পার্টির প্রতিষ্ঠা
ওয়েবডেস্ক প্রতিবেদন
১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের ৩ বছরের মাথায় বর্তমান উজবেকিস্তানের তাসখন্দে ১৯২০ সালের ১৭ অক্টোবর তৈরি হয় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যুক্ত বহু ভারতীয় সেইসময়ে প্রবাসে থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন ব্রিটিশদের অত্যাচার এড়াতে। এদেরই একটা অংশ মুখ্যত এম এন রায়ের উদ্যোগে লেনিন তথা বলশেভিক পার্টির সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেন। তৃতীয় আন্তর্জাতিকের দ্বিতীয় কংগ্রেসের (১৯২০) অব্যবহিত পরেই এই ভারতীয়দের বিপ্লবীদের নিয়ে গঠিত হয় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি। ভারতে কাজ করার জন্য সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠিত হয়।এই সাতজন ছিলেন এম.এন. রায়, এভলিন রায়-ট্রেন্ট, অবনী মুখার্জি, রোজা ফিটিংগভ, মোহাম্মদ আলী, মোহাম্মদ শফিক এবং আচার্য। শফিক দলের সম্পাদক নির্বাচিত হন।
এরপর ধীরে ধীরে মুজফফর আহমদ, এস এ ডাঙ্গে,সিঙ্গারভেলু চেট্টিয়ার,শৌকত উসমানী প্রমুখেরা ভারতের মূল ভূখন্ডে কমিউনিস্ট আদর্শের বিস্তার ঘটান। এই বিস্তারে প্রধান ভূমিকা ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্য থেকে ভারতবর্ষের পূর্ণ স্বাধীনতার আন্দোলনের দাবি, শ্রমিক,কৃষকদের সংগঠিত করে জমিদারতন্ত্র ও পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে লড়াই । এই দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের মধ্য দিয়েই ভারতীয় জনমানসে কমিউনিস্টদের প্রতি আস্থা ও আন্তরিকতা বৃদ্ধি পায় । পেশোয়ার ষড়যন্ত্র মামলা(১৯২২-১৯২৭),কানপুর বলশেভিক ষড়যন্ত্র মামলা(১৯২৪),মীরাট ষড়যন্ত্র মামলা(১৯২৯) ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের লড়াইতে কমিউনিস্টদের ভূমিকাকে জনমানসে সুপ্রতিষ্ঠিত করছিল। এই চলার পথে বহুবার পার্টি ব্রিটিশ সরকার দ্বারা নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছিল কিন্তু এর জনভিত্তি ক্রমশ বাড়তেই থাকে।
প্রথম পার্টি কংগ্রেস (বোম্বাই-১৯৪৩)
এই পথেই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয় ১৯৪৩ সালের ২৩মে থেকে ১ জুন পর্যন্ত বম্বেতে । গোটা দেশের ১৫,৫৬৩জন পার্টি সদস্যের প্রতিনিধি হিসাবে এই কংগ্রেসে উপস্থিত হয়েছিলেন ১৩৯জন,এর মধ্যে ৩০জন ছিলেন বাংলার। বিভিন্ন বিক্ষিপ্ত কমিউনিস্ট গ্রুপগুলো একত্রিত হয়ে একটি শক্তিশালী কমিউনিস্ট পার্টি তৈরি হয়। পার্টি কংগ্রেসের সামান্য আগে ১৯৪১সালে গদর-কীর্তি গ্রুপ সিপিআই-এর সাথে মিশে যায়, এই অংশের শ্রদ্ধেয় নেতা বাবা সোহান সিং ভাকনা এই পার্টি কংগ্রেসের অন্যতম প্রতিনিধি ছিলেন। এই কংগ্রেসের রিপোর্টে উল্লেখ আছে যে সেইসময়ের মধ্যেই গোটা দেশে পার্টির ২,৬৩৭ জন সর্বক্ষণের কর্মী ছিলেন। এই সম্মেলনের সভাপতিমন্ডলীতে ছিলেন কমরেড মুজাফ্ফর আহমেদ, ডাঙ্গে, ভাইয়াজি কুলকার্নি,কেরালার কৃষ্ণা পিল্লাই, কলকাতার মহিলা নেত্রী মণিকুন্তলা সেন, ডিএস বৈদ্য, এবং ছাত্রনেত্রী নার্গিস বাটলিওয়ালা।বঙ্কিম মুখোপাধ্যায় পতাকা উত্তোলন করেন, বাবা সোহান সিং ভাকনা শহীদ প্রস্তাব উত্থাপন করেন।
পার্টির সাধারণ সম্পাদক পি সি জোশী রাজনৈতিক প্রতিবেদন পেশ করতে নয় ঘণ্টা সময় নেন। বি টি রণদিভে, ‘শ্রমিক শ্রেণী এবং মাতৃভূমি রক্ষা’র প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন। ছয়টি ভ্রাতৃপ্রতিম দল – গ্রেট ব্রিটেন, দক্ষিণ আফ্রিকা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চিলি, কিউবা এবং কানাডা – কংগ্রেসকে শুভেচ্ছা জানিয়ে তাদের বার্তা পাঠিয়েছিল, এছাড়া কংগ্রেসে শ্রীলঙ্কা এবং বার্মার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। এই সম্মেলন থেকে ১৪জনের কেন্দ্রীয় কমিটি নির্বাচিত হয়। পলিটব্যুরো সদস্য হন তিনজন-পি সি জোশী, গঙ্গাধর অধিকারী, বি টি রণদিভে, জোশী সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
দ্বিতীয় পার্টি কংগ্রেস (কোলকাতা-১৯৪৮)
স্বাধীন ভারতে সম্পূর্ণ এক নতুন পরিস্থিতিতে গণআন্দোলনের পীঠস্থান কোলকাতায় ২৮ফেব্রুয়ারি-৬মার্চ,১৯৪৮ অনুষ্ঠিত হয় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় পার্টি কংগ্রেস। অস্ট্রেলিয়া,বার্মা,সিংহল ও যুগোশ্লাভিয়া থেকে ভ্রাতৃত্বমূলক প্রতিনিধির উপস্থিতি ছাড়াও বিভিন্ন দেশের কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে অভিনন্দন বাণী পাঠানো হয়েছিল। নির্বাচিত ৯১৯ জন প্রতিনিধির মধ্যে ৬৩২ জন উপস্থিত হয়েছিলেন। তেলেঙ্গানা থেকে নির্বাচিত ৭৫জনের মধ্যে ৫জন মতন উপস্থিত হতে পেরেছিলেন। দক্ষিণ ভারতের প্রতিনিধিদের কয়েকজন আত্মগোপন করে কলকাতায় আসেন।স্বাধীনতার মুহূর্তে সাম্রাজ্যবাদ -বিরোধী আন্দোলনের জয়ে মানুষের উৎসবে পার্টি অংশ নিলেও কিছুদিন পর থেকে ক্ষমতা হস্তান্তরের তাৎপর্য সম্পর্কে মূল্যায়ন এর প্রশ্নে মতপার্থক্য শুরু হয়। নেহরু সরকারের জনবিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে পার্থক্য থাকা সত্বেও নতুন পর্যায়ের বিপ্লবী গণসংগ্রাম পরিচালনার কর্মসূচি নেওয়া হয় এই সম্মেলন থেকে। এই কংগ্রেসের প্রকাশ্য সমাবেশে জনতার ঢল নেমেছিল কলকাতায়। অধিবেশন সমাপ্তির ঠিক কুড়ি দিন পরে পশ্চিমবাংলায় কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ হয়। সম্মেলন থেকে ৩১ জনের কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয়। পলিটব্যুরোর সদস্য হন বি টি রণদিভে, ভবানী সেন, সোমনাথ লাহিড়ী,জি অধিকারী, অজয় ঘোষ, এন কে কৃষ্ণাণ, সি রাজেশ্বর রাও,এম চন্দ্রশেখর রাও,এস এস ইউসুফ।১৯৫০ সালের জুন মাসে কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক থেকে নতুন সদস্যদের যুক্ত করে কেন্দ্রীয় কমিটি ও পলিটব্যুরো গঠিত হয়। কেন্দ্রীয় কমিটিতে ৯জন সদস্য ছিলেন। তিনজন পলিটব্যুরো সদস্য ছিলেন সাধারণ সম্পাদক সি রাজেশ্বর রাও, এম বাসবপুন্নাইয়া, বীরেশ মিশ্র। এই কংগ্রেস থেকে বি টি রণদিভে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
তৃতীয় পার্টি কংগ্রেস (মাদুরাই -১৯৫৩-৫৪)
জাতীয় সংগ্রামের এক নতুন তরঙ্গের আহুত হয় তৃতীয় কংগ্রেস। ১৯৫৩ সালের ২৭ ডিসেম্বর থেকে ১৯৫৪ সালের ৩জানুয়ারি অবধি মাদুরাই তে এই পার্টি কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। জনবিরোধী কংগ্রেসকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করা এবং কেন্দ্র ও রাজ্য বিকল্প গণতান্ত্রিক সরকার গড়ার শ্লোগান ওঠে এই কংগ্রেস থেকে। এই কংগ্রেসের আগে গৃহীত পার্টি কর্মসূচির ভিত্তিতে কাজ করতে গিয়ে ভারতীয় বাস্তবতার সঙ্গে কিছু বিষয়ের অমিল দেখা দেয়। রাজনৈতিক মতপার্থক্য শুরু হলেও এই কংগ্রেসে সেই পার্থক্য তীব্র আকার নেয়নি। বিশ্বশান্তির সপক্ষে ভারতের ভূমিকা প্রশংসিত হয়। এই কংগ্রেসে ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠন ও গণতান্ত্রিক ঐক্যের সরকার গঠনের প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। এই কংগ্রেসে কেন্দ্রীয় কমিটিতে পশ্চিমবঙ্গের থেকে স্থান পান জ্যোতি বসু, রণেন সেন, মুজাফফর আহমেদ,ভূপেশ গুপ্ত। পলিটব্যুরোতে একমাত্র পশ্চিমবঙ্গের সদস্য ছিলেন রণেন সেন। কেন্দ্রীয় কমিটিতে ৩৯জন সদস্য ছিলেন। পলিটব্যুরোর সদস্য হন অজয় কুমার ঘোষ,হরকিষাণ সিং সুরজিৎ,পি রামমূর্তি, ই এম এস নাম্বুদিরিপাদ,এস এ ডাঙ্গে,রণেন সেন,সি রাজেশ্বর রাও,পি সুন্দরাইয়া,জেড এ আহমেদ। সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন অজয় কুমার ঘোষ।
চতুর্থ পার্টি কংগ্রেস (পালঘাট-১৯৫৬)
গণসংগ্রাম ছাড়াই উন্নয়নের তত্ত্ব খারিজ করে এই কংগ্রেস জনস্বার্থে মূল্যবৃদ্ধি, শ্রমিক ছাঁটাই, কৃষক উচ্ছেদ, করের বোঝা ও বৈদেশিক পুঁজির লুন্ঠন থেকে দেশকে বাঁচাতে গণতান্ত্রিক শক্তির সম্মিলিত সংগ্রামের ডাক দেয়। কংগ্রেসের কাজ পরিচালনার জন্য গঠিত সভাপতিমণ্ডলীতে পশ্চিমবঙ্গের দুজন ছিলেন-বঙ্কিম মুখার্জি ও রেণু চক্রবর্তী। জ্যোতি বসু ও প্রমোদ দাশগুপ্ত কলকাতার উত্তর-পশ্চিম লোকসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনের জন্য পালঘাট কংগ্রেসে যোগদান করতে পারেননি।ড.মেঘনাদ সাহার মৃত্যুতে এই কেন্দ্রের উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল।সেসময় বঙ্গ বিহার সংযুক্তিকরণ এর বিরুদ্ধে এই নির্বাচন বিরাট গুরুত্ব পেয়েছিল। মতানৈক্য থাকলেও এই সময়ে বিভিন্ন সংগ্রামে বিশেষ করে ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের আন্দোলনের প্রথম সারিতে ছিল পার্টি।এই কংগ্রেসে যে কয়েকটি প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছিল তার মধ্যে ভাষা ভিত্তিক প্রদেশ গঠনের প্রস্তাবও ছিল। এই কংগ্রেস থেকে দুটি প্রধান ধারার আত্মপ্রকাশ ঘটে- একটা শ্রেণী সহযোগিতার লাইন, অপরটি বৃহৎ বুর্জোয়াদের নেতৃত্বে বুর্জোয়া ভূস্বামীদের এই সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রামের লাইন। অপর একটি ধারা এই দুই বিপরীতমুখী কর্মপ্রয়াসের মধ্যে সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করে।
এই সম্মেলন থেকে ৩৯ জন সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয়। পলিটব্যুরোর সদস্য নির্বাচিত হন অজয় কুমার ঘোষ,ই এম এস নাম্বুদিরিপাদ,হরকিষাণ সিং সুরজিৎ, পি রামমূর্তি,এস এ ডাঙ্গে,ভূপেশ গুপ্ত,সি রাজেশ্বর রাও,পি সুন্দরাইয়া, জেড এ আহমেদ। এই সম্মেলন থেকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন অজয় কুমার ঘোষ।
পঞ্চম কংগ্রেস (অমৃতসর-১৯৫৮)
১৯৫৮ সালের ৬ থেকে ১৪ এপ্রিল অমৃতসরে পার্টির পঞ্চম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়।কেরালায় প্রথম কমিউনিস্ট নেতৃত্বাধীন সরকার গঠনের প্রেক্ষাপটে রাজ্যে রাজ্যে বিকল্প গণতান্ত্রিক সরকার গঠনের সম্ভাবনার প্রসঙ্গ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে এই কংগ্রেসে। নির্দিষ্ট হয় পার্টিকে গণপার্টিতে পরিণত করে শান্তিপূর্ণভাবে সংসদীয় পথে চলার লক্ষ্য। অন্যদিকে শ্রেণী সহযোগিতার লাইন খারিজ করে পঞ্চম পার্টি কংগ্রেস একইসঙ্গে কংগ্রেস দল ও দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করার আহ্বান জানায়। এই সম্মেলন থেকে ১০১ সদস্যের জাতীয় পরিষদ গঠিত হয়। কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ছিলেন ২৫ জন। কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন: অজয় কুমার ঘোষ,এ কে গোপালন,বি টি রণদিভে, এস এ ডাঙ্গে, ভূপেশ গুপ্ত, পি সি জোশী, এম বাসবপুন্নাইয়া, জেড এ আহমেদ। এই সম্মেলন থেকে সাধারণ সম্পাদক পদে অজয় কুমার ঘোষ পুনরায় নির্বাচিত হন।
ছবিঃ কিছুক্ষেত্রে নির্দিষ্ট ছবি না মেলায় প্রাসঙ্গিক ছবি ব্যবহৃত হয়েছে