ওয়েবডেস্কের পক্ষে মুখবন্ধ
আজকের ভারতে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার জগতে প্রতিদিন যে কায়দায় উগ্র-দক্ষিনপন্থী রাজনীতি নিজেদের হাত শক্ত করছে, ইতিহাসের চূড়ান্ত বিকৃতি সাধনের মাধ্যমে অতীত গৌরব পুনরুদ্ধারের নামে আসলে স্বাধীন ভারত নির্মাণের ভাবনাকেই ধ্বংস করে দিচ্ছে, রাজনৈতিক পরিসরে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির গুরুত্বকে আমাদের সেই প্রেক্ষিতে উপলব্ধি করতেই হবে। জে ভি স্তালিন শুধু রাশিয়ার নেতা ছিলেন না, এক অভুতপূর্ব ভূ-রাজনৈতিক সংকটের সময়েই তিনি হয়ে উঠেছিলেন গোটা দুনিয়ায় মুক্তিকামী জনসাধারণের নেতা। এমন অসাধারণ অর্জনের গভীরতায় কোন সার্বিক ভাবনা ছিল যার জোরে সোভিয়েত ইউনিয়ন একদিকে ফ্যাসিবাদের বর্বর সামরিক আক্রমণ প্রতিহত করেছিল, আরেকদিকে মুছে যাওয়ার মুখ থেকে বিজয় ছিনিয়ে এনে বিশ্বের দরবারে ‘সমাজতান্ত্রিক দেশ’ হিসাবে নিজে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল? এর উত্তর খুঁজতে শুধু রাজনীতি কিংবা বিচ্ছিন্ন করে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির আলোচনা করলে চলে না। মার্কসবাদী হিসাবে স্তালিনের শ্রেষ্ঠ কৃতিত্ব এই যে তিনি শুধুই পুঁজিবাদী দর্শনের বিরুদ্ধে মার্কসবাদ’কে প্রতিষ্ঠা করেননি, বাইরের সংগ্রামে বিজয়ের পাশাপাশি ভিতরের লড়াইতেও (মার্কসবাদী মহলের অভ্যন্তরীণ বিতর্ক) বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের মতাদর্শকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজে তিনি ছিলেন অজেয়। তাই স্তালিন, আর তাই স্তালিন ও তাঁর বিজ্ঞানভাবনা।
স্তালিন অ্যাজ সায়েন্টিস্ট শিরোনামে দ্য মর্ডান কোয়াটার্লি রিভিউ পত্রিকা (১৯৫৩ সাল, Vol. 8- No. 3) বিখ্যাত ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানী জে ডি বার্ণাল-র এই প্রবন্ধটি প্রকাশ করে। বর্তমান প্রবন্ধটি তারই ভাষান্তর। ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছিলেন আয়েষা আখতার, আমরা জরুরী কিছু সম্পাদনা করেছি, সম্পূর্ণ লেখাটি তিন পর্বে প্রকাশিত হল। বাংলা শিরোনাম ওয়েবডেস্কের নিজস্ব।
জে ডি বার্ণাল
জনসাধারণ এবং ব্যক্তি মানুষের সম্পর্কে এই সুগভীর অনুভূতিই ভালো এবং মন্দ সময়ে একইভাবে সুনিশ্চিত পদক্ষেপ নিতে স্তালিনকে সাহায্য করেছিল। এটাই ছিল তাঁর বিচারের ভিত্তি, যা তাঁকে অগ্রপশ্চাৎ বিচাররহিত ডকট্রিনেয়ার এবং মন্থরতমদের চেয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে অপারগ এমনসব সাবধানীদের (যারা জরুরী সময় নষ্ট করে ফেলে) মাঝে ভারসাম্য রেখে চলতে সমর্থ করেছিল। ১৯৩০-র ২রা মার্চ তারিখে প্রাভদায় লিখিত ‘সাফল্যে মাথা ঘুরে যাওয়া’ (Dizzy with success) শীর্ষক প্রবন্ধটি হল এর সর্বশ্রেষ্ঠ নিদর্শন। এ লেখায় তিনি জাতীয় উৎপাদনের কাজে নীতি হিসাবে যৌথকরণ (collectivisation)-র গতিকে ত্বরান্বিত করার দায়িত্বজ্ঞানহীন এবং আত্মঘাতী প্রচেষ্টাকে সঠিক সময়ে সামাল দিতে সক্ষম হন।
পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার শিল্পায়ন এবং যৌথ খামারের পত্তন-এই দুই মহৎ রূপান্তর স্তালিনের সবচেয়ে চিরস্থায়ী কীর্তিস্তম্ভ। যদিও এর জন্য অর্থনীতি ও কৃৎকৌশলের সুগভীর চর্চা এবং লক্ষ্য অর্জনে মহত্তম অবিচলতার প্রয়োজন ছিল, তা সত্ত্বেও সোভিয়েত ইউনিয়নের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সক্রিয় ইচ্ছার প্রতিফলনই ছিল একমাত্র কারণ যা একে সম্ভবপর করেছিল। অগভীর চিন্তাবিদের দল, ‘পশ্চিমী সভ্যতা’র রক্ষণশীল দার্শনিকরা স্তালিনের প্রতি এই বলে দোষারোপ করেছেন যে, তিনি ক্ষমতালিপ্সার দ্বারাই পরিচালিত। কিন্তু তাঁর চিন্তা এবং রচনা সম্পর্কে যাঁদের ন্যুনতম ধারণা রয়েছে, তাঁদের কাছে ঐসব চিন্তাবিদের মতামত নিছক অজ্ঞতার পরিচয়কেই তুলে ধরে। রাজনৈতিক ক্ষমতার আসল চরিত্রটি স্তালিন এতই ভালো বুঝতেন যে, একজন মানুষ বা একটা গোষ্ঠীর পক্ষে যে তা অর্জন করা বা ধরে রাখা সম্ভব বলে তিনি বিশ্বাস করতেন না। তিনি জানতেন যে, রাজনৈতিক জীবনের ঘটনাগুলি শুধুমাত্র সামাজিক শক্তিসমূহের দ্বন্দ্বের ফলাফল হিসেবেই প্রকাশিত হয়, লক্ষ কোটি মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা তাতে প্রতিফলিত আর একমাত্র অনুকূল বাস্তব পরিস্থিতি এবং সে সম্পর্কে সচেতনতাই জনসাধারণকে আন্দোলিত করতে পারে।
‘উৎপাদনের পরিকল্পনাকে শুধুমাত্র সংখ্যার এবং কাজকর্মের হিসাব ভাবাটা মুর্খামি। প্রকৃতপক্ষে উৎপাদন পরিকল্পনা লক্ষ কোটি মানুষের জীবন্ত এবং বাস্তব ক্রিয়াকর্মেরই মূর্ত প্রকাশ। নতুন জীবন সৃষ্টিতে নেমেছে এমন লক্ষ লক্ষ মানুষ আমাদের উৎপাদন পরিকল্পনাকে যথার্থ করে তোলে। প্রাণবন্ত মানুষ, আপনি এবং আমি, আমাদের কর্মস্পৃহা, নতুন পথে কাজ করার ক্ষেত্রে আমাদের প্রস্তুতি, পরিকল্পনা রূপায়ণে আমাদের সংকল্প, এসবই আমাদের পরিকল্পনাকে যথার্থ করে তোলে’।
লেনিনবাদ, পৃষ্ঠা-৩৮৭
সহযোগিতা আর আলোচনার প্রয়োজন কী স্তালিন তা উদাহরণ আর হুঁশিয়ারি দিয়ে বারে বারে দেখিয়েছেন। প্রশাসনিক আদেশ জারির আমলাতান্ত্রিক অভ্যাসের নিন্দাও করেছেন। অর্থহীন ‘ফুয়েরার তত্ত্ব’র ন্যায় অহমিকা যা হিটলারকে অধঃপতনে নিয়ে যায়, সেসবের প্রতি ঘৃণা ছাড়া স্তালিন আর কিছুই পোষণ করতেন না।
তাঁর শেষ লেখাতেও স্তালিন বলেছিলেন- সমাজপ্রগতির নিয়মগুলি নৈর্ব্যক্তিক (objective), তাদের তৈরি করা যায় না, সেগুলিকে আবিষ্কার করতে হয় এবং আবিষ্কারের সেই প্রক্রিয়ায় সবসময়ই নতুন এবং অপ্রত্যাশিত সত্যে পৌঁছনোর সম্ভাবনা থাকে। পুঁজিবাদ থেকে সমাজতন্ত্রে এবং সমাজতন্ত্র থেকে কমিউনিজমে রূপান্তরের পথে ভালো বা মন্দ অনেক বিস্ময়েরই জন্ম হয় বা হবে। স্তালিনের প্রতিভা এইখানে যে তিনি তাৎপর্যপূর্ণ নিত্যনতুন অভিব্যক্তিগুলি খুঁজে বার করতেন, তাদের লালন-পালন করতেন। তাঁর কাছে এগুলি খুবই স্বাভাবিক ছিল কারণ, ব্যক্তি মানুষের সাফল্যের প্রতি সচেতন উৎসাহ যোগানো, সেইসব লালন-পালনে এবং তা থেকে শিক্ষাগ্রহণ করতে তিনি সমর্থ ছিলেন।
এ বিষয়ে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত, স্টাখানভের সাফল্যে তাঁর তরফে দ্রুত স্বীকৃতি প্রদান এবং উপলব্ধি যে- এখানে বিষয়টা শুধু এই নয় যে একজন অন্যদের চেয়ে কঠোরভাবে এবং অধিকতর উৎসাহ নিয়ে কাজ করছে বরং ঘটনা হলো এই যে, শ্রমজীবিদের সারি থেকে থেকে একজন আধুনিক বৈজ্ঞানিক কৃৎকৌশল রপ্ত করেছে এবং তার বাস্তব অভিজ্ঞতার সাথে তাকে মেলাতে পেরেছে। স্তালিন তৎক্ষণাৎ বুঝতে পেরেছিলেন, এর ফলে জনগণের মেধার সেই রুদ্ধদ্বার ঐশ্বর্যভাণ্ডারটি ব্যবহারের পথটিই উন্মুক্ত হলো, যা পুঁজিবাদ কখনো স্পর্শ করেনি এবং এর ফলে তাৎক্ষনিক উৎপাদনের প্রচলিত নিয়মের বাধা দূর হলো। ইতিহাসে এই প্রথম, শ্রমিকেরা ইতিবাচক পথে বিজ্ঞানের রাজ্যে প্রবেশ করল। এবার বিজ্ঞানকেও তাদের জন্য পথ প্রশস্ত করে দিতে হবে। ‘লোকে বিজ্ঞানের কথা বলে। তারা বলে যে, বিজ্ঞানের তত্ত্বাবলী, কারিগরী পুস্তিকা বা নির্দেশাবলীতে যা লেখা রয়েছে, তার সঙ্গে স্টাখানোভাইটদের নতুন এবং উন্নততর প্রযুক্তিমানে পৌঁছনোর দাবি খাপ খায় না। কিন্তু কী ধরনের বিজ্ঞান নিয়ে তারা আলোচনা করছে? বিজ্ঞানের তত্ত্বগুলি সর্বদা প্রয়োগ ও অভিজ্ঞতার দ্বারা পরীক্ষিত হয়। যে বিজ্ঞান প্রয়োজন আর অভিজ্ঞতা থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে তা কেমন বিজ্ঞান? আমাদের রক্ষণশীল কমরেডরা যা বোঝাচ্ছেন, বিজ্ঞান যদি সতিই তেমনটা হতো তাহলে মানুষের জন্য বহুদিন আগেই তার মৃতবৎ কিছু একটায় পরিণত হত। বিজ্ঞান অলৌকিক বিশ্বাসকে মেনে নেয় না বলেই তাকে বিজ্ঞান বলা হয়, বাতিল এবং সেকেলে যা কিছু তার বিরুদ্ধে হাত ওঠাতে এর ভয় করে না। অভিজ্ঞতা এবং প্রয়োগের কণ্ঠস্বর কান পেতে শোনে বলেই এর নাম বিজ্ঞান’।
লেনিনবাদ, পৃষ্ঠা-৫৫৫
সমগ্র শ্রমিকশ্রেণি শুধুমাত্র জ্ঞানকে ব্যবহার না করে তার সৃষ্টিকে অবদান রাখলে যে বৈপ্লবিক ফলাফল দেখা দিতে পারে সে সম্পর্কে এটাই ছিল স্তালিনের উপলব্ধি। ১৯৩৬-র মে মাসে উচ্চশিক্ষায় প্রবিষ্ট শ্রমিকদের এক সমাবেশে বিজ্ঞানের স্বপক্ষে বলতে গিয়ে স্তালিন সেই নীতির কথা তুলে ধরেন, ‘বিজ্ঞান বিকশিত হোক! এমন বিজ্ঞান, যা জনগণ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে না, জনগণ থেকে দূরত্ব বজায় রাখে না বরং যা জনগণের সেবা করতে প্রস্তুত, তার সমগ্র কীর্তিকে জনগণের হাতে তুলে দিতে প্রস্তুত, সেই বিজ্ঞান যা চাপের মুখে নয়, স্বেচ্ছায়, স্বতঃপ্রবৃত্তভাবে জনগণের সেবা করে…….. বিজ্ঞান বিকশিত হোক এমন বিজ্ঞানে, যার উপাসকেরা বিজ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যগুলির শক্তি এবং তাৎপর্য উপলব্ধি করে এবং বিজ্ঞানের স্বার্থে সেগুলিকে নিপুণভাবে প্রয়োগ করে, আবার সেইসব ঐতিহ্যের ক্রীতদাস হতে অস্বীকারও করে; এমন বিজ্ঞান, পুরানো ঐতিহ্য, মানদণ্ড এবং পদ্ধতিগুলি অচল হয়ে পড়ে প্রগতির সামনে বাধাস্বরূপ হয়ে দাঁড়ালে তাদের ভেঙে ফেলবার সাহস ও সংকল্প যার রয়েছে এবং এমন বিজ্ঞান, যা নতুন ঐতিহ্য, নতুন মানদণ্ড, নতুন পদ্ধতি গড়ে তুলতেও একইরকম সমর্থ’।
‘বিজ্ঞান তার বিকাশের পথে বেশ কিছু সাহসী মানুষের সন্ধান পেয়েছে যাঁরা পুরানোকে ভেঙে গুঁড়িয়ে নতুনকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম তা সে যে বাধাই সামনে আসুক না কেন। বিজ্ঞানের এমন মানুষেরা হলেন গ্যালিলিও, ডারউইন এবং আরও অনেকে যাঁদের নাম খুবই পরিচিত। আমি বিজ্ঞানের এমনই একজন কোরিথিয়াসের কথা বলতে চাই, যিনি একই সাথে আধুনিক বিজ্ঞানের মহত্তম ব্যক্তিত্বও বটে। আমার মনে আসছে লেনিনের কথা, তিনি আমাদের শিক্ষক, আমাদের পথপ্রদর্শক……. কখনও কখনও এমনও হয় যে, বিজ্ঞান এবং কারিগরির ঐ নতুন ধারাকে যারা আলোকোজ্জ্বল করে তোলেন তাঁরা সুপরিচিত বিজ্ঞানী নন, কিন্তু বিজ্ঞানের জগতে সম্পূর্ণ অপরিচিত জনসাধারণ, সাধারণ মানুষ, বাস্তব কাজে নিয়োজিত মানুষ, অভিনব পদ্ধতির আবিষ্কারক। এখানে আমাদের সঙ্গে এক টেবিলে বসে রয়েছেন কমরেড স্টাখানভ এবং পাপানিন। এরা বিজ্ঞান জগতের কাছে অপরিচিত, প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রিহীন, যদিও কাজের ক্ষেত্রে এরা কান্ডজ্ঞানসম্পন্ন শ্রমিক। কিন্তু কে না জানে যে, স্টাখানভ এবং স্টাখানভাইটরা শিল্পক্ষেত্রে তাদের বাস্তব কাজের জগতে বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির জগতের সুপরিচিত ব্যক্তিদের তৈরি করা প্রচলিত মানদণ্ডগুলিকে বাতিল করে দিয়েছেন? প্রকৃতি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চাহিদার সাথে খাপ খায় এমন নতুন মানদণ্ডও এরাই হাজির করেছেন। কে না জানে যে পাপানিন এবং পাপানিনাইটেরা ভাসমান হিমশৈল নিয়ে হাতেকলমে কাজ করতে গিয়ে ঘটনাচক্রে, কোনো বিশেষ উদ্যোগ ছাড়াই আর্কটিক সম্পর্কে পুরানো ধ্যানধারণাকে বাতিল করে দিয়েছেন এবং প্রকৃতি বিজ্ঞানের চাহিদার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এক নতুন ধারণা প্রতিষ্ঠা করেছেন? কে অস্বীকার করতে পারে যে, স্টাখানভ এবং পাপানিন হলেন বিজ্ঞানে দুই অভিনব পন্থার আবিষ্কারক, আমাদের উন্নত বিজ্ঞানের দুই চরিত্র?’
ইন্টারন্যাশনাল বুক রিভিউ, সংখ্যা ১-২, মার্কস মেমোরিয়াল লাইব্রেরি থেকে ১৯৩৮ সালে প্রকাশিত
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে এই উন্নতি আরও স্পষ্ট রূপ ধারণ করে, শ্রমিক ও বিজ্ঞানীরা পরস্পরের পরিপূরক দুটি গোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ায়। এরা রাশানালাইজার, যারা নিরবচ্ছিন্নভাবে উৎপাদনের খুঁটিনাটি উন্নতি ঘটিয়ে চলেছে এবং অভিনব পন্থার আবিষ্কারক যারা উৎপাদনের চরিত্রে আমূল পরিবর্তনের সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে।
বৈজ্ঞানিক এবং কারিগরি অগ্রগতির যে অফুরন্ত ভাণ্ডার এতদিন সুষ্ঠু ছিল এবং সত্যি বলতে, আগের সব ব্যবস্থা যাদের সরাসরি দমিয়ে রেখেছিল, তার আবিষ্কার শেষপর্যন্ত সমাজতন্ত্রের সর্বোত্তম সুফল বলে প্রমাণিত হবে। স্তালিন ভালোভাবেই বুঝেছিলেন যে, পরবর্তী অধ্যায়ে, অর্থাৎ কমিউনিজমে উত্তরণের পথে এর কতটা প্রয়োজন। মানসিক এবং কায়িক শ্রমের মূলগত পার্থক্যগুলির বিলোপসাধনও তার মধ্যে অন্যতম এক কর্তব্য। ‘তৃতীয়ত, সমাজের এমন সাংস্কৃতিক অগ্রগতি প্রয়োজন যা সমাজের সব সদস্যের শারীরিক এবং মানসিক সক্ষমতার সার্বিক উন্নতি নিশ্চিত করবে যাতে সমাজের সব সদস্যকেই সমাজের প্রগতিতে সক্রিয় কর্মী হিসেবে নিজেদের গড়ে তোলার জন্য পর্যাপ্ত শিক্ষালাভ করতে পারে’।
সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্রের অর্থনৈতিক সমস্যাবলী, পৃষ্ঠা-৭৬
‘এর জন্য আবার দৈনিক কাজের সময়কে কমিয়ে ছয় এমনকি পাঁচ ঘন্টা করা দরকার। আরও প্রয়োজন সর্বজনীন বাধ্যতামূলক কারিগরি শিক্ষার প্রবর্তন, সমাজের সকলে যাতে স্বাধীনভাবে তাদের পেশা বেছে নিতে পারে এবং সারা জীবন ধরে তাঁদের কোনো একটা পেশায় আটকে থাকতে না হয়’।
সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্রের অর্থনৈতিক সমস্যাবলী, পূঃ ৭৭
একমাত্র সমাজতন্ত্রেই এমন বিকাশ সম্ভব। আবার এমন বিকাশই সমাজতন্ত্রের জয়কে দ্রুত এবং সুনিশ্চিত করে তোলে। সমগ্র জনসংখ্যার শিক্ষিত হয়ে ওঠা কোটি কোটি অ্যাটম বোমার সমান এক শক্তি। এক্ষেত্রে সেই শক্তি ধ্বংসাত্মক নয়, গঠনমূলক। ইতিমধ্যেই, দু বছরেরও আগে, সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রশিক্ষিত নরনারীর সংখ্যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বেশি ছিল এবং যতদিন পুঁজিবাদ থাকবে এবং উচ্চশিক্ষা একটি শ্রেণির প্রাধান্যবিস্তারকে সুনিশ্চিত করার কাজে ব্যবহৃত হবে, ততদিন এই পার্থক্য আরও বাড়তে বাধ্য। এদেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির কর্তৃপক্ষ যে ছাত্র সংখ্যার একটা নির্দিষ্ট পরিমাণকে (যারা ঐ বয়সী জনসংখ্যার মাত্র ৩.২৫ শতাংশের প্রতিনিধি) নির্বোধ আত্মতুষ্টির সাথে মেনে নিয়েছে তা দেশের অর্থনীতির পক্ষে বা সঠিকভাবে বলতে গেলে গোটা দেশের জনজীবনেই বিপর্যয় ডেকে আনবে। স্তালিন যে নতুন শক্তিকে দেখতে পান এবং যাকে বিশেষ করে লালন-পালন করেন তা একমাত্র প্রকৃত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই পাওয়া সম্ভব। কারিগরি বিদ্যায় ব্যাপক প্রগতির প্রভাবে সাবেকী বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের রূপান্তর এবং শ্রমজীবী জনগণের মাধ্যমে তা কীভাবে নতুন সোভিয়েত বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের বিস্তৃত রূপে পরিণতি পাচ্ছে সেদিকে তিনি তীক্ষ্ণ নজর রেখেছিলেন। ইউ এস এস আর-র খসড়া সংবিধান প্রসঙ্গে বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের সোভিয়েত বুদ্ধিজীবীরা হলো এক সম্পূর্ণ নতুন ধরনের বুদ্ধিজীবী, যাদের নিজেদের শিকড় বাঁধা পড়ে গেছে শ্রমিকশ্রেণি এবং কৃষকদের সাথে…….আগে তাদের সম্পদশালী শ্রেণিগুলির সেবা করতে হতো, কারণ তাদের সামনে অন্য কোনো বিকল্প ছিল না। আজ তারা নিশ্চিতভাবে জনসাধারণের জন্য কাজ করবে কারণ এখানে আর কোনো শোষক শ্রেণি নেই। নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে, এই কারণেই তারা সোভিয়েত সমাজের সুষম সদস্য, যে সমাজে শ্রমিক এবং কৃষকদের পাশাপাশি, তাদের সাথে মিলিতভাবে তারা নতুন এক শ্রেণিহীন, সমাজতান্ত্রিক সমাজ গড়ে তোলার কাজে নিযুক্ত’।
লেনিনবাদ, পৃষ্ঠা-৫৬৬, ৫৬৭
একটা উন্নয়নশীল সমাজে বস্তুগত এবং মানবিক উপাদানগুলির মধ্যেকার সক্রিয় সামঞ্জস্য বজায় রাখার থেকেই স্তালিনের প্রকৃত মহত্ত্বের সর্বোচ্চ উপলব্ধি সম্ভব। আধুনিক শিল্পের উৎপাদন পদ্ধতি, কাঁচামালের প্রয়োজনীয়তা, নতুন প্রযুক্তির প্রয়োজনীয়তা এবং বিমানের প্রয়োগ সম্পর্কে তাঁর চেয়ে বেশি হয়ত কেউ জানত না। এসব বিষয়ে তাঁর চেয়ে ব্যাপকভাবে আর কেউ বুঝতও না। কিন্তু এর জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতায় মোহাবিষ্ট হয়ে তিনি কখনো যন্ত্রের ওপর বা টেকনোক্র্যাসিতে অমানুষিক আস্থা স্থাপন করেননি। প্রকৃতপক্ষে, অর্থনীতি প্রসঙ্গে আলোচনা থেকে দেখা যায় যে, যারা সেভাবে ভাবত, তাদেরই বরং তিনি তিক্ততম ব্যঙ্গে বিদ্ধ করতেন। তিনি সবসময়ই মানুষকে সবার উপরে স্থান দিতেন, ‘মানুষ উৎপাদনের জন্য উৎপাদন করে না, করে নিজেদের প্রয়োজন মেটানোর জন্য। যে উৎপাদন সমাজের প্রয়োজন থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে, তা শুকিয়ে মরে যায়’।
সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্রের অর্থনৈতিক সমস্যাবলী, পৃষ্ঠা-৮৪
নরনারীর জন্য স্তালিনের উদ্বেগ আরও একবার প্রতিফলিত হয় অত্যাচারিত জনগণ এবং জাতিগোষ্ঠীগুলির অগ্রগতির জন্য তাঁর ভাবনার মধ্য দিয়ে। নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি জানতেন যে তারা পশ্চাৎপদ তো নয়ই, বরং তথাকথিত অগ্রবর্তী সভ্যতার তুলনায় আপেক্ষিক অর্থে অনেক বেশি সম্ভাবনাময়। গোটা পৃথিবীতে জনগোষ্ঠী সমস্যার প্রশ্নে স্তালিনের সমাধানই সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলেছে। তিনি দেখিয়েছেন যে, সকল জনজাতি, এমনকি সবচেয়ে আদিম জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক, প্রযুক্তিগত এবং অর্থনৈতিক জীবনকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নীত করেও কীভাবে তাদের প্রত্যেকের জাতিগত সংস্কৃতির মূলসত্তাকে অক্ষুণ্ণ রাখা যায়। একদিকে তাঁর সেই পদ্ধতির সাফল্য এবং উল্টোদিকে ‘পয়েন্ট ফোর প্রজেক্ট’ কিংবা ‘কলম্বো প্ল্যান’-এর শোচনীয় ব্যর্থতা- এই বৈপরীত্য থেকে কোনো দেশের স্বনির্ভরতার জন্য পুঁজিবাদী শোষণব্যবস্থাকে আবশ্যিক অপসারণের মার্কসবাদী শর্তই সুপ্রমাণিত হয়। এটা এমনই এক শিক্ষা যা শুধুমাত্র সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের দেশগুলিই শেখেনি, এশিয়ার বহু দেশও ইতিমধ্যেই তা শিখতে শুরু করেছে এবং ভবিষ্যতে সময় এলে, সকলেই তা শিখবে। এই ক্ষেত্রেও স্তালিন সমাজবিজ্ঞানে তাঁর সবচেয়ে প্রত্যক্ষ অবদানটি রেখেছেন। ভাষাবিজ্ঞানে মার্কসবাদ প্রসঙ্গে (Concerning Marxism in Linguistics) নামে তাঁর নিবন্ধটি শিরোনামায় উল্লেখিত বিষয়বস্তুর তুলনায় অনেক বেশি ব্যাপক। এটি হল সমগ্র সমাজ-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্র, বিশেষত, এতে উল্লেখিত আদর্শগত উপরিকাঠামো, যা একটি নির্দিষ্ট সময়ে সীমাবদ্ধ এবং একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির হয়ে কাজ করে এবং ভাষা, বস্তুগত উৎপাদনের যন্ত্র যা পুরানো এবং নতুন শ্রেণিবিন্যাসের সাহায্যে কাজ করে, তা যেভাবেই তাদের সৃষ্টি হোক না কেন-এই দুইয়ের পার্থক্য সম্পর্কে মার্কসবাদী বিশ্লেষণের সম্প্রসারণ। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য হয়। যেভাবে তার উন্নতি ঘটানো হচ্ছিল তার বিরুদ্ধে স্তালিনের সতর্কবাণী মার্কসবাদকে যান্ত্রিকভাবে, নির্বোধভাবে বা খুঁটিয়ে না দেখে প্রয়োগের বিরুদ্ধে এক অমূল্য সংশোধনী।
তিনি লিখেছিলেন, ‘সাধারণত মেনে নেওয়া হয়, মতের যুদ্ধ ছাড়া, সমালোচনার অধিকার দ্বারা কোনো বিজ্ঞানই গড়ে ওঠে না বা বিকশিত হয় না। কিন্তু এই সাধারণভাবে স্বীকৃত নিয়মকে চরম অসম্মানজনকভাবে উপেক্ষা আর লঙ্ঘন করা হয়েছিল। ভুল করতে পারে না এমন ঘনিষ্ঠ একদল নেতার উদয় হয়েছিল, যারা যে কোনো সম্ভাব্য সমালোচনা থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে নিজেরাই এক নিয়মে হয়ে দাঁড়িয়েছিল এবং যা খুশি তাই করছিল’।
ভাষাবিজ্ঞানে মার্কসবাদ প্রসঙ্গে, সোভিয়েত নিউজ, লন্ডন, পৃষ্ঠা-২২
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের মতো এ বিষয়েও স্তালিনের হস্তক্ষেপ বাস্তব জ্ঞানের কষ্টিপাথরে যাচাইকৃত। ভ্রান্ত উৎসাহ এবং মার্কসবাদের বিকৃতি শুধরে দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে তাঁর সদাসতর্কতারই পরিচায়ক এমন হস্তক্ষেপ। মার্কসবাদী ধ্যানধারণার সম্পূর্ণতম এবং মুক্ত বিকাশ সবসময়ই তাঁর লক্ষ্য ছিল। কিন্তু তিনি দেখেছিলেন যে, তাদের প্রয়োগের জন্য নিরবচ্ছিন্ন সচেতনতা দরকার যাতে কোনও সময়েই গোঁড়ামিতে (dogmatism) অধঃপতিত না হতে হয়। স্তালিনের কীর্তি সোভিয়েত ইউনিয়নকে গড়ে তোলা এবং তাকে রক্ষা করার চেয়েও বৃহত্তর। এমনকি যে শান্তি ও প্রগতির আশা তিনি সারা বিশ্বে জাগিয়েছিলেন, তার চাইতেও বেশি। তাঁর চিন্তা এবং দৃষ্টান্ত আজ লক্ষ কোটি নরনারী ও শিশুর জীবন এবং চিন্তায় মূর্ত; আর তা আজ মহান মানব ঐতিহ্যের অবিভাজ্য অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগামী কয়েক বছরে এর পরিবর্তন হবে না তা সে যত বড় পরিবর্তনই আসুক না কেন, যে পরিবর্তনের জন্য তিনি কাজ করেছেন যাকে তিনি স্বাগত জানাতেন। মার্কসের চিন্তা কোনো শেষ বিশ্রামস্থল খুঁজে পায়নি, পেতে পারেও না। স্তালিন তার সাথে এমন দ্যুতি ও আবেগ যুক্ত করেছেন, যা অবিস্মরণীয়। পরিবর্তন সম্পর্কিত প্রথম চিন্তাবিদ গ্রিক দার্শনিক হেরোক্লিটাসের কথা থেকে তিনি বিভিন্ন উদ্ধৃতি দিতেন। তার বাচনভঙ্গী অনুসরণ করেই বলা যায়- ‘একের মধ্যে সমগ্র এই পৃথিবী কোনো ঈশ্বর বা মানুষের দ্বারা তৈরি হয়নি। এক জীবন্ত শিখা হয়ে এ ছিল, আছে এবং চিরকাল থাকবে’।