অঞ্জন বেরা
২১ শে জুন, ১৯৭৭ সাল। পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকার পরিচালনার চৌত্রিশ বছরের (১৯৭৭-২০১১) অভিজ্ঞতা বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্রের সাধারণ ইতিহাসে নজিরবিহীন। জনগণের ভোটে জিতে একটানা এরকম বাম নেতৃত্বাধীন সরকার পরিচালনার নজির অন্য কোথাও তৈরি হয়নি। এই কৃতিত্ব রাজ্যবাসীর।
বামফ্রন্ট সরকার নজিরবিহীন শুধুমাত্র মেয়াদের দৈর্ঘ্যের কারণেই নয়। বামফ্রন্ট সরকারের তাৎপর্য—রাজনৈতিক এবং তার বিকল্প নীতির সূত্রে। বামফ্রন্ট সরকার পরাজিত হবার তেরো বছর পারেও যেকোনও জনস্বার্থবাহী বিকল্প নীতির অনুশীলনে সেই সরকারের অভিজ্ঞতাগুলির প্রাসঙ্গিকতা অনস্বীকার্য। শুধু সাফল্যের অভিজ্ঞতা নয়, তার সীমাবদ্ধতা এবং দুর্বলতার অভিজ্ঞতাও। সব মিলিয়ে বুর্জোয়া-জমিদার ব্যবস্থার কাঠামোগত সীমাবদ্ধতার মধ্যে রাজ্যস্তরে জনস্বার্থবাহী বিকল্প নীতি তুলে ধরায় বামফ্রন্ট সরকারের অবদান ও সাফল্য সমগ্র দেশে আজও বিকল্প নীতি প্রতিষ্ঠার প্রকল্পে গুরুত্বপূর্ণ দিশারি।
বামফ্রন্ট সরকার ছিল পথিকৃৎ। বহু ক্ষেত্রেই একথা প্রযোজ্য। শুধু পশ্চিমবঙ্গে নয়, সমগ্র দেশেই। যে পথে আগে কেউ হাঁটেনি সেপথে চলতে হয়েছে বামফ্রন্ট সরকারকে। বলাবাহুল্য সেপথও ছিল কাঁটাবিছানো। প্রতিকূলতা ছিল পাহাড়প্রমাণ। ষড়যন্ত্র এবং অপপ্রচার ছিল লাগাতার। হিংস্র আক্রমণ কখনও থামেনি। চৌত্রিশ বছরে ২৮০০-র বেশি সিপিআই(এম) এবং বামপন্থী কর্মীকে শহীদের মৃত্যু বরণ করতে হয়েছে। দূর্ভাগ্যজনক হলেও একথা অস্বীকার করা যাবে না, বৃহৎ সংবাদ মাধ্যম চৌত্রিশ বছরে বামফ্রন্টে সরকারের একটি কাজেরও প্রশংসা করেনি। যদিও মিডিয়ার ‘প্রতিষ্ঠান-বিরোধী’ ভূমিকা তৃণমূল জমানায় আত্মবিলোপের পথে।
বামফ্রন্ট সরকার এরাজ্যে আকস্মিকভাবে গঠিত হয়নি। বিশেষত স্বাধীনতা উত্তর পর্বে বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তির লাগাতার আন্দোলন সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ, ১৯৬০ দশকের দ্বিতীয়ার্ধে স্বল্পমেয়াদি দুটি যুক্তফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠা, ১৯৭০ দশকের প্রথমার্ধে স্বৈরাচার ও আধাফ্যাসিস্ত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, জরুরি অবস্থার সাহসী মোকাবিলা, আত্মত্যাগ ১৯৭৭ সালের বামফ্রন্ট সরকার গঠনের প্রেক্ষাপট নির্মাণ করে। সত্তর দশকের সেই সময় সিপিআই(এম)’র ১১০০ নেতা,কর্মী, সংগঠককে শহীদ হতে হয়। গণতন্ত্রের সংগ্রাম যত এগিয়েছে তত বেশি মূল্য দিতে হয়েছে।
১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকারের প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে নতুন এক পর্বে প্রবেশ করে পশ্চিমবঙ্গ। মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু শপথ নেওয়ার দিনই স্পষ্ট করে বলেন, বামফ্রন্ট সরকার শুধুমাত্র মহাকরণে বসে কাজ করবে না। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করা হবে। গড়ে তোলা হবে গ্রামের সরকার।
বামফ্রন্ট সরকার দায়িত্বভার গ্রহণ করেই সমস্ত রাজনৈতিক বন্দিকে মুক্তি দেওয়ার জন্য অভূতপূর্ব উদ্যোগ নেয়। মুক্তি পান নকশালপন্থী এবং কংগ্রেসের অনেক নেতা কর্মীও। বামফ্রন্ট সরকার ট্রেড ইউনিয়ন অধিকারকে সুরক্ষা দেয়, রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের, এমনকি পুলিশ কর্মীদের সংগঠনকে স্বীকৃতি দেয়। গণতান্ত্রিক প্রতিবাদ আন্দোলন বা ধর্মঘট ভাঙতে কখনও বামফ্রন্ট পুলিশ পাঠায়নি। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেনি। নাট্য প্রযোজনা সহ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে পুলিশি বা প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ রদ করা হয়। জাতীয় স্তরে আইন পাশ হবার পর পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকারই দেশের মধ্যে প্রথম রাজ্যস্তরে মানবাধিকার কমিশন গঠন করে।
কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের গণতান্ত্রিক পুনর্বিন্যাসের দাবি তুলে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় রাজনৈতিক প্রশাসনিক ও আর্থিক ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারগুলির অধিকারের প্রশ্নে বামফ্রন্ট সরকারের উদ্যোগ গণতন্ত্রের সংগ্রামে উল্লেখযোগ্য। কেন্দ্রীয় সরকার বাধ্য হয় সারকারিয়া কমিশন গঠন করতে।
ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ
বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় বসার পরের বছরেই, ১৯৭৮ সালে রাজ্যে প্রথম পঞ্চায়েত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। গ্রামে গ্রামে বাস্তুঘুঘুর বাসা ভেঙে রাজ্য সরকার গ্রামোন্নয়নের ভার তুলে দেয় হয় পঞ্চায়েতের মাধ্যমে গ্রামের মানুষের হাতে। নিয়মিত পঞ্চায়েত নির্বাচন করেছে। পঞ্চায়েত ব্যবস্থার নেতৃত্বে উঠে আসে দুর্বলতর অংশের মানুষের প্রতিনিধিরা। বামফ্রন্ট সরকারই পঞ্চায়েতে মহিলাদের জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে— প্রথমে ৩৩ শতাংশ, তারপর ৫০ শতাংশ। তফসিলি জাতি, উপজাতি এবং ওবিসি সম্প্রদায়ের জন্য জনসংখ্যার অনুপাতে পঞ্চায়েতে আসন ও পদ সংরক্ষণ করা হয়। একই ব্যবস্থা নেওয়া হয় পৌরসভাতেও। বামফ্রন্ট সরকারই দেশের মধ্যে প্রথম পশ্চিমবঙ্গে পৌর নির্বাচনে ১৮ বছর বয়স্কদের ভোটাধিকার প্রদান করে। চৌত্রিশ বছরে বামফ্রন্ট-বিরোধীদের মিলিত ভোট সব সময়ই প্রায় ৫০ শতাংশ থেকেছে। বহু পঞ্চায়েত ও পৌরসভা চৌত্রিশ বছরে কখনই বামফ্রন্টের হাতে আসেনি। কিন্তু তার জন্য বিরোধী পঞ্চায়েত প্রধান বা পৌর প্রধানের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়নি।
অর্থনৈতিক বিকাশ
বামফ্রন্ট সরকারের সামগ্রিক কর্মপরিকল্পনার অঙ্গ হিসাবেই কৃষি ও কৃষকের স্বার্থে ভূমিসংস্কারের বিষয়টিকে বিচার করতে হবে। সারা দেশের জমির মাত্র ৩% পশ্চিমবঙ্গে। অথচ গোটা দেশে ভূমি সংস্কারের মাধ্যমে যত জমি বণ্টিত হয়েছে তার ২২% পশ্চিমবঙ্গেই হয়েছিল। ভূমি সংস্কারের ফলেই রাজ্যে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকেরা ৮৪ শতাংশ কৃষি জমির মালিকে পরিণত হয়। জাতীয় স্তরে তা ৩৪ শতাংশের সামান্য বেশি। পাট্টা পেয়ে জমির মালিক হয়েছেন কৃষক পরিবারের মহিলারাও। পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ১৫লক্ষ ১৩ হাজার নথিভুক্ত বর্গাদারের আইনি অধিকার সুরক্ষিত করা হয়।
ভূমি সংস্কারের উপর ভিত্তি করেই কৃষিতে সাফল্য আসে। স্বাধীনতার পর থেকেই পশ্চিমবঙ্গ ছিল খাদ্যশস্য উৎপাদনে ঘাটতি রাজ্য। বামফ্রন্ট সরকারের আমলে খাদ্যশস্য উৎপাদনে উদ্বৃত্ত রাজ্যে পরিণত হয়।
পশ্চিমবঙ্গে দারিদ্রসীমার নিচে থাকা মানুষের সংখ্যা বামফ্রন্ট সরকারের আমলে ধারাবাহিকভাবে কমে। ২০১০-১১ সালে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে শিল্পপণ্যের বাজার ছিল প্রায় ২৭ হাজার কোটি টাকার।
শিক্ষা
বামফ্রন্ট সরকার রাজ্যে দায়িত্ব গ্রহণের পরই শিক্ষাক্ষেত্রে চরম নৈরাজ্য রদ করতে সুচিন্তিত পদক্ষেপ নেয়। প্রাথমিকস্তর থেকে উচ্চশিক্ষায় সুস্থ স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক পরিবেশ প্রতিষ্ঠা, শিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারিত করা এবং গুণমান বৃদ্ধি করা বামফ্রন্ট সরকারের উল্লেখযোগ্য সাফল্য। বামফ্রন্ট সরকারের সময়েই সাক্ষরতা আন্দোলন কার্যত গণআন্দোলনের রূপ নেয়। ১৯৯১ সালে ইউনেস্কোর বিখ্যাত ‘নোমা পুরস্কার’ পেয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকার, সাক্ষরতা কর্মসূচির সাফল্যে।বামফ্রন্ট সরকারই প্রথম সরকারি কাজকর্মে ও শিক্ষার ক্ষেত্রে সাঁওতালি ভাষার স্বীকৃতি দেয়। নেপালী ভাষার স্বীকৃতিও বামফ্রন্টের সময়েই। উচ্চশিক্ষায় সংখ্যালঘুদের আরও বেশি উৎসাহিত করতে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা করে বামফ্রন্ট সরকারই।
১৯৭৭ সালে রাজ্যে মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ২লক্ষেরও কম। ২০১১ সালে তা দাঁড়ায় সাড়ে ১০ লক্ষের মতো। ছাত্রীরা সংখ্যায় ছাত্রদের ছাপিয়ে যায়। গত তেরো বছরে মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী আনুপাতিক হারে বাড়েনি। শিক্ষকদের মর্যাদা ও সুরক্ষা দেয় বামফ্রন্ট সরকারই। সরকারি তহবিল থেকে বেতন, পেনশন ও পারিবারিক পেনশনের ব্যবস্থা ১৯৭৭ সালের আগে অলীক কল্পনা ছিল।
স্বাস্থ্যক্ষেত্রে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি
বামফ্রন্ট সরকার পঞ্চায়েত ও পৌরসভাগুলির মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে যুক্ত করে জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার উপর জোর দেয়। রাজ্যে ৭৩% মানুষ সরকারি হাসপাতালে আসতেন, যখন গোটা দেশে এই হার ছিল ৪০ শতাংশের মতো। গড় আয়ু, জন্মহার, মৃত্যুহার, প্রসূতি মৃত্যুর হার এবং শিশু মৃত্যুর হারে পশ্চিমবঙ্গ জাতীয় হারের চেয়ে অনেক এগিয়ে যায় বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে।
শিল্পায়নের উদ্যোগ
কৃষির সাফল্যের ভিতের উপর দাঁড়িয়েই রাজ্যের অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানের সুযোগ প্রসারিত করতে শিল্পায়নের উপর নজর দেয় বামফ্রন্ট সরকার। কেন্দ্রের বৈষম্যমূলক নীতির মুখে রাজ্য সরকার নিজের উদ্যোগেই কাজ শুরু করে।বেসরকারি পুঁজির সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে গড়ে তোলা হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালস ন’শোর বেশি অনুসারী শিল্পেই দু’লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থান হয়। সল্টলেকে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পেও কাজের সুযোগ বেড়েছিল নানা স্তরে।
ক্ষুদ্র শিল্পে সংখ্যার বিচারে ও কর্মসংস্থানের বিচারে বামফ্রন্টের সময়েই পশ্চিমবঙ্গ দেশের সেরার শিরোপা পায়। সপ্তম বামফ্রন্ট সরকারের সময়কালে রাজ্যে প্রায় ২৮ লক্ষ ক্ষুদ্র শিল্প ইউনিটে কর্মসংস্থান হয়েছিল প্রায় ৫৫ লক্ষ মানুষের। উপকৃত মানুষের সংখ্যা আরও কয়েকগুণ বেশি। ১৯৯১ থেকে ২০০৮-এর মধ্যবর্তী সময়ে শিল্প বিনিয়োগের পরিমাণের মানদণ্ডে আমাদের রাজ্য উঠে আসে দেশের মধ্যে তিন নম্বর স্থানে। ২০১০ সালে শিল্পে বিনিয়োগ হয় প্রায় ১৫ হাজার ৫২ কোটি টাকা। আন্তরিকতার সঙ্গে বামফ্রন্ট সরকার দাঁড়িয়েছে স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলির পাশে। পাশাপাশি ছিল ‘পশ্চিমবঙ্গ নাগরিক কর্মসংস্থান প্রকল্প’,‘উদীয়মান স্বনির্ভর কর্মসংস্থান প্রকল্প’,‘বাংলা কর্মসংস্থান প্রকল্প’-র মতন উদ্যোগগুলি।
শিল্পায়ন ও পরিকাঠামো উন্নয়ন থমকে যাওয়ায় রাজ্যে ২০১১ সালের পর একটিও নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি হয়নি। ১৯৭৭ সালে এরাজ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন হতো মাত্র ১৬১৫ মেগাওয়াট। ২০১১ সালের গোড়ায় তা দাঁড়ায়, ১১,৩০০ মেগাওয়াটে। প্রায় প্রতিটি পরিবারে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া হয়।
সামাজিক সুরক্ষা
বামফ্রন্ট সরকার সমাজের দুর্বলতর অংশের স্বার্থরক্ষায় সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প গ্রহণ করে অনেক আগে থেকে। বার্ধক্য ভাতা (শুরু ১৯৭৯ সাল), প্রতিবন্ধী ভাতা (শুরু ১৯৮০ সাল), আদিবাসী বার্ধক্যভাতা (একমাত্র পশ্চিমবঙ্গে), কৃষক ভাতা, বিধবা ভাতা শুরু করা হয় রাজ্য সরকারের নিজের উদ্যোগে। আগে এরকম প্রকল্প ছিল না বললেই চলে। ভূমিহীন কৃষক, রাজ্যের বন্ধ কলকারখানা ও বন্ধ চা বাগানের শ্রমিক, অন্যান্য অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের জন্য নানা ধরনের সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের পথিকৃৎ বামফ্রন্ট সরকারই। বামফ্রন্ট সরকার ২ কোটি ৬৪ লক্ষ গরিব মানুষকে ২টাকা কেজি দরে চাল দিত। শুধু বিপিএল নয়, এপিএল’র দরিদ্র মানুষেরও এই সুবিধা দেওয়া হয়েছে। বামফ্রন্ট সরকারই ‘ল্যাম্পস’-র কর্মচারীদের রাজ্য বেতন কমিশনের আওতায় এনেছিল। মহিলা সমৃদ্ধি যোজনা এবং আদিবাসী মহিলা স্বশক্তিকরণ যোজনা প্রকল্প রূপায়ণে পশ্চিমবঙ্গের স্থান ছিল দেশের মধ্যে প্রথম।
বামফ্রন্ট সরকারের আমলে গ্রামাঞ্চলে গরিবের জন্য বাড়ি তৈরিতে পশ্চিমবঙ্গ ছিল দেশে প্রথম তিনটি রাজ্যের মধ্যে এবং সংখ্যালঘু গরিব মানুষের জন্য বাড়ি তৈরির ক্ষেত্রে দ্বিতীয় স্থানে। শুধু গ্রাম নয়, শহরেও গরিব মানুষকে বসবাসের জমি দিতে একগুচ্ছ পদক্ষেপ নেওয়া হয়। যেমন, উদ্বাস্তুদের নিঃশর্ত জমি প্রদান; ঠিকা প্রজাস্বত্ব আইনের সংশোধন করা, কুড়ি বছরের বেশি সময়ের উপর সরকারি জমিতে বসবাসকারীদের মাত্র ১ টাকায় ৯৯ বছরের লিজ প্রদান ইত্যাদি।
সংখ্যালঘু উন্নয়ন
পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘু বিষয়ক দপ্তর প্রথম চালু হয় বামফ্রন্ট আমলে। মাদ্রাসা শিক্ষার আধুনিকীকরণ, মাদ্রাসা শিক্ষাকে মাধ্যমিক শিক্ষার সমতুল্য করার কৃতিত্ব বামফ্রন্ট সরকারের। বামফ্রন্ট সরকারই মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশন গঠন করে। মাদ্রাসাগুলিকে সংখ্যালঘু প্রতিষ্ঠান হিসাবে ঘোষণা করে। প্রতিষ্ঠা করে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়।
পশ্চিমবঙ্গ সংখ্যালঘু উন্নয়ন ও বিত্ত নিগমের প্রতিষ্ঠাও বামফ্রন্ট সরকারের আমলে। কর্মসূচি রূপায়ণে নিগম একদশকের উপর ধারাবাহিকভাবে দেশের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেছিল। ২০১১ সালের পর অবস্থা বেহাল।
বামফ্রন্ট সরকারই দেশে প্রথম রঙ্গনাথ মিশ্র কমিশনের সুপারিশ মেনে ‘অন্যান্য অনগ্রসর সম্প্রদায়’(ওবিসি)-র তালিকায় বিভিন্ন মুসলিম সম্প্রদায়কে অন্তর্ভুক্ত করে। মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য সরকারি চাকরিতে সংরক্ষণের সুবিধা সম্প্রসারণে তা ছিল এক ঐতিহাসিক এবং নজিরবিহীন পদক্ষেপ।
সুস্থায়ী উন্নয়ন
তবে শুধুমাত্র সহায়তা প্রকল্প মারফত কোনও সমাজ সুস্থায়ী উন্নয়নের পথে এগতে পারে না। তাই স্থায়ী কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানোর লক্ষ্য শিল্প প্রসারে জোর দেওয়া হয়। সেইসঙ্গে সরকারি দপ্তরগুলিতে এবং স্কুল কলেজ গ্রন্থাগার প্রভৃতি ক্ষেত্রে নিয়ম মেনে শূন্যপদ পূরণে দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। স্কুল সার্ভিস কমিশন, কলেজ সার্ভিস কমিশন, মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশন, মিউনিসিপ্যাল সার্ভিস কমিশন বামফ্রন্ট সরকারের তৈরি।
বামফ্রন্ট সরকার শুধু রাজ্য সরকারি কর্মচারী নয়, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী, পৌরসভা, পঞ্চায়েত, সমবায় প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের বেতন, পেনশন, পারিবারিক পেনশন, কেন্দ্রীয় হারে মহার্ঘভাতা দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছিল। এসবে বামফ্রন্ট সরকার কখনই কাটছাঁট করেনি।
সুস্থায়ী উন্নয়নের অন্যতম প্রধান শর্ত ধর্মনিরপেক্ষতা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও জাতিগত ঐক্য। এক্ষেত্রে দৃষ্টান্তমূলক ভূমিকা পালন করেছে বামফ্রন্ট সরকার। ১৯৮৪-র শিখবিরোধী দাঙ্গা এবং ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দমনে বামফ্রন্ট সরকারের ভূমিকা গোটা দেশে প্রভাব ফেলে।
‘চৌত্রিশ’ বছরের পর
বাম-বিরোধী রাজনীতির অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য বামফ্রন্ট সরকারের সমস্ত সাফল্য ও অগ্রগতিকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা। ‘চৌত্রিশ’ বছর সম্পর্কে কুৎসা শুধু ২০১১-র আগে নয়, ২০১১-র পরেও জারি রয়েছে লাগাতার। সেটা খুব অস্বাভাবিক নয়। কারণ নানা রঙের স্বৈরাচারী শক্তির সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী বামফ্রন্ট সরকারের অভিজ্ঞতাগুলি।
বামফ্রন্ট সরকারের সময়কার জনস্বার্থবাহী বিকল্প নীতি ও সেই নীতি রূপায়ণের অভিজ্ঞতার গুরুত্ব আজ আরও প্রাসঙ্গিক। নয়া উদারবাদ সঙ্কটমুক্ত নয়, বিকল্পহীনও নয়। রাজ্যে এবং সমগ্র দেশে বিকল্পের লড়াই মানুষ চান। সদ্য সমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনে দেশের সামগ্রিক ফলাফলে তার ইঙ্গিত আশাব্যঞ্জকভাবে স্পষ্ট।
পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকারের কর্মকাণ্ড আগামী দিনের বিকল্পের নীতি ও কর্মসূচি নির্মাণের লড়াইয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ।