সাম্প্রদায়িক হিংসার মোকাবিলায় সুনির্দিষ্ট রূপরেখা নির্ধারণ করতে হবে
রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সর্বক্ষেত্রেই উপযুক্ত বন্দোবস্ত গ্রহণ করতে হবে
রামনবমীর শোভাযাত্রাকে কেন্দ্র করে গত ৩০ মার্চ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সংঘর্ষ ও হিংসার ঘটনা সংগঠিত হয়েছে। এমনটা যে ঘটতে পারে সেই আঁচ আগেই পাওয়া যাচ্ছিল। মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষজনকে আক্রমণের উদ্দেশ্যে বিগত কয়েক বছর ধরেই হিন্দুত্বের ঝাণ্ডাধারিরা রামনবমীর শোভাযাত্রাকে ব্যবহার করে চলেছে। গত বছর, অর্থাৎ ২০২২-এও মধ্যপ্রদেশের খারগোন, মহারাষ্ট্র, গুজরাট, ঝাড়খণ্ড ও পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলার শিবপুরে রামনবমীর মিছিলের সময় হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা সামনে এসেছিল।
এবছরও রমজান ও রামনবমী একই সময়ে আয়োজিত হয়। উৎসব পালনের সময় যে সমস্ত এলাকায় মুসলমানেরা মসজিদে নমাজ পাঠরত সাম্প্রদায়িক প্ররোচনা যোগাতে সেইসব স্থানকেই বেছে নেওয়া হয়।
৩০ মার্চ ও তার পরবর্তী সময়ে জলগাঁও, মালাড ও ঔরঙ্গাবাদে (যার নাম বদলে শম্ভাজিনগর রাখা হয়েছে) একাধিক হামলা ও হিংসার ঘটনা ঘটে, একজনের মৃত্যুও হয়। বিহারের সাসারাম ও বিহার শরীফ এলাকায় গুরুতর অশান্তি দেখা দেয়। হরিয়ানা ও গুজরাটের ভদোদরা অঞ্চলেও হিংসা ছড়িয়ে পড়ে। পশ্চিমবঙ্গে রামনবমীর মিছিলকে কেন্দ্র করে প্রথমে হাওড়ায় এবং পরে হুগলী জেলায় অশান্তি চরম আকার নেয়।
মহারাষ্ট্র ও গুজরাটের মতো বিজেপি শাসিত রাজ্যের পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারে রামনবমীর শোভাযাত্রাকে উপলক্ষ করে অশান্তি বাধানো হয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে আরএসএসের নিয়ন্ত্রণাধীন বিভিন্ন সংগঠনগুলিই এইসব ঘটনায় মুসলমান মানুষ বসবাস করেন এমন এলাকাগুলিতে উত্তেজক স্লোগানসহ জমায়েত করেছে, তারস্বরে ডিজে বাজিয়ে মসজিদের সামনে তলোয়ার ও অন্যান্য অস্ত্র সহ মিছিল করেছে। এরই ফলে হাওড়ায় অশান্তি ছড়িয়েছে এবং হিংসার ঘটনায় ডালখোলায় একাধিক মানুষ আহত ও একজন নিহত হয়েছে।
হাওড়ায় রামনবমীর শোভাযাত্রা পূর্বনির্ধারিত রাস্তা ছেড়ে অন্য পথে এগোনো সত্বেও পুলিশ ও প্রশাসন নিজেদের যথাযথ দায়িত্ব ও ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়েছে। এমন সম্ভাবনা প্রতিরোধে কার্যত কোনও পরিকল্পনাই ছিল না। কয়েকটি স্থানে পুলিশ অশান্তির মধ্যেই দায় এড়িয়ে সরে গেছে, আবার কিছু জায়গায় তারা আক্রমণকারীদের সাথেই বিভিন্ন হামলার ঘটনায় যুক্ত ছিল। হিন্দুত্বের ধ্বজাধারীদের এমন সাজানো-গোছানো পরিকল্পনার যথাবিহিত প্রতিরোধে সার্বিক ব্যর্থতার দায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের। এমন সম্ভাবনা সম্পর্কে তাদের কাছে সতর্কবার্তা ছিল না এমন নয়। হাওড়ার শিবপুরে গতবছরেও এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল।
বিগত কয়েক বছর যাবত আরএসএস-বিজেপি রামনবমীর শোভাযাত্রাকে ব্যবহার করে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি করার চেষ্টা করে চলেছে। সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা প্রশমনের বদলে ঐ দিনে তৃনমূল কংগ্রেস নিজেরাই সেইসব মিছিলে যুক্ত থেকেছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে যে ভীতি সৃষ্টি হয়েছে তাকে ব্যবহার করে তারা নিজেদের রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে চাইছে।
তৃণমূল-বিজেপি উভয়েই পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে দুই দলের বাইনারি প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। সেই উদ্দেশ্যেই তারা মানুষের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিভাজন কায়েম করতে চায়। পশ্চিমবঙ্গে সিপিআই(এম) ও বামফ্রন্টের আহ্বানে সাড়া দিয়ে প্রতিদিন রাজ্যের সাধারণ মানুষ দুর্নীতিপরায়ণ তৃনমূল সরকারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছেন। একে প্রতিহত করতেই রাজনীতির নামে এমন নির্লজ্জ প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে।
বিহারে সাসারাম ও বিহার শরীফ এলাকায় বিভিন্ন মসজিদ, মাদ্রাসা ও সংখ্যালঘুরা বসবাস করেন এমনসব এলাকায় দোকান-বাজারে লুট চালানো হয়েছে, ঘরবাড়ি- স্কুটার ইত্যাদিতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। সবচাইতে জঘন্য ঘটনাটি ঘটেছে মাদ্রাসা-এ-আজিজিয়া’তে। এই মাদ্রাসাটি বিহারের সুপ্রাচীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির অন্যতম। মাদ্রাসায় আগুন লাগিয়ে প্রায় সাড়ে চার হাজার বই ও হাতে লেখা দুস্প্রাপ্য পুঁথিপত্র জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে।
বিহারে নিতিশ কুমারের সরকার নিজেদের সম্পর্কে আত্মতুষ্টির কারণে সম্ভাব্য বিপদের প্রতি অমনোযোগী থাকায় উপযুক্ত বন্দোবস্ত নেয়নি। নিতিশ কুমার ও জেডি(ইউ) দল যবে থেকে মহাগঠবন্ধনে ফেরত এসেছেন তখন থেকেই বিজেপি সে রাজ্যে কোণঠাসা হয়ে পড়ে। রামনবমীর শোভাযাত্রাকে কেন্দ্র করে বিজেপি বিহারে নিজেদের হারানো জমি ফেরত পেতে চাইছে। সম্প্রতি সারণ এলাকায় গণপিটুনিতে এক মুসলমান যুবকের মৃত্যু ঘটে। সেই ঘটনাই আসন্ন বিপদের সম্ভাবনা জানিয়ে দেয়। সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ও উস্কানিমূলক প্ররোচনার ঘটনাকে এড়াতে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন ছিল। বিহারে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে মহাগঠবন্ধন সরকার এখনও অবধি কড়া মনোভাব রেখেই চলেছে, আগামিদিনে এধরণের পরিস্থিতির মোকাবিলায় বিহার সরকারের আরও দ্রুত ও যথোপযুক্ত প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। পশ্চিমবঙ্গের মত প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তা অবশ্য বিহারে নেই।
এই সমস্ত ঘটনায় কেন্দ্রীয় সরকার নির্লজ্জের ন্যায় পার্টিজানসুলভ আচরণ বজায় রেখেছে। যে সমস্ত রাজ্যে সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনা ঘটেছে সেখানে মুখ্যমন্ত্রীদের এড়িয়ে সংশ্লিষ্ট রাজ্যপালদের সাথে বৈঠক করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। এর থেকেই বোঝা যায় কেন্দ্রীয় সরকার চাইছে ঐ সব রাজ্যে নির্বাচিত রাজ্য সরকারের উর্ধে উঠে রাজ্যপালেরা স্বতন্ত্র ভূমিকা পালন করুন। সম্প্রতি বিহারে থাকাকালীন অমিত শাহ ঘোষণা করেছিলেন রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতায় এলে একটিও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনা ঘটবে না। দাঙ্গাকারিদের উল্টো করে ঝুলিয়ে দেওয়া হবে বলেও তিনি হুঁশিয়ারি দেন- আসলে ঐ কথা বলে তিনি দাঙ্গাকারী মানেই মুসলমান বোঝাতে চেয়েছেন, তাদের ভীতসন্ত্রস্থ করতে চেয়েছেন।
রামনবমী, গনেশ চতুর্থীর মতো ধর্মীয় উৎসবের দিবসগুলিকে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে আক্রমণের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা চলছে, একই উদ্দেশ্যে আজকাল হনুমান জয়ন্তীকেও বাড়তি গুরুত্ব দিয়ে প্রচারের আলোয় সামনে আনা হয়েছে। জনসাধারণের মধ্যে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ প্রতিষ্ঠা ও হিংসাশ্রয়ী দাঙ্গা সংগঠিত করাই এসবের উদ্দেশ্য। দেশজুড়ে এমন উগ্র সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির মোকাবিলায় রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক উভয় পথেই সমস্ত ধর্মনিরপেক্ষ, গনতান্রিক ও অ-বিজেপি রাজনৈতিক শক্তিসমূহকে সুনির্দিষ্ট রূপরেখা নির্ধারণ করেই সামনে এগোতে হবে।