In the endangered Himalayas -Parthapratim Biswas

৩০ জুলাই ২০২৩ (রবিবার)

গত কয়েক দশকে নগরায়নের যে গতি পৃথিবীর পাশাপাশি দেশের মানুষ দেখছে তাতে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষম ধাক্কায় জন জীবন বিপর্যস্ত হওয়ার আশংকা উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে। এমন আশংকা সমতলের মেগা কিংবা মেট্রো সিটির গণ্ডি ছাড়িয়ে থাবা বসাচ্ছে পাহাড়ের জনপদ গুলিকে। ফলে জলবায়ুর নেতিবাচক পরিবর্তনকে প্রতিহত করার পরিকল্পিত প্রয়াসের পরিবর্তে হিমাচল প্রদেশ থেকে অরুনাচল প্রদেশ পর্যন্ত ব্যাঙের ছাতার মতো বেড়ে চলেছে নগরায়নের গতি । আর সেই বেগতিক নগরায়নের বলি হচ্ছে হিমালয়ের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে গজিয়ে ওঠা জনপদের মানুষ ।


গত বছর সংবাদ শিরোনামে এসেছিলো উত্তরাখণ্ডের জোশীমঠএর ভূমিধ্বসের ঘটনা । ভূমিধ্বস কেবল জোশীমঠের ব্যতিক্রমী ঘটনা নয় কার্যত গোটা হিমালয় অঞ্চল জুড়েই বাড়ছে এমন প্রবণতা। হড়পা বানের ধাক্কায় ভয়াবহ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পাহাড়ি উপত্যকার বিস্তীর্ণ জনপদ । হিমালয় অঞ্চলের ভুবৈশিস্ত অনুযায়ী এই পাহাড়ের শিলাস্তরের বয়স তুলনামুলক ভাবে কম এবং ভূপৃষ্ঠের গভীরে থাকা সেই শিলাস্তরগুলির স্থায়িত্ব এখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি । এবং ফলে প্রতিনিয়ত সেই শিলাস্তরের সরণ এবং সংঘাত লেগে থাকার কারনে হিমালয়ের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের ভূপৃষ্ঠের স্থায়িত্ব ততোটা পোক্ত নয়। ফলে এমন পাহাড়ের ঢাল কিংবা উপত্যকা জুড়ে থাকা বিস্তীর্ণ অঞ্চল অবস্থিত জোন -৪ থেকে জোন -৫ এর মতো অতি উচ্চ থেকে উচ্চ মানের ভুমিকম্প প্রবন এলাকায় । এই প্রেক্ষিতে হিমালয়ের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে পর্যটন কেন্দ্রিক অর্থনীতির দাপটে নগরায়নের বাড়তি গতি , বাড়তি নির্মাণ সেই অংশের বাস্তুতন্ত্রের বিপদ বাড়িয়ে তুলেছে ।


পর্যটন কেন্দ্রিক অর্থনীতি নির্ভর দুটি রাজ্য উত্তরাখণ্ড এবং হিমাচলপ্রদেশ নগরায়নের ধাক্কায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দুই অঙ্গরাজ্য। হিমাচল প্রদেশের মোট ভৌগোলিক এলাকা ৫৫৬৭৩ বর্গ কিলোমিটারের মধ্যে ৪৪৬১ বর্গ কিলোমিটার অতি উচ্চমাত্রার ভুকম্পন প্রবন এবং ৩৮২৪৯ বর্গ কিলোমিটার এলাকা পড়ে উচ্চ ভুমিকম্প প্রবন এলাকার মধ্যে । হিমাচল প্রদেশ জুড়ে মোট নির্মাণ ক্ষেত্রের পরিমাণ ৮৬৬ বর্গ কিলোমিটার । সেই রাজ্যের ১৬২৮ কিলোমিটারের জাতীয় এবং ৯৯৩ কিলোমিটার রাজ্য সড়ক তৈরি হয়েছে ভূমিধ্বস এবং ভুমিকম্পের নিরিখে স্পর্শকাতর এলাকার ওপর দিয়েই। প্রায় ৮০০০০ গাছ কেটে হয়েছে এই সড়ক নির্মাণ প্রকল্প গুলি। ফলে এই তথ্যগুলি থেকে এটা স্পষ্ট যে কেবল বেসরকারি উদ্যোগে লুকিয়ে চুরিয়ে পাহাড়ের বুকে নির্মাণ হচ্ছে না বরং নগরায়নের এমন অপরিকল্পিত নির্মাণ যজ্ঞ চলছে সরকারি উদ্যোগেই। এই সমস্ত পাহাড়ি রাজ্যে পর্যটনের পাশাপাশি বিকল্প রাজস্বের উৎস হয়ে উঠছে জলবিদ্যুৎ শিল্প।

এবিষয়ে কোন সন্দেহ থাকা উচিৎ নয় তাপবিদ্যুৎ কিংবা পরমানু বিদ্যুতের তুলনায় জলবিদ্যুৎ হল পরিবেশবান্ধভ বিদ্যুৎ উৎপাদনের অন্যতম বিকল্প । যেটি উৎপাদন খরচের তুলনায় অনেকটাই কম এবং এদেশের প্রেক্ষিতে গরীবের ঘরে বাতি জ্বালানোর দীর্ঘমেয়াদী শক্তির আধার । সেই নিরিখে অরুনাচল থেকে হিমাচল প্রদেশ কিংবা উত্তরাখণ্ড হয়ে উঠেছে এদেশের বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্র । এমন রাজ্যগুলিতে একদিকে জলবিদ্যুৎ তৈরি করে পুরন হয় যেমন বিকল্প বিদ্যুতের জাতীয় চাহিদা নিরসনের অঙ্ক আর অন্যদিকে ঐ বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাধ্যমে খোলে রাজ্যে রাজস্ব সংগ্রহের বিকল্প পথ । আর এভাবেই অর্থনীতির চক্রব্যূহে এসে পড়ে সেই রাজ্যের উন্নয়নের আর্থিক সমীকরনের বিষয়টি ।


সারাবছর ‘ মুফতে’ পাওয়া হিমবাহ গলা জলের মতো প্রাকৃতিক সম্পদকে বাঁধ দিয়ে আটকে ফেলতে পারলেই সেটা হয়ে উঠছে বিদ্যুৎ তৈরির ক্ষেত্রে কাঁচামালের মতই । প্রকল্পের প্রাথমিক নির্মাণের খরচ বাদ দিলে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের পরিচালন ব্যায় ন্যুনতম । ফলে , মাইক্রো থেকে মেগা বিনিয়োগকারীদের পাখির চোখ হয়ে উঠেছে এই জলবিদ্যুৎ শিল্প । তাই নদীর স্বাভাবিক গতিপথ আটকে ঝুরি ঝুরি বাঁধ তৈরি হচ্ছে জলবিদ্যুতের ‘ কাঁচামাল’ জল ধরে রাখতে । আর এমন অসংখ্য জলাধারে জমে থাকা বাড়তি জলের চাপ সেই বাঁধ সংলগ্ন বিস্তীর্ণ এলাকার শিলাস্তরের ভারসাম্যের বিপদ ডেকে আনছে । পাশাপাশি যত্রতত্র বাঁধের কারনে একদিকে যখন নদীর স্বাভাবিক গতি ক্ষীণ হয়ে নদীবক্ষের নুড়ি পাথরকে শুকিয়ে তুলছে তখন তারও প্রভাব পড়ছে স্থানীয় উস্নায়নে । উত্তরাখণ্ডে প্রস্তাবিত বহু নদী বাঁধের অবস্থান অনেক উচ্চতায় , যেটাকে ‘ গ্লেসিয়াল’ বা ‘ সাব-গ্লেসিয়াল ‘ অঞ্চল বলা হয় । ফলে এমন অঞ্চল হিমবাহের খুব কাছে বলেই হিমবাহ গলে জলোচ্ছ্বাসের বিপদ এবং ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা সেখানে বহুগুনে বেশি । ফলে ভবিষ্যৎ বিপর্যয় মোকাবিলার স্বার্থে ‘ coastal regulatory zone ‘ এর মতো ‘ glacial regulatory zone’ তৈরি করে তার মধ্যে যাবতীয় নির্মাণ নিষিদ্ধ করা উচিত । এর পাশাপাশি হিমাচলের ১১৮ টা ১০০-১৫০০ মেগাওয়াটের জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের ৬৭ টা প্রকল্প ভূমিধ্বস এবং ভূমিকম্প প্রবন এলাকায় গড়ার ছাড়পত্র কিভাবে জুটল তাঁর জবাব সরকারকেই দিতে হবে।
পর্যটন কেন্দ্রিক অর্থনীতিতে হিমালয়ের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে হু হু করে বেড়েছে তীর্থযাত্রীদের আনাগোনা , বেড়ে চলেছে স্থায়ী জনঘনত্ব । আর তার সাথে তাল দিয়ে বেড়ে চলেছে নির্মাণের বহর । বেড়েছে নরম পাহাড়ের বুক চিরে উপড়ে ফেলা গাছের ওপর দিয়ে মাল্টি লেন হাইওয়ে , বেড়েছে সেই রাস্তা জুড়ে চলা ভারি গাড়ির বহর । বাড়ছে পর্যটন অর্থনীতির মেরুদণ্ড হিসাবে দোতলা তিনতলা থেকে বহুতল । আর এই সমস্ত নির্মাণ কাজ চলেছে রম রমিয়ে ভূমিধ্বস বিধ্বস্ত পাহাড়ের আলগা মাটির ওপরেই। যে মাটি হাল্কা ভুমিকম্পের কাঁপুনিতে আলগা হয়ে হারিয়ে ফেলতে পারে তার ভারবহন ক্ষমতা যে ক্ষমতা পাহাড়ের জমাট বাঁধা স্বাভাবিক মাটির তুলনায় অনেকটাই কম। ফলে সেই এলাকায় নির্মাণ অতি বিপজ্জনক । ফলে প্রয়োজন সেখানে বিকল্প নির্মাণ পদ্ধতি এবং সামগ্রীর ব্যবহারের ওপর।

পাহাড়ে নির্মাণের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত পাহাড়ের ঢালের স্থায়িত্ব । সেই ঢালের স্থায়িত্ব নির্ভর করে পাহাড়ের পাথর- মাটির শক্তির ওপর এবং তার ভারবাহন ক্ষমতার ওপর । আবার সেই ভার বহন ক্ষমতার সাথে জুড়ে থাকে পাহাড় জুড়ে গাছপালার উপস্থিতি। কারন পাহাড়ে গাছের শেকড় সেই অঞ্চলে ভূমিধ্বস রোধে বিশেষ কার্যকরী এবং আলগা মাটিকে বেঁধে রাখতেও উপযোগী ( geo-reinforcement) বলে প্রমানিত । ফলে সড়ক – সেতু – হোটেল – বাড়ি যে কোনো নির্মাণের কারনেই যখন সবুজ পাহাড় নেড়া হয় তখন সেই আলগা মাটি – নরম পাথরের পাহাড়ে অনিশ্চিত হয় সেই নির্মাণের স্থায়িত্ব এবং অস্তিত্ব । তখন বিপর্যয় নেমে আসাটা কেবল সময়ের অপেক্ষা । পাহাড়ি অঞ্চলে গভীর নির্মাণের প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ে মাটির নিচে জলপ্রবাহের গতিপথের ওপরও । বাড়তি নির্মাণের চাপে জল্প্রবাহের পথ ক্রমাগত অবরুদ্ধ হতে থাকলে জলের বাড়তি চাপে সেই অঞ্চলের মাটির ভারবাহন ক্ষমতা কমতে থাকে । ক্রমাগত নির্মাণের চাপে ভুস্তরের জলপ্রবাহ বিঘ্নিত হলে অতি বৃষ্টিতে সেই অঞ্চল জুড়ে ভূমিধ্বসের বিপদ বেড়ে ওঠে। পাহাড়ের প্রাকৃতিক ঢালের কারনে বৃষ্টির জল দ্রুত ঢাল বেয়ে উপত্যকার দিকে ধেয়ে চলে । এই প্রেক্ষিতে পাহাড়ের ঢালে বাড়তি নির্মাণের চাপ সেই অঞ্চলের নিকাশি ব্যবস্থার স্বাভাবিক পথ অবরুদ্ধ করায় বাড়ে পাহাড়ে বন্যার সম্ভাবনা স্বাভাবিক বৃষ্টিতেই আর অল্প সময়ে অতি বৃষ্টি আরও ভয়ানক ! ফলে নগরায়নের ধাক্কায় পাহাড় জুড়ে নিকাশি , বজ্র পরিশোধন বিপর্যস্ত হতে বসেছে । এই প্রেক্ষিতে পাহাড়ে নগরায়ন পাহাড় বাসীর জীবনের , পাহাড়ের বাস্তুতন্ত্রের বিপদ বাড়াচ্ছে প্রতিনিয়ত। ফলে পাহাড়ের মানুষের জীবন জীবিকার স্বার্থেই প্রয়োজন নিয়ন্ত্রিত নগরায়ন ভাবনা।

Spread the word

Leave a Reply