This Internship is a mixture of Fanaticism and Fraud

কলতান দাশগুপ্ত

অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন সপ্তম বারের জন্য দেশের কেন্দ্রীয় বাজেট পেশ করলেন। দেশে বর্তমানে আর্থিক বৈষম্য চরমে। দেশের বেশির ভাগ মানুষের বেঁচে থাকাই দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে কাজ না পাওয়া ও খেতে না পাওয়ার যন্ত্রণায়। সরকারের প্রথম বাজেটের থেকে অনেকের আশা ছিল যে, সরকার তার জীবন জীবিকার সঙ্কটের কিছুটা সুরাহা করার চেষ্টা করবে সরকারী ব্যয়বরাদ্দ বৃদ্ধি করে। শিক্ষা, স্বাস্থ্যয় ব্যয়বরাদ্দ বাড়বে। এর কোনটাই ঘটেনি। সদ্য সমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনের আগে গোটা দেশ কার্যত দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। একদিকে মোদী এবং আর এস এস যারা ধর্মকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা তৈরি করে ভোটের বৈতরণী পার হতে চেয়েছিলেন। অন্যদিকে সাধারণ মানুষ যারা রুটি রুজির অধিকার চেয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন। অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে ৪০০ আসন পাওয়ার কথা ঘোষণা করলেও সাধারণ মানুষের ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের ফলে বিজেপিকে খানিকটা হোচট খেতে হয়েছে। তারা বাধ্য হয়েছে জোট সরকার তৈরি করতে। সাধারণ মানুষের এই ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের ফলে অর্থমন্ত্রীর উপর চাপ তৈরি হয়েছিল এবারের বাজেটকে জনমুখী করার জন্য। কিন্তু জোট সরকারের বাধ্যবাধকতার বাইরে নির্মলা সীতারামন বের হতে পারেন নি। NDA সরকার যে চেয়ারের উপর বসে আছে সেই চেয়ারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দুটি পায়া জেডিইউ ও টিডিপি তাদের নিজেদের রাজ্যের জন্য বাড়তি প্যাকেজ পেল, কিন্তু এ দেশের বিক্ষুব্ধ চাকরিপ্রার্থী যুবসমাজ কার্যত এবারও বাজেট থেকে খালি হাতে ফিরতে বাধ্য হচ্ছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় যে অতীতে বিভিন্ন বক্তৃতায়, মোদী বছরে ২ কোটি চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন । অর্থনৈতিক সমীক্ষা প্রতিবেদনে উল্লেখিত ছিল যে দেশের বেকারত্বের সমস্যা মেটাতে হলে অ-কৃষি খাতে বার্ষিক প্রায় ৭৮.৫১ লাখ কর্মসংস্থান তৈরি করতে হবে। তার ধারপাশ দিয়ে যায়নি এই বাজেট।

ক্রমবর্ধমান বেকারি কমাতে কয়লাখনি, ইস্পাত, রেল, প্রতিরক্ষা, ব্যাংক ইত্যাদি ক্ষেত্রে সরকারি শুন্যপদে স্থায়ী নিয়োগ বাড়ানোর কোন পরিকল্পনা এবারের বাজেটে ঘোষণা হয়নি। একটার পর একটা কয়লা খনি বেসরকারি মালিকের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। ২০১৯ সালের পর থেকে রেলের নতুন নিয়োগ বন্ধ। পরপর রেল দুর্ঘটনার পর রেলে কর্মসংস্থান নিয়ে কথা উঠলেও নিয়োগ হচ্ছে না। প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রেও ‘অগ্নিবীর’ নামক চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ হচ্ছে অথচ স্থায়ী নিয়োগের কথা শোনা যাচ্ছে না। নিয়োগের নতুন চাহিদা সৃষ্টি করে শিল্প ক্ষেত্রের নতুন কর্মসংস্থান তৈরীর কোন উদ্যোগ এবারের বাজেটে নেই। দেশের যুবদের সাথে প্রতারণা করা হয়েছে এই বাজেটে। বাজেটের পরিকল্পনা অনুযায়ী কর্মসংস্থানের জন্য পাঁচ দফা প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। এতে নতুন নিয়োগে ইনটার্নশিপ ভাতা কর্পোরেটদের দেবে কেন্দ্র। ঘোষণা অনুযায়ী আগামী পাঁচ বছরে মোট ১ কোটি কর্মপ্রার্থীদের নতুন কর্মসংস্থান ও তাদের কাজের উপযুক্ত প্রশিক্ষনের সুযোগ পৌঁছে দেওয়া হবে এই প্রকল্পের মাধ্যমে। পাঁচ প্রকল্পের মধ্যে একটি প্রকল্পে বলা হচ্ছে, যে শিল্প সংস্থা নতুন কর্মী নিয়োগ করবে তাদের ইনটার্নশিপ তৈরি হিসাবে প্রথম তিন মাসের বেতন দেবে কেন্দ্র, যা হবে ১৫ হাজার টাকা। প্রশিক্ষন ও ইনটার্নশিপের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে মোট ২ লক্ষ কোটি টাকা।

এই নতুন ইন্টার্নশিপের নাম এমপ্লয়মেন্ট লিঙ্ক ইন্সেন্টিভ বা কর্মসংস্থানের সঙ্গে যুক্ত উৎসাহ ভাতা। এতে বলা হচ্ছে যে নতুন কর্মীকে প্রথম চার বছরের ইপিএফের মালিকের জমার অর্থ দেবে কেন্দ্র। এটা ইন্টার্নশিপ প্রকল্পের আওতায় হবে। এই ইপিএফ-এর টাকা শিল্প মালিকের কাছে সরসরি পৌছে দেওয়া হবে। আরো একটি প্রকল্পে, নিয়োগকারী অতিরিক্ত যে নতুন নিয়োগ করবে তাতে প্রতি কর্মী পিছু ৩ হাজার টাকা দু’বছর নিয়োগকারীকে ইন্টার্নশিপ ‘ভাতা হিসাবে দেবে কেন্দ্র। প্রতি নতুন কর্মী পিছু নিয়োগকারীর মোট ভর্তুকি মিলবে ৭২ হাজার টাকা। মোদী সরকার কর্মসংস্থানেও এবারে কর্পোরেট ভর্তুকি শুরু করে দিল। গত বছরের বাজেট পর্যন্ত কর্পোরেটদের ঋণ মকুব, কর মকুবের সুযোগ করে দিতেন মোদী। বদলে ইলেক্টোরাল বন্ডে হাজার হাজার কোটি টাকা কর্পোরেটরা মোদিকে ভেট দিত। এবার শ্রমিকের মজুরি দেওয়ার চাপটুকুও যাতে কর্পোরেটদের ওপর না পড়ে তার জন্য ভর্তুকি দেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। না হলে বেসরকারি সংস্থায় ইন্টার্নশিপের কাজ কে করবেন বা না করবেন সেই নিয়ে সরকারের মাথাব্যথা থাকা উচিত নয়।

স্থায়ী কাজ কমে যাওয়া, চুক্তিভিত্তিক কাজের নিরাপত্তা ও প্রয়োজনীয় মাইনে না থাকার ফলে বর্তমানে সাধারন মানুষের আয় কমে গেছে, ফলে ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। বাজারে চাহিদা হ্রাস পাওয়ায় শিল্পে উৎপাদনের হার কমছে। ফলে কর্মী ছাঁটাই বেড়ে চলেছে। সেই সময়ে কর্পোরেটদের নতুন নিয়োগে উৎসাহী হওয়ার কোনও লক্ষ্মন দেখা যাচ্ছে না। আর্থিক সমীক্ষা রিপোর্টে বলা হয়েছে চলতি বছরে কর্পোরেটদের মুনাফা চলতি বছরে বেড়েছে, তা সত্ত্বেও তাদের বিনিয়োগ বাড়েনি। ইকনমিক টাইমসের (২২শে মার্চ, ২০২৩) রিপোর্ট অনুযায়ী গত ১০ বছরে মুকেশ আম্বানির মোট সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে ৩৫০ শতাংশ আর গৌতম আদানীর সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে ১২২৫ শতাংশ। স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে যে, মুনাফা বৃদ্ধির মাধ্যমে অর্থের জোগান বাড়লেও দেশে কর্মসংস্থানে সৃষ্টির ক্ষেত্রে কোনও সহায়ক ভূমিকা নেয়নি কর্পোরেটগুলি। যন্ত্রপাতি ক্রয় এবং উৎপাদনের কাজেও অর্থ বিনিয়োগ হয়নি।

লোকসভা নির্বাচনের আগে কংগ্রেস দল যে ন্যায় পত্র প্রকাশিত করেছিল সেখানে অ্যাপ্রেন্টিসশিপ নামক একটি প্রকল্প ছিল। সেখানে বলা ছিল ২৫ বছরের কম বয়সী স্নাতকদের এক বছরের এপ্রেন্টিসশিপের অধিকার দেওয়া হবে আইন তৈরি করে। যেকোনো কাজের জায়গায় তারা শিক্ষানবিশ হিসেবে যোগ দিতে পারবেন, তার জন্য সরকার এক লক্ষ টাকা করে তাদের দিতে বাধ্য থাকবে। এবারের বাজেটের ইন্টার্নশিপ ঘোষণাটি খানিকটা তার আদলে হলেও একটি মূল জায়গায় তফাৎ রয়েছে। এবারের বাজেটে এই ইন্টার্নশিপ নিয়ে কোন আইন প্রণয়নের নির্দেশ নেই। গোটা বিষয়টি কর্পোরেট মালিকদের ইচ্ছা অনিচ্ছার ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। গোটা প্রকল্পের বাস্তবায়নের ভবিষ্যৎ নিয়োগ কর্তৃপক্ষের হাতে থাকছে। যদি কখনো তারা নিয়োগে ইচ্ছুক হন, তবেই বেতন বা প্রফিডেন্ট ফান্ডের টাকা দেওয়ার প্রশ্ন সামনে আসবে। এটা মনে রাখা দরকার যে ২০১৬ থেকে ২০২২ অবধি সারা দেশে মাত্র ১৮ শতাংশ যুবক-যুবতী দক্ষতা বাড়ানোর সুযোগকে ব্যবহার করে কাজ খুঁজে পেয়েছে। এর থেকে আমরা বুঝতে পারি যে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিস্তার লাভ না করলে কাজের সুযোগ তৈরি হয় না। অথচ বিস্তার লাভের বদলে অর্থনীতি ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে, কারণ কর্পোরেটদের কথামতো কল্যানকামী রাষ্ট্রের ভূমিকা থেকে ক্রমাগত নিজেকে সরিয়ে এনেছে মোদি সরকার। স্বাভাবিকভাবেই গত ১০ বছরের পথ ধরেই বেকারত্বের মোকাবিলায় দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার ভূমিকাই এবারের বাজেটে কেন্দ্রীয় সরকার গ্রহণ করেছে। অনেক নতুন ধরনের শব্দ চয়ন ইত্যাদি থাকলেও গ্রামীণ কর্মসংস্থানের মূল বিষয়ে যে রেগা প্রকল্প তা নিয়ে এই বাজেটে প্রয়োজনীয় কিছু ঘোষণা হয়নি। এবারের বাজেটে বরাদ্দ হয়েছে ৮৬,০০০ কোটি টাকা। চলতি আর্থিক বছরের প্রথম চার মাসে ইতিমধ্যেই ৪১,৫০০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে, বাকি আট মাসের জন্য মাত্র ৪৪,৫০০ কোটি টাকার বরাদ্দ পড়ে রইল৷ ভারতের গ্রামীণ এলাকায় বেকারত্ব যে গভীর সংকটে রয়েছে তাতে এই বরাদ্দ একেবারেই অপর্যাপ্ত।

বিগত দিনে মোদি সরকারের পদ্ধতি ছিল যে কোন বিষয়ে চমক হাজির করা, সেটা কাশ্মীরের গণতন্ত্র হত্যা থেকে আরম্ভ করে ইউনিফর্ম সিভিল কোড হয়ে নাগরিকত্ব সংশোধন আইন চালু করা পর্যন্ত বিদ্যমান থেকেছে। প্রকৃত সমস্যা সমাধানের থেকে উচ্চস্বরে কোন একটি আয়োজনে মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়া মারফত চোখ ও মনকে ধাধিয়ে দিয়ে নিজের কাজ হাসিল করতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন মোদি। বাজেটেও বেকারি সমস্যা নিয়ে একই কাজ করলেন মোদী। যেভাবে এই সমস্যার প্রকৃত মোকাবিলার দরকার ছিল তা করা হয়নি। বেকারেরা নিজেদের যোগ্যতা অনুযায়ী স্থায়ী কাজ চায়। কর্পোরেট মালিকের ইচ্ছা অনুযায়ী ইন্টার্নশিপ হিসেবে কাজ করা কখনোই স্থায়ী কাজের বিকল্প হতে পারে না। কিন্তু স্থায়ী কাজের কোনও পরিকল্পনা নেই সরকারের, কারণ ন্যাশনাল মানিটাইজেশন পাইপলাইনের নামে একের পর এক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিক্রি করে স্থায়ী কাজের সুযোগ ক্রমশ কমিয়ে আনছে এই সরকার। তাই ইন্টার্নশিপ প্রকল্প বেকারদের প্রতি একটা যন্ত্রণার তামাশা ছাড়া আর কিছুই নয়। স্থায়ী কাজের সন্ধানে রাস্তায় থাকা বিক্ষুব্ধ যুব অংশকে সরকারের এই ভাঁওতাবাজির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেই হবে।

Spread the word

Leave a Reply