অর্কপ্রভ সেনগুপ্ত
উনিশ শতকের কোনও এক তপ্ত অপরাহ্ন। ভারতে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের হৃৎপিণ্ড, কলকাতা শহরে হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে ধুলোমাখা পথে হেঁটে চলছে এক বালক। আরও অনেকের মতোই, সে এসেছে কলকাতা ভাগ্য পরীক্ষার জন্যই। মাথা গোঁজার ঠাই হয়েছে এক আত্মীয়ের বাড়িতে। বালক জাতিতে ব্রাহ্মণ, সংস্কৃতে পন্ডিত বলে তার পরিবারের খ্যাতি আছে। কিন্তু সংস্কৃত শিখলে তো আর চাকরি হবে না। তার অনেক দায়িত্ব, অনেক কাজ। অভাবের সংসারের ভার কাঁধে নিতে হবে, মুছিয়ে দিতে হবে দুঃখী মায়ের চোখের জল। সংস্কৃত শিখলে তা হবে কিভাবে ? শিখতে হবে তাদের ভাষা, যাদের মানদন্ড আজ রাজদন্ডে পরিণত হয়েছে। সেই ইংরেজি শিখে একটা চাকরি জোগাড় করার আশাতেই এই চোদ্দ-পনেরো বছরের ছেলে বনমালিপুরের গ্রাম ছেড়ে এসেছে কলকাতায়। দারিদ্র্য আর ক্ষুধা নিত্যসঙ্গী – তবুও প্রবল জেদ কমার বিন্দুমাত্র লক্ষণ নেই। এমন মনের সঙ্গে শরীর কি আর সবদিন পাল্লা দিতে পারে ? সেইদিনও পারেনি। ঐ প্রখর রোদে অন্যমনস্ক হয়ে, খিদের জ্বালায় পথ চলতে চলতে ঠনঠনিয়ার কাছে ঐ বালকের শরীর জবাব দিয়ে দিল। এক পা চলারও আর ক্ষমতা রইল না। কত লোক রাজপথে দিয়ে চলছে, খিদেয় তেষ্টায় কাতর ঐ বালককে দেখে কেউ কোনও ভ্রুক্ষেপও করল না। এগিয়ে এল শুধু একজন। দোকানে বসে মুড়ি-মুড়কি বিক্রেতা এক মহিলা। মধ্যবয়স্কা ঐ বিধবাই বসিয়ে জল দিলেন, দই কিনে এনে ফলার করালেন মুড়কি দিয়ে। ফলারের শেষে যখন বালক আবার পথ ধরল, ততক্ষণে ঐ অপরিচিত বিধবা তাঁর থেকে জোর করে প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিয়েছেন, খাবারের সমস্যা যখনই থাকবে, তখনই যেন সে এসে তাঁর কাছে ফলার করে যায়। বালকের নাম, ঠাকুরদাস বন্দোপাধ্যায়।
ঠাকুরদাস তাঁর জীবনের এই ঘটনা ভুলে যাননি। ভুলে যাননি এই কৃতজ্ঞতার ঋণ। ঋণ পরিশোধের ভার তিনি অর্পণ করেছিলেন তাঁর সুযোগ্য পুত্রকে। পিতার কাছ থেকে এই কাহিনী শুনে ঠাকুরদাসের পুত্র তাঁর ‘আত্মচরিত’-এ যত্ন সহকারে তা লিপিবদ্ধ করেন। কাহিনী শেষে তিনি মন্তব্য করেছিলেন – ‘পিতৃদেবের মুখে এই হৃদয়বিদারণ উপখ্যান শুনিয়া, আমার অন্তঃকরণের যেমন দুঃসহ দুঃখানল প্রজ্জ্বলিত হইয়াছিল স্ত্রীজাতির উপর তেমনি প্রগাঢ় ভক্তি জন্মিয়াছিল। এই দোকানের মালিক, পুরুষ হইলে ঠাকুরদাসের উপর, কখনই, এরূপ দয়াপ্রকাশ ও বাৎসল্যপ্রদর্শন করিতেন না’। এই পুত্র, বলাই বাহুল্য, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।
‘নবজাগরণ’-এর স্টিম ইঞ্জিন তখন দ্রুত ছুটতে শুরু করেছে বাংলায়। পশ্চিমের খোলা দ্বার দিয়ে যুক্তিবাদ ও মানবতাবাদের যে নতুন ঝোড়ো হাওয়া বইতে শুরু করেছে, তাকে ঠেকানোর সাধ্য বাংলার রক্ষণশীল সমাজের ছিল না। অচলায়তনে প্রথম আঘাত হেনেছিলেন রাজা রামমোহন রায়। তাঁর উদ্যোগে যে আন্দোলন গড়ে ওঠে, তারই ফলশ্রুতি ছিল ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে বাংলার সতীদাহ প্রথা রোধ। রক্ষণশীল হিন্দু-সমাজ বিনা যুদ্ধে সূচাগ্র মেদিনীও ছাড়তে রাজি ছিল না। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে ‘হিন্দুশাস্ত্রবিহিত ধর্মকর্ম’ বজায় রাখার জন্য স্থাপিত হল ‘ধর্মসভা’। তাঁরা ঘড়ির কাঁটাকে পেছনের দিকে ঘোরানোর প্রচেষ্টা করতে লাগলেন আপ্রাণ। জয়গোপাল তর্কালঙ্কার, নিমাইচাঁদ শিরোমণির মতো সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপকরা ‘ধর্মসভা’-র পক্ষ থেকে প্রিভি কাউন্সিলে সতীদাহ প্রথা আবার চালু করা হোক, এই মর্মে আবেদনপত্র অবধি পাঠিয়ে বসলেন। প্রতিটি ক্রিয়ারই সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া থাকে। “ধর্মসভা” যেমন ঘড়ির কাঁটা উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দিতে প্রয়াসী হল, উল্টোদিকে আবির্ভাব হল এমন একটি গোষ্ঠী যাঁরা চাইলেন যত দ্রুত সম্ভব বাংলার হিন্দু সমাজকে বাল্যবিবাহ ও কৌলীন্যপ্রথা মুক্ত করতে, চাইলেন বিধবাবিবাহ ও স্ত্রী শিক্ষা চালু করতে। এঁরা ছিলেন ডিরোজিও-এর অনুগামী, ‘ইয়ং বেঙ্গল’ গোষ্ঠী। তাঁদের উদ্দেশ্য নিঃসন্দেহে সাধু ছিল, কিন্তু যে কঠিন কাজ তাঁরা করার প্রচেষ্টা করছিলেন, তা সফল করার আর যে মতাদর্শিক লড়াই-এ তাঁরা নেমেছিলেন, তা সঠিক ভাবে লড়ার মতো দীর্ঘমেয়াদী ধৈর্য তাঁদের ছিল না। তাই পত্রপত্রিকার বাদানুবাদে পাল্লা তাঁদের দিকেই ভারি থাকলেও, রাজা রামমোহনের মৃত্যুর প্রায় দুই দশক পরেও দেখা গেল বাংলার সমাজসংস্কার সম্পর্কে লেখালেখি হয়েছে অনেক, কিন্তু কাজের কাজ হয়নি কিছুই।
ছাত্রজীবনে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে ‘ডিরোজিয়ান’-দের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। তাঁদের প্রতিষ্ঠিত ‘সাধারণ জ্ঞানোপার্জিকা সভা’-র তিনি সদস্য ছিলেন এবং সেই সূত্র প্যারীচাঁদ মিত্র, শিবচন্দ্র দেব, কৃষ্ণমোহন বন্দোপাধ্যায়, রামতনু লাহিড়ী, গোবিন্দচন্দ্র বসাক প্রমুখের সঙ্গে তাঁর পরিচিতি গড়ে ওঠে। শুধু এই সংগঠনই নয়, ‘তত্ত্ববোধিনী সভা’, ‘সর্বশুভকরী সভা’ এবং ‘বেথুন সোসাইটি’-এর সঙ্গেও ঈশ্বরচন্দ্র যুক্ত ছিলেন। অর্থাৎ মতাদর্শের সংগ্রামে তাঁর অবস্থান কি, তা নিয়ে তাঁর দ্বিধার জায়গা কখনই তেমন ছিল না। বাল্যবিবাহ এবং বহুবিবাহ যে রদ করা উচিৎ, স্ত্রী শিক্ষার যে প্রসার ঘটানো উচিৎ এবং বিধবাবিবাহ সমাজে চালু করা উচিৎ – এই সকল অবস্থান ছাত্র অবস্থা থেকেই ছিল তাঁর সুদৃঢ়। তাঁর কিছু দ্বিধা ছিল পিতা-মাতাকে। বিদ্যাসাগর জানতেন, এই নিয়ে যে কাগজের বাক্য বিনিময়ের বাইরে বাস্তবের মাটিতে এই কাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে যে এক পা-ও অগ্রসর হবে, তার বিরুদ্ধে হেন কোন অস্ত্র নেই, যা হিন্দু সমাজের রক্ষণশীল অংশ প্রয়োগ করবে না। অজ্ঞেয়বাদী ঈশ্বরচন্দ্রের কাছে বাবা মা-ই ঈশ্বর ছিলেন। তাঁর পদক্ষেপের জন্য তাঁদের বিন্দুমাত্র কোনও অসুবিধা ভোগ করতে হবে, সামাজিক অসম্মান সহ্য করতে হবে, এমন ভাবনা ছিল তাঁর কল্পনার বাইরে। এই কারণে বাল্যবিবাহ প্রথার বিরুদ্ধে অনেক আগেই কলম ধরলেও, দীর্ঘকাল বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহের স্বপক্ষে কিছুই লেখেননি।
বাড়ির চন্ডিমন্ডপে বসে এক সন্ধ্যেবেলা বিদ্যাসাগর পিতা ঠাকুরদাসের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করছিলেন, এমন সময় ভগবতী দেবীর আবির্ভাব ঘটে। তিনি ছেলের কাছে সরাসরি জানতে চান – ‘তুই এতদিন যে শাস্ত্র পড়লি, তাতে বিধবাদের কোন উপায় আছে ?’ বিদ্যাসাগর উত্তর দেন শাস্ত্রমতে বিধবা নারীর সামনে দুটি পথ খোলা – হয় ব্রহ্মচর্য, নয় সহমরণ। ঠাকুরদাস একথা শুনে বলেন – ‘রাজা রামমোহন রায়, কালীনারায়ণ চৌধুরী ও দ্বারকানাথ ঠাকুর, প্রভৃতির যোগারে ও পরামর্শে গভর্নর জেনারেল লর্ড বেন্টিঙ্ক সহমরণ প্রথা নিবারণ করেছেন। আর কলিতে ব্রহ্মচর্য সম্ভব নয়। সুতরাং বিধবাদের পক্ষে বিবাহ-ই একমাত্র উপায়।‘ বিদ্যাসাগর উত্তর দেন, তাঁর নিজেরও তাই ধারণা, এমনকি তিনি এও মনে করেন, যে শাস্ত্র খুঁজলে এই ধারণার স্বপক্ষে স্বীকৃতিও পাওয়া যাবে, তবে তার সঙ্গে এও যোগ করেন – ‘কিন্তু এ বিষয়ে পুস্তক করলে অনেকেই নানা প্রকার কুৎসা ও কটু বাক্য করবে। তাতে আপনারা পাছে দুঃখ পান, সেজন্য নিবৃত্ত আছি’। এই কথা শুনে ঠাকুরদাস ও ভগবতী দেবী দুজনেই বিদ্যাসাগরকে আশ্বাস দেন, তাঁরা সকল কুৎসা ও সমাজের কটু বাক্য সহ্য করতে রাজি আছেন, বিদ্যাসাগর নির্ভয়ে এই কাজে হাত দিতে পারেন। উক্ত ঘটনা শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্নের রচনায় পাওয়া যায়। কোনও কোনও ঐতিহাসিক এই ঘটনার সত্যতা সম্পর্কে সন্দিহান। সামান্য কিছু বদল ছাড়া একই ঘটনা বিদ্যাসাগরের অন্যান্য জীবনীতেও পাওয়া যায়। তাই এই ঘটনা সম্ভবতঃ সত্যিই। ঠাকুরদাস অন্ততঃ বিদ্যাসাগরকে যে উৎসাহ প্রদান করেছিলেন বারেবারে আর এই নিয়ে লেগে থাকতে বলেছিলেন, তার প্রমাণ অন্যত্রও পাওয়া যায়। আর ভগবতী দেবীর প্রত্যক্ষ সম্মতি ব্যতীত এমন কাজে বিদ্যাসাগরের মতো মাতৃভক্ত মানুষ হাত দেবেন, এরকম হওয়ার সম্ভবনা অতি ক্ষীণ।
যাই হোক, এরপর থেকেই আমরা লক্ষ্য করব বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহের পক্ষে শাস্ত্রীয় সম্মতি খুঁজে বের করতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। এইখানেই তাঁর পথ ‘ইয়ং বেঙ্গল’-এর পথের থেকে আলাদা হয়ে গেল। বিদ্যাসাগর শাস্ত্রে বিধবা বিবাহের পক্ষে সমর্থন নিজের বিবেকের জন্য খুঁজছিলেন না। শাস্ত্র ‘হ্যাঁ’ বলুক বা ‘না’ বলুক, বিধবা বিবাহ যে হওয়া উচিৎ, একথা তিনি অনেক আগে থেকেই সঠিক বলে মনে করে এসেছেন। অধ্যাপক পবিত্র সরকারের এই বিষয়ে পর্যবেক্ষণ যথাযথ। তিনি বলেছেন – ‘…সেই সময়ে, সেই যুগে বিদ্যাসাগরের শাস্ত্র সন্ধান হিন্দু সমাজপতিদের মুখ বন্ধ করার জন্য, নিজের বিশ্বাসের সমর্থনের জন্য নয়।‘ শেষ অবধি তিনি বিধবা বিবাহের সমর্থনে যে পরাশর স্মৃতি ব্যবহার করবেন, তাতেই এমন অনেক কথা লেখা আছে, বিদ্যাসাগর যা সম্পর্কে একেবারেই নিশ্চুপ থেকেছেন। যেমন ৪/২৪-এ রয়েছে ‘কোনো ঋতুস্নাতা নারী যদি পতিসংসর্গ না করে তাহলে সে নরকে যায় এবং পরবর্তী জন্মেও বার বার বিধবা হয়।‘ এইপ্রকার শ্লোক সম্পর্কে বিদ্যাসাগর একেবারেই নিরব। যে সকল ব্রাহ্মণ কুলপতিরা বিদ্যাসাগরের বিরুদ্ধে এই নিয়ে তর্কে অবতীর্ণ হয়েছিলেন, তাঁরা এই বেছে বেছে শ্লোক গ্রহণ করার বিষয়টি ঠিকই তুলে ধরেছিলেন। আসলে বিদ্যাসাগর প্রকাশ্যেই বলেছিলেন, তিনি ‘দেশাচারের দাস’ নন। শাস্ত্র বিষয়ে তাঁর আলাদা করে কোনও মোহ নেই। কিন্তু তিনি জানতেন, সাধারণ মানুষের আছে। সমাজের আলোচনার যে একটি স্বীকৃত মতের ‘Overton Window’ থাকে, এবং ধৈর্য সহকারে জনমতের এই ‘Window’-টিকে কাঙ্খিত লক্ষ্যে সরাতে হয়, একথা তাঁর বিলক্ষণ জানা ছিল। তাই ‘ইয়ং বেঙ্গল’-এর মতো ছিপে তিনি হেঁচকা টান দেননি, বহু শতাব্দীর পঙ্কিল দিঘি থেকে বাংলার সমাজকে টেনে তোলার বাধা রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের যে কাঁটা তাকে নির্মূল করতে চেয়েছেন কাঁটা দিয়েই।
এই কাঁটা তোলার কাঁটাই হলো পরাশর সংহিতার সেই বিখ্যাত শ্লোক –
‘নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে ক্লীবে চ পতিতে পতৌ।
পঞ্চস্বাপৎসু নারীণাং পতিরন্যো বিধীয়তে।।’
বিদ্যাসাগর এই ব্যাখ্যা করলেন এইরকম – ‘পতি যদি নষ্ট, মৃত, সন্ন্যাসী, ক্লীব বা পতিত হয় তবে স্ত্রী অন্য পতি গ্রহণ করতে পারেন।‘ এই ব্যাখ্যার জোরেই শেষ অবধি বিধবা বিবাহ স্বীকৃত হলেও, আদতে কিন্তু ভারতের অধিকাংশ পন্ডিত কর্তৃক স্বীকৃত ব্যাখ্যা এ ছিল না। তাই স্বাভাবিক ভাবেই, ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে ‘বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’ প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আলোড়ন পড়ে গেল। বিদ্যাসাগরের পূর্বে উনিশ শতকের তিরিশের দশকের শেষ ভাগ থেকে সমগ্র চল্লিশের দশক ধরে বিধবা বিবাহ সম্পর্কে বিতর্ক চলছিল। কাগজের যুক্তি আর পাল্টা যুক্তির মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ ছিল। যাঁরা বিধবা বিবাহ প্রচলনের পক্ষে ছিলেন, তাঁরা অধিকাংশই ক্রমশঃ বুঝতে পারছিলেন, শাস্ত্রীয় অনুমোদন খুঁজে না পেলে সমাজে এই প্রথা প্রচলন করা কঠিন হবে। ‘সম্বাদ ভাস্কর’-এর সম্পাদক গৌরীশংকর তো সরাসরই আবেদন জানান – ‘প্রাচীন হিন্দু মহাশয়েরা এই সময় শাস্ত্রীয় প্রমাণানুসারে নিয়মবদ্ধ করিয়া যদি বিধবাদিগের বিবাহ প্রচলিত করেন তবে তাঁহারদিগের বংশাবলীকে উত্তরকালীন আপদ হইতে মুক্ত রাখিয়া যাইবেন।‘ শান্তিপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ঈশ্বরচন্দ্র ঘোষাল পন্ডিতদের একটি সভার আয়োজন করেন বিধবাবিবাহ প্রচলন করার শাস্ত্রীয় অনুমোদনের সন্ধানে। কিন্তু কাজের কাজ এতে কিছুই হয়নি। অচলায়তন যেমন, তেমনই ছিল। বিদ্যাসাগরের বই এতে যেন হাতুড়ির আঘাত করল। তিনি পাশে পেলেন যেমন বহু মানুষকে, তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়ালও এক বিশাল শক্তি। বিদ্যাসাগরের বই সেই আমলে ১৫ হাজার কপি বিক্রি হয়েছিল। এই জনপ্রিয় বইয়ের যুক্তিজাল খন্ডন করে একের পর এক পুস্তিকা লেখা হতে থাকল। বিদ্যাসাগরের যুক্তি যাঁরা খন্ডন করলেন, তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন নবদ্বীপের ভট্টপল্লীনিবাসী পঞ্চানন তর্করত্ন। প্রথমতঃ, তিনি শ্লোকের অনুবাদই ভিন্ন প্রকার করেন। তাঁর অনুবাদটি ছিল – ‘যে পাত্রের সহিত বিবাহের কথাবার্তা স্থির হইয়া আছে, তাহার সহিত কন্যার বিবাহ দিতে হইবে; তবে এই ভাবী পতি যদি নিরুদ্দেশ হয়, মরিয়া যায়, প্রব্রজ্যা অবলম্বন করে, ক্লীব বলিয়া স্থির হয় বা পতিত হয়, তবে পঞ্চপ্রকার আপদে, ঐ কন্যা পাত্রান্তর প্রদান বিহিত।’ তিনি বলেন এই অনুবাদই দেশের অধিকাংশ পন্ডিতের মতে সঠিক অনুবাদ। বিদ্যাসাগর কৃত অনুবাদকে মান্যতা প্রদান করেন, এমন পন্ডিতের সংখ্যা হাতে গোনা। দ্বিতীয়তঃ, তিনি যুক্তি দিলেন, যদি ঐ অনুবাদকে সঠিক বলেও ধরা হয়, পরাশর সংহিতাতেই অন্যত্র রয়েছে কলি-প্রারম্ভের পর ‘পরিণীতা নারীর পত্যন্তর’ নিষিদ্ধ। এই যুগ নিঃসন্দেহে কলিকাল। অতএব ঈশ্বরচন্দ্রের যুক্তি পরাশর সংহিতা অনুসারেও অনুমোদিত নয়। ভট্টপল্লীর ব্রাহ্মণরা ব্যবস্থাপক সভায় বিধবা বিবাহ প্রচলনের বিপক্ষে যে আবেদনপত্র প্রেরণ করেছিল, তাতে তো স্পষ্ট অভিযোগ রয়েছে, বিদ্যাসাগর আদতে শাস্ত্রের অপব্যাখ্যা করে ‘নব্যসম্প্রদায়ের কতিপয় যুবক’-কে নাচিয়ে এই বিষয়টি খুঁচিয়ে তুলেছেন। ব্রাহ্মণ পন্ডিতদের মধ্যে এই নিয়ে কোনও দ্বি-মতই নেই যে বিধবা বিবাহ শাস্ত্র স্বীকৃত নয়। বিদ্যাসাগরের অবশ্য শাস্ত্রে কি বলে তা দিয়ে কিছুই যায় আসত না। ‘অসহনীয় শাস্ত্র বিধান ও লোকাচার প্রতিপালন’-এর বোঝাকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার জন্য, যত দুর্বলই হোক, শাস্ত্র থেকে উঠে আসা একটা পাল্টা যুক্তি তাঁর প্রয়োজন ছিল। সেই ‘Polemic’-এর হাতিয়ার হিসেবে তিনি পরাশর সংহিতার ঐ শ্লোককে জনমত তৈরিতে এতো নিপুণ ভাবে ব্যবহার ও প্রতিবাদী মতগুলিকে ‘বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক দ্বিতীয় সম্বাদ’ নামক পুস্তকে এমন দক্ষতার সঙ্গে খন্ডন করেন, যে তাঁকে হত্যা করার জন্য কলকাতাস্থিত এক বিত্তবান প্রভাবশালী ভাড়াটে গুন্ডা অবধি নিয়োগ করে। এই কাজে অবশ্য সেই বিত্তশালী বিফল হয়েছিলেন, কিন্তু কি বিপদ মাথায় নিয়ে প্রাণের মায়া তুচ্ছ করে বিদ্যাসাগর এই কাজে অগ্রসর হয়েছিলেন, এই ঘটনা থেকেই বোঝা যায়।
বিদ্যাসাগরের বই প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই দেখা গেল বঙ্গসমাজ স্পষ্ট দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। সংখ্যাগুরু অংশ বিদ্যাসাগরের প্রস্তাবের ঘোরতর বিরোধী। কলকাতার রাধাকান্ত দেবের ধর্মসভা, যশোহরের হিন্দুধর্ম সংরক্ষণী সভা ইত্যাদি সংস্থা বিদ্যাসাগরের ভয়ংকর বিরোধিতা করে। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা, সংবাদ ভাস্কর-এর মতো কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশ সংবাদপত্রই বিদ্যাসাগরের বিপক্ষে দাঁড়ায়। রুচিহীন কাদা ছোঁড়া হয় তাঁকে উদ্দেশ্য করে। কিন্তু বিদ্যাসাগর স্বভাবসিদ্ধ ভাবেই এসবে বিন্দুমাত্র বিচলিত হলেন না। ১৮৫৫ সালের অক্টোবর মাসে তিনি ৯৮৭ জনের স্বাক্ষর সম্বলিত একটি আবেদনপত্র লন্ডনে ভারতের ব্যবস্থাপক সভার বিবেচনার জন্য প্রেরণ করলেন। স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে ছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিচারপতি দ্বারকানাথ মিত্র, অক্ষয়কুমার দত্ত, প্যারীচরণ সরকার, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। এর বিপক্ষে রাধাকান্ত দেব আরেকটি পাল্টা আবেদনপত্র প্রেরণ করেন। এতে স্বাক্ষর ছিল ৩৬,৭৬৩ জনের। এই আবেদনপত্র ছাড়াও বিধবা বিবাহের বিপক্ষে ত্রিবেণী, ভাটপাড়া, নদীয়া, বাঁশবেড়িয়ার মতো অঞ্চল থেকে বেশ কিছু আবেদনপত্র প্রেরিত হয় যার মিলিত স্বাক্ষর ছিল প্রায় ৫০ থেকে ৬০ হাজারের মতো।
বিধবা বিবাহ সংক্রান্ত বিতর্ক যদি আজকের দিনের নির্বাচন হত, নিঃসন্দেহে বিদ্যাসাগরের জমানত জব্দ হত। তিনি গো-হারা হারতেন। কিন্তু ব্যবস্থাপক সভাতে স্বাক্ষরের সংখ্যার থেকেও অধিক গুরুত্ব দেওয়া হল আবেদনে থাকা যুক্তিকে। আদতে বিদ্যাসাগর শাস্ত্রের যুক্তির আড়ালে ছিল তাঁর অখন্ড মনুষ্যত্বের যুক্তি। এই যুক্তি ছিল বিধবা নারীর ভয়াবহ জীবন যন্ত্রণাকে লাঘব করার স্বপক্ষে এবং স্বামীর মৃত্যুতে দুঃস্থ, দুর্বিষহ, পরনির্ভর জীবনযাত্রার বিধানের বিপক্ষে প্রদত্ত সাধারণ মানবিকতার প্রতি আপীল। শুষ্ক শাস্ত্রের যুক্তির মারপ্যাঁচের বিপরীতে এই আপীলই জয়যুক্ত হয়েছিল ব্যবস্থাপক সভার বিবেচনায়। এর ভিত্তিতেই ১৮৫৬ সালের ১৬-ই জুলাই ভারতে বিধবা বিবাহ আইন সিদ্ধ হল। সমাজের যারা গোষ্ঠীপতি, যারা বিত্তবান – যারা বিদ্যাসাগরকে প্রতিহত করতে কোনও উপায়ই বাদ দেননি, তাঁরা ‘দেশ রসাতলে গেল’, বলে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বাংলার শ্রমজীবী মানুষ কিন্তু সমর্থন করল তাদের ঈশ্বরকেই। শান্তিপুরে বিদ্যাসাগরপেড়ে নামের কাপড় বোনা হল। তার পাড়ে লেখা হল বিখ্যাত এই লাইন কটি –
“সুখে থাকুক বিদ্যাসাগর চিরজীবী হয়ে।
সদরে করেছে রিপোর্ট বিধবাদের হবে বিয়ে।।
কবে হবে শুভদিন, প্রকাশিবে এ আইন,
দেশে দেশে জেলায় জেলায় বেরবে হুকুম,
বিধবা রমণীর বিয়ের লেগে যাবে ধুম;
মনের সুখে থাকব মোরা মনোমত পতি লয়ে।।
এমন দিন কবে হবে, বৈধব্য-যন্ত্রণা যাবে,
আভরণ পরিব সবে, লোকে দেখবে তাই –
আলোচাল কাচকলা মালসার মুখে দিয়ে ছাই, –
এয়ো হয়ে যাব সবে বরণডালা মাথায় লয়ে।।”
‘ছোটলোক’-দের এই প্রশংসার প্রত্যুত্তর ‘ভদ্রলোক’-রা দিয়েছিলেন এইভাবে –
‘মরে থাকুক বিদ্যাসাগর চিররুগী হয়ে।
সদরে করেছে রিপোর্ট বিধবার হবে বিয়ে।।’
ঈশ্বরচন্দ্র অবশ্য যথারীতি তাঁকে নিয়ে এই নিন্দা-প্রশংসার টানাপোড়েনে বিশেষ মাথা ঘামাননি। তিনি কর্মকেই প্রধান মনে করতেন, সেই দিকেই মনযোগ দিয়েছিলেন। তিনি বিধবা বিবাহ প্রচলন করাকে তাঁর জীবনের ‘সর্বপ্রধান সৎকর্ম’ বলে চিহ্নিত করেছিলেন। শুধু আইন হয়েই যাতে তা না থাকে, তার তিনি আপ্রাণ প্রচেষ্টা করেন। এই আইন অনুসারে প্রথম বিধবা বিবাহ অনুষ্ঠিত হয় শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন ও কালীমতী দেবীর মধ্যে। বিদ্যাসাগর স্বয়ং এই বিবাহের মূল দায়িত্ব হাতে নেন এবং এর পেছনে সেই সময়ে প্রায় দশ হাজার টাকা ব্যয় করে। শুধু এই বিবাহই নয়, ১৮৬৭ সালের মধ্যে ৬০-টি বিধবা বিবাহের জন্য বিদ্যাসাগর মোট ব্যয় করেছিলেন প্রায় বিরাশি হাজার টাকা। উনিশ শতকের ষাটের দশকে বিধবা বিবাহ নিয়ে প্রাথমিক ভাবে যে উৎসাহ দেখা দিয়েছিল, তা ছিল অত্যন্ত ইতিবাচক। মনে হয়েছিল, সমাজ ক্রমশঃ এমন বিবাহ মেনে নিচ্ছে। বাস্তব তা ছিল না। প্রাথমিক আইনি পরাজয়ে কিছু পিছু হটলেও অচিরেই সমাজপতিরা প্রত্যাঘাত শুরু করলেন। হিন্দু রক্ষণশীলতার এক নতুন জোয়ার দেখা দিল ষাটের দশকের শেষ ভাগ থেকে। সনাতন ধর্মের পবিত্রতা রক্ষার্থে বিধবা বিবাহের বিপক্ষে প্রবল প্রচার শুরু হল। বিধবা বিবাহ দেওয়ার জন্য বরিশালের দুর্গামোহন দাসকে তাঁর মক্কেলরা বয়কট করলেন। রাস্তায় বেরোলেই তাঁকে নিয়ে ছড়া কাটা আর গায়ে ধুলো দেওয়া হয়ে দাঁড়াল নিত্যদিনের বিষয়। এমনকি প্রথম যিনি বিধবাবিবাহ করেছিলেন, সেই শ্রীশচন্দ্র স্ত্রী কালীমতীর মৃত্যুর পর পন্ডিতদের দিয়ে আনুষ্ঠানিক ক্রিয়াকর্ম করে আবার জাতে ফেরেন। এইসব দেখে বিরক্ত বিদ্যাসাগর দুর্গাচরণ বন্দোপাধ্যায়কে আক্ষেপ করে লিখেছিলেন – ‘আমাদের দেশের লোক এত অসার ও অপদার্থ বলিয়া পূর্বে জানিলে আমি কখনই বিধবা বিবাহ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করিতাম না’।
এ ছিল নিছক কথার কথা। দেশের লোক কেমন, তা বিদ্যাসাগর এই বিষয়ে হাত দেওয়ার আগেও ভালোই জানতেন। জানতেন বলেই নিজের পরোয়া না করলেও পাছে পিতা-মাতার অপমান হয়, পাছে তাঁদের সমাজের গঞ্জনা সহ্য করতে হয়, এই ভীতি থেকে বিধবা বিবাহ প্রসঙ্গে দীর্ঘকাল এগোননি। তারপর হাত যখন দিলেন, সমাজপতি ও বিত্তবান এবং তাঁদের অধীনে থাকা সংখ্যাগুরু লোকের কোনও পরোয়া না করেই এগিয়েছিলেন। একথা ঠিক, আইনি বিজয়ই শুধু তিনি লাভ করেছিলেন, সামাজিক স্বীকৃতি নয়। বিধবা বিবাহ যে সমাজে স্বীকৃতি পায়নি, তার সবথেকে বড়ো প্রমাণ হল ১৮৫৬ থেকে ১৯১১ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি লক্ষ লক্ষ বিধবার মধ্যে বিধবা বিবাহ হয়েছে কম বেশি মাত্র পাঁচশো। কিন্তু সংখ্যা বিদ্যাসাগরের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। তাহলে তিনি বিধবা বিবাহের বিপক্ষে সব আবেদন মিলিয়ে প্রায় লক্ষের কাছে সইয়ের বিরুদ্ধে মাত্র ৯৮৭ সই সম্বলিত বিধবা বিবাহের স্বপক্ষে রচিত আবেদনপত্র লন্ডনের ব্যবস্থাপক সভাতে প্রেরণ করার সাহস দেখাতেন না। রুশ বিপ্লবের ঠিক পরে, যখন এমন মনে হয়েছিল শিশু সোভিয়েত রাষ্ট্রের আয়ু সীমিত, লেনিন মন্তব্য করেছিলেন – আমরা যদি বিফলও হই, যে প্রক্রিয়া শুরু হল তা থামবে না। এবার কোন সময়ে, কোন দেশের শ্রমজীবী জনতা একে তার অন্তিম পরিণতি দেবেন, সে আলাদা বিষয়। আসল কথা হল, আমরা বরফের চাঙড়টা ভেঙে দিয়েছি, রাস্তা এখন উন্মুক্ত। বিদ্যাসাগরও অনায়াসে একই কথা বলতে পারতেন বিধবা বিবাহের সামাজিক প্রসারের ব্যর্থতার প্রেক্ষিতে। এইদিক দিয়ে বিফল হলেও, বিধবা বিবাহের আইনি স্বীকৃতি আদায়ের মাধ্যমে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা বরফের জগদ্দল চাঙড়টা তিনি ভেঙে গুঁড়ো করে দিতে পেরেছিলেন। ভবিষ্যতে সেই পথে হেঁটে বিধবা বিবাহের সামাজিক স্বীকৃতির পথ হয়ে গিয়েছিল উন্মুক্ত, যে স্বীকৃতি আজ বাস্তবেও এসেছে।
মার্কস ‘লুই বোনাপার্টের অষ্টাদশ ব্রুমেয়ার’-এ মন্তব্য করেছিলেন, মানুষ ইতিহাস গড়ে, কিন্তু সে তা ইচ্ছেমত গড়ার সুযোগ পায় না। তাঁর এই পর্যবেক্ষণে কোনও ভুল নেই। অতীত থেকে চলে আসা ঐতিহ্যের যে বেতালের মতো গলিত শব আমাদের কাঁধে বসে আছে, তাকে অগ্রাহ্য করে সত্যিই ইতিহাস গড়ার কাজ কঠিন। কিন্তু পরিস্থিতির দ্বারা সীমাবদ্ধ হয়েও, সমাজের সংখ্যাগুরুর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েও যা সঠিক ও যা সহজ, তাঁর মধ্যে সঠিককে বেছে নেওয়াই একজন মানুষের বৈপ্লবিক চেতনার পরিচায়ক। এই দিক দিয়ে বিদ্যাসাগর ছিলেন মহাবিপ্লবী। তিনি রবীন্দ্রনাথের ভাষাতেই, ‘বঙ্গদেশে একক ছিলেন’। চক্রব্যূহে বেষ্টিত অভিমন্যুর মতো তিনি তাঁর লড়াই একাহাতেই লড়েছেন। রমেশচন্দ্র দত্ত তাঁর এই লড়াইয়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন – ‘একদিকে স্বার্থপরতা, জড়তা, মূর্খতা ও ভণ্ডামি, – অন্যদিকে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। একদিকে বিধবাদিগের উপর সমাজের অত্যাচার,পুরুষের হৃদয়-শূন্যতা, নির্জ্জীব জাতির নিশ্চলতা, – অন্যদিকে বিদ্যাসাগর। একদিকে শত শত বৎসরের কুসংস্কার ও কুরীতির বল, উপধর্ম্মের উৎপীড়ন, অপ্রকৃত হিন্দুধর্ম্মের গন্ডমূর্খ ও স্বার্থপর ভট্টাচার্য্যদিগের মত, অন্যদিকে বিদ্যাসাগর। একদিকে নির্জ্জীব, নিশ্চল, তেজোহীন বঙ্গসমাজ, – অন্যদিকে বিদ্যাসাগর।
গত ১৬-ই জুলাই বিধবা বিবাহ আইন প্রচলনের ১৬৭ বছর পূর্ণ হল। আমরাও এমন এক বঙ্গসমাজে দাঁড়িয়ে যা স্বার্থপরতা, জড়তা, মুর্খামি ও ভন্ডামিতে পরিপূর্ণ। বিদ্যাসাগর আজও প্রাসঙ্গিক। তিনি এই অন্ধকার দরিয়ায় ডাঙার সন্ধানে থাকা বঙ্গবাসীর কাছে বাতিঘরের প্রজ্জ্বলিত অগ্নি। তাঁর থেকেই আমরা সাহস পাই, যা সত্য ও যা সহজ, তার মধ্যে সত্য়কে বেছে নেওয়ার। তাঁর দৃঢ়তাই আমাদের প্রেরণা যোগায় এক লক্ষের বিরুদ্ধে ৯৮৭-এর একজন হয়ে দাঁড়াতে।