জয়দীপ মুখার্জী
বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ দার্শনিক কার্ল মার্কস বলেছিলেন, “দার্শনিকরা এযাবৎ পৃথিবীকে কেবল বিভিন্ন ভাবে ব্যাখ্যাই করেছেন, কথা হলো তাকে পরিবর্তন করা”। তাঁর দ্বান্দ্বিক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদের তত্ত্বের সফল রূপায়ণ ঘটিয়ে বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে গোটা দুনিয়াকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে রাশিয়ার নভেম্বর বিপ্লব দেখিয়েছিল পৃথিবীকে পরিবর্তন করা সম্ভব। পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে শ্রেণী বৈষম্যহীন সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়। ১৯১৭-র ৭ থেকে ১৭ নভেম্বর রাশিয়ায় সর্বহারার নেতৃত্বে সেই বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান শুধু মানবসভ্যতার অগ্রগতির অভিমুখই নির্ণয় করেনি একইসঙ্গে সারা পৃথিবীর মেহনতি মানুষকে শোষণের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হওয়ার সংগ্রামে শামিল হওয়ার শক্তি যুগিয়েছে।
বিপ্লবের বছর খানেক আগে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারন অনুধাবন করতে গিয়ে মার্কসবাদকে বিকশিত করে রাশিয়ার বিপ্লবের মহান নায়ক ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন বললেন, পুঁজির ক্রমাগত কেন্দ্রীভবন একচেটিয়া পুঁজির জন্ম দিচ্ছে ও অবশেষে সাম্রাজ্যবাদের পর্বে পরিণীত হচ্ছে। অতএব পুঁজিবাদের সর্বোচ্চস্তর হলো, সাম্রাজ্যবাদ (ইম্পিরিয়ালিজম, দ্য হাইয়েস্ট স্টেজ অফ ক্যাপিটালিজম, ১৯১৬)। লক্ষ্যণীয় হলো, সাম্রাজ্যবাদ সমগ্র বিশ্বকে ধনতান্ত্রিক শোষণের পরিধির মধ্যে নিয়ে আসছে। একইসঙ্গে বিশ্বের সম্পদ ও বাজারের দখলদারির জন্য সাম্রাজ্যবাদী শিবিরের মধ্যে হিংস্র দ্বন্দ্বের জন্ম দিচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদের দুর্বলতম গ্রন্থিতে শৃঙ্খল ভেঙ্গে ফেলার সম্ভাবনাকে লেনিন তাত্ত্বিক ভাবে সামনে নিয়ে এসেছিলেন। বিংশ শতকের প্রথম দু’দশক জুড়ে চলা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ইউরোপের সবচেয়ে পশ্চাৎপদ অর্থনীতির দুর্বলতম গ্রন্থি ছিল রাশিয়া। দূরদর্শী লেনিন সাম্রাজ্যবাদী শিবিরের আভ্যন্তরীণ যুদ্ধকে রাশিয়ার জার সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধে পরিণত করার আহ্বান জানালেন।
প্রসঙ্গত পুঁজিবাদ থেকে সাম্যবাদী সমাজে উত্তরণের দীর্ঘ পথ সম্পর্কে কার্ল মার্ক্সের বুনিয়াদি বিশ্লেষণ ছিল, পুঁজিবাদের গর্ভেই সাম্যবাদের উৎস্যমুখটি নিহীত আছে। পুঁজিবাদ থেকে তার ঐতিহাসিক বিকাশ। পুঁজিবাদ যে সামাজিক শক্তির জন্ম দেয় তারই দ্বান্দ্বিক ফলশ্রুতি সাম্যবাদ। এই উত্তরণের পর্যায়ে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা সম্পর্কে তাঁর ব্যাখ্যা ছিল, পুঁজিবাদী ও সাম্যবাদী ব্যবস্থা দুটির মধ্যবর্তী পর্যায়ে আছে একটি থেকে অন্যটিতে বৈপ্লবিক রূপান্তরের কালপর্বটি। অর্থাৎ, আর্থ সামাজিক ব্যবস্থার বিশেষ স্তর। এই স্তরে জুড়ে আছে রাজনৈতিক উৎক্রমণের একটি পর্বও, যেখানে শুধুমাত্র সর্বহারার বৈপ্লবিক একনায়কতন্ত্র ব্যতীত রাষ্ট্র আর কোনো কিছুই হতে পারে না। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অবশ্যম্ভাবী ফলশ্রুতি চূড়ান্ত বৈষম্যকে বিবেচনায় রেখে মার্ক্সের সতর্কীকরণ ছিল, শুধুমাত্র উৎপাদনের উপকরণগুলিকে সমগ্র সমাজের সর্বজনীন সম্পত্তিতে পরিবর্তন করা হলেই বন্টনের ত্রুটিগুলি এবং বুর্জোয়া অধিকারের অসাম্য বিলুপ্ত হয় না। ‘শ্রমদানের পরিমাণ মোতাবেক’ উৎপাদিত বস্তু যতদিন পর্যন্ত ভাগ করে দেওয়া হতে থাকবে, এই বুর্জোয়া অসাম্য ততদিন বজায় থাকবে। অর্থাৎ, রাষ্ট্রের ক্ষমতা দখল এবং সর্বহারার একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর পুঁজিবাদের অবসান ঘটিয়ে সামাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার নির্মাণ একটি দীর্ঘ যাত্রা পথ ও নিরন্তর গুণগত উত্তরণের প্রক্রিয়া।
সোভিয়েত বিপ্লবের প্রাক্কালে ১৯১৭-র আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে লেনিন তাঁর ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’ পুস্তিকায় পুঁজিবাদের পূর্ণ উচ্ছেদের পর নির্দিষ্ট একটি পর্যায় পর্যন্ত রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা এবং পরবর্তীতে ভিন্ন ভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে রাষ্ট্রের রূপান্তর সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করেছিলেন। তাঁর ব্যাখ্যা ছিল, ‘বিপ্লব পরবর্তী যুগে মূলত দুটি স্তর। নিম্নতর স্তরের সমাজতন্ত্র এবং চূড়ান্ত লক্ষ্যে সাম্যবাদে উত্তরণ। তাঁর অভিমত ছিল, সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উৎপাদনের উপকরণগুলির অভাব বজায় থাকবে। পর্যায়ক্রমে সাম্যবাদে উত্তরণ ঘটলে উৎপাদিত বস্তুর প্রাচুর্যের কারনে প্রধান প্রয়োজনগুলির ক্ষেত্রে সেই অভাব দূর হয়ে যাবে’। একইসঙ্গে লেনিনের সতর্কবার্তা ছিল, পরাভূত পুঁজিবাদের শক্তিকে কখনও খাটো করে দেখা চলবে না। সুযোগ পেলেই বুর্জোয়ারা প্রবল পরাক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়বে।
সমাজ বিকাশের পথে মার্কসের বুনিয়াদী বিশ্লেষণ এবং লেনিনের ব্যাখ্যা, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা নির্মাণের অভিজ্ঞতায় অক্ষরে অক্ষরে প্রমাণিত হয়েছিল। রাশিয়ার বুর্জোয়া শক্তি এবং গোটা বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদী শিবিরের কাছে সর্বহারা শ্রেণীর এই বৈপ্লবিক জয় ছিল চরম হতাশাব্যাঞ্জক ঘটনা। তাই শৈশবেই সমাজতন্ত্রকে বিনাশ করতে তৎপর হয়ে উঠেছিল ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, জাপান, আমেরিকার মতো সামরিক শক্তিধর সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি। ১৯১৮-র জানুয়ারি থেকে ১৯২২-র অক্টোবর, রাশিয়া জুড়ে টানা চার বছর ক্ষমতাচ্যুত জারের শ্বেত সৈন্য বাহিনী এবং তাদের সহায়তাকারী ১৪টি সামরিক শক্তিধর দেশ সদ্যোজাত সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রবল আক্রমণ চালিয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী অক্ষশক্তি এবং মিত্রশক্তি মিলে মিশে একাকার হয়ে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে অচিরেই বিনাশ করতে উন্মত্ত যুদ্ধে লিপ্ত হলো।
তাদের এই ষড়যন্ত্র যে কতখানি নির্মম ছিল তার প্রমাণ মেলে উইনস্টন চার্চিলের “দ্য ওয়ার্ল্ড ক্রাইসিস : দ্য আফটারম্যাথ” বইয়ে। সেখানে তীর্যকের সুরে তিনি লিখছেন, “মিত্রপক্ষ রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধরত ছিল? কখনই না; তবে তারা সোভিয়েত রাশিয়ানদের দেখামাত্র গুলি করতো। রাশিয়ার মাটিতে তারা ছিল আক্রমণকারী। সোভিয়েত সরকারের শত্রুদের তারাই অস্ত্র সরবরাহ করে সাহায্য করতো। তারা বন্দরগুলি বন্ধ করে সেখানকার জাহাজগুলি ডুবিয়ে দিয়েছিল। তাঁরা মনেপ্রাণে চেয়েছিল, সর্বপ্রকার চক্রান্তও করেছিল সোভিয়েত রাষ্ট্র ধ্বংসের জন্য”।
পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ চার দিক থেকেই তখন আক্রমণ। ১৯১৯-র অক্টোবরে সাবেক জার আমলের সেনাবাহিনীর জেনারেল নিকোলাস ইউডেনিচ শ্বেত সৈন্য বাহিনী নিয়ে উত্তর দিক থেকে ঝাঁপিয়ে পড়লেন পেত্রোগ্রাদের সীমানায়। তাঁর পশ্চাতে সহায়তাকারী সশস্ত্র ব্রিটিশ-মার্কিন-জার্মান সেনা পল্টন। অক্টোবরের ১৮, ২০, ২১ তিনদিন নিউইয়র্ক টাইমসে বড় বড় হরফে খবর ছাপানো হলো, “পেট্রোগ্রাদে সোভিয়েত বিরোধী সেনা”; “আবার পেট্রোগ্রাদের আত্মসমর্পণের সংবাদ : মস্কোর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন” এবং “সোভিয়েত বিরোধী বাহিনী পেট্রোগ্রাদের সন্নিকটে : শহর দখলের অপেক্ষা”। উত্তর দিক থেকে ইউডেনিচ যখন পেত্রোগ্রাদ আক্রমণ করছেন তখন দক্ষিণে ডেনিকিন নামে জার আমলের আরেক সেনা জেনারেল, জারিৎসিন (পরবর্তীতে, স্তালিনগ্রাদ) দখল করে মস্কো শহরের ১২০ মাইলের কাছে পৌঁছে যান। নিউইয়র্ক টাইমস খবর করলো, “রাশিয়ার বলশেভিক শাসন ব্যবস্থা একেবারে ধ্বসে পড়ার উপক্রম। বলশেভিকদের প্রধান ঘাঁটি মস্কো থেকে লোকজন পালাতে শুরু করেছে”।
সাম্রাজ্যবাদী শিবিরের এই উল্লাস অবশ্য বেশি সময় স্থায়ী হয়নি। মহান বিপ্লবী জোসেফ স্তালিনের পরিকল্পনা অনুযায়ী লালফৌজ হঠাৎ প্রতি আক্রমণ শুরু করলো। বলশেভিক বিপ্লবীরা সমস্ত শক্তি নিয়ে প্রতিরোধে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। ইউডেনিচ কিংবা, ডেনিকিন কেউই এর জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। প্রবল প্রতিরোধে শ্বেতসৈন্য বিপর্যস্ত হয়ে পড়লো। বহির্দেশীয় সেনা পল্টনও নেতৃত্বের অভাবে ছন্নছাড়া হয়ে পড়লো। ব্রিটিশ পতাকার আড়ালে ইউডেনিচ পালালেন দক্ষিণের দিকে। ১৯২০-র ২৯ ফেব্রুয়ারি নিউইয়র্ক টাইমস খবর করলো, “ইউডেনিচের পলায়ন। ১০ কোটি মার্ক মূল্যের সম্পত্তি নিয়ে প্যারিস অভিমুখে যাত্রা”। ডেনিকিন পালালেন কৃষ্ণসাগরের দিকে। ভগ্ন সেনাবাহিনী নিয়ে কৃষ্ণসাগরের নভোরসিস্কে পৌঁছে এক ফরাসি রণতরীতে উঠে চম্পট দিলেন। তাঁর সেনা বাহিনীর সদস্যরা মিশে গেলেন জনতার ভিড়ে। লালফৌজের মরণপণ লড়াইয়ে একে একে মুক্ত হল, উত্তর, পূর্ব, ও পশ্চিমের সীমান্ত। ১৯২২-র ১৯ অক্টোবর লালফৌজ ব্লাডিভস্তক মুক্ত করলো। জাপানি সেনা আত্মসমর্পণ করলো। অবসান হলো সাম্রাজ্যবাদী শিবিরের প্রত্যক্ষ সহায়তায় জারতন্ত্র ফিরিয়ে আনার প্রতিবিপ্লবী গৃহযুদ্ধ। সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন-ব্রিটিশ-ফরাসি-জাপানি-জার্মান সম্মিলিত ২ লক্ষ বহির্দেশীয় সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে লাল ফৌজ ও বলশেভিক পার্টির রক্তক্ষয়ী লড়াই সাড়ে চার বছর জারি ছিল।
যুদ্ধের ফলশ্রুতি ছিল ভয়ঙ্কর। স্প্যানিশ ফ্লু, টাইফাসের মত মারণ ব্যাধি, অনাহার এবং ভয়াবহ যুদ্ধের বলী নারী-শিশু-পুরুষ মিলিয়ে ৭০ লক্ষ মানুষের মৃত্যু। আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ গিয়ে দাঁড়ালো, ৬ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। দেশজুড়ে চরম খাদ্য সংকট। আভ্যন্তরীন উৎপাদন তলানিতে। কল-কারখানার রুগ্ন দশা, মজুরির নিশ্চয়তা নেই, অযুত হাতে কোনো কাজ নেই। আইন শৃঙ্খলা ভগ্নপ্রায়, প্রশাসনিক ব্যবস্থা স্থবির, একেবারে অচলাবস্থা। জবরদস্তি জারের সৈন্যবাহিনীতে নাম লেখানো লক্ষ শ্রমিক-কৃষক যুদ্ধের জেরে পঙ্গুত্বের শিকার। তার ওপর দেশজুড়ে মারাত্মক সংক্রামক রোগের প্রকোপ, ভয়ানক টাইফাস মহামারি। এক চূড়ান্ত অরাজক অবস্থার মধ্যে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা নির্মাণের কাজ শুরু করতে হয়েছিল বলশেভিক পার্টিকে।
এই পরিস্থিতিতে দশম পার্টি কংগ্রেসে লেনিন ‘নয়া আর্থিক পুনর্গঠন নীতি’ বা, ‘নেপ’ গ্রহণ করলেন। ১৯১৭-র বিপ্লবের পর ঘোষিত ভূমি বিধান (ডিক্রি অন ল্যান্ড) অনুযায়ী ১৫ কোটি হেক্টর কৃষি জমি কৃষকদের মধ্যে বণ্টন করা হয়েছিল। নতুন রাষ্ট্র ব্যবস্থা কৃষকদের খাজনা থেকে রেহাই দিয়েছিল। সমস্ত মর্গেজ এবং অপরিশোধিত ঋণ মুকুব করে দিয়েছিল। এই ঋণের পরিমাণ ছিল কয়েকশত কোটি রুবল স্বর্ণ মুদ্রা। বিনিময়ে নতুন রাষ্ট্র ব্যবস্থা তাঁদের কাছে লালফৌজ এবং দেশবাসীর জন্য পর্যাপ্ত শস্য এবং খাদ্য উৎপাদনের দাবি করেছিল। কিন্তু নতুন ব্যবস্থার সঙ্গে কৃষকরা মানিয়ে উঠতে পারলেন না। কর ব্যবস্থা মুকুব হলেও উদ্বৃত্ত ফসল ফলানোর প্রয়োজনীয়তা তাঁরা বুঝতে সক্ষম হলেন না। রাষ্ট্র খাদ্যশস্যের যে দর ঠিক করে দিয়েছিল, কৃষকদের তাতেও পোষাচ্ছিল না। জমিতে উদ্বৃত্ত ফসল রাষ্ট্র সংগ্রহ করবে এই ব্যবস্থার সঙ্গেও তাঁরা মানিয়ে উঠতে পারছিলেন না। অচিরেই তাঁরা নিজেদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত জমিতে চাষ আবাদ করা বন্ধ করে দিলেন। পরিণতি হল ভয়ঙ্কর। খাদ্য সরবরাহে টান পড়লো। ‘নেপ’ -এর মাধ্যমে ‘কুলাক’দের (ধনী কৃষক)’ হাতে জমি ফিরিয়ে দেওয়া হলো। সমবায় ব্যবস্থায় যৌথখামারের মাধ্যমে ফসল সংগ্রহ (কেনা) এবং বণ্টন চালু করা হলো। ফিরিয়ে আনা হলো কর ব্যবস্থা তবে সেটা হলো অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত। ‘নেপ’-এর প্রয়োগ গত সাফল্যে কৃষি উৎপাদন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে শুরু করলো।
যদিও ‘নেপ’-এর প্রয়োগ মোটেই সহজ কাজ ছিল না। পার্টির অভ্যন্তরে তীব্র মতাদর্শগত সংগ্রাম চালিয়েই লেনিন অগ্রসর হয়েছিলেন। পার্টির পলিটব্যুরো এবং কেন্দ্রীয় কমিটির অন্যতম সদস্য ‘এক দেশে সমাজতন্ত্র নির্মাণের বিরোধী’ লিওন ট্রটস্কি শুরু থেকেই এর বিরোধী ছিলেন। তাঁর সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় কমিটির অপর তিন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য জিনোভিয়েভ, কামেনেভ এবং বুখারিন। তাঁদের বক্তব্য ছিল, ‘নেপ’ চালু করার অর্থ হলো, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার প্রত্যাবর্তন। এই লড়াইয়ে লেনিন পাশে পেয়েছিলেন স্তালিনকে। লেনিনের স্পষ্ট বার্তা ছিল, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় তিনটি বিষয়ের উপর গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। প্রথমত, উৎপাদনের উপকরণের বৃহৎ কেন্দ্রগুলির ওপর রাষ্ট্রের সার্বিক মালিকানা। দ্বিতীয়ত, সর্বহারার হাতে সমস্ত রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং কৃষক সমাজের সঙ্গে নিবিড় মৈত্রীর বন্ধন। তৃতীয়ত, সর্বহারার অটুট নেতৃত্ব। ‘নেপ’ সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য ছিল, হ্যাঁ সাময়িক ভাবে মনে হতে পারে আমরা পিছোচ্ছি। কিন্তু এটা আমরা জেনে বুঝেই করছি। প্রথমে আমরা একটু পিছোচ্ছি অনেক লম্বা দৌড়ের প্রস্তুতির জন্য। যাতে দৌড়ের গতিতে আমরা মস্ত বড় উল্লম্ফন দিতে পারি।
সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি ও সমাজ গঠনে ‘নেপ’-এর ভূমিকা ছিল অপরিসীম। কৃষি ব্যবস্থায় উদ্বৃত্ত মূল্যের ওপর ভিত্তি করেই শিল্পে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল সোভিয়েত রাশিয়া। এক দশকের মধ্যেই ইউরোপের শিল্পোন্নত দেশগুলির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টক্কর দিতে আরম্ভ করেছিল। ‘নেপ’ চালু হওয়ার পাঁচ বছরের মধ্যেই ১৯২৫-এ চতুর্দশ পার্টি কংগ্রেসে স্তালিন সোভিয়েত রাশিয়াকে ভারি মেশিনারি আমদানির দেশ থেকে ভারি মেশিনারি উৎপাদনের দেশে রূপান্তরিত করার প্রস্তাব গ্রহণ করতে সমর্থ্য হয়েছিলেন।
যদিও লেনিনের আকস্মিক প্রয়াণের পরও সিপিএসইউ-এর মধ্যে সমাজতান্ত্রিক শিল্প ও কৃষি নির্ভরতা, কৃষি সম্পর্ক নিয়ে বিতর্ক ছিল। পলিটব্যুরোর অন্যতম সদস্য প্রেয়োব্রাঝেনেস্কির সওয়াল ছিল, যেভাবে পুঁজির আদিম সঞ্চয় ধনতান্ত্রিক শিল্পের ভিত্তি তৈরি করেছিল সেভাবেই আদিম সমাজতান্ত্রিক সঞ্চয়ের প্রক্রিয়া শুরু করা হোক। বুখারিনের অভিমত ছিল, সোভিয়েত রাষ্ট্র বিভিন্ন প্রকল্পে বিনিয়োগ করে কৃষির উৎপাদিকা শক্তি বৃদ্ধি করুক। কংগ্রেসে দুটি প্রস্তাবই বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠের বিরোধিতায় খারিজ হয়ে গিয়েছিলো। স্তালিনের স্পষ্ট বার্তা ছিল, এটা বিপজ্জনক। এতে শ্রেণী বিভক্ত রুশ কৃষকসমাজে ধনী কৃষকরা শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে। এতে বিপ্লবের পক্ষে পৃথক ধরণের বিপদ তৈরি হবে। বরং, যৌথখামারের মাধ্যমে সংগ্রহ ও বণ্টনের প্রক্রিয়াতেই কৃষি উৎপাদনে সমৃদ্ধি বাড়বে। ‘নেপ’ -এর সফল রূপায়ণের ওপর ভিত্তি করেই গোটা বিশ্বের আঙ্গিনায় কৃষি, শিল্প, বিজ্ঞান, গবেষণা, চিকিৎসা, ক্রীড়া, সাহিত্য, সংস্কৃতিতে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন উৎকর্ষ স্থাপনে অবিস্মরণীয় সাফল্য অর্জন করেছিল। যার প্রমাণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্যাসিস্ত শক্তির বিরুদ্ধে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েতের দুর্দান্ত জয়। সাম্রাজ্যবাদী ফ্যাসিস্ত শক্তির সমতুল্য সামরিক ভারসাম্যে পৌঁছতে তাদের লেগেছিল একদশকেরও কম সময়। ধনতান্ত্রিক বিশ্ব’কে যে অর্থনৈতিক শিখরে পৌঁছতে সময় লেগেছিল ৩০০ বছর, মাত্র ৩০ বছরেই সবার হাতে কাজ দিয়ে মানুষের মৌলিক পাঁচটি চাহিদা মিটিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন সেই শিখর অতিক্রম করে গিয়েছিল।
সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার মেয়াদ কাল ৭৪ বছর। গত শতাব্দীর সূচনায় ঘটে যাওয়া নভেম্বর বিপ্লব পার করলো ১০৭ বছর। সোভিয়েত ইউনিয়নসহ পূর্ব ইউরোপে সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়ের পরও সেই যুগান্তকারী ঘটনাই মানবসভ্যতার অভিমুখকে গুণগত ভাবে পরিবর্তন করে দিয়েছিল। মার্কসবাদের সৃজনশীল বিজ্ঞানকে পৃথিবীর বুকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল। শোষণমুক্ত মানবসমাজই যে ইতিহাসের ভবিষ্যৎ তার অনিবার্যতাকে শাশ্বত করেছিল।