শমীক লাহিড়ী
পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত নির্বাচন হবে ৮ই জুলাই। ৮ই জুন বিকাল ৫টায় নতুন নির্বাচন কমিশনার রাজীব সিনহা এই ঘোষণা ক’রে নির্বাচনের নির্ঘন্ট প্রকাশ করেন। ৯ই জুন সকাল ১০টায় সরকারী বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ ক’রে জানানো হয়, এই দিনই সকাল ১১টা থেকে মনোনয়নপত্র জমা নেওয়ার কাজ শুরু হবে। ১৫ই জুন পর্যন্ত মোট ৬ দিন ধার্য করা হয় এই নির্বাচনের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার জন্য। দৈনিক ৪ ঘন্টা করে মোট ২৪ ঘন্টার মধ্যে ৭৩,৮৮৭টি আসনের জন্য মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার কাজ হবে। এর মধ্যে ৬৩,২২৯টি গ্রাম পঞ্চায়েত এবং ৯,৭৩০টি পঞ্চায়েত সমিতি আসনের জন্য ৩৪১টি ব্লক দপ্তরে এবং জেলা পরিষদের ৯২৮টি আসনের জন্য ৬২টি মহকুমা শাসকের দপ্তরে মনোনয়নপত্র জমা করার সুযোগ পাবে ইচ্ছুক প্রার্থীরা।
৭ই জুন নতুন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব পেয়েছিলেন রাজীব সিনহা। দায়িত্ব গ্রহণের ২৪ ঘন্টার মধ্যেই ত্রিস্তর পঞ্চায়েত নির্বাচনের নির্ঘন্ট ঘোষণা করেন তিনি। এত তাড়াহুড়ো করে নির্বাচন ঘোষণা করা হঠাৎই এত জরুরী হয়ে পড়ল কেন – এ প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। সাধারণভাবে নির্বাচনের দিন/নির্ঘন্ট ঘোষণার পর ৪/৫দিন সময় নেয় নির্বাচন কমিশন নিজেদের এবং ইচ্ছুক রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের প্রস্তুতির জন্য। সাধারণভাবে সব স্বীকৃত রাজনৈতিক দলগুলির সাথে নির্বাচন ঘোষণার পূর্বেই সভা করে থাকে নির্বাচন কমিশন। শুধুমাত্র আমাদের রাজ্যই নয় সব রাজ্য নির্বাচন কমিশনাররাই এই প্রথা মেনে চলেন। সেটাও করা হয়নি এবার।
৬.৭ মিনিটে মনোনয়ন জমা!
রাজ্য নির্বাচন কমিশনের তাড়াহুড়োর ফল কি তা রাজ্যের মানুষ দেখছেন। প্রথমেই প্রশ্ন করা হয়েছিল ৭৩,৮৮৭টি আসনের জন্য মাত্র ৪০২টি মনোনয়নপত্র জমা নেওয়ার কেন্দ্র কিভাবে দৈনিক ৪ ঘন্টার হিসাবে মোট ২৪ ঘন্টার মধ্যে এই কাজ সম্পন্ন করবে? যদি গড়ে প্রতিটি আসনে অন্তত: ১০জন করে প্রার্থী থাকে তাহলে ৭,৩৮,৮৭০টি মনোনয়নপত্র গ্রহণ করার জন্য মাত্র ২৪ ঘন্টা অর্থাৎ ১,৪৪০ মিনিট বরাদ্দ করা হয়েছে। জেলা পরিষদের আসন সংখ্যা যদি বাদও দেওয়া হয়, তাহলে বাকি ৭২,৯৫৯টি আসনের জন্য অন্তত: ৭,২৯,৫৯০টি মনোনয়নপত্র জমা নেওয়ার জন্য ৩৪১টি ব্লক অফিস বরাদ্দ করা হয়েছে। এর অর্থ ১৪৪০/৭২৯৫৯০=০.০০১৯x৩৪১= ০.৬৭ মিনিট= ৪০.২ সেকেন্ড বরাদ্দ করা হয়েছে ১টি মনোনয়নপত্র জমা করার জন্য। যদি ১০টি টেবিলে একসাথে মনোনয়নপত্র জমা নেওয়া হয়, তাহলেও প্রতি মনোনয়নপত্র পিছু বরাদ্দ মাত্র ৬.৭ মিনিট।
মনোনয়নপত্র ৩ পাতার, ঘোষণা পত্র আরও ৩ পাতার। মনোনয়নপত্রে ৪১টি এবং ঘোষণাপত্রে ৬২টি শূণ্যস্থান পূরণ করতে হয়, যা রিটার্নিং অফিসার অথবা তার সহযোগীদের পরীক্ষা করে মিলিয়ে দেখে নিতে হয়। এছাড়া ভোটার তালিকা, আধার কার্ড, ভোটার আইকার্ড, জাতির শংসাপত্র জমা করতে হবে প্রার্থীদের, যা অবশ্যই পরীক্ষা করে দেখার কথা রিটার্নিং অফিসার অথবা তার সহযোগীদের। এছাড়াও স্বীকৃত রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রে ২টি ফর্ম জমা দিতে হয়। সেটিও পরীক্ষা করে দেখার কথা এদেরই। ৬.৭ মিনিটে কোন মানুষ এই কাজ করতে পারবে, তার উত্তর কি দেবেন নির্বাচন কমিশনার রাজীব সিনহা?
৮ঘন্টায় ৬৪,৫৫৯ মনোনয়ন!
এর ফল কি হলো? ৯তারিখে কার্যত বিনা প্রস্তুতির কারণে ৩৪১টি বিডিও ও ৬২টি এসডিও দপ্তরে কার্যত মনোনয়নপত্র জমা নেওয়ার কাজ শুরুই করা যায়নি। এমনকি ১০ই জুনও নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র না পৌঁছানোর জন্য মনোনয়নপত্র জমা নেওয়ার কাজ হয়নি বহু ব্লক দপ্তরে। প্রথম ৩দিন অর্থাৎ ৯, ১০ ও ১২ই জুন নির্বাচন কমিশনের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী মাত্র ৪৪ হাজার মনোনয়নপত্র জমা পড়েছিল। ১৩ই জুন পর্যন্ত জমা পড়া মনোনয়নপত্রের সংখ্যা ছিল ৯৪ হাজার। ১৪ই জুন এই সংখ্যা পৌঁছে গেল ১,৬২, ৬৫৫। অর্থাৎ বাকি রয়ে গেছিল আরও অন্তত: ৫.৫ লক্ষ মনোনয়নপত্র জমা নেওয়ার কাজ, বাকি ৪ঘন্টায়। শেষ ২দিন, ১৪-১৫ই জুন বহু ব্লক দপ্তর দখল নিয়েছিল বোম-পিস্তল হাতে শাসকদল তৃণমূলের সশস্ত্র দুস্কৃতিরা। ১৩ই জুন পর্যন্ত তৃণমূল ৯,৩২৮টি মাত্র মনোনয়ন জমা করতে পেরেছিল, আর ১৫ই জুন এই সংখ্যা হয়ে গেল ৭৩,৮৮৭। প্রথম ১২ ঘন্টায় ৯,৩২৮ টা আর শেষ ৮ঘন্টায় ৬৪,৫৫৯টি মনোনয়ন জমা করে ফেললো তৃণমূল!! এ তো ভারী রঙ্গ যাদু, এ তো বড় রঙ্গ!
রক্তাক্ত নীল পাড় সাদা শাড়ি
নির্বাচন কমিশন এমন ভূমিকা গ্রহণ করল, যাতে কার্যত নির্বাচনে মানুষ অংশগ্রহণ করতে না পারে। বিরোধী দলগুলির প্রার্থীরা যাতে মনোনয়নপত্র জমা দিতে না পারে তার জন্য শাসকদল তৃণমূলের চেষ্টার কোনও খামতি ছিলনা। বোমা-পিস্তল-বন্দুক-সমাজবিরোধী সব জড়ো করেছে তৃণমূল। বিরোধীদের আটকাবার জন্য ২জনের লাশ ফেলে দিতেও বিন্দুমাত্র দ্বিধাগ্রস্ত নয় তৃণমূল। পুলিশমন্ত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশেই পুলিশ নীরব দর্শক। আবার কোথাও পুলিশ বিরোধী দলের প্রার্থীদের আটকাবার জন্য হুমকি দিলো, তাতে কাজ না হলে মিথ্যা মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার করছে। দলের সুপ্রিমো মমতা বন্দোপাধ্যায়ের নির্দেশেই সব সমাজবিরোধী বোমা-পিস্তল-বন্দুক নিয়ে বিরোধীদের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া রুখতে ময়দানে নেমে পড়েছিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাদা শাড়ি এখন রক্তে ভেজা। রক্তের হোলি খেলাতেই তিনি ও তাঁর দল অভ্যস্ত।
গোপন প্রেম
মমতা বন্দোপাধ্যায়ের এত ভয় কিসের? আসলে তিনি খুব ভালোভাবেই জানেন, এই রাজ্যের মানুষ ভোট দেওয়ার সুযোগ পেলে ওনার দল নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। এমনকি ওনার গোপন বোঝাপড়ার সঙ্গী মোদী-শাহ’র দল বিজেপিরও একই আশঙ্কা রয়েছে। মানুষের সামনে এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, দুর্নীতিগ্রস্ত তৃণমূলের মাথাদের রক্ষা করছে মোদী-শাহ’র বিজেপি সরকার। তাই ৯ বছর আগে শুরু হওয়া সারদা সহ অন্যান্য চিটফান্ড মামলা অথবা নারদা ঘুষ মামলা ধামাচাপা দিয়েছে ইডি-সিবিআই। এই বোঝাপড়ার জন্যই মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো বধূ যার বিরুদ্ধে বেআইনি সোনা নিয়ে আসার অভিযোগ, তাকে কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ন্ত্রিত কাস্টমস দপ্তর, সিআইএসএফ জওয়ান, এয়ারপোর্ট অথরিটি ছেড়ে দিয়েছিল। কয়লা-বালি-সোনা-গরু সব পাচারেই মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপোর নাম উঠে আসা সত্ত্বেও মাঝে মধ্যে ডেকে পাঠানো ছাড়া কোনও কার্যকরী ব্যবস্থা নেয়নি বা নিতে পারেনি সিবিআই-ইডি কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশেই।
এমনকি নির্বাচনের মনোনয়ন জমা দেওয়ার সময়েও বহু যায়গায় মানুষ দেখেছে, বাম ও অন্যান্য বিরোধী দলের প্রার্থীদের মনোনয়ন জমা দিতে বাধা দেওয়া হ’লেও, অনেক বিজেপি প্রার্থীই বিনা বাধায় মনোনয়ন জমা দিতে পেরেছে। এই সত্য ঢাকার জন্য কর্পোরেট মিডিয়া বিজেপি তৃণমূলের সংঘর্ষের কয়েকটা মাত্র ঘটনাকেই সারাদিন ধরে প্রচার করেছে, প্রকৃত ঘটনাগুলো আড়াল করে রাখার জন্যই। তৃণমূলের টিকিট কিনতে ব্যর্থ হাজার হাজার চোর লুটেরা তৃণমূলী দিব্যি তৃণমূলের টিকিটে দাঁড়িয়ে পড়েছে।
এইসব গোপন বোঝাপড়ার ফল ক্রমশ মানুষের সামনে প্রকাশিত হয়ে পড়ছে। এখন বাংলার মানুষ বুঝেছেন তৃণমূলের আসল রক্ষাকর্তা বিজেপি। এত দুর্নীতির সাথে যুক্ত থেকেও মুখ্যমন্ত্রী অথবা তার পরিবারের সদস্যদের বাঁচিয়ে রাখার প্রতিদান হিসাবে, তৃণমূল গোয়া-মেঘালয়-মণিপুর-ত্রিপুরা ইত্যাদি রাজ্যে নিজেদের প্রার্থী দিয়ে, বিরোধী দলগুলির বিধায়ক ভাঙিয়ে বিজেপিকে সরকার করতে সাহায্য করেছে, যেন নিজের নাক কেটে অপরের যাত্রাভঙ্গ। একইভাবে সংসদে কখনও বিজেপি’র আনা বিভিন্ন জনবিরোধী স্বেচ্ছাচারী আইনগুলি পাশ করতেও তৃণমূল ঘুরপথে সাহায্য করেছে।
মূল অপরাধ
শুধু তাই নয় এই রাজ্যে দাঙ্গাবাজদের কোনদিনই স্থান ছিল না বাম আমলে। আরএসএস-বিজেপির কোনও অস্তিত্বই ছিল না বামফ্রন্টের ৩৪ বছরে। বিগত ১২ বছরে তৃণমূলের বদান্যতায় এই রাজ্যে এখন আরএসএস’র কয়েক হাজার শাখা আর স্কুল গজিয়েছে। এই রাজ্য থেকে তৃণমূলের বদান্যতাতেই বিজেপির ১৯জন সাংসদ আর ৭৭ জন বিধায়ক ভোটে জিতে এসেছে। অথচ বামফ্রন্টের ৩৪ বছর সময়কালে হাতে গোনা ১০ জন কাউন্সিলার বা পঞ্চায়েতও ছিল না বিজেপি’র। এই জন্যই প্রয়াত কমরেড জ্যোতি বসু বলতেন – মমতা বন্দোপাধ্যায়ের সবচেয়ে বড় অপরাধ এই রাজ্যে সাম্প্রদায়িক বিজেপি-আরএসএস’কে স্থান করে দেওয়া।
বিগত ১২ বছরে অনেক অপরাধের মধ্যে তৃণমূলের অন্যতম অপরাধ – রাজ্যে সাধারণ মানুষের ভোট দেওয়ার অধিকার কেড়ে নেওয়া, বিরোধীদের ওপর স্বৈরাচারী কায়দায় আক্রমণ চালানো আর পঞ্চায়েত পৌরসভার মত স্বায়ত্ত্বশাসিত সংস্থাগুলি ধ্বংস করা।
গ্রাম বাংলা ও বামফ্রন্ট সরকার
বামফ্রন্টের সময় গড়ে উঠেছিল গ্রামের মানুষের দ্বারা পরিচালিত পঞ্চায়েতী ব্যবস্থা। ১৯৭৮ সালে বামফ্রন্টের তৈরী পঞ্চায়েত আইন ছিল গোটা দেশের সামনে মডেল। এই কারণেই ৮০-র দশকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী বামফ্রন্টের তৈরী পঞ্চায়েতী ব্যবস্থার আদলে সমগ্র দেশে এই ধরণের পঞ্চায়েতী ব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সংবিধানের ৭৩ ও ৭৪তম সংশোধনীর মাধ্যমে তৈরী হয়েছিল সমগ্র দেশের জন্য নতুন পঞ্চায়েতী আইন। বামফ্রন্ট সরকার নতুন পঞ্চায়েত আইন তৈরী করে গরীব খেটে খাওয়া মানুষের হাতে ক্ষমতা এবং একইসাথে ভূমিসংস্কারের মাধ্যমে গরীব ভূমিহীন মানুষের হাতে জমি তুলে দিয়ে গ্রামবাংলার এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছিল। ১১লক্ষ একরেরও বেশি জমি ভূমিহীন চাষীদের হাতে তুলে দেওয়ার মাধ্যমে গ্রামবাংলার অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এনেছিল বামফ্রন্ট।
এর ফলে শুধুমাত্র গ্রামবাংলাতেই তৈরী হয়েছিল ২২হাজার কোটি টাকার ভোগ্যপণ্যের বাজার। যার ফলশ্রুতিতে ৮০ দশকের শেষের দিকে শুরু হওয়া শিল্পায়ন, ২০১০ সালে পশ্চিমবঙ্গকে শিল্পবিনিয়োগে একেবারে ওপরের সারিতে নিয়ে গিয়েছিল। গ্রামবাংলার অর্থনৈতিক সাফল্যের সুফল পেয়েছিল মফস্বল-শহরের তরুণ প্রজন্ম। তৈরী হয়েছিল অনেক নতুন কল-কারখানা, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, শিল্পতালুক, আইটি হাব এই পশ্চিমবাংলাতেই। ১৯৭৭ সালে যেখানে দারিদ্র সীমার নীচে ৬৬% মানুষ ছিল, তা ২০০০ সালেই নেমে আসে ২১% এ। বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠার আগে রাজ্যের ৬০% এর বেশি মানুষ ছিল নিরক্ষর, ২০০০ সালেই তা নেমে আসে ২৩% এ। ১৯৭৭ এর আগে যে পশ্চিমবঙ্গ খাদ্যের জন্য অন্য রাজ্যের ওপর নির্ভরশীল ছিল, তা বামফ্রন্ট সরকারের আমলে শুধুমাত্র খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে ওঠে তাই নয়, বরং উদ্বৃত্ত ধান-সব্জি অন্য রাজ্যে পাঠানো শুরু হয়।
একদিকে ভূমি সংস্কারের মাধ্যমে গরীব ভূমিহীন মানুষের আয় বৃদ্ধি, পঞ্চায়েতের মাধ্যমে গরীব খেটেখাওয়া মানুষের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়ার কাজ যেমন করেছিল বামফ্রন্ট সরকার, একই সাথে সমস্ত মানুষকে শিক্ষার আওতায় নিয়ে আসার জন্য তৈরী করেছিল অসংখ্য স্কুল-কলেজ। গ্রামের গরীবের প্রকৃত ক্ষমতায়ন হয়েছিল একইসাথে অধিকার-আয়বৃদ্ধি-শিক্ষা প্রসারের মাধ্যমে। এই ভাবেই গ্রাম বাংলার পরিবর্তন ঘটিয়েছিল বামফ্রন্ট সরকার।
গ্রাম বাংলা ও তৃণমূল
তৃণমূল শাসনের বিগত ১২ বছরে সমগ্র গ্রামীন অর্থনীতি দখল করেছে ফড়ে-দালালরা। এদের কাছে কৃষক অত্যন্ত কম দামে তার ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হয় আজ। একদিকে কৃষক ফসলের ন্যায্য মূল্য পায় না, অন্যদিকে তৃণমূলের ফড়ে-দালালরা বাজারে চড়া দামে চাল-সব্জি বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা মুনাফা লুঠছে। বামফ্রন্টের আমলে গড়ে ওঠা কৃষি-মৎস ও অন্যান্য সমবায়গুলি ধ্বংস ক’রে দিয়েছে তৃণমূল। এই সমবায়গুলির পরিবর্তে এখন ফড়ে-দালালরাই গ্রামবাংলার অর্থনীতিকে শাসন করে। ফলে একদিকে মরছে কৃষক, অন্যদিকে মূল্যবৃদ্ধির চাপে ধুঁকছে ক্রেতারা।
বামফ্রন্টের আমলে গড়ে ওঠা হাজার হাজার প্রাথমিক, উচ্চ প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলি আজ ধুঁকছে উপযুক্ত সংখ্যক শিক্ষক-শিক্ষিকা না থাকার জন্য। সরকারী শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করে, বেসরকারী মুনাফাখোর ব্যবসায়ীদের হাতে শিক্ষাব্যবস্থা তুলে দেওয়াই তৃণমূলের মূল লক্ষ্য। ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠছে বেসরকারী কেজি স্কুল থেকে শুরু করে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত। বাংলার শিক্ষক নিয়োগের দুর্নীতি, মধ্যপ্রদেশের বিজেপি পরিচালিত সরকারের ‘ভ্যাপম কেলেঙ্কারি’কেও ছাপিয়ে গেছে। স্বয়ং শিক্ষামন্ত্রী সহ হাফডজন শিক্ষা দপ্তরের একেবারে শীর্ষস্থানীয় আধিকারিক এই অপরাধে এখন জেলের ঘানি টানছে।
বামফ্রন্ট সরকারের আমলে গড়ে ওঠা শিল্পগুলি একে একে রাজ্য ছেড়ে পালিয়েছে তৃণমূলীদের তোলাবাজীতে অতিষ্ঠ হয়ে, বিগত ১২ বছরে। নতুন কোনও শিল্প তৈরী হয়নি রাজ্যে তৃণমূলের আমলে। বামপন্থীদের দীর্ঘ লড়াইয়ের ফসল রেগা প্রকল্প বা ১০০ দিন কাজের নিশ্চয়তা প্রকল্প। বিগত প্রায় ২বছর ধরে রাজ্যে ১জন মানুষও ১দিনের জন্য কাজ পায়নি, পঞ্চায়েতের তৃণমূলী মাতব্বরদের চুরির জন্য। তাই তৃণমূল আমলে ১কোটিরও বেশি গ্রাম বাংলার তরুণতরুণী ভিন রাজ্যে পাড়ি দিতে বাধ্য হয়েছে কাজের সন্ধানে। সম্প্রতি উড়িষ্যার বালাসোরে করমন্ডল এক্সপ্রেসের ভয়াবহ দুর্ঘটনায় আহত-নিহত প্রায় সবাই কাজের সন্ধানেই ভিন রাজ্যে যাচ্ছিলেন।
যে পঞ্চায়েত বামফ্রন্টের আমলে গ্রাম সংসদের মাধ্যমে মানুষের অংশগ্রহণে পরিচালিত হত, তা এখন চোর-জোচ্চর-বাটপার-লুঠেরাদের দখলে চলে গেছে। ১০০ দিনের কাজ, আবাস যোজনা বা গরীব মানুষের ঘর, রাস্তা-খাল-পুকুর সংস্কারের অর্থ লুটে খেয়েছে তৃণমূলীরা। এমনকি অসহায় বৃদ্ধদের বার্ধক্য ভাতা বা বিধবা ভাতা থেকেও কাটমানি খেতে ছাড়ে না এই লুটেরা তৃণমূলীরা। যে গরীব কৃষক বাম আমলে জমির পাট্টা-বর্গার অধিকার পেয়েছিল, তৃণমূলী জমি মাফিয়ারা সে সব জমি লুটে খাচ্ছে এখন। সরকারী জমি এমনকি খাল-পুকুরও বেচে দিচ্ছে তৃণমূলীরা। সর্বগ্রাসী লুটই এখন তৃণমূলীদের অক্সিজেন।
ভাগ করো ও শাসন করো
বামফ্রন্টের আমলে যে গ্রাম বাংলায় হিন্দু-মুসলমান-খ্রীষ্টান-বৌদ্ধ-জৈন-শিখ-নাস্তিক একই সাথে শান্তিতে বসবাস করতো, সেই বাংলায় শতাধিক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে তৃণমূলের ১২ বছরের রাজত্বকালে। জাত-ধর্ম-ভাষার ভিত্তিতে মানুষকে বিভক্ত করার আরএসএস-বিজেপির ঘৃণ্য নীতি বাংলায় প্রায় একই কায়দায় তৃণমূল গ্রহণ করেছে। আসলে দেশজুড়ে আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি, বেকার বৃদ্ধি, বেহাল অর্থনীতি, রেল-ব্যাঙ্ক-বীমা-খনি-বিদ্যুৎ বেসরকারী মুনাফাখোরদের হাতে তুলে দেওয়া এই সব অপরাধ আড়াল করার জন্যই বিজেপি জাত-ধর্ম-ভাষার ভিত্তিতে গরীব-সাধারণ মানুষকে বিভক্ত করার নীতি নিয়ে চলে। বাংলায় সেই নীতি নিয়েই চলতে চাইছে তৃণমূল নিজেদের অপরাধ আড়াল করার জন্যই।
জোট বেঁধেছে মানুষ
এই জন্যই লুটেরা-দাঙ্গাবাজ বিজেপি-তৃণমূলের বিরুদ্ধে বাংলার মানুষ আজ ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াইতে নেমেছে। মানুষের মনোভাব বুঝেই তাই একদিকে বিজেপি যেমন পঞ্চায়েত নির্বাচন যাতে না হয় সেই চেষ্টা করছে, আর তৃণমূল বিরোধীদের মনোনয়নপত্র জমা দিতে বাধা দিয়ে, ভোট লুট করে পঞ্চায়েতগুলোকে আবার লুটের আখড়া বানাতে চাইছে। মানুষের ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের মাধ্যমেই বাংলাকে দাঙ্গাবাজ আর লুটেরাদের হাত থেকে বাঁচানো সম্ভব হবে। তাই আমাদের লড়াই – দাঙ্গাবাজ-লুটেরাদের পঞ্চায়েত থেকে হটাও, মানুষের পঞ্চায়েত গড়ে তোলো।