স্বাধীনতার লড়াই, দেশপ্রেমের খতিয়ান- সুজন চক্রবর্তী…


দেশদ্রোহী কারা?


এ দেশের স্বাধীনতার লড়াই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ঘটনাবহুল। দীর্ঘ ইতিহাস সংগ্রামের। নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধানের ভারতবর্ষ। নানান চিন্তা, নানান ধারা-উপধারা। অজস্র, অসংখ্য সংগ্রাম। অজস্র-অসংখ্য স্রোতধারা।


তিনটি মূল ধারাকে আবর্তিত করে আমাদের স্বাধীনতার লড়াই। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ধারা, যার নেতৃত্ব দিয়েছে কংগ্রেস। কংগ্রেস তখন একটা মঞ্চ। তার মধ্যেই নানান প্রবাহ। চরমপন্থী, নরমপন্থী। কমিউনিস্ট, সোস্যালিষ্ট। ডোমিনিয়ন ষ্ট্যাটাস কিংবা পূর্ণ স্বরাজ। হিন্দু-মুসলমান, সবাই। অনেকক্ষেত্রেই, যে যার ধারণার পার্থক্য নিয়েই। আপোষকামিতা কিংবা সংগ্রামী চরিত্র – সব ধরণের অংশ নিয়েই জাতীয় আন্দোলনের নানান ধারার মানুষের মধ্যে ব্যাপক প্রভাব নিয়ে কংগ্রেস, স্বাধীনতার লড়াইয়ের একটা মঞ্চ। একই সাথে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিপ্লববাদী আন্দোলনের ধারা। আপোষ কিংবা অহিংসা নয়, বৃটিশের চোখে চোখ রেখে লড়াই। পথের ঠিক ভুল যাই থাক না কেন, নিখাদ দেশপ্রেম। বন্দুকের গুলি কিংবা ফাঁসির দড়ি কোনদিন ওদের আপোষহীন লড়াই কিংবা বিশ্বাসকে টলাতে পারেনি। বোমা-গুলির আক্রমণ আর সংগ্রামী চেতনায় বৃটিশকে নাস্তানাবুদ করার ব্রত। আর ছিল সংগঠিত গণআন্দোলনের ধারা। শ্রমিক-কৃষকের সংগঠিত গণআন্দোলনের বিকাশ ঘটানো। ছাত্র-যুব-মহিলা-লেখক-শিল্পী বিভিন্ন অংশের সংগঠিত শক্তির সমাবেশ। দুনিয়ার অগ্রসরমান চিন্তাকে সঙ্গে নিয়ে মানব মুক্তির আন্দোলন। নভেম্বর বিপ্লবের প্রভাব তখন বাড়ছে। বামপন্থার মনোভাব বাড়ছে। গড়ে উঠছে কমিউনিস্ট পার্টি। সমাজতন্ত্রের ধারণা এবং স্বপ্নগুলো ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে। জন্ম নিয়েছে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কমিউনিস্টদের সংগঠন গড়ে উঠছে। তারা স্বাধীনভাবে কাজ করছে। প্রয়োজন মত কংগ্রেসের সঙ্গে থেকেও স্বাধীনতা সংগ্রামে শরিক হচ্ছে। মতাদর্শগত আলাপ-আলোচনায় দেশের মানুষের লড়াইকে অর্থবহ করে তুলেছে। মতাদর্শে দৃঢ়, সংগ্রামী চেতনায় আপোষহীন সংগঠিত একটা প্রয়াস। সংগ্রাম, ইতিহাস এবং সমসাময়িক বিভিন্ন দলিলেই এই তিনটি ধারার উপস্থিতি স্পষ্ট।


দেশের স্বাধীনতার লড়াইতে যাদের বৃটিশ বিরোধী সংগ্রামী, অথবা দেশপ্রেমিক কোন ভুমিকাই ছিল না, তারা হঠাৎ দেশপ্রেমিক সাজতে চাইছে। বৃটিশের পদলেহনকারী, বিশ্বাসঘাতক এই শক্তি তাই অন্য সবাইকেই দেশদ্রোহী হিসাবে চিহ্নিত করতে চায়। স্বাধীনতার লড়াই এর উজ্জ্বল ঐতিহ্য যাদের – তারা নাকি দেশদ্রোহী! সেলুলার জেলের অমানুষিক, কঠিন জীবনকে যারা জয় করেছেন, আপোষহীন, সংগ্রামী, চেতনাবদ্ধ – তারা নাকি দেশদ্রোহী! দেশের সংবিধানকে তছনছ করার প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে যারা – তারা নাকি দেশদ্রোহী! গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে রক্ষার লড়াইতে যারা অকুতোভয়, ওদের বিবেচনায় তারা দেশদ্রোহী। কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয়ের অসংখ্য প্রতিবাদী – তারা দেশদ্রোহী? শ্রমিক-কৃষক অজস্র মানুষ, যারা অধিকারের দাবীতে লড়ছে – তারা দেশদ্রোহী? আর যারা বৃটিশের বিরুদ্ধে লড়াইতে কোন দিন অংশ নেয়নি – তারা দেশপ্রেমিক? যারা দেশের সংবিধানের মূল মর্মবস্তু তছনছ করতে চায় – তারা? যারা মানুষের অধিকার, ব্যক্তিস্বাধীনতা, গণতন্ত্র অথবা ধর্মনিরপেক্ষতাকে ভেঙে গুড়িয়ে দিতে চায়, তারা দেশপ্রেমিক?


আর এস এস-এর ইতিহাসে ছদ্ম দেশেপ্রেমের আখ্যান ছত্রে ছত্রে স্পষ্ট। বৃটিশ বিরোধী স্বাধীনতার লড়াই এর ইতিহাসে এরা সেই ভুমিকাই নিয়েছিল, যা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে রাজাকাররা নিয়েছিল। স্বাধীনতার লড়াইতে এদের বৃটিশ বিরোধী সংগ্রামের কোন ধারাই নেই। যা কিছু আছে, তা দালালীর। সেই ধারার না আছে কোন আপোষহীন বিপ্লবী, না আছে কোন শহীদ। স্বাধীনতার লড়াইয়ের চাইতে বৃটিশের দালালীতেই যাদের আগ্রহ, দেশের মানুষের মধ্যে বিভাজন, ঘৃণা ছড়ানো আর দাঙ্গার পরিস্থিতি এবং সুযোগ নেওয়াতেই তাদের আগ্রহ। তারা ঠিক করবে দেশদ্রোহী কারা? দেশপ্রেমের সার্টিফিকেট দেবার দোকান খুলবে তারা? দেশের মানুষ কখনো তা মেনে নিতে পারে না। ইতিহাস, বর্তমান কিংবা ভবিষ্যত – কোন মতেই তাকে প্রশ্রয় দিতে পারে না।

ক্রমশ…

লেখাটি সম্পূর্ণ ৬টি পর্বে প্রকাশিত হবে…

Spread the word

Leave a Reply