বাবিন ঘোষ
Never forget the 18th April, 1930
Never forget the 18th April, 1930, the day of Easter Rebellion in Chittagong. Keep ever fresh in your memory the fights of Jalalabad, Julda, Chandannagar and Dhalaghat. Write in red letters in the core of your hearts the names of all patriots who have sacrificed their lives at the altar of India’s freedom.
My earnest appeal to you- there should be no division in our organization. My blessings to you all, inside and outside the jail. Fare you well.
Long Live Revolution.
Bande Mataram.
Surya Kumar Sen
Chittagong Jail
11th Jan., ‘34, 7 PM.

পরাধীন ভারতের এক রাজবিদ্রোহীর এই ছিল শেষ চিঠি। কাকে? তাঁর পরিবার পরিজনকে নয়, তাঁর লড়াইয়ের সহযোদ্ধাদের প্রতি। জালালাবাদ থেকে ধলঘাটের লড়াইকে মনে রেখে দেশের স্বাধীনতার লড়াইয়ে শাহাদাৎ বরণকারী বিপ্লবীদের যেন না ভুলে যাওয়া হয় আর সংগঠন যেন ক্ষতিগ্রস্থ না হয়, শেষ চিঠিতে এই দুটি মাত্র ‘চাহিদা’ ছিল তাঁর। মৃত সূর্য সেন-কেও এতখানি ভয় ছিল ব্রিটিশরাজের যে তাঁর মরদেহ অবধি পরিবারের হাতে হস্তান্তর না করে গভীর রাতে সমুদ্রের জলে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছিল।
কীসের ভয়?
অবিভক্ত বাংলা তথা সারা ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের ইতিহাস ১৯৩০ এর বহু আগের। পলাশীর যুদ্ধের পর এক দশক ঘুরতে না ঘুরতেই শুরু হল’ সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ। ভয়ানক খাদ্যাভাবের সময়ে লুঠেরা কোম্পানীরাজের একেবারে “আদিম আত্মসাৎ” বিদ্রোহী করে তুলল’ প্রান্তিক গ্রামীন মানুষকে। মজনু শাহ, চিরাগ আলি থেকে থেকে ভবানী পাঠক, বৈকুন্ঠপুর থেকে মুর্শিদাবাদ হয়ে বক্সা অবধি ফকির- সন্ন্যাসীদের নেতৃত্বে ভূমিহীন চাষি, কর্মচ্যুত গ্রামীন হস্তশিল্পী, বেকার হয়ে যাওয়া সৈন্য থেকে জমি-খোয়ানো ভূস্বামীদের একাংশ, অস্ত্র তুলে নিয়েছিল ব্রিটিশ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানীর নৃশংস শোষণের বিরুদ্ধে। বল্গাহীন সন্ত্রাস এবং দিশি সহযোগী শক্তিদের (বড় জমিদার, নবাব) মদতে এই বিদ্রোহকে দমন করা হল’।
চুয়াড়, পাহাড়িয়া, পাইক বিদ্রোহ হতে হতে উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি শুরু হল’ সাঁওতাল বিদ্রোহ। এই গোটা সময়কালে কোম্পানীর লুঠেরা শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াইটা মূলতঃ নিম্নবর্গের মানুষ লড়েছিলেন। এই লড়াইগুলির মধ্যে একটি ‘কমন থিম’ ছিল’ যে এগুলি নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলের বা নির্দিষ্ট কিছু জনগোষ্ঠীর ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ছিল’। গোটা দেশের মানুষের দাবি দাওয়ার প্রতিফলন খুব স্বাভাবিক কারণেই এই লড়াইগুলির মধ্যে ছিলনা, যদিও এই প্রতিটা লড়াই আসলে অর্থনৈতিক দাবিতে খেটে খাওয়া শ্রেণীর লড়াই ছিল’। মাথায় রাখা প্রয়োজন যে রেল বা টেলিগ্রাফ ব্যবস্থা তখনো এ দেশে চালু হয়নি। তথ্য বা খবরের আদানপ্রদান, মানুষের চলাফেরার পরিসর খুবই কম ছিল রেল-টেলিগ্রাফের যুগের তুলনায়। সংবাদপত্র’ও তখন শৈশবাবস্থায় এবং মূলতঃ শহরকেন্দ্রিক ছিল’। তদুপরি ১৭৯৩ সালের পরে কর্নওয়ালিসের হাত ধরে চিরস্থায়ী বন্দোবস্থ এক নতুন জমিদার শ্রেণীর জন্ম দিল’ যারা তাদের অস্তিত্ব এবং ঐশ্বর্যরক্ষার তাগিদেই কোম্পানীরাজের বশংবদ এবং কোম্পানীর দেশীয় সহযোগী শক্তি হয়ে উঠেছিল। ‘আধুনিক’ ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জন্ম সবে হচ্ছে তখন।
১৮৫৭’র মহাবিদ্রোহ ঔপনিবেশিক শাসনের ভিত অবধি নাড়িয়ে দিয়েছিল। ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ক্ষমতা সরাসরি হাতে তুলে নিল ব্রিটিশ সরকার। এর সাথে সাথেই নতুন বেশ কিছু রাষ্ট্রনীতির-ও জন্ম হল’। প্রথমতঃ দিশি রাজা, নবাব, জমিদার, জায়গীরদারদের এ দেশের মানুষের “স্বাভাবিক নেতৃত্ব” (ন্যাচরাল লিডার) হিসাবে মেনে নেওয়া হল’। ১৭৫৭ থেকে শুরু হওয়া সাম্রাজ্যের সীমানা বাড়ানোর লড়াইয়ে দিশি রাজা রাজরাদের সাথে যে বৈরিতামূলক সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল’, যা কিনা বড়লাট ডালহৌসির আমলে সবচেয়ে তীব্র চেহারা নেয় (ডক্ট্রিন অফ ল্যপ্স, ইত্যাদি নীতির মাধ্যমে), তার পরিবর্তে সেই দিশি রাজন্যবর্গের সাথে ব্রিটিশ সরকার এক রকমের (বশ্যতামূলক) সৌহার্দ্যের নীতি গ্রহণ করল’। শ্রেণী হিসাবে এর পরের ৯০ বছর (১৯৪৭ সাল) অবধি এদের বিশেষ কোনো অবদান আর রইলনা জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের আন্দোলনে। জাতীয় কংগ্রেসের তরফে এই শ্রেণীকে পাশে পাওয়ার জন্য বা নিদেনপক্ষে এদের বিরোধীতার সম্মুখীন যাতে না হতে হয়, তার জন্য এদের সকল করদ রাজ্যে রাজনৈতিক আন্দোলন করা হবেনা, সেরকই প্রায় অবস্থান নেওয়া হয়। অবশ্য জাতীয় আন্দোলনের জিতে যাওয়া যখন এক রকম প্রায় সময়ের অপেক্ষা হয়ে দাঁড়াল, সেই তিন-এর দশকের শেষ দিক থেকে জাতীয় কংগ্রেসের দক্ষিণপন্থী অংশে এদের প্রভাব উত্তোরত্তর বৃদ্ধি পেল’। পরবর্তীতে মূলতঃ এদেরই পয়সার জোরে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ, মুসলিম লীগ, জনসঙ্ঘ, স্বতন্ত্র পার্টি’র উত্থান ঘটে[1]।
অতএব, এটুকু স্পষ্ট যে সশস্ত্র জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে শ্রেণী হিসাবে ভূস্বামী শ্রেণীর বিশেষ কোনো অবদান ছিলনা। তদুপরি নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণী জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বে চলে আসে বঙ্গভঙ্গ-পরবর্তী সময়ে, বিশেষ করে অবিভক্ত বাঙলার কংগ্রেস সংগঠনে। শ্রেণী হিসাবে জাতীয় আন্দোলনের নেতৃত্বে মধ্যবিত্ত একটা বড় জায়গা করে নিতে পারে। জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বে মূলধারার জাতীয় আন্দোলনের সমান্তরাল যে সশস্ত্র আন্দোলন চলতে থাকে, তার নেতৃত্ব গোড়া থেকেই মূলতঃ শিক্ষিত মধ্যবিত্তের হাতে রয়ে যায়। সেই সশস্ত্র আন্দোলনের চরিত্রে একটা বিরাট পরিবর্তন খিলাফত আন্দোলনের পরবর্তী সময়কাল থেকে লক্ষ্য করা যায়। সশস্ত্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতির এই পরিবর্তিত চরিত্র সবচেয়ে ভালভাবে লক্ষ্য করা যায় সূর্য সেনের মধ্যে এবং সে কারণেই ওপনিবেশিক শাসনের প্রচন্ড এক ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় সূর্য সেন। ব্যক্তি সূর্য সেন নয়, নির্দিষ্টভাবে সূর্য সেনের রাজনীতিই এই মহাভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
সূর্য সেনের রাজনীতি
১৯১০-১১ সাল থেকে বহরমপুরে কলেজে পড়তে আসার পর থেকেই সশস্ত্র বিপ্লবী রাজনীতিতে হাতেখড়ি ঘটে সূর্য সেনের। প্রাক-গান্ধী সেই যুগ উদীয়মান চরমপন্থী রাজনীতির যুগ বাংলায়। কলেজের পড়া শেষ করে ফিরে গেলেন নিজের জন্মস্থান চট্টগ্রামে। সে যুগের নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষিত যুবক শিক্ষকতার চাকরি নিল এক হাইস্কুলে। ক্লাসে পড়ানোর পাশাপাশি ছাত্রদের মধ্যে দেশপ্রেম চারিত করার কাজ চলতে থাকল। দেশের রাজনীতিতে এলেন গান্ধী, শুরু হল’ অসহযোগ আন্দোলন। সে সময় থেকেই সর্বক্ষণের রাজনৈতিক কর্মীর জীবন শুরু সূর্য সেনের। অসহযোগ আন্দোলনের তীব্রতা এবং সে আন্দোলনে দেশের মানুষের বড় অংশের সমর্থন থাকা সত্ত্বেও ব্রিটিশ সরকার দাবি মানতে রাজি হল’না। একটি শাসনব্যবস্থা, যা কিনা মূলতঃ দাঁড়িয়ে রয়েছে অস্ত্রের জোরে আর কিছু দেশীয় বশংবদের সহযোগীতায়, তার বিলোপ অহিংস পদ্ধতিতে কোনো আন্দোলনের মধ্য দিয়ে হবেনা, এ কথা সূর্য সেন বুঝেছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও জাতীয় কংগ্রেসের দেশব্যাপী জনগনের মধ্যে যে বিরাট প্রভাব এবং সংগঠন, তাকে তিনি বুঝতে ভুল করেন নি। হাতে গোনা কিছু উদবুদ্ধ তরুণের আত্মত্যাগ আর কিছু মুষ্টিমেয় ব্রিটিশ কর্মচারী বা তাদের দিশি তল্পিবাহকদের হত্যা করে যে স্বাধীনতা আন্দোলনে বিরাট কিছু মূল্য যুক্ত করা যাবেনা, এও তাঁর কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছিল বিংশ শতকের প্রথম আড়াই দশকের বিপ্লববাদীদের কাজের পদ্ধতি ও তার ফলাফল দেখে। ঠিক রাস্তাটা খুঁজতে খুঁজতে আইরিশ বিপ্লবীদের কাজের প্রতি আকৃষ্ট হলেন। ড্যান ব্রীনের আত্মজীবনী পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন। পথের দিশা পেয়েছিলেন।
খুঁটিয়ে পড়তেন ভারতে এবং বহির্বিশ্বে বৈপ্লবিক আন্দোলনের হাল-হকিকৎ। কমিউনিস্ট পার্টির তদানীন্তন মুখপত্র “স্বাধীনতা” পত্রিকায় (২৭শে মার্চ ১৯৩০) শচীন্দ্রনাথ গুহ’র একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছিল “বর্মার বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থা” নামে। শচীন্দ্রনাথ গুহ সূর্য সেনের সংস্পর্শে আসার পরে তিনি শচীন্দ্রনাথের থেকে খুঁটিয়ে জেনে নিয়েছিলেন তদানীন্তন বর্মার সায়া সানের নেতৃত্বে, হতদরিদ্র কৃষকদের নিয়ে গঠিত ‘গালন আর্মি’-র ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলনের খবর। রাসবিহারী বসু এবং রাজা মহেন্দ্রপ্রতাপ প্রমুখ নেতারা জাপানকে কেন্দ্র করে যে প্যান-এশিয়ান-মুভমেন্ট শুরু করেছিলেন, তারও খবরাখবর নিয়মিত রাখতেন মাস্টারদা। রাশিয়ার বলশেভিক বিপ্লব এবং পরবর্তী ঘটনাবলীর প্রতিও তাঁর আগ্রহ ছিল। ভারতের দারিদ্র্য, কুসংস্কারে, জাতিভেদে দীর্ণ সমাজব্যবস্থাকে তিনি পাল্টাতে চেয়েছিলেন। তাঁর সহকর্মী এবং ১৯৩০ এর চট্টগ্রামের যুব অভ্যুত্থানের সঙ্গী বিপ্লবী বিনোদবিহারী দত্তের লেখায় জানা যায় যে তিনি রাশিয়ার নতুন সমাজব্যবস্থা কে “উদীয়মান সূর্যের রক্তিমাভা” বলে বিবেচনা করতেন। লেনিনের ভোগবিলাসহীন সহজ জীবন এবং স্বার্থত্যাগের প্রশংসা করতেন।
১৯২৮ সালের জাতীয় কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনকে সূর্য সেন কাজে লাগালেন সাম্রাজ্যবাদের সাথে সম্মুখ সমরে এগোনোর জন্য। অধিবেশনের প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিল মতিলাল নেহরু কমিটির রিপোর্ট। সেই রিপোর্টে “ডোমিনিয়ন স্টেটাস”, মানে, ব্রিটিশ শাসনের অন্তর্গত থেকেই স্বায়ত্তশাসন-ই জাতীয় আন্দোলনের লক্ষ্য হওয়া উচিত, এই সুপারিশ ছিল। সূর্য সেন বুঝতে পেরেছিলেন দেশের মানুষের সে সময়ের চূড়ান্ত সরকার-বিরোধী মেজাজের সাথে এই সিদ্ধান্ত সুপারিশ খাপ খাবে না এবং এই মেজাজকে থিতিয়ে যেতে দেওয়া চলবেনা। বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের নেতৃত্বের তরফ থেকে তিনি কঠিন লড়াই করে সুভাসচন্দ্র বসু কে বোঝাতে সক্ষম হ’ন যে পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি ছাড়া আর কোনো দাবিই জাতীয় আন্দোলনের সেই স্তরে অযৌক্তিক হয়ে পড়েছে। প্রসঙ্গতঃ এই অধিবেশনে চট্টগ্রাম জেলা কংগ্রেসের প্রতিনিধি হিসাবে সূর্য সেন যোগ দিয়েছিলেন এবং পূর্ণ স্বাধীনতার দাবির সমর্থনে সর্বোচ্চ সংখ্যক প্রতিনিধির সমর্থন যাতে পাওয়া যায়, তার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন। যদিও জাতীয় কংগ্রেসের রক্ষণশীল নেতৃত্ব সেই সুপারিশের ওপর ভোটাভুটিতে ১৩০০-৮০০ ভোটের ব্যবধানে জয়লাভ করে, বিপুল সংখ্যক প্রতিনিধিদের ক্ষোভ বুঝতে পেরে এই সিদ্ধান্তকে পরবর্তী এক বছরের জন্যই কার্যকরী করে। পরের বছর, অর্থাৎ ১৯২৯ সালের লাহোর অধিবেশনেই পূর্ণ স্বরাজের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হ’ন তদানীন্তন কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ। দেশের জাতীয় আন্দোলনের সর্বাপেক্ষা বড় দল/মঞ্চ-কেই এইরকম কুশলী ভাবে ব্যবহার করে গোটা দেশের রাজনৈতিক ন্যারেটিভ কে পালটে দেওয়ার এই রাজনৈতিক দুরদর্শিতা এবং সাংগঠনিক ক্ষমতা দেখাতে পেরেছিলেন যে বিপ্লবী নেতৃবৃন্দ, তাঁদের অন্যতম ছিলেন সূর্য সেন। লাহোর অধিবেশনের পর থেকে আর কখনো জাতীয় কংগ্রেস ‘পূর্ণ স্বাধীনতার’ চেয়ে কম কোন দাবিদাওয়ায় ফিরতে পারেনি। ১৯২৮ এর কলকাতা অধিবেশনে কংগ্রেস সেবাদলের তরফে সুভাসচন্দ্র বসুকে সামনে রেখে যে সামরিক ভঙ্গিতে কুচকাওয়াজ করা হয়, সেই কুচকাওয়াজে সামরিক ধাঁচে, সামরিক বেশে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সূর্য সেনের অন্যতম সহকর্মী (পরবর্তী জীবনে কমিউনিস্ট পার্টির নেতা, ৩ বারের বিধায়ক এবং সাংসদ) বিপ্লবী কমরেড গণেশ ঘোষ। জাতীয় কংগ্রেসের অন্দরমহল থেকে ব্রিটিশ সরকারের গোয়েন্দা দফতর অবধি খবরটা পৌঁছয় যে জাতীয় কংগ্রেসের নীতিতে এবং নেতৃত্বে মিলিট্যান্সি ক্রমেই জায়গা করে নিচ্ছে।
১৯২৯ এ সাইমন কমিশন-বিরোধী দেশজোড়া গণ-আন্দোলনের ওপর ভয়ঙ্কর দমননীতি প্রয়োগ করল ব্রিটিশ সরকার। প্রত্যক্ষ দৈহিক আক্রমণে হত্যা করা হল’ লালা লাজপত রাই কে। সূর্য সেন সহ বিপ্লবী নেতৃত্ব বুঝতে পারলেন যে দেশের মানুষ প্রত্যাঘাতের ইচ্ছায় ফুঁসছে। লালাজী’র হত্যার কিছু পরেই ১৯২৯ এই সূর্য সেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রামে রাজনৈতিক সম্মেলন হয়। উদ্দেশ্য ছিল জনগনের কাছে একট সংগ্রামশীল রাজনৈতিক কর্মসূচী প্রকাশ্যে পেশ করা। মূল রাজনৈতিক সম্মেলনের পাশাপাশি যুব সম্মেলন, ছাত্র সম্মেলন ও নারী সম্মেলন করা হয়। সুভাসচন্দ্র বসু, যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত, লতিকা বসু সহ আরো অনেক নামী মানুষের উপস্থিতিতে এই সম্মেলন হয়। লক্ষ্যণীয় জাতীয় আন্দোলনে এবং তাও আবার বিপ্লবী ভাবধারার আন্দোলনের লক্ষ্যে নারীদের নিয়ে সম্মেলন এর আগে বাংলায় ঘটেনি। এই সম্মেলনের ৩ বছর বাদেই ১৯৩২ সালে যখন চট্টগ্রামের ইউরোপীয়ান ক্লাবের ওপর আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয় বিপ্লবী নেতৃত্ব, সেই একশনের দায়িত্ব দেওয়া হয়য় প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার-কে। প্রীতিলতার ডায়রি থেকে জানা যায়-
“এই শুভক্ষণটির জন্যই প্রহর গুণেছি। কিন্তু মাস্টারদা, আমি যে অনুবর্তী কর্মী হয়েই কাজ করতে চাই। নায়িকার ভূমিকায় আমাকে ঠেলে দিচ্ছেন কেন? মাস্টারদা দৃঢ় অথচ আবেগকম্পিত কন্ঠে বললেন ‘বাংলার ঘরে ঘরে বীর যুবকদের আজ আর অভাব নেই। বালেশ্বর থেকে কালারপুল পর্যন্ত এঁদেরই দৃপ্ত অভিযানে দেশের মাটি বারে বারে তাজা রক্তে সিক্ত হয়েছে, কিন্তু বাংলার ঘরে ঘরে মায়ের জাতি এবার যে শক্তির খেলায় মেতেছে ইতিহাসের সে অধ্যায় আজও অলিখিত রয়ে গেছে। তোমার সাফল্যে বা তোমার আত্মদানে সে অধ্যায় রচিত হয়ে উঠুক–এই আমি চাই। ইংরেজ জানুক, বিশ্বজগৎ অবলোকন করুক যে, এ দেশের মেয়েরাও আজ আর পিছিয়ে নেই”।
জাতীয় কংগ্রেসের সানগঠনিক বৃত্ত অনেকখানি বেড়ে যায় চট্টগ্রামে এর ফলে। পরবর্তীতে জেলা কংগ্রেসের সাংগঠনিক নির্বাচনে সূর্য সেন মনোনীত সকল প্রার্থী প্রচুর সমর্থনে জয়ী হ’ন। কিন্তু কংগ্রেসের মধ্যে রক্ষণশীল এবং ভূস্বামীদের স্বার্থরক্ষাকারী অংশ সাংগঠনিক নির্বাচনের এই ফলাফলে হতাশ হয়ে দৈহিক আক্রমণ করে সূর্য সেন ও তাঁর অনুগামীদের। নিজে আহত হয়েও প্রত্যাঘাতে উন্মুখ বিপ্লবী অংশকে নিরস্ত করেন সূর্য সেন, যাতে পুলিশ প্রশাসন বিপ্লবী অংশকে গ্রেপ্তার করে রাজনৈতিক-সাংগঠনিক কাজে বাধার সৃষ্টি না করতে পারে। এর কিছুদিন পরেই যখন কংগ্রেসের জাতীয় নেতৃত্ব দেশজুড়ে আইন অমান্যের ডাক দেয়, চট্টগ্রামে সেই প্রকাশ্য আন্দোলনের পাশাপাশি অত্যন্ত গোপনে সশস্ত্র বিপ্লবী অভ্যুত্থানের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায় সূর্য সেনের নেতৃত্বেই। ক্যালেন্ডারে তারিখ এসে পৌছয় ১৮ই এপ্রিল। The Easter Uprising in India happened.
কোন ভাববিলাসিতা নয়, রোম্যান্টিক কোন মোহ নয়, একটা সুস্পষ্ট রাজনীতি করে গেছেন সূর্য সেন। ধৈর্যের সাথে, যত্ন-মমতা-বিচক্ষণতা- দৃঢ়তার সাথে। ছাত্র, যুব, মহিলা- সমাজের এই তিন অংশকে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অবতীর্ণ করে শাসকের জন্য কোনো কম্ফর্ট জোন তিনি ফেলে রাখেন নি। বিপ্লবী আন্দোলনের পরের স্তরে, অর্থাৎ, সহযোগী দল হিসাবে চট্টগ্রামের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে থেকে, গরিব চাষী-মাঝিমাল্লাদের মধ্যে থেকে বহু মানুষকে তৈরি রেখেছিলেন বিপ্লবীদের শেল্টার দেওয়া, কোয়ার্টার-মাস্টারের ভূমিকা পালনের জন্য। যুগান্তর ও অনুশীলন এই দুই বিপ্লবী গোষ্ঠীর আভ্যন্তরীণ দ্বন্ধ মিটিয়ে একসাথে কাজ করানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন সূর্য সেন। অনেক দূর অবধি সফল ও হয়েছিলেন। ব্রিটিশ রাজ বুঝতে ভুল করেনি যে তাদের ভাষায় “ভদ্রলোক টেররিস্ট”-রা ব্যক্তিহত্যা এবং ব্যক্তিগত আত্মবলিদানের অধ্যায় শেষ করে এবারে ব্যপকতম মঞ্চের ব্যবহার করছেন, একেবারে গোড়ার শ্রেণীর মধ্যে পেনিট্রেট করতে শুরু করে দিয়েছেন, বাড়ির অন্তঃপুরেও সংগঠন বাড়াতে শুরু করেছেন।
শত্রুপক্ষের মূল্যায়ণ
মহাভারতের উদ্যোগ পর্বের এক অংশে শ্রীকৃষ্ণ ভীষ্মের সমরপান্ডিত্যের প্রসঙ্গে অর্জুনকে বলে যে মিত্র হিসাবে তিনি অর্জুনের প্রশংসা তো করবেন-ই। কিন্তু আসল কথা হল’ কৌরবপক্ষ অর্জুনের কী মূল্যায়ণ করে। সেটাই আসল।
মেজর জন হান্ট, যিনি ১৯৫৩’র প্রথম সফল এভারেস্ট অভিযানের দলনেতা ছিলেন, ২ এর দশকে বেঙ্গল পুলিশের আইবি তে মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সের তরফে পোস্টেড ছিলেন। তাঁর মেময়ার্সে দুটি জিনিস পাওয়া যায় ভীষণ ভাবেঃ বাংলার পল্লীপ্রকৃতির প্রতি অসীম ভালবাসা আর “অনুশীলন সমিতি”, “যুগান্তর গোষ্ঠী”-র কার্যকলাপের প্রতি ভীতি ও শত্রুপক্ষের প্রতি তারিফ ও! ডিস্ট্রিক্ট ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং বেঙ্গল পুলিশের তদানীনতন এক স্পেশাল সুপারিন্টেন্ডেন্ট R.E.A Ray লিখেছিলেন ““in the Chittagong raid Bengal terrorists reached a standard of organization and daring of conception and execution never previously attained.”
[R. E. A. Ray, “Report on the Activities of Terrorists in Bengal during the Period April to December 1930,” (1931)]
শুধুমাত্র “bengali terrorists” দের বিরুদ্ধেই গোটা স্বাধীনতা সংগ্রামে বীভৎস criminal tribes act লাগু করা হয়েছিল’। উত্তর পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলে প্রযোয্য নৃশংস Murderous Outrages Act যার আওতায় একেকটা গ্রাম জ্বালিয়ে দিত’ ব্রিটিশ সরকারের পুলিশ, সেই আইন ও কিছু এদিক ওদিক করে বাংলায় প্রয়োগ করার সিদ্ধান্ত প্রায় নিয়েই ফেলেছিল’ বেঙ্গল গভর্নমেন্ট। সেই Murderous Outrages Act এর ছায়ায় প্রণীত Bengal Terrorist Outrages Act, 1932 প্রণয়ণ করা হয় চট্টগ্রামের অভ্যুত্থানের পরেই। লাগু করা হয় বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে মূলতঃ তৎকালীন বাংলার বড়লাট স্যার জন এন্ডারসনের উদ্যোগে। এই আইনের আওতায় গ্রামের পর গ্রাম কে মোটা টাকা জরিমানা করা যেত’ বিপ্লবীদের আশ্রয় দেওয়া বা তাদের খবর পুলিশকে না দেওয়ার সন্দেহে। প্রীতিলতা ওয়দ্দেদারের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম রেলওয়ে ইন্সটিটিউটে আক্রমণের পরে গোটা চট্টগ্রাম টাউনের সকল অধিবাসীবৃন্দের ওপর ৮০,০০০ টাকা জরিমানা লাগু করা হয়েছিল’। এতদসত্ত্বেও চট্টগ্রাম সশস্ত্র যুব বিদ্রোহের বীর বিপ্লবীদের নাম ঠিকানা খুঁজে পেতে ১৯৪১ সাল অবধি হন্যে হয়ে ছুটতে হয়েছিল’ আইবি কে। এই গোটা তদন্তে ১৯৩১-৩৭ অবধি ৬ বছরে খরচ হয়েছিল’ ১৫ লক্ষ পাউন্ড! ১৯৪১ এ বিনোদ বিহারী দত্ত গ্রেপ্তার হয়ে কলকাতায় আইবি’র সদর দপ্তরে প্রেরিত হলেন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। ইন্টারোগেশন শুরু করার আগে সংস্লিষ্ট অফিসার অনুরোধ করেন বিনোদ বাবু কে “একটু দেখতে” যাতে তাকে বা তার কোনো সহকারী কে বিপ্লবীদের হাতে “শাস্তি” না পেতে হয় এই কর্তব্যপালনের জন্য! তাদের ও সংসার আছে কীনা!
ইন্ডিয়ান পলিটিকাল ইন্টেলিজেন্সের লন্ডনের সদর দপ্তরে যত ফাইল মেন্টেইন করা হত, তার ৯৫% ছিল’ বাংলার সশস্ত্র বিপ্লবী আর তাদের “growing Bolshevik tendencies” নিয়ে। অহিংস জাতীয়তাবাদী আন্দোলন নিয়ে তাদের গোটা আর্কাইভের ২% এর বেশি জায়গা নেয়নি।
[Kate O’Malley, Ireland, India and Empire: Indo-Irish Radical Connections, 1919–1964 (Manchester and New York: Manchester University Press, 2008), 18]
১৯৩৫ সালের গভর্ন্মেন্ট অফ ইন্ডিয়া এক্টের আওতায় প্রাদেশিক স্বায়ত্ত্ব শাসন চালু হওয়ার পরে ধীরে ধীরে সশস্ত্র আন্দোলনের তীব্রতা কমতে থাকে বিগত তিন দশকে প্রথমবার। সে অর্থে, ঔপনিবেশিক সরকার কে এত বড় একটা রাজনৈতিক সংস্কার করতে বাধ্য করার কৃতিত্ব বহুলাংশে সশস্ত্র বিপ্লবীদের ই। তবে ব্রিটিশ সরকারের মতে এই “বিপদ” আবারো চাড়া দিতে পারত’ কারণ আইবি’র মতে সশস্ত্র বাঙালী বিপ্লবীদের কাজের ধারা পালটে যায় “বলশেভিক ইনফ্লুয়েন্স” এর কারণে এবং তাঁরা বেশি বেশি করে কৃষক-রায়ত-মজদুরদের ইস্যু তে প্রকাশ্য আন্দোলনে অবতীর্ন হ’ন, এবং দাবি না মিটলে আবারও অস্ত্র হাতে তুলে নিতে পারতেন।
[David M. Laushey, Bengal Terrorism and the Marxist Left: Aspects of Regional Nationalism in India, 1905–1942 (Calcutta: Firma K. L. Mukhopadhyay, 1975)]।
উপসংহার
সূর্য সেন আসলে একটা রাজনীতির নাম। যেমন গান্ধী আরেকটি রাজনীতির নাম। এ দেশের পরিস্থিতি অনুধাবন করে লড়াইয়ের কোন ময়দান বাদ দেন নি সূর্য সেন। জাতীয় কংগ্রেসের সংগঠন হোক বা চট্টগ্রামের পাহাড়-জঙ্গল। প্রকাশ্য ও গোপন, আইনি ও আইন-বহির্ভুত রাজনীতির প্রথম সফল সংমিশ্রণ তিনিই দেখিয়ে গেছেন। কাজেই, তাঁর হাতে গড়া বিপ্লবীদের একটা বড় অংশ যখন পরবর্তীকালে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন, তাঁদের মধ্যে সংসদীয় এবং এক্সট্রা-পার্লামেন্টারি স্ট্রাগল কে মিলিয়ে মিশিয়ে চলতে বিশেষ দ্বিধা-সংকোচ বা অসুবিধা দেখা দেয়নি। পার্লামেন্টকেই সর্বরোগের দাওয়াই বা তাকে স্রেফ একটি শুয়োরের খোঁয়াড় হিসাবে দেখার মত বালখিল্যতা তাঁদের মধ্যে ছিলনা। তাঁরা বুঝতেন যে ময়দান পেলেই তাকে লড়াইয়ের উপযোগী বানিয়ে নিতে হবে।
১৮ই এপ্রিল এই উপমহাদেশের ইতিহাসে একটি মাইলফলক।
১৮ই এপ্রিল ১৯৩০, এ উপমহাদেশের রাজনীতি একটি অনন্যসাধারণ এবং অভূতপূর্ব স্তরে উন্নীত হয়েছিল’।
এ দিনের এটাই lasting legacy।
তথ্যসূত্রঃ
১) বিপ্লবতীর্থ চট্টগ্রাম স্মৃতি সংস্থা, “সূর্য সেন স্মৃতি”, গ্রন্থমেলা, এপ্রিল ১৯৭১।
২) David M. Laushey, Bengal Terrorism and the Marxist Left: Aspects of Regional Nationalism in India, 1905–1942 (Calcutta: Firma K. L. Mukhopadhyay, 1975)]
৩) Kate O’Malley, Ireland, India and Empire: Indo-Irish Radical Connections, 1919–1964 (Manchester and New York: Manchester University Press, 2008)
৪) R. E. A. Ray, “Report on the Activities of Terrorists in Bengal during the Period April to December 1930,” (1931)
৫) Ramachandran, Rajesh (2004), “Princes and the parivar” in Times of India, April 17, 2004.
৬) Michael Silvestri, Policing ‘Bengali Terrorism’ in India and the Worldঃ Imperial Intelligence and Revolutionary Nationalism, 1905–1939 (Palgrave Macmillan, 2019
[1] Ramachandran, Rajesh (2004), “Princes and the parivar” in Times of India, April 17, 2004. The candid statements of Saradar Angre, the erstwhile political advisor to Vijayraje Scindhia is explicit on this point.