Writing the Truth Five Difficulties (Part V)

প্রাককথন

রাজনীতির চিরায়ত প্রশ্নটি যা চলছে তার বদল ঘটানোকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত। এই বদল কেমন, এর প্রকৃত অর্থ আসলে কী এ নিয়েই যাবতীয় বিতর্ক। এখানেই ইতিহাস নির্দিষ্ট কর্তব্য সম্পাদনে সমাজের কেউ কেউ অন্যদের চাইতে কিছুটা বাড়তি দায় স্বীকার করেন। প্রচলিত অর্থে তাদেরই আমরা বুদ্ধিজীবী বলি।

এরা কথা বলেন, লেখেন এবং সবটাই করেন সেই বদলের উদ্দেশ্যে। কিন্তু বাস্তব হল এই যে পুঁজিবাদ সমাজব্যবস্থা হিসাবে এমনই এক বিকৃত পরিবেশ নির্মাণ করে যখন একদল মানুষ সমাজে বসবাস করতে চান এই বলে যে তারা চাইলেই লিখতে পারেন, বলতে পারেন, শাসককে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারেন। অর্থাৎ বুদ্ধিজীবী হওয়ার সমস্ত গুণ লক্ষণ তাদের মধ্যে রয়েছে কিন্তু আপাতত সে কাজটি তারা করছেন না! এহেন অবস্থান আজকের দিনে আর নতুন কিছু না, আন্তোনিও গ্রামশির সুবাদে দুনিয়া জেনে গেছে বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেও আসলে দুটি গোষ্ঠী রয়েছে। সাবেক অংশটি যা চলছে তার সুবাদেই করেকম্মে রয়েছেন বলে আর নতুন করে হুজ্জুতি পাকাতে চান না।

এই অনীহা কেন?

বুদ্ধিজীবীর অভিধায় ভূষিত হতে যাদের সাধ তারা আচমকা এমন জড়ভরত হয়ে ওঠেন কিভাবে?

Writing the Truth, Five Difficulties শিরোনামে ১৯৩৫ সালে তারই অনুসন্ধানে কলম ধরেন বের্টল্ট ব্রেখট্‌, পাঁচটি অধ্যায়ে সেই পর্যালোচনা শেষ করেন। এ লেখায় তার সেই বিখ্যাত ধরণটিই ফুটে উঠেছে যে কায়দায় তিনি থিয়েটারের আঙ্গিক বদল দিয়েছিলেন। চোখের সামনে যা দেখানো হচ্ছে সেটা যে আসল না আগাগোড়া সে বিষয়ে দর্শক কিংবা পাঠককে সচেতন রাখাই সে আঙ্গিকের মূল কথা।

মুখবন্ধে তিনি উল্লেখ করেছেন-  ‘আজকের সময়ে যে মিথ্যা এবং অজ্ঞতার বিরুদ্ধে লড়তে চায় এবং লিখতে চায় সত্যি কথা, তাকে অতি অবশ্যই পাঁচটি ঝামেলার মোকাবিলা করতে হবে। সত্যির বিরোধিতা যখন সর্বস্থানে, তখন তাকে অবশ্যই যা সত্যি তা লেখার সাহস দেখাতে হবে; সত্যিকে গুপ্ত রাখার প্রচেষ্টা যখন সর্বত্র, তখন তাকে চিনে নেওয়ার আগ্রহ থাকতে হবে; থাকতে হবে সত্যিকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করার দক্ষতা; সঙ্গে কারা এই অস্ত্র যথাযথ ব্যবহার করতে পারবেন তা বেছে নেওয়ার বিচারবোধ; এবং পরিশেষে থাকতে হবে সেই নির্বাচিত লোকজনের মধ্যে সত্যিকে ছড়িয়ে দেওয়ার কৌশলী বুদ্ধি। ফ্যাসিবাদের অধীনে বাস এমন লেখকদের জন্য, যারা পলাতক বা নির্বাসিত তাদের এমনকী নাগরিক স্বাধীনতা রয়েছে এমন দেশে কর্মরত লেখকদেরও এই সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়।’

ব্রেখটের সেই প্রবন্ধটির সম্পূর্ণ বাংলা অনুবাদ আমরা রাজ্য ওয়েবসাইটে পাঁচ পর্বের ধারাবাহিক হিসাবে প্রকাশ করছি।

প্রতি সপ্তাহের বুধবার।

আজ পঞ্চম তথা শেষ পর্ব।

Bertolt-Brecht

বের্টল্ট ব্রেখট্

৫ম পর্ব

বহু মানুষের মধ্যে সত্যকে ছড়িয়ে দেওয়া কৌশলী বুদ্ধি

সত্যসন্ধানে তাঁদের প্রয়োজনীয় সাহস আছে এই গর্বে, সত্যিকে খুঁজে পেয়েছেন এই আনন্দে, হয়তো তাকে একটা কেজো আকার দিতে যে খাটনি হয় তার পরিশ্রান্তিতে এবং যাদের স্বার্থরক্ষা করার জন্য এই কাজ করা হচ্ছে তারা এটা চটপট বুঝে ফেলুক এই অধৈর্যভাব থেকে, অনেকে মনে করেন যে সত্যির প্রচারে কোনও বিশেষ কৌশলী বুদ্ধির প্রয়োগের প্রয়োজন নেই। এই মনে হওয়ার কারণে তাঁরা অনেকসময় তাঁদের পুরো কাজের কার্যকারিতাকেই জলাঞ্জলি দিয়ে দেন। যখন সত্যিকে চাপার বা গোপন করার চেষ্টা করা হচ্ছে, তখন সব সময় জরুরি তার প্রচারে কৌশলী চাতুর্যের প্রয়োগ। কনফুসিয়াস প্রাচীন স্বদেশপ্রেমে ভর্তি ঐতিহাসিক পাঁজি বর্ণনার সময় তার প্রতি বিশ্বস্ত থাকেননি। তিনি কিছু কিছু শব্দ পাল্টে দিয়েছিলেন। যেখানে পাঁজিতে লেখা ছিল, “দার্শনিক ওয়ানকে হানদের শাসক বধ করেছিলেন কারণ তিনি এই বা ঐ কথাটি বলেছিলেন,” কনফুসিয়াস সেখানে বধ কথাটি পাল্টে খুন কথাটি বসিয়ে দেন। পাঁজিতে যেখানে লেখা ছিল, যে অমুক স্বৈরাচারীর প্রাণনাশ হয় গুপ্তহত্যার ফলে, কনফুসিয়াস গুপ্তহত্যা-র জায়গায় লিখে দেন মৃত্যুদণ্ড কথাটি। এইভাবে কনফুসিয়াস ইতিহাসের ব্যাখ্যার এক নতুন রাস্তা খুলে দিয়েছিলেন।           

একই ভাবে আমাদের সময়ে কেউ যদি জ্ঞাতিসম্প্রদায় বা জাতির জায়গায় বলে জনতা, যদি জমির জায়গায় বলে ব্যক্তি-মালিকানাধীন জমি, তাহলে সে এই ছোট কাজটির মধ্যে দিয়েই বহু মিথ্যার প্রতি থাকা তার সমর্থন প্রত্যাহার করবে। এই শব্দগুলোর মধ্যে যে জঘন্য গুপ্ত ইঙ্গিত রয়েছে, সেগুলিকে এর মাধ্যমে সে হটিয়ে দিতে পারে। জ্ঞাতিসম্প্রদায় (ফোক) কথাটির মধ্যে ইঙ্গিত থাকে যে এই সম্প্রদায়ের সকল মানুষের মধ্যে একটি বিশেষ ঐক্য রয়েছে এবং কিছু সাধারণ স্বার্থ রয়েছে; তাই এই কথাটা তখনই ব্যবহার করতে হবে যখন আমরা একটি বৃহৎ সংখ্যক মানুষের কথা বলব, কারণ একমাত্র তখনই এমন কোনও সম্প্রদায়ের কল্পনা করা যায় যাদের স্বার্থ একই ধরণের। একই দেশে বসবাসকারী জনতার মধ্যেও যে নানা ধরণের, এমনকী পরস্পর বিরোধী স্বার্থ থাকতে পারে – এই সত্য চেপে যাওয়া হয়। একই ভাবে, যে লোক জমির কথা বলার সময় প্রাণবন্তভাবে চষা জমির ঘ্রাণ ও রঙের উপর জোর দিয়ে কথা বলে, সে আদতে শাসকদের মিথ্যাকেই সমর্থন করছে। কারণ আদত প্রশ্ন জমির উর্বরতা নিয়ে নয়, চাষির জমির প্রতি ভালোবাসা নিয়ে নয় অথবা তাদের চাষ করার পরিশ্রম নিয়েও নয়;  যে বিষয় সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ তা হল ফসলের দাম এবং শ্রমের মূল্য। যারা জমি থেকে মুনাফা শোষণ করে আর যারা জমিতে ফসল ফলায় তারা এক লোক নয়, আর সেই কারণেই শেয়ার বাজারে জমিতে লাঙলের দাগ থেকে উঠে আসা মাটির গন্ধ পাওয়া যায় না। সেখানকার ঘ্রাণ সম্পূর্ণ অন্যরকম। তাই ব্যক্তি-মালিকানাধীন জমি কথাটা বললেই সঠিক বক্তব্য তুলে ধরা হয়; ওতে চোখে ধুলো দেওয়ার সুযোগ কম থাকে।

যেখানে দমন-পীড়ন চলছে, সেখানে শৃঙ্খলার জায়গায় বশ্যতা কথাটা ব্যবহার করা উচিৎ, কারণ শৃঙ্খলা স্ব-আরোপিতও হতে পারে এবং তার মধ্যে একপ্রকার মহত্ত্ব রয়েছে যা বশ্যতার মধ্যে নেই। আর সম্মান-এর একটা বিকল্প ভালো শব্দ হল মানব-সম্মান; কারণ এর মধ্যে দ্বিতীয়টিতে ব্যক্তির কথাও মনে রাখা হয়। আমরা খুব ভালোই জানি ঠিক কোন ধরণের বজ্জাতের দল জাতির সম্মান রক্ষার ধুয়ো তুলে দৌড়ে আসে। এও জানি যে বুভুক্ষ মানুষের শ্রমে এদের নিজেদের খাবার জোটে তাদের এরা ঠিক কতটা উদারভাবে সম্মান দেয়। কনফুসিয়াসের কৌশলী বুদ্ধি তাই আজও প্রাসঙ্গিক। যেমন টমাস মুরের ইউটোপিয়াতে একটি দেশের বর্ণনা আছে যেখানে ন্যায়ের রাজত্ব বিরাজমান। ওই বর্ণিত দেশ একই সঙ্গে ছিল তাঁর মাতৃভূমি ইংল্যান্ডের থেকে একেবারেই আলাদা, আবার একেবারে ভিন্ন জীবনযাত্রার ধরণ ছাড়া তার সঙ্গে ইংল্যান্ডের ঘনিষ্ট সাদৃশ্যও ছিল।

সাখালিন দ্বীপে যে শোষণ ও অত্যাচার চলে, লেনিন তার বর্ণনা দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু জারের পুলিশ সম্পর্কে তাঁকে সতর্ক থাকতে হয়েছিল। তাই রাশিয়ার জায়গায় তিনি লিখলেন জাপানের কথা, আর সাখালিনের জায়গায় কোরিয়া। জাপানি বুর্জোয়াদের কীর্তিকলাপ তাঁর পাঠকদের অব্যর্থ ভাবে মনে করিয়ে দিল রুশ বুর্জোয়া আর সাখালিনের কথা, কিন্তু তাঁর এই পুস্তিকাটা রোষের মুখে পড়ল না কারণ তখন রাশিয়া জাপানের শত্রু ছিল। একই ভাবে জার্মানি সম্পর্কে এমন অনেক কথা যা জার্মানিতে বসে বলা যায় না, তা অস্ট্রিয়া সম্পর্কে বলা যেতে পারে।

সন্দিগ্ধ রাষ্ট্রকে টুপি পরানোর এইরকম আরও অনেক কৌশলী উপায় আছে।

ভলতেয়ার চার্চের অলৌকিকতার মতাদর্শের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন ওর্লেয়ঁ-এর কুমারীকে নিয়ে একটি বীররসাত্মক কবিতা লিখে। তিনি ওতে লিখেছিলেন জোন অফ আর্ক যে পুরুষ মানুষ পরিপূর্ণ সেনাবাহিনী, অভিজাতদের সভা এবং খ্রিস্টান সন্ন্যাসীদের মধ্যে থেকেও কুমারী থেকেছিলেন তার কারণ নিঃসন্দেহে দৈব ও অলৌকিক ঘটনাবলী। শাসকশ্রেণির বিলাসপূর্ণ দ্বারা চিহ্নিত কামুক কর্মকান্ডের বর্ণনা লেখার মার্জিত শৈলীর মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলে তিনি যে ধর্ম তাদের এই উচ্ছৃঙ্খল যাপনের সুযোগ দেয় তার প্রতি পাঠকের অনাস্থা তৈরি করতে চেয়েছিলেন। তিনি এমনকী যাদের জন্য এই লেখা, এই উদ্দিষ্ট পাঠকবর্গের কাছে তা বেআইনি ভাবে পৌঁছে দিতেও সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর পাঠকদের মধ্যে যারা ক্ষমতাশালী ছিলেন তারা এই লেখার প্রচার করেছিল অথবা ক্রমবর্ধমান প্রচারের প্রতি সহিষ্ণু ছিল। এই কাজের অর্থই ছিল, তারা তাদের বিলাস ব্যসন রক্ষা করে যে পুলিশ, তাদের উপর থেকে নিজেদের সমর্থন প্রত্যাহার করে নেওয়া। আরেকটা উদাহরণ দেওয়া যায়: মহাকবি লুক্রেশিয়াস খোলাখুলিই বলেছিলেন, এপিকিউরিয় নিরীশ্বরবাদের জনপ্রিয়তার প্রসারের প্রধান কারণগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল তাঁর পদ্যের সৌন্দর্য।               

একথা সত্যি যে কোনও বক্তব্যের সাহিত্যিক মান উঁচু হলে তার মাধ্যমে একটা রক্ষাকবচ পাওয়া যায়। তবে, প্রায়শই লেখার উঁচু মান সন্দেহেরও জন্ম দেয়। সেই রকম পরিস্থিতি হলে লেখার মান সচেতন ভাবে নামিয়ে ফেলা উচিৎ। যেমন, বহুনিন্দিত সস্তা গোয়েন্দা গল্পের মোড়কে প্রছন্ন ভাবে পাচার করা যেতে পারে খারাপ পরিস্থিতির বিবরণ। গোয়েন্দা গল্পে এইরকম বিবরণ থাকতেই পারে। এর থেকে অনেক কম গুরুত্বপূর্ণ কারণে মহান শেক্সপিয়ার সচেতন ভাবে নিজের কাজের মান নামিয়ে ফেলেছিলেন। যে দৃশ্যে নিজের শহর থেকে বিদায় নেওয়ার সময় করিওলেনাসকে তার মায়ের সম্মুখীন হতে হয়, সেখানে শেক্সপিয়ার সচেতন ভাবে ছেলের প্রতি মায়ের ভাষণকে খুব দুর্বল ভাবে লিখেছেন। সুযুক্তির মাধ্যমে করিওলেনাস তার পরিকল্পনা থেকে বিরত থাকলে শেক্সপিয়ারের চলত না; তাঁর প্রয়োজন ছিল সে যাতে আবার তার আলস্যের পুরনো অভ্যাসের কাছে পরাজয় স্বীকার করে।                              

কোন কৌশলে সত্যির প্রসার ঘটানো যায়, শেক্সপিয়ার তার উপায়ও দেখিয়ে গেছেন: অ্যান্টনির সিজারের মৃতদেহের সামনে রাখা ভাষণ স্মরণীয়। ঐ ভাষণে অ্যান্টনি বারে বারে জোর দিয়ে বলে গেছে যে ব্রুটাস একজন ন্যায়পরায়ণ মানুষ, কিন্তু তার পাশাপাশি সে যে ঘটনা ঘটেছে তারও বর্ণনা দিয়ে গেছে, আর যা ঘটেছে তার বর্ণনা যে তা ঘটিয়েছে তার বর্ণনার থেকে ছিল বহুগুণ হৃদয়গ্রাহী। বক্তা এইভাবেই নিজেকে তথ্যে ভেসে যেতে দেন, তিনি নিজে বলার পরিবর্তে কথা বলতে দেন তাদেরকেই। 

আজ থেকে চার হাজার বছর আগের এক মিশরীয় কবিও এই একই কায়দা অনুসরণ করেছিলেন। সেও ছিল এক বিশাল শ্রেণি সংগ্রামের সময়। যে শ্রেণি এতকাল শাসন করেছিল তারা হিমশিম খাচ্ছিল তাদের প্রবল প্রতিপক্ষ, যে শ্রেণি এতকাল অধীনে থেকে খেটেছিল, তাদের আক্রমণ প্রতিহত করতে। এই পদ্যে শাসকের দরবারে এক পন্ডিতের আবির্ভাব হয় এবং এই অভ্যন্তরীণ শত্রুর বিরুদ্ধে সে সংগ্রামের ডাক দেয়। নিম্নশ্রেণির এই অভ্যুত্থানের ফলে যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে তার একটি দীর্ঘ এবং চিত্তাকর্ষক বিবরণ তিনি দিয়েছিলেন। সেই বিবরণ হল নিম্নরূপ:  

বর্তমানে: অভিজাতরা বিলাপ করছে আর ভৃত্যরা উল্লাস। প্রতি শহরে শোনা যাচ্ছে: আমাদের মধ্যে থেকে শক্তিশালীদের বিতাড়ন কর। দফতরগুলি ভেঙে খোলা হচ্ছে আর তার নথি সরিয়ে ফেলা হচ্ছে। দাসরা হয়ে যাচ্ছে শাসক।

বর্তমানে: একজন সদ্বংশজাত পুত্রকে আর কেউ স্বীকৃতি দিচ্ছে না। মালকিনের সন্তান হয়ে যাচ্ছে তার দাসীর পুত্র।

বর্তমানে: নগরশ্রেষ্ঠীদের বাঁধা হচ্ছে জাঁতা কলে। যারা কখনও দিনের আলোয় বেরোয়নি তাদের টেনে নিয়ে আসা হয়েছে রোদে।  

বর্তমানে: আবলুস কাঠের তৈরি দান সিন্দুকগুলি ভেঙে ফেলা হচ্ছে; পবিত্র জয়ন্তী গাছ কেটে বানানো হচ্ছে বিছানা।

চেয়ে দেখ, রাজধানীর পতন ঘটছে এক ঘটিকার মধ্যে।

চেয়ে দেখ, এ দেশের দরিদ্ররা হয়ে উঠেছে ধনী।

চেয়ে দেখ, যার আগে খাওয়ার জন্য রুটি ছিল না তার হাতে এখন ফসলের গোলা; তার নিজের গোলায় সে অন্যের সম্পদে ভরে তুলছে।

চেয়ে দেখ, মানুষ যখন খেতে পাচ্ছে তখনই খুশি।

চেয়ে দেখ, যার আগে কোনও শস্য ছিল না তার হাতে এখন গোলা; যারা আগে দান হিসেবে হাত পেতে শস্য নিত তারা এখন শস্য বিলি করছে।

চেয়ে দেখ, যাদের লাঙল টানার কোনও বলদ ছিল না তাদের কাছে এখন বলদের পাল; যারা আগে ভারবাহী পশু জোগাড় করতে পারত না তাদের কাছে এখন চকচকে গবাদি পশুর পাল।

চেয়ে দেখ, যারা আগে নিজের জন্য কুঁড়ে বানাতে পারত না তার ঘরে উঠেছে আজ চার মুজবুত দেওয়াল।

চেয়ে দেখ, শস্যাগারে মন্ত্রীরা আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন, আর আগে যাদের দাঁড়িয়ে ঘুমনোরও অবসর ছিল না তাদের হাতে এসেছে বিছানা।

চেয়ে দেখ, যারা আগে নিজেদের জন্য ডিঙি নৌকাও বানাতে পারত না তারা আজ জাহাজের অধিকারী; জাহাজের মালিকরা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছেন, জাহাজ আর তাঁদের নেই।    

চেয়ে দেখ, যাদের আগে কাপড় ছিল তারা আজ ন্যাকড়া গায়ে বেরিয়েছে আর যাদের নিজের কাপড় বুনিয়ে নেওয়ার সামর্থ্য ছিল না তাদের গায়ে আজ পট্টবস্ত্র।

বিত্তবান ঘুমোতে যায় তৃষ্ণার্ত হয়ে, আর যে একসময় তার কাছে তলানি মদ ভিক্ষা চাইত তার হাতে কড়া যবসুরা।

চেয়ে দেখ, যে সঙ্গীতের কিছুই বোঝে না তার হাতে এখন বীণা; যাকে কেউ কোনওদিন গান শোনায়নি সেই এখন সঙ্গীত শুনে তার প্রশংসা করে।

চেয়ে দেখ, স্ত্রীহীন যে জন একা ঘুমতো, আজ মহিলা পরিবেষ্টিত; যে একসময় জলে নিজের মুখ দেখত এখন আয়নায় তা দেখে।

চেয়ে দেখ, এই দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা কাজের খোঁজে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। মহামহিমকে কেউই কিছু খবর দেয় না। যে একসময় দূত ছিল সেই নিজেই এখন খবর পাঠাতে অন্যদের পাঠায়… 

চেয়ে দেখ, এই পাঁচজনকে তাদের মালিক পাঠিয়েছে। তারা বলছে; এগিয়ে এসো; আমরা এসেছি।

অর্থপূর্ণ ভাবে, যে প্রকার বিশৃঙ্খলার বর্ণনা এখানে দেওয়া হয়েছে তা শোষিত মানুষের কাছে খুবই কাম্য মনে হবে। এখানে কবির যে উদ্দেশ্য তা স্বচ্ছ নয়। তিনি স্পষ্টভাবে এই পরিস্থিতির নিন্দা করছেন, কিন্তু সেই নিন্দা খুব দুর্বল…

জোনাথান সুইফ্‌ট, তাঁর একটি বিখ্যাত পুস্তিকায় বলেছিলেন যে এই দেশে সমৃদ্ধি ফিরিয়ে নিয়ে আসা যেতে পারে যদি দরিদ্র মানুষের সন্তান জবাই করে তাদের মাংস বিক্রি করা হয়। শাসক শ্রেণিরা হৃদয়হীনতা যদি অপ্রতিরোধ্য হয় তাহলে ঠিক কি ধরণের অর্থনীতি স্থাপিত হবে তা তিনি নিখুঁত হিসেবের দ্বারা তুলে ধরেছিলেন। 

সুইফ্‌ট এক্ষেত্রে বোকা সেজেছিলেন। তিনি এমন এক চিন্তাধারার রক্ষণে উদ্যমী হয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ যুক্তি সাজাতে কলম ধরেছিলেন যাকে তিনি আদতে তীব্রভাবে ঘৃণা করতেন, মূলভাব হিসেবে নিয়েছিলেন এমন এক প্রশ্নকে যা ঐ চিন্তাধারার ক্রুরতা একদম স্পষ্ট ভাবে সবার সামনে তুলে ধরেছিল। যে কেউ সুইফ্‌টের থেকে বুদ্ধিমান হতে পারে, বা আরও মানবিক হতে পারেন – বিশেষ করে তারা যারা এখনও অবধি তলিয়ে ভেবে দেখেনি তাদের দৃষ্টিভঙ্গির যৌক্তিক পরিণতি ঠিক কী।

যে ক্ষেত্রেই হোক না কেন, প্রচারণা (প্রোপাগান্ডা) চিন্তার খোরাক যোগায় এবং তা শোষিতদের স্বার্থরক্ষার কাজে উপযোগী। তাই এইরকম প্রচারণার খুবই প্রয়োজন রয়েছে। বিশেষ করে সেই সব সরকারের অধীনে থাকাকালীন যারা শোষণের প্রসারে সদা সক্রিয় এবং চিন্তাভাবনাকে নিচু চোখে দেখে।

আদতে শোষিতদের কাজে লাগতে পারে এমন সবকিছুকেই নিচু চোখে দেখা হয়। কাল খাবার জুটবে কিনা তা নিয়ে চিন্তিত থাকা নীচ মানসিকতা, যে দেশে দেশরক্ষকরাই ক্ষুধার্ত সেই দেশেও দেশরক্ষকের সম্মান ফিরিয়ে দেওয়া নীচ মানসিকতা; যে নেতার জন্য দেশে দুর্ভাগ্য নেমে আসে তার নেতৃত্বকে প্রশ্ন করা নীচতার পরিচয়; যে কাজ শ্রমিকদের খাদ্যের যোগান দিতে অক্ষম তাতে যোগ দেওয়ার ব্যাপারে সংশয়ও নীচতা; যে অর্থহীন কর্মকান্ডে অংশ নিতে চাপ দেওয়া হচ্ছে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করাও নীচ মানসিকতার পরিচায়ক; যে পরিবারের আর কোনওপ্রকার উদ্বেগেই উপকার হওয়ার নয় তাদের প্রতি নিঃস্পৃহ থাকাও নীচতা। যারা ক্ষুধায় কাতর তাদের নিন্দা করে তুলনা করা হয় সেই সব লোভী নেকড়ের সঙ্গে যারা কিছুই রক্ষা করতে আগ্রহী নয়; যারা তাদের শোষকদের প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করে অভিযোগ করা হয় তারা আদতে নিজেদের শক্তিকেই সন্দেহ করছে; যারা নিজেদের শ্রমের মূল্য দাবি করে তাদের নিন্দা করা হয় নিষ্কর্মা বলে। এইরকম সরকারের অধীনে স্বাভাবিকভাবেই চিন্তাভাবনা করাকে একটা হীন কাজ বলে মনে করা হতে থাকবে এবং ক্রমশ তাতে আরও কলঙ্কলেপন করা হবে। কীভাবে চিন্তাভাবনা করতে হয়, তা তাই কোথাও আর শেখানো হয় না, আর যদিও বা কোনোখানে চিন্তাভাবনা করার অভ্যাস জন্ম নেয়, সঙ্গে সঙ্গেই নেমে আসে শাস্তির খাঁড়া।

তবুও, কিছু কিছু ক্ষেত্র সব সময়ই থাকবে যেখানে শাস্তির ভয় না করেই চিন্তাচেতনার জয়যাত্রার দিকে মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করা যেতে পারে। এ হল সেই ক্ষেত্রগুলো যেখানে চিন্তাভাবনার প্রয়োজন স্বৈরতন্ত্রের নিজের স্বার্থেই রয়েছে। যেমন উদাহরণ স্বরূপ, সামরিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে চিন্তার জয়যাত্রার দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে। এমনকি যথাযথ সংগঠনের মাধ্যমে পশমের যোগান বাড়ানোর মত বিষয়, অথবা কোনও শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদানের বিকল্প আবিষ্কারের মত বিষয়েও চিন্তাভাবনার দরকার হয়। খাবারে ভেজাল মেশাতে, যুব সম্প্রদায়কে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করতে – এই সব কিছুর জন্যই ভাবনা চিন্তার প্রয়োজন; আর এই সব বিষয়ের সঙ্গে জড়িয়েই কীভাবে ভাবনাচিন্তা করতে হয় তার বর্ণনা দেওয়া সম্ভব। এই সব বিষয়ে ভাবনাচিন্তা করার যে অবধারিত উদ্দেশ্য, যুদ্ধের প্রশংসা, তা কৌশল করে এড়িয়ে যাওয়া যায়, আর কীভাবে আরও ভালো ভাবে যুদ্ধ করা যায় এই প্রশ্নকেও ঘুরিয়ে দেওয়া যায় অন্য আরেকটি প্রশ্নের দিকে – যুদ্ধ করার আদৌ কোনও অর্থ আছে কী। সেই প্রশ্ন থেকে যে ভাবনার জন্ম নেয় তাকে আবার  চালনা করা যায় পরের প্রশ্নের দিকে: কীভাবে এই অর্থহীন যুদ্ধকে ঠেকানো যায় ?

খুব স্বাভাবিক ভাবেই, এই প্রশ্নগুলি মোটেই খোলাখুলি করা যাবে না। তবে তাই বলে কী আমরা যে চিন্তা ভাবনাকে উৎসাহ দিতে চাইছি তার কোনও উপযোগিতা নেই ? এমনভাবে কী তাকে গড়ে তোলা যাবে না যে তা থেকে কিছু বাস্তব পদক্ষেপের জন্ম হতে পরে ? যাবে।    

আমাদের সময়ে জনগণের একটি অংশের (যা সংখ্যায় বৃহৎ) উপর আরেকটি অংশের (যা সংখ্যায় ক্ষুদ্র) শোষণ ততক্ষণই চলতে পারে যতক্ষণ সাধারণ মানুষের মধ্যে এক বিশেষ প্রকার মানসিকতা তৈরি করে টিকিয়ে রাখা হয়েছে ও এই বিশেষ ধরণের মানসিকতার প্রাধান্য কায়েম করা হয়েছে সকল বিষয়ক্ষেত্রে। আসলে প্রাণিবিদ্যার মতো ক্ষেত্রেও কোনো একটি আবিষ্কার, ইংরেজ ডারউইনের আবিষ্কারের মত, আকস্মাত শোষণকাঠামোর জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে। তবুও, একথা মনে রাখতে হবে, ডারউইনের ক্ষেত্রে কিছুকাল অবধি চার্চ-ই শুধু শঙ্কিত ছিল; সাধারণ জনতা কোন গোলামাল ধরা পড়েছে তা কিছুই ধরতে পারেনি। সাম্প্রতিক বছরগুলিতেও পদার্থবিদদের গবেষণার প্রভাব যুক্তিবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এমন ভাবে পড়েছে যার ফলে শোষণ চালিয়ে যাওয়ার সহায়ক বেশ কয়েকটি গোঁড়ামির অস্তিত্বই এখন বিপদের মুখে। হেগেল, যিনি ছিলেন প্রাশিয়ান রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় দার্শনিক, যাঁর ক্ষেত্র ছিল যুক্তিবিজ্ঞানের জটিল অনুসন্ধান, তাঁর থেকেই মার্কস এবং লেনিনের মতো সর্বহারার বিপ্লবের ধ্রুপদী প্রচারকরা পেয়েছিলেন অমূল্য প্রয়োগযোগ্য পদ্ধতি। বিজ্ঞানের বিষয়গুলির বিকাশ একই সঙ্গে পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, কিন্তু অসম, আর তাই রাষ্ট্র কখনও সব দিকে নজর রাখতে পারে না। তাই সত্যির অগ্রগামী বাহিনী নিজের পছন্দমত বেছে নিতে পারে সেই সকল লড়াইয়ের জায়গা যেখানে নজরদারী অপেক্ষাকৃত কম।           

জরুরি হল সঠিক ভাবে ভাবনাচিন্তা করতে শেখানো, যে ভাবনাচিন্তা সমস্ত বস্তু ও প্রক্রিয়ার ক্ষণস্থায়ী এবং পরিবর্তনশীল দিকগুলো অনুসন্ধান করতে পারে। বড়ো ধরণের বদল সম্পর্কে শাসকদের প্রবল ঘৃণা থাকে। তারা চায় সবই একইরকম থাকুক – যদি সম্ভব হয়, হাজার বছর ধরে। সূর্য আর চন্দ্র যদি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে যায় তাহলে তারা খুবই খুশি হবে। তখন তো আর কেউ ক্ষুধায় কাতর হবে না, কেউ রাতের খাবারও চাইবে না। যখন শাসকরা বন্দুক চালায়, তারা চায় না তাদের শত্রুরা পাল্টা গুলি চালানোর সুযোগ পাক; তাদেরটাই শেষ গুলি চালানো হতে হবে। তাই যে ধরণের ভাবনাচিন্তা পরিবর্তনের ওপর জোর দেয়, তা শোষিতদের উৎসাহিত করার একটা ভালো পন্থা।    

বিজয়ী শাসকদের মোকাবিলা করতে সক্ষম এমন আরেকটি চিন্তাধারা হল এই ভাবনা যে, সমস্ত কিছুর মধ্যে আর সমস্ত পরিস্থিতিতেই দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয় এবং তা বাড়তে থাকে। এই প্রকার দৃষ্টিভঙ্গি (অর্থাৎ দ্বান্দ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি, যা শেখায় সব কিছুই বহমান ও পরিবর্তনশীল) এমন সমস্ত বিষয়ের মধ্যে চারিয়ে যাওয়া দিতে পারে যেখানে আপাতত শাসকের নজর নেই। দৃষ্টান্ত স্বরূপ জীববিদ্যা বা রসায়নের মতো বিষয়ে এই পদ্ধতির প্রয়োগ করা যায়। এছাড়াও অন্যভাবে, যেমন একটি পরিবারের ভবিতব্য বর্ণনা করার সময় এই চিন্তাধারাকে তুলে ধরা সম্ভব, এখানেও তা শাসকে খুব একটা নজরে আসবে না। অসংখ্য বিষয়, যা সর্বদা পরিবর্তনশীল, তার উপর নির্ভর করেই যে সব চলছে এই ভাবনাটাই একনায়কদের জন্য সাংঘাতিক, আর এই ভাবনাকে এমন সব আকারে হাজির করা সম্ভব যা দেখে পুলিশ কিছু বুঝতেও পারবে না। তামাকের দোকান খোলার সময় একজন মানুষ যে সব প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যায় আর যে সব পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়, তার একটা পরিপূর্ণ বিবরণই যথেষ্ট স্বৈরতন্ত্রকে একটা ধাক্কা মারার। কেনো, তা একটু ভাবলেই স্পষ্ট হবে। যে সরকার জনগণকে দুর্দশার মধ্যে নিয়ে চলেছে তারা সব সময় চেষ্টা করবে দৈন্যের মধ্যে থাকা অবস্থায় জনতা যেন না ভাবে এর জন্য সরকার দায়ী। তাই দেখা যাবে এই ধরণের সরকার ভাগ্য নিয়ে প্রচুর কথা বলে। বোঝানোর চেষ্টা করে সকল খারাপ অবস্থার জন্য তারা নয়, দায়ী আসলে ভাগ্য। দুর্দশার আদত কারণ কী, তা নিয়ে কেউ খোঁজাখুঁজি শুরু করলেই সরকারই যে এর জন্য দায়ী সেই তথ্য হাতের আসার আগেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু এই ভাগ্য নামক বুজরুকি ধারণাটির একটি সাধারণ বিরোধ করা সম্ভব; দেখানো সম্ভব যে মানুষের ভাগ্য নির্মাণ করে মানুষই।  

আরেকটি বিষয় রয়েছে যা নানা উপায়ে করা যেতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ, কেউ একটা কৃষি খামারের গল্প বলতে পারে – ধরা যাক, খামারটি আইসল্যান্ডের। পুরো গ্রামের আলোচনার বিষয় এই খামারটির উপর থাকা একটি অভিশাপ। এক কৃষক রমণী কুয়োতে ডুবে আত্মহত্যা করেছে ওই খামারে; আর খামারের মালিক যে কৃষক সে দিয়েছে গলায় দড়ি। একদিন ঐ কৃষকের ছেলে আর একটি মেয়ের মধ্যে বিবাহ হল, বিয়েতে পণ হিসেবে ছেলেটি পেল কয়েক একর ভালো জমি। তারপরেই খামার থেকে অভিশাপ যেন সরে গেল। কেন ঐ খামারের ভাগ্য ফিরল, তা নিয়ে গ্রামের লোকেদের মধ্যে দেখা গেল ভাগাভাগি। একদল বলল কৃষকের যুবক ছেলেটা বড়োই হাসিখুশি তাই ভাগ্য ফিরেছে, আর আরেকদল বলল নতুন বউ ঘরে আসার সময় যে নতুন জমি পেয়েছে তার ফলে খামার বড়ো হওয়াতে এখন তা থেকে স্বচ্ছল জীবনযাপন করা যায়, কপাল ফিরেছে তাতেই।        

এমনকী নিছক প্রাকৃতিক দৃশ্যপটের বর্ণনা করা হচ্ছে এমন কবিতার মাধ্যমেও উদ্দেশ্য সাধন করা সম্ভব, যদি সেই দৃশ্যপটে মনুষ্যসৃষ্ট কিছু বিষয়বস্তু অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

সত্যির প্রসারে জরুরি কৌশলী বুদ্ধি। 

সারসংক্ষেপ

আমাদের সময়ের একটি বৃহৎ সত্য হল এই যে উৎপাদন ব্যবস্থার উপর ব্যক্তিগত মালিকানাকে হিংসার মাধ্যমে টিকিয়ে রাখার জন্য  আমাদের মহাদেশ ক্রমশ বর্বরতন্ত্রের কাছে মাথা নত করছে। এই সত্যিকে শুধু স্বীকৃতি দেওয়াই যথেষ্ট নয়, কিন্তু যদি স্বীকৃতিও না মেলে, তাহলে আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ সত্যির আবিষ্কার অসম্ভব। আমরা যে পরিস্থিতিতে পড়েছি সেটা একটা বর্বরতন্ত্র (যেটা সত্যি), একথা সাহস করে লিখেও বা কী হবে, যদি না স্পষ্ট করে না লিখি কেনো এই পরিস্থিতিতে আমরা পড়েছি ? আমাদের বলতে হবে নির্যাতন করা হয় কারণ ওর মাধ্যমে সম্পত্তি সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা হয়। অবশ্য একথা বললেই আমাদের সঙ্গ ছেড়ে যাবেন এমন প্রচুর বন্ধু যাঁরা নির্যাতনের বিরুদ্ধে শুধু একটাই কারণে, তাঁরা মনে করেন নির্যাতন ছাড়াও সম্পত্তি সম্পর্ক বজায় রাখা সম্ভব, যা একটা অসত্য কথা। 

আমাদের দেশের বর্বর পরিস্থিতি সম্পর্কে এমন সত্যি কথা বলতে হবে যাতে সেই পদক্ষেপই নেওয়া হয় যার মাধ্যমে এর অবসান সম্ভব – সেই পদক্ষেপ হল, সম্পত্তি সম্পর্কের বদল।

এর সঙ্গে, আমাদের এই সত্যি বলতে হবে তাদেরকে যারা এই সম্পত্তি সম্পর্কের ফলে সবথেকে দুর্দশার মধ্যে রয়েছে এবং যারা নিজেদের পরিস্থিতি পাল্টাতে সবথেকে বেশি আগ্রহী – শ্রমিকরা ও তাদের বন্ধু হিসেবে যাদের আমরা টেনে আনতে পারি তারা, কারণ মুনাফার কিছু ভাগ পেলেও তাদের হাতেও উৎপাদন ব্যবস্থার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।

আর আমাদের এগোতে হবে কৌশলী ভাবে। 

এই পাঁচ ঝঞ্ঝাট অতিক্রম করতে হবে একই সময়ে একই সঙ্গে, কারণ আমরা বর্বর পরিস্থিতি সম্পর্কে সত্যিকে আবিষ্কার করতে পারব না যতক্ষণ না যারা তার দ্বারা পীড়িত হচ্ছে তাদের কথাও চিন্তা না করছি; যতক্ষণ না ভীরুতার শেষ চিহ্নটুকু ঝেড়ে ফেলছি এগোতে পারব না ততক্ষণ; আর বর্তমান পরিস্থিতির আসল চিত্র কী এটা বুঝে সেই জ্ঞান ব্যবহার করতে প্রস্তুত এমন কারোর হাতে আমরা যখন তা তুলে দিচ্ছি, আমাদের এটাও বুঝতে হবে এই সত্যিকে এমনভাবে তাদের হাতে দেওয়া জরুরি যাতে তা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যায়, এবং একই সঙ্গে আমাদের এই কাজ করতে হবে এমন কৌশলী চাতুর্যের সঙ্গে যাতে শত্রু আমাদের এই সত্যির প্রচার আবিষ্কার করে তাতে বাধা দিতে না পারে।

একজন লেখককে যখন সত্যি লিখতে বলা হয়, তখন আবশ্যক এই বিষয়গুলিকে মাথায় রাখা।

ভাষান্তরঃ রবিকর গুপ্ত

ব্যবহৃত ছবিঃ সোশ্যাল মিডিয়া সুত্রে প্রাপ্ত

Spread the word

Leave a Reply