বাবিন ঘোষ
এ দেশে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে যে বিরাট আন্দোলন চালিয়ে শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করা সম্ভব হয়, তাতে আসমুদ্রহিমাচলব্যাপী ভারতের জনগনের অংশগ্রহণ ছিল। আরো নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত মানুষের তরফে ব্যাপকভাবে এবং কিছুটা উচ্চবিত্তের অংশগ্রহণ ছিল।

কিন্তু জাতীয় চেতনার এই উণ্মেষে সকল রাজনৈতিক লড়াই যে শুধুমাত্র বিদেশী শক্তির ঔপনিবেশিক শাসনকেই লক্ষ্য করেই লড়া হয়েছিল, তা নয়। কিছু খুব গুরুত্বপূর্ণ লড়াই / অভ্যুত্থান ঘটে যায় ব্রিটিশরাজের দেশীয় সহযোগী শক্তির বিরুদ্ধেও। প্রকৃত প্রস্তাবে এই লড়াইগুলো বুঝিয়ে দেয় যে শুধুমাত্র বিদেশীদের সাম্রাজ্যবাদী শাসনই দেশের বেশিরভাগ মানুষের দুরবস্থার জন্য দায়ী ছিলনা, বরং সেই ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার জন্য দেশীয় বহু কায়েমী স্বার্থের ও বড় ভূমিকা ছিল। উপনিবেশবাদ শুধুমাত্র বিদেশী রাষ্ট্রশক্তির স্বার্থে উপনিবেশের মানুষের শ্রমশক্তির আদিম আত্মসাৎ নয়, বরং তা দেশীয় এক বা একাধিক শ্রেণীর মাধ্যমে সেই শাসনের পক্ষে লেজিটিমেসি বা বৈধতা নির্মাণ করতে থাকে। ১৮৫৫’র সাঁওতাল বিদ্রোহ কোনো হঠাৎ করেই ঘটে গিয়ে থেমে যাওয়া ‘একটি’ ঘটনা ছিল না। তার আগে এবং পরের আরো বেশ কিছু গণঅভ্যুত্থানের ধারাবাহিকতার মধ্যে এটিকে place করতে হবে। সাঁওতাল বিদ্রোহ বা বিদ্রোহসমূহের গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক অবদান হল’ যে সেগুলি ভারতে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের পক্ষে এই ‘বৈধতা নির্মাণ’কেই বিরাট চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড় করাতে পেরেছিল। পরবর্তীকালে গান্ধীর নেতৃত্বাধীন জাতীয় আন্দোলন-ও বারেবারে এই বৈধতাকে চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড় করিয়েছে। কিন্তু সে আন্দোলনের নেতৃত্বে থেকেছে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত, দেশের তদানীন্তন উদীয়মান বুর্জোয়া শ্রেণী। অথচ সে সকল আন্দোলনের প্রায় ৫ দশক আগেই প্রান্তিক জনজাতির একেবারে গরিব খেটে খাওয়া মানুষেরা এই বৈধতাকে কঠিন চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড় করায়।
এ তথ্য আজ সর্বজনবিদিত যে ‘সাঁওতাল পরগণার’ মানুষের বিপুল অংশগ্রহণ ঘটেছিল এই বিদ্রোহে, যার মূলে ছিল দেশীয় জমিদার এবং মহাজন শ্রেণীর তরফে গরিব সাঁওতালদের ওপর বল্গাহীন লুঠ। সরকার নিযুক্ত স্পেশাল কমিশনার এশলি ইডেন এবং অন্যান্য আরো ব্রিটিশ আমলাদের বয়ানে ফুটে ওঠে বহিরাগত জমিদার মহাজনদের হাতে সাঁওতালদের ভয়াবহ শোষণের চিত্র। কিন্তু এই শোষণের অর্থনৈতিক ভিত্তিটা, তার একেবারে গোড়ায় ছিল সেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর আমলের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বিখ্যাত ‘পালামৌ’-এ একেবারে ছবির মত বর্ণনা রয়েছে কীভাবে ‘সভ্য সমাজের’ আর্থিক আইনকানুন একটি বৌদ্ধিক বা ব্যবহারিকভাবে অপ্রস্তুত ‘অসভ্য সমাজ’ মানে সাঁওতালদের ওপর রাতারাতি চাপিয়ে দেওয়ার ফলে কী মারাত্মক আর্থসামাজিক বিকৃতির সৃষ্টি হয় ।
ঐতিহাসিকভাবে নিষ্কর জমিতে বসবাস, চাষাবাদ করে খেটে খাওয়া শক্ত সমর্থ এই মানুষগুলো খুব অল্প সময়ের মধ্যে বহিরাগত জমিদার / মহাজনদের প্রায় ক্রীতদাসে পরিণত হয়েছিল। জমিকে ক্রয়-বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত করা হয় কোম্পানীর শাসনে, সাথে সাথে ব্রিটেনের শিল্পবিপ্লব পরবর্তী organisations of production দ্রুত হটিয়ে দেয় তুলনামূলকভাবে বহু যোজন পিছিয়ে থাকা তদানীন্তন ভারতের হস্তশিল্পকে। ফলতঃ জমির ওপরে ভারতীয়দের নির্ভরশীলতা আরো বেড়ে যায়। এর ওপর চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কল্যাণে জন্ম হয় বংশানুক্রমিক জমিদারশ্রেণীর, যারা এই ভূসম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে দেশের কোটি কোটি মানুষের ওপর মুষ্ঠিমেয় মানুষের এক সামন্ত শ্রেণীর প্রভুত্ব পেয়ে গেল। বহু মুৎসুদ্দি বেনিয়াও জমি কেনাবেচার আইনি সুযোগে জমিদারি কিনে এই সামন্ততন্ত্রের অংশ হয়ে উঠল। বস্তুতঃ অষ্টাদশ শতকের শেষ থেকে উনবিংশ শতকের প্রায় শেষ অবধি এ দেশে আর্থসামাজিক ভাবে ক্ষমতাবান হওয়ার প্রায় একমাত্র পথ রয়ে গেল জমিদার হয়ে ওঠা। সেই জমিদারির ক্ষমতা সময়ের সাথে সাথে বাড়ানোর রাস্তা ছিল নতুন নতুন জমির খন্ড নিজের নিজের জমিদারিতে যোগ করা। মানে, মুনাফার সর্বোচ্চায়ন ঘটানোর রাস্তাই তখন যথাসম্ভব বেশি জমির ওপর কর্তৃত্ব কায়েম করা। ঔপনিবেশিক শাসকের কাছে আর্থসামাজিক এই মডেল সম্পূর্ণ গ্রহণযোগ্য ছিল। এক দিকে ঔপনিবেশিক সরকার জমির ওপর খাজনা থেকে আয় করে যেতে থাকল’, অন্য দিকে সেই জমি থেকেই উৎপন্ন কাঁচা মাল সস্তায় কিনে তা দিয়ে বিবিধ পণ্য প্রস্তুত করে এ দেশেরই মানুষকে অনেক বেশি দামে তা কিনতে বাধ্য করতে পারল’। জমিদার শ্রেণী সেই লুঠের কাজে যোগ্য সঙ্গত দিয়েছিল। মাঝে মধ্যে ব্রিটিশ সরকারের সাথে জমিদারশ্রেণীর কিছু ঠোকাঠুকি লাগলেও মোটের ওপর এই ব্যবস্থাই দুই তরফের কাছেই যথেষ্ট লাভজনক ছিল। উপরন্তু জমিদারের লেঠেল বাহিনী সরকারের যাবতীয় দমনপীড়নে সহযোগী শক্তি হয়ে কাজ করেছিল।
একটা সময়ে এসে এই জমিদারি ব্যবস্থা গিলে খেতে চাইল’ পাহাড়, বনাঞ্চল। এসব অঞ্চলে যুগযুগ ধরে বাস করা জনজাতিগুলি ঐতিহাসিকভাবেই আর্থিক আদান প্রদান এর সমসাময়িক রীতিনীতির সাথে অভ্যস্ত ছিলনা। তাদের নিজেদের অন্তর্মুখী সমাজ সংগঠন বাইরের জগতের সাথে খুব বেশি interact ও করত’ না। এইরকম জনজাতিগুলোর মধ্যে সাঁওতালদের বৈশিষ্ট্য ছিল অনাবাদী পোড়ো বা জঙ্গলখন্ডকে চাষযোগ্য করে তোলায়। কঠোর পরিশ্রমী এই মানুষগুলো সকল যুগেরই বৃহত্তর আর্থসামাজিক জটিলতার থেকে নিজেদের মোটামুটি বাইরে রেখে খুব অল্প চাহিদায় নিজেদের জীবন কাটিয়ে দিত’। তদানীন্তন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সীর অন্তর্গত রাজমহল-বীরভূম-মানভূমের রাঢ় অঞ্চলের ‘দামিনি কোহ’ জায়গাটির ও ইতিহাস সাঁওতালদের নিয়োগ করে বনাঞ্চল সাফ করে চাষযোগ্য এবং ঔপনিবেশিক শাসনের মূল নীতি অনুযায়ী, খাজনার আদায়যোগ্য করে তোলার ইতিহাস। এই ইতিহাসে দু’বার দুটি ভয়ঙ্কর বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের তরফে। এই বেইমানির ইতিহাসে কলঙ্কজনক ভূমিকা রয়েছে এ দেশের জমিদার মহাজন শ্রেণীর-ও।
প্রথম বিশ্বাসঘাতকতা ঘটে যখন সাঁওতালদের এই অঞ্চলে নিয়ে আসে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কর্তারা। তাদেরকে দিয়ে শ্বাপদসংকুল এই বিস্তীর্ণ বনাঞ্চল সাফ করিয়ে চাষযোগ্য করা হয়। কঠিন মাটি, প্রকৃতির চন্ড শক্তির সাথে প্রাণ হাতে করে লড়াই চালিয়ে সাওতালেরাই এই অঞ্চলে সর্বপ্রথম কৃষিকাজ শুরু করে। তাদের সাথে সরাসরি দেনাপাওনার সম্পর্ক থাকে কোম্পানী সরকারের। রাজস্ব বিভাগের নথি থেকেই দেখা যায় যে ১৮৩৮ থেকে ১৮৫১ সাল, মানে ১৩ বছরের মধ্যে ঐ অঞ্চলের কৃষি রাজস্ব প্রায় ১২ গুন বেড়ে যায়। জনসংখ্যা বাড়ে প্রায় ৮ গুন। মহাভারতের ময়দানবের মতই জঙ্গল কেটে খান্ডবপ্রস্থকে যেন ইন্দ্রপ্রস্থে পরিণত করেছিল অনার্য lineage-এর এই সকল সাঁওতালেরা। ব্যবস্থা একরকম চলছিল। দারিদ্র্য, কঠিন শ্রম, এসবের সহাবস্থান সত্ত্বেও স্বভাব-শান্ত সাওতালেরা কোনো ‘হাঙ্গামা’য় প্রবৃত্ত হয়নি। কিন্তু পরিস্থিতি পালটে যায় যখন এইসব জমির ক্রমবর্ধমান কৃষি উৎপাদন দেশীয় জমিদারদের চোখে পড়ে যায়। কোম্পানীর শাসকদের সাথে lobby করে তারা এই অঞ্চলে জমিদারি পত্তনের অনুমতি আদায় করে। সাঁওতাল আর সরকারের মধ্যে গজিয়ে উঠল পরশ্রম আত্মসাৎকারী এই জমিদারশ্রেণী। খাজনার হার বাড়তে থাকল’ দ্রুত, খাজনা আদায়ের পদ্ধতি হয়ে উঠল’ লুঠতরাজের নামান্তর। এর সাথে সাথে এইসব অঞ্চলে রেললাইন বসানো শুরু হতে হতেই সস্তার শ্রমিক হিসাবে সাঁওতালদের নেওয়া হল’, যে পেশায় অত্যল্প মজুরি, মারাত্মক খাটুনি আর নিত্যনৈমত্তিক লাঞ্ছনা ছিল দস্তুর। সাঁওতাল নারীরা হয়ে উঠল’ এই তাবৎ দু:শাসনদের লোভের, ভোগদখলের বস্তু। জুটল’ এসে আরেক বিপদ, তেজারতির কারবার করা মহাজনেরা।
যে সমাজে অর্থের বিনিময়ে বেচাকেনাটুকুও সরগড় হয়নি মানুষের মধ্যে, সেই সমাজে এই মহাজন জোঁকের পাল এসে জুটল’ চড়া সুদে টাকা ধার দিতে। প্রথাগত শিক্ষায়, অক্ষরজ্ঞানের দিক থেকে প্রায় অপ্রশিক্ষিত সাঁওতালদের দাসব্যবস্থায় নিয়ে গেল’ এরা ” চুক্তিপত্র” করে। সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বর্ণনায় “সামকনামা” বলে এক ধরনের চুক্তির বর্ণনা রয়েছে, যাতে সামান্য কিছু টাকা কর্জ নেওয়ার পরিবর্তে একেকটি সাঁওতাল পরিবারকেই বংশানুক্রমে আইনবলে দাস হিসাবে ব্যবহার করা যেত’। কার্ল মার্কস ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অভিঘাত প্রসঙ্গে যে ধ্বংসের কথা লিখেছিলেন, তার সবচেয়ে ভয়াবহ একটি কেস স্টাডি হল’ উনবিংশ শতকের বেঙ্গল প্রভিন্সের এই ‘Santhal Problems’। সাঁওতালদের চিরাচরিত জীবনযাত্রাকে ধ্বংস করে, স্বাধীন কৃষক / শিকারী / বনজ সংগ্রহকারী থেকে তাদের প্রায় শেকলবন্দি ভূমিদাসে পরিণত করা হল’। বহিরাগত মহাজন/কারবারিরা তাদের নিজেদের জায়গায় ফিরে গিয়ে বলাবলি করত যে কম সময়ে দুহাতে রোজগার করতে চাইলে এইসব অঞ্চলে যাওয়া উচিত! ফরচুন হান্টার্সদের মৃগয়াভূমি হয়ে উঠল দামিনি কোহ আর তাদের শিকার হল সাওতালেরা। পাঁচ পুত্রসন্তান সমেত এক নিষাদরমণীকে বারণাবতের জতুগৃহে সামান্য খাদ্য পানীয়ের লোভ দেখিয়ে এনে তারপরে পুড়িয়ে মারতে হাত কাঁপেনি আর্য বীর পঞ্চপান্ডবের। মহাকাব্যের সেই অংশটির আরো অনেক বেশি সময় ধরে পুনরাবৃত্তি ঘটেছে আঠারো শতকের চারের দশক থেকে ১৯৪৭ অবধি। তার পরেও বিরাট কিছু উন্নতি যা কিনা পরবর্তী ৭৮ বছরে প্রত্যাশিত ছিল’, তা যে ঘটেনি, গত দু দিনের মধ্যেই ছত্তিশগড়ের বিস্তীর্ণ বনাঞ্চল আদানিদের স্বার্থে সাফ করতে শুরু করে দেওয়া থেকেই বোঝা যায়। নিষাদদের জতুগৃহে পাঠাতে না পারলে, সকল প্রাণীসমেত খান্ডবদাহন করিয়ে পুঁজির অগ্নিদেবের খিদে মেটাতে না পারলে বর্ণশ্রেষ্ঠদের জন্য ইন্দ্রপ্রস্থের নির্মাণ কী করেই বা সম্ভব হবে? কাজেই সাওতালেরা কেন অস্ত্র তুলে নিয়েছিল ১৮৫৫ সালের ৩০শে জুন, কেন তারা হুলের ডাক দিয়েছিল, তার উপলব্ধি কঠিন কিছু নয়।
সেই হুল খাতায় কলমে হেরে গেছিল ব্রিটিশ মাস্কেটের মুখে, মুর্শিদাবাদের নবাবের হাতির পায়ের নীচে, প্রায় ১৫ হাজার সাওতালের শাহাদাতে৷ কিন্তু সরকার বুঝেছিল বিপদ। ব্রিটিশ অফিসারদের জার্নালে, রিপোর্টে বারে বারে স্বীকার করা হয়েছে সাঁওতালদের দাবির ন্যায্যতার কথা। সাঁওতালদের honour in the battlefield এর ভূয়সী প্রশংসা রয়েছে এশলি ইডেনের লেখায়। শত্রুর দিকে তারা বিষ না মাখানো তীর ছুঁড়েছিল। হত্যার উদ্দেশ্যে নয়, নিজেদের ন্যায্য অধিকারের দাবিতে তাঁরা অস্ত্র তুলেছিলেন। সরকার সিদ্ধান্ত নিল’ যে সাঁওতালদের সাথে এই বেইমানির উপশমের ব্যবস্থা করতে হবে। ১৮৫৫ সালে মূলতঃ স্যার জন ক্যাম্পবেলের উদ্যোগে গোটা সাঁওতাল পরগণাকে সরকারি মানচিত্রে নিপুন হাতে এঁকে দিয়ে non-regulation area ঘোষণা করা হল। মানে, সেখানে সরকারি আইন কানুনের বেশিরভাগই খাটবে না এবং সাঁওতালদের জাতীয় রীতিনীতি অনুযায়ী তাঁরা সে অঞ্চলে জীবযাপন করবে। খাজনার হার অনেক খানি কমানো হল। তেজারতির সুদের হারের উর্ধ্বসীমা বেঁধে দেওয়া হল। এই বন্দোবস্তে তেমন কিছু সোনায় মুড়ে দেওয়া হয়নি সাঁওতালদের, তবু তাঁরা খানিক নি:শ্বাস নেওয়ার পরিসর পায়। তারা কিন্তু সেটুকুতেই খুশী হয়েছিল। কিন্তু সামন্তপুঁজি সেটুকু concession-এও খুশী থাকতে পারেনি। তাদের মুখপত্র (অমৃতবাজার পত্রিকা, হিন্দু পেট্রিয়ট) কান্নাকাটি করে যেতেই লাগল হিন্দু জমিদার আর মহাজনদের প্রতি ঘটে যাওয়া এ ‘অন্যায়’ নিয়ে! সামন্তবাদ আর তার তদানীন্তন মনিব উপনিবেশবাদ ধার দিতে থাকল তাদের অস্ত্রে। সে অস্ত্রের নাম মহাভারতে বলা হয়েছে ‘ত্রাষ্ট’। এ অস্ত্রে শত্রুপক্ষ স্মৃতি হারিয়ে ফেলত। যুদ্ধ আর করবে কী! ১৮৫৫’র হুলের এই স্মৃতির মৃত্যু ঘটা অবধি তারা অপেক্ষা করল।
পরের বেইমানিটা ঘটল এর ২০ বছর বাদে যখন বড়লাট লর্ড নর্থব্রুকের আমলে আবারো ব্রিটিশরাজের আইনকানুন এই অঞ্চলে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা শুরু হল। ১৮৭২ সালের বেঙ্গল গভর্ন্মেন্ট রিপোর্ট (পলিটিকাল) এ দেখা যায় স্যার জন ক্যাম্পবেলের মতামত ক্রমশ: কোনঠাসা হচ্ছে, বড়লাট নর্থব্রুক সেক্রেটারি অফ স্টেট ডিউক অফ আর্গিল ফিরিয়ে আনতে চাইছে আবারো তাদের দেশীয় তল্পিবাহকদের আচ্ছে দিন। শেষ পর্যন্ত ১৮৫৫ সালের Santhal Parganas Act কে খর্ব করা হল ১৮৭৫ নাগাদ। শাসকদের ভুলটা হল’ অন্যত্র। যে স্মৃতির মৃত্যু ঘটেছে বলে তারা ভেবেছিল’ সেই গণ-স্মৃতি সুপ্তি থেকে জেগে উঠল সাঁওতাল সমাজে। শুরু হল লড়াইয়ের আরেক অধ্যায়। ১৮৮০ সালে আরেক আন্দোলন জন্ম নিল।
সাঁওতাল বিদ্রোহ ১৮৫৭’র মহাবিদ্রোহের মাত্র ২ বছর আগে ঘটে। সশস্ত্র এই আন্দোলনের লক্ষ্যবস্তু হয় দেশীয় জমিদার, মহাজন আর রেলের কর্তারা। এই তিন গোষ্ঠীকেই প্রত্যক্ষ অত্যাচারীর ভূমিকায় সাওতালেরা দেখেছিল। তারা লুঠ করেছিল মূলত: খাদ্যশস্য। তাঁরা ধ্বংস করেছিল মহাজন/ জমিদারের কাছারি আর রেলবাবুদের বাংলো। তাদের লড়াইয়ের অনুপ্রেরণা ছিল তাঁদের সুপ্রাচীন ঈশ্বরবিশ্বাস। তাঁদের বিষ্ময়কর সাহসের উৎস ছিল তাঁদের প্রকৃতির প্রতি ভালবাসা এবং নিজেদের মধ্যে চিরকালীন ঐক্য। তারা কোনো রাজ্যবিস্তারের জন্য লড়াই করেনি, উপার্জন বা সঞ্চয়ের জন্য লুঠ করেনি, নিছক হত্যার উদ্দেশ্যে লড়াই করেনি। তাঁরা তাঁদের শত্রুপক্ষের সমীহ ও শ্রদ্ধা আদায় করে নিতে পেরেছিলেন। খুব স্বাভাবিক কারণেই তাঁদের বিশ্ববীক্ষা ছিল সীমিত, লড়াইয়ের উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশরাজের উচ্ছেদ নয়, বরং অন্যায্য খাজনা আর দেনার জালের বিলোপ ঘটানো। বৃহত্তর জাতীয়তাবাদ নয়, বরং এই লড়াইকে প্রত্যক্ষ এক শ্রেণীর বিরুদ্ধে আরেক শ্রেণীর লড়াই হিসাবেই হয়তো দেখতে হবে। তবুও, প্রকৃত প্রস্তাবে সাঁওতাল বিদ্রোহ বা হুল এ দেশের অন্ত্যজ জনজাতির তরফে সম্ভবতঃ প্রথম ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ আন্দোলন লুঠেরা রাজের বিরুদ্ধে। মানুষ হিসাবে একটি জনজাতির স্বীকৃতি আদায়ের লড়াইও বটে।