গৌতম রায়
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন বিরোধীদলের নেত্রী ছিলেন, তখন কতগুলি লব্জ ছিল তার একদম স্বভাবজাত। কোনো ঘটনা ঘটলেই তিনি রাজ্য পুলিশের উপর বিন্দুমাত্র আস্থা জ্ঞাপন না করে, সরাসরি সিবিআই তদন্তের দাবি করতেন। আর দ্বিতীয়টি হল, যে কোনো ধরনের নির্বাচন, মানে পাড়ার ক্লাব নির্বাচন যদি হয় ,সে ক্ষেত্রেও তিনি দাবি করতেন, কেন্দ্রীয় বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে নির্বাচন করতে হবে।
বিরোধী নেত্রী মমতা যখন শাসকে পরিণত হলেন, তখন এত আশ্চর্যজনক ভাবে তার এই বিরোধী থাকাকালীন রাজনৈতিক চরিত্রের অদল বদল ঘটলো যে একজন নিরপেক্ষ, চোখ কান খোলা মানুষের কাছে, এই সন্দেহটাই তীব্র হলো যে, ওই মমতাই কি এই মমতা ?
পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পালাবদল হওয়ার পর আজ পর্যন্ত কোনো একটি নির্বাচন নিরপেক্ষভাবে হয়নি। অনেকের হয়তো মনে হতে পারে, ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে ,রাজ্যের শাসক তৃণমূল কংগ্রেস খারাপ ফল করলো, অপরপক্ষে কেন্দ্রের শাসক বিজেপি ভালো ফল করলো– এটাই তো কেন্দ্রীয় বাহিনীর তত্ত্বাবধানে নিরপেক্ষ ভোটের যথেষ্ট বড় প্রমাণ। কিন্তু একটু তলিয়ে যদি আমরা বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখতে পাবো যে ,কেন্দ্রে বিজেপি সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর, সেনা থেকে শুরু করে আধা সেনা সমস্ত স্তরেই এক অদ্ভুত ধরনের সমীকরণ ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠেছে। এই সমীকরণ কিন্তু বিজেপি যতই দেশপ্রেমের সমীকরণ বলে দাবি করুক না কেন, সেই সমীকরণ হয়েছে ধর্মীয় বিভাজনের সমীকরণ। সেই সমীকরণ হয়েছে জাত পাতের ভিত্তিতে সেনার মধ্যেও একটা অদ্ভুত, অদৃশ্য ব্যবধানের পাঁচিল তুলে দেওয়ার সমীকরণ।
সেই সমীকরণ যুক্ত আধা সামরিক বাহিনী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকেই বিভিন্ন নির্বাচন গুলিতে অসীন হয়ে ,সাধারণ মানুষের ভোটদানের ভিত্তিতে, নিজস্ব রাজনৈতিক পছন্দের স্বাধীন প্রকাশের ক্ষেত্রটিকে কতখানি নিরপেক্ষভাবে প্রকাশিত হতে দিচ্ছে, তা রীতিমতো বিতর্কের বিষয়। তবুও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন পুলিশ, যেভাবে দলদাস পুলিশে পরিণত হয়েছে, শাসকের গেস্টাপো বাহিনীতে পরিণত হয়েছে, সেই আঙ্গিক থেকে বলতে হয় যে, সাধারণ মানুষের ভোট গ্রহণ কেন্দ্রে যাওয়া ঘিরে, আতঙ্কের পরিবেশ, ভয়ের পরিবেশ, দূর করবার ক্ষেত্রে এই কেন্দ্রীয় বাহিনীর উপস্থিতি একটা বড় রকমের ভূমিকা পালন করবে।
কেন্দ্রীয় বাহিনী মানে নিরপেক্ষ কোনো সত্ত্বা, যা নাগরিক সমাজের মতদানের অধিকার কে নিরপেক্ষভাবে প্রয়োগের ক্ষেত্রটিকে সুনিশ্চিত করবে– এমনটা সম্পূর্ণভাবে ধরে নেওয়ার কোনো কারণ নেই। তবু বলতে হয় ,মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন পুলিশ বাহিনী, যা কার্যত তৃণমূলের দলদাস বাহিনীতে পরিণত হয়েছে, তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন পুলিশের দ্বারা নির্বাচন পরিচালনার থেকে এই কেন্দ্রীয় বাহিনীর নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন অনেক বেশি সাধারণ মানুষের কাছে নিরাপত্তার ক্ষেত্রটিকে প্রসারিত করবে।
পশ্চিমবঙ্গে এখন সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা প্রদানের বিষয়টি আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকার, নিজেদের দায়িত্ববোধের মধ্যে রাখতে রাজি হন নন। সেই কারণেই সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার প্রশ্নটিকে যখন রাজনীতির প্রাঙ্গণে সব থেকে বেশি মানুষ গুরুত্ব দেয়, তখনই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে মহামান্য আদালতের ভূমিকা। মানুষের নিরাপত্তা বিধান, যেটা সংবিধানগতভাবে নির্বাচনে জেতা একটি রাজনৈতিক দলের নিয়ন্ত্রণাধীন রাজ্য সরকারের প্রাথমিক কর্তব্য, সেই প্রাথমিক কর্তব্য পালনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের সার্বিক ব্যর্থতার দরুন এখন সবটাই আদালতের উপরে কার্যত বর্তেছে। আর যেভাবে বিভিন্ন স্তরের নিয়োগ থেকে শুরু করে, গরু পাচার, সোনা পাচার, কয়লা পাচার — সবকিছুতেই আদালতকে সক্রিয় হয়ে উঠতে হচ্ছে, তা কোনো অবস্থাতেই একটা গণতান্ত্রিক কাঠামো যুক্ত দেশের গণতান্ত্রে স্বাস্থ্যের লক্ষণ হতে পারে না। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শাসনকাল এমন একটা পরিবেশের সৃষ্টি করেছে যে, গণতন্ত্রের স্বাস্থ্য এখন নির্ভর করছে রাজনৈতিক দলগুলির কর্মকাণ্ডের ভেতরে নয়, কার্যত আদালতের উপর। কারণ ,শাসক দল ব্যতীত অন্য কোনো বিরোধী রাজনৈতিক দল ,যাঁরা প্রকৃত অর্থে শাসক বিরোধিতার কাজ করে, বিজেপির মত ছদ্ম বিরোধিতার মানসিকতা নিয়ে চলে না ,তাঁদেরকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তাঁর সরকার, তাঁর প্রশাসন ,কোনো অবস্থাতেই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড কে পরিচালিত করতে দিচ্ছে না।
স্বভাবতই সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক দল, যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও যে সমস্ত মানুষ মমতার দলের সর্বস্তরের নেতাদের ব্যাপক দুর্নীতি দরুন, হকের চাকরি পাচ্ছেন না, সেই সমস্ত মানুষরা বাধ্য হয়ে আদালতে শরণাপন্ন হচ্ছেন। সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার প্রশ্নে না,গরিক অধিকারকে সুরক্ষিত রাখবার প্রশ্নে যে কাজ রাজ্যের বিধানসভার করা দরকার, সেই কাজ বাধ্য হয়ে করতে হচ্ছে মহামান্য আদালতকে ।কার্যত নির্বাচিত আইনসভা কে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেভাবে ঠুটো জগন্নাথে পরিণত করেছেন ,একেবারে নিজের দলীয় অফিসে পরিণত করেছেন, তাতেই মহামান্য আদালতকে প্রায় সর্বক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করে, নাগরিক অধিকারকে সুরক্ষিত করতে হচ্ছে।
আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনকে (২০২৩) ঘিরে যে পরিস্থিতিতে মহামান্য আদালতকে প্রতিটি পঞ্চায়েত ভোটের বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়োগের নির্দেশ দিতে হয়েছে, তার জন্য যে সামগ্রিক পরিবেশ ,তা কখনোই গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোর পক্ষে স্বাস্থ্যকর নয়। গোটা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে বিরোধী বামপন্থী, কংগ্রেস, আইএসএফ– যেটা প্রকৃতপক্ষে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আরএসএস–বিজেপিকে সাহায্য করার যে রাজনীতি, সেই প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতিকে প্রতিহত করবার জন্য আত্মনিবেদিত, সেই রাজনৈতিক শক্তিকে নির্বাচনী সংগ্রামের গোটা প্রক্রিয়ার বাইরে রেখেই ,একটা লোক দেখানো পঞ্চায়েত ভোট মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় করতে চেয়েছিলেন ,সেই লক্ষ্যেই তিনি নিজের পরিবারের সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এক ব্যক্তিকে রাজ্যের নির্বাচন কমিশনার করবার জন্য মহামান্য রাজ্যপালের কাছে সুপারিশ পাঠিয়ে ছিলেন। আর রাজ্যপাল যতই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ঘিরে রাজ্য সরকারের সঙ্গে একটা সংঘাতের ছদ্ম পরিবেশ তৈরি করুন না কেন, নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে তিনি যে মানসিকতার পরিচয় দিয়েছেন, তা থেকেই এটা পরিষ্কার , রাজ্য সরকারকে গণতান্ত্রিক পরিবেশকে ধ্বংস করে ,ধর্মীয় বিভাজন রেখাকে আরও দগদগে করে, তার নিয়োগকর্তা আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির অনুকূলে সমস্ত রাজনৈতিক পরিবেশকে প্রভাবিত করবার জন্য যে তিনি সমস্ত কিছু নিয়ন্ত্রণ করছেন, সেই বিষয়টি দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে।
রাজ্যপালের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি অদৃশ্য সহানুভূতির জেরেই হাজার হাজার প্রকৃত বিরোধী প্রার্থীরা আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য মনোনয়ন পত্র পর্যন্ত পেশ করতে পারছেন না। পুলিশ-তৃণমূলের জল্লাদ বাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণে এ পর্যন্ত গোটা পশ্চিমবঙ্গে বেশ কিছু গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতাকর্মী শহীদ হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরো বেশি মানুষ। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায় অধ্যুষিত এলাকায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই গেস্টাপো বাহিনী সশস্ত্র আক্রমণ চালাচ্ছে। বিরোধী বাম, কংগ্রেস, আইএসএফের নেতাকর্মীদের খুন করছে। মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষকে টার্গেট করা হয়েছে যাতে করে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে বিভাজনর রেখা একটা নগ্ন জায়গায় চলে যায়।এই সুযোগে মমতার রাজনৈতিক সত্ত্বার ধারক বাহক, আরএসএসের বিভাজনের রাজনীতির যে ফলশ্রুতি, তা আরো বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠতে পারে। তার জন্যে এভাবে মমতা চাইছেন, আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি যেভাবে হিন্দু মুসলমানের ভিত্তিতে আড়াআড়িভাবে মানুষকে ভাগ করে, ভোটকে ভাগ করতে চায় সেই রাস্তাটিকে পরিষ্কার করে দেওয়ার।
এত রক্ত ঝরার বিনিময় মহামান্য আদালত পঞ্চায়েতের প্রতিটি বুথে ভোটের সময় কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়োগের আদেশ দিয়েছেন। রাজ্যের নির্বাচন কমিশনকেই এই কেন্দ্রীয় বাহিনী পাওয়ার জন্য আবেদন করতে হবে এমন আদেশ মহামান্য আদালত দিয়েছেন। আশঙ্কা করা যায়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বশংবদ নির্বাচন কমিশনারের নিয়ন্ত্রণাধীন নির্বাচন কমিশন, মহামান্য হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের নির্দেশ মোতাবেক কেন্দ্রীয় বাহিনী চাওয়ার আদেশ ঘিরে ,আবেদন করবার ক্ষেত্রেও নানা ধরনের আইনি টালবাহানা করে ,আরো বহু মানুষের রক্ত ঝরানোর জন্য তৃণমূলের যে পরিকল্পনা, তাকে সফল করেই, শেষ পর্যন্ত আদালতের নির্দেশ মানার দিকে যাবে ।
এটাই দুর্ভাগ্যের বিষয় মমতার এই রক্ত ঝরানোর পরিকল্পনা, মমতার এই বিভাজনের রাজনীতির পরিকল্পনা, আসন্ন লোকসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আরএসএস যেভাবে গোটা ভারত জুড়ে রাজনৈতিক হিন্দু রাষ্ট্রের সামনে রেখে, হিটলার– মুসোলিনির ফ্যাসিবাদের ভারতীয় সংস্করণের রূপায়ণ ঘটাতে চাইছে ,সেই প্রক্রিয়াকে রুখবার ক্ষেত্রে, এই সমস্ত ঘটনাক্রম না ঘটলে তো আদালতের পক্ষে শুধু আশঙ্কাকে নির্ভর করে, সব সময় কঠিন অবস্থান নেওয়া সম্ভবপর নয়। তবু দেরিতে হলেও মহামান্য আদালত যে অবস্থান গ্রহণ করেছেন, সেই অবস্থানকে সশ্রদ্ধ চিত্তে স্বাগত জানিও বলতে হয়, কেন্দ্রীয় বাহিনীর দৈনন্দিন কার্য পরিচালনা ,আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনকে ঘিরে, যাতে কোনোভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিয়ন্ত্রণাধীন পুলিশ বাহিনী, যা কার্যত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলদাস বাহিনীতে পরিণত হয়েছে, তারা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে ,রাস্তাঘাট চেনানোর নাম করে, কেন্দ্রীয় বাহিনীকে যাতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলদাস পুলিশ বাহিনী প্রতারিত করতে না পারে, প্রভাবিত করতে না পারে ,তার জন্য মহামান্য আদালতকে সরাসরি নজরদারি করতে হবে।
এই নজরদারি ব্যতীত আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচন রক্তপাতহীন করতে পারা যাবে না। কারণ, পঞ্চায়েত ভোটকে কেন্দ্র করে কেন্দ্রীয় বাহিনীকে কিভাবে ঠুটো জগন্নাথ করে রাখা যায় ,তার জন্য কিন্তু ইতিমধ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার পেটোয়া পুলিশ বাহিনী এবং দলীয় জহ্লাদ বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছেন। তাই মহামান্য হাইকোর্ট কে কেবলমাত্র কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের নির্দেশ দিয়েই নিশ্চিন্ত হলে চলবে না। এই কেন্দ্রীয় বাহিনী যাতে রাজ্য পুলিশের কোনোরকম নিয়ন্ত্রণের দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে, স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে, সেই ব্যাপারটিকে সুনিশ্চিত করবার জন্য, মহামান্য আদালতের সুনির্দিষ্ট তত্ত্বাবধায়ন একান্ত প্রয়োজন। পশ্চিমবঙ্গের নাগরিকদের প্রাণ রক্ষার জন্য প্রয়োজন। সর্বোপরি গোটা ভারতের গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ পরিবেশকে বজায় রাখবার জন্য, ভারতের সংবিধানকে সুরক্ষিত করে রাখবার জন্য প্রয়োজন।
মতামত লেখকের নিজস্ব