই তিনি জড়িত নন, কিন্তু উপভোক্তার চাপের মুখে তাকেই ৫মিনিটের নির্ধারিত সময়ের চ্যাট বা কলে সমাধান দিতে হবে ,সব সমস্যার সমাধান। উপভোক্তার পছন্দ না হলে ফোন আঙুল বুলিয়ে কয়েকটা স্টার কম দিলে টিম লিডার, ম্যানেজার এসে কর্মীটিকে শাসিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। টার্গেট মনে করিয়ে দিয়ে যাচ্ছে।  পরিষেবা ভিত্তিক তথ্যপ্রযুক্তি সহায়ক ক্ষেত্রে এই  দৃশ্য প্রতি অফিসের প্রতি কিউবিকলে।

এই ITES  শ্রমিকের বেশিরভাগেরই বেতন ৭হাজার থেকে শুরু করে ২৫ বা ৩০হাজার টাকা। অর্থাৎ  অধিকাংশই  বেতন পান ২৬০০০টাকারও নিচে। সারাদিনে ছোট-বড় বিরতি মিলিয়ে ১ঘণ্টার ৫মিনিটও  বেশি বিরতি নিলে কাটা যেতে পারে অর্ধেক দিনের ছুটি।

২১০০০ এর নিচে বেতন প্রাপ্ত কর্মীদেরও দেওয়া হচ্ছে না ESI এর সুযোগ। বিশাখা গাইডলাইন, POSH কমিটি  ইত্যাদি ছোটোখাটো IT/ITES কোম্পানিগুলিতে অলীক স্বপ্ন। ফলে মহিলা কর্মীরা কর্মক্ষত্রেও সুরক্ষিত নন।  মাতৃত্বকালীন ছুটি নিলে ফিরে এসে দেখছেন হয় চাকরি চলে যাচ্ছে বা সরিয়ে দেয়া হচ্ছে তুলনামূলকভাবে কম গুরুত্ত্বপূর্ণ পদে। 

SEZ অফিসেও নেই ক্রেশের ব্যবস্থা। মহিলা  এবং পুরুষ কর্মীদের বেতনের তারতম্য? তাও আছে। নেই বেতনের আশ্বাস, নেই চাকরির স্থায়িত্ব। অধিকাংশ তথ্যপ্রযুক্তি বা তথ্যপ্রযুক্তি সহায়ক কর্মীই কাজ করেন কনট্রাক্ট -এর  উপর নির্ভর করে। নেই কাজের জায়গায় সুরক্ষা।  অথচ বেশিরভাগ মানুষ এসি অফিসে বসা এই শ্রমিকদের আপাত ঝাঁ চকচকে জীবন দেখে ভেবেই নিয়েছেন এরা আসলে ‘শ্রমিক’ নন।  নিতান্তই চাকুরীজীবি। বললে ভুল হবে না  যে বেশিরভাগ তথ্যপ্রযুক্তি কর্মীও এই কথাই ভাবেন।

যেই সময়ে দাঁড়িয়ে সরকারি চাকুরিজীবীদের উপর নেমে আসছে বেসরকারিকরণের প্রবল চাপ, সেই সময়ে দাঁড়িয়ে চাকরি জীবনের শুরুর দিন থেকে বেসরকারি চাপের মুখে কাজ করে যাচ্ছেন যারা  ৯ই জুলাইয়ের ধর্মঘট তাদের জন্য আলাদা গুরুত্ত্ব রাখবে একথা  বলা বাহুল্য।

বেশিরভাগ কর্মীর নিজেকে আর বাকি শ্রমিকদের থেকে আলাদা ভাবার যে প্রবণতা তার জন্য দাঁড়িয়েই আজ তাদের প্রতি এই প্রবল শোষণ।

গিগ, কারখানা বা বন্দরের শ্রমিক, সরকারি চাকুরীজীবি, প্রকল্প-শ্রমিক , চাষী এদের সবার মতোই আমরা তথ্যপ্রযুক্তি কর্মীরাও আসলে শ্রমজীবী, একইভাবে পুঁজিবাদের থাবার নিচে চ্যাপ্টা হচ্ছি প্রত্যেকদিন। ধরণ আলাদা হলেও, দিনের শেষে শোষণ একইরকমের। শুধু উঁচু উঁচু অফিসের মোটা কাঁচ ভেদ করে সমাজ এই শোষণকে একভাবে ভাবতে পারেনি এখনো, হয়তো!

কর্পোরেটদের মুনাফার প্রতি লোভ , বর্তমান কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের কর্পোরেট-প্রেম এইসবের পাকেচক্রে জড়িয়ে পড়ে আমরা নিজেরাও বুঝছি না এই গোটা একটা জালে আমরা সাধারণ মানুষ , তথ্যপ্রযুক্তি  শ্রমিকরা, তথ্যপ্রযুক্তি সহায়ক শ্রমিকরা, গিগ শ্রমিকরা,   অন্যান্য ক্ষেত্র শ্রমিকরা, চাষী , পরিবহন কর্মী জড়িয়ে আছি।  আমরা সবাই শ্রমিক, সবাই উপোভোক্তা।  আর আসল সুতো নাচাচ্ছে কর্পোরেট, যাদের ছেলের ১০০০কোটি টাকা খরচ করা  বিয়েতে  গিয়ে আমার আপনার ভোটে জেতা মন্ত্রী, আমার আপনার এই শ্রমিকদের দেওয়া ট্যাক্সের টাকায় বেতন পাওয়া মন্ত্রীরা উৎসব করছে।

গোটাটাই একটা চক্রব্যূহ। আমরা ফাঁসছি, ওরা ফাঁসাচ্ছে। আমরা কেউ আলাদা নই। আমরা সবাই এক। আর তাই ৯ই জুলাইয়ের ধর্মঘট কোনো বিশেষ শ্রেণীর নয়, সাধারণের। তথ্যপ্রযুক্তি কর্মীরা এই ধর্মঘটে অংশ নিলেও আমরা জানিনা  পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তার প্রভাব কিভাবে নির্ধারিত হবে কিন্তু তা স্বত্ত্বেও এই ধর্মঘট সফল করার সর্বত চেষ্টা তথ্যপ্রযুক্তি কর্মীরা করবে।

Spread the word

Leave a Reply