ই ভি এম, ভি ভি প্যাট এবং ইলেক্টোরাল বন্ড প্রসঙ্গে
তারিখঃ সোমবার, ২২শে মার্চ, ২০২১
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র সাধারণ সম্পাদক ভি ভি প্যাট যুক্ত ই ভি এমের কার্যকারিতা এবং নির্বাচনে ইলেক্টোরাল বন্ডের প্রভাব সম্পর্কে ভারতের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিককে চিঠি লিখেছেন। সেই চিঠিরই সম্পূর্ণ বয়ান বাংলায় রাজ্য পার্টির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হল।
মাননীয় শ্রী অরোরা জী,
২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের পরে দেশের বিবিধ রাজনৈতিক দল এবং জনসাধারনের মধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গে কিছু ন্যায্য প্রশ্নের উদয় হয়েছে। সেই সংক্রান্ত কিছু বিষয়ে ভারতের নির্বাচন কমিশনের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেই আমি এই চিঠি লিখছি।
সমস্ত প্রশ্ন দুটি ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট রয়েছেঃ
ক) ভিভিপ্যাটের সাথে ইভিএম’র কার্যকারিতা
এবং
খ) সবার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতার সমান সুযোগসহ স্বচ্ছ নির্বাচনী প্রক্রিয়া সম্পর্কে নিশ্চিত হতে অর্থ এবং ইলেক্টোরাল বন্ডের প্রভাব প্রসঙ্গে
এই দুটি প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টে ইতিমধ্যেই অনেকগুলি পিটিশন জমা হয়েছে। যদিও সেইসব আবেদনে এখনও কোন শুনানি হয় নি।
সিটিজেন্স কমিশন অন ইলেকশন্স ( সি সি ই ) নামে একটি সামাজিক সংগঠনের তরফে ভারতে ব্যবহার হওয়া ইভিএম এবং ভিভিপ্যাট সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। সাইবার সিকিউরিটি এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ক্ষেত্রে একাধিক বিশেষজ্ঞের মতামতের ভিত্তিতে সেই প্রতিবেদনে কিছু বৈধ প্রশ্ন তোলা হয়েছে।
নির্বাচনী গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় কোন দেশে নির্বাচনী বিধি সংক্রান্ত প্রকরণ প্রায় পুরোটাই নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের উপরে, আমাদের দেশে নির্বাচন কমিশনই হল সেই প্রতিষ্ঠান। সংবিধানের ৩২৪ নম্বর ধারা অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনই এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে চুড়ান্ত।
যথাযথ নির্বাচনের কাজ প্রক্রিয়াগত স্বচ্ছতার উপরে নির্ভরশীল এবং নির্বাচন কমিশনের তরফে ঘোষিত অঙ্গীকারসমূহকে প্রমানস্বাপেক্ষ হতে হয়। অথচ এই দুটি বিষয়েই ২০১৯ সালের নির্বাচনের প্রসঙ্গে নির্বাচন কমিশনের প্রতিক্রিয়া বহু ক্ষেত্রেই উল্লেখযোগ্যভাবে অপর্যাপ্ত প্রতিপন্ন হয়েছে। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র পক্ষ থেকে আমরা এমন একাধিক অভিযোগ নথিভুক্ত করেছিলাম যেগুলির প্রতি হয় অত্যাল্প নজর দেওয়া হয়েছে অথবা কোন ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হয় নি।
সিটিজেন্স কমিশন অন ইলেকশন্স ( সি সি ই ) যা কিছু প্রতিবেদনে প্রকাশ করেছে তার খুঁটিনাটির প্রসঙ্গ ব্যাতিরেকেও বলা যায় ভি ভি প্যাট যুক্ত ই ভি এম-এর কার্যকারিতা সম্পর্কে তারা কিছু বৈধ প্রশ্নই উত্থাপন করেছেন। আমরা মনে করি স্বচ্ছ নির্বাচনের প্রয়োজনে প্রশ্নগুলির সমাধান হওয়া একান্ত প্রয়োজন। ভোটারের ইচ্ছানুযায়ী প্রার্থীর পক্ষেই তার ভোটদান নিশ্চিতকরণের উদ্দেশ্যেই ২০১৩ সালের নির্বাচনে ভি ভি প্যাটের বন্দোবস্ত করা হয়েছিল। ভোটদান সঠিক হয়েছে বুঝতে ভি ভি প্যাট থেকে যে কাগজ ভোটদানের সময় মুদ্রিত আকারে প্রকাশিত হয় তাকে ঘিরেই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠছে। যার নামে ভোট পড়ল সেই নির্দিষ্ট প্রার্থীর নামই ভি ভি প্যাটে মুদ্রিত হয়। কিন্তু ভি ভি প্যাটের সেই তথ্য ই ভি এমের কন্ট্রোল ইউনিট যা ভোট গননার কাজে ব্যবহার হয় তাতে নথিভুক্ত হয় কিনা কেউ জানে না। প্রযুক্তিগত দিক থেকে বলা যায় ভিভিপ্যাটে মুদ্রনের নির্দেশটি ইভিএমের ব্যালট ইউনিট থেকে কন্ট্রোল ইউনিট ঘুরে তবেই প্রেরিত হয়। এইবারের নির্বাচনে ইভিএমের যে তিনটি ইউনিট ব্যবহৃত হবে তার নির্দেশ প্রেরণের ক্রম যদিও আলাদা। সেই কারনেই নির্দেশের ক্রম সংক্রান্ত প্রশ্নটি এত গুরুত্বপূর্ণ। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক যে নির্বাচন কমিশনের কাছে এই প্রশ্নে এখনও কোন উত্তর নেই। ফলে ব্যালট ইউনিটে নির্বাচকের পছন্দ সঠিকভাবে ভিভিপ্যাটে প্রতিফলিত হওয়া সংক্রান্ত দুশ্চিন্তা রয়েই যাচ্ছে। যে সমস্ত বিধানসভা ক্ষেত্রে এইবার নির্বাচন হবে সেই সংখ্যার পরিপ্রেক্ষিতে এখনও অবধি ব্যালট ইউনিটে সংযুক্ত করার মতো উপযুক্ত সংখ্যায় ভিভিপ্যাটও নেই।
নির্বাচনের কাজে স্বচ্ছতা বজায় রাখার প্রশ্নে ভিভিপ্যাটের গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রয়েছে। ভিভিপ্যাট ব্যবভার হবার আগে ইভিএমের সুরক্ষার বিষয়টি এই কারনেই নিশ্ছিদ্র ধরা হত যে ইভিএমে ব্যাবহৃত চিপটি প্রার্থীদের নাম এবং নির্বাচনী প্রতীক সম্পর্কে কোন তথ্য না রেখেই কাজ করতে পারে। এর পরেও মক পোলিং হতো এবং ইভিএম সিল করার ব্যাবস্থা ছিল। ভিভিপ্যাট সংযুক্ত হবার পরে গোটা ব্যাপারটাই বদলে গেছে। এখন ইভিএমে প্রার্থীদের নাম এবং নির্বাচনী প্রতীক সম্পর্কিত সমস্ত তথ্যই যুক্ত করা থাকছে। ভিভিপ্যাটের কাগজে প্রার্থীর নাম মুদ্রিত হবার শর্ত হিসাবে এই বন্দোবস্ত করা হয়েছে। সেই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য প্রযুক্তিগত সহায়তায় একটি বেসরকারি এজেন্সি কাজ করেছে। ফলে যদি ইভিএম কারসাজি হয়ে থাকলে কন্ট্রোল ইউনিটের দ্বারা ভিভিপ্যাটেও কারসাজি করার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। এই মর্মে নির্বাচন কমিশন এখনও অবধি কোন প্রতিক্রিয়াও জানায় নি।
প্রচারের কাজে অর্থ ব্যবহারের প্রসঙ্গটিও একইরকম গুরুত্বপূর্ণ। ইলেক্টোরাল বন্ড ব্যবহার করা ফলে কর্পোরেট অনুদানের বিষয়টিকে সম্পূর্ণ অস্বচ্ছ হয়ে গেছে। আমরা নির্বাচন কমিশনকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, সর্বোচ্চ আদালতের সামনে কমিশনের পক্ষ থেকেই দুবার জানানো হয়েছিল যে ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে নির্বাচনী তহবিলে অর্থদান সংক্রান্ত হিসাবকে নির্বাচন কমিশনের পক্ষে নজরদারিতে আনা সম্ভব নয়। এই প্রসঙ্গে সর্বোচ্চ আদালত কোন জরুরী ভিত্তিক নির্দেশ জারী করেনি। ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে নির্বাচনী তহবিলে কর্পোরেটদের টাকা যোগানোকে নজরদারির আওতায় আনার কাজ কীভাবে করা হবে তা এখনও নির্ধারিত হয় নি, অথচ স্বচ্ছ নির্বাচনের প্রশ্নে প্রত্যেকের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ক্ষেত্রে সমতা রক্ষার বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের দায়বদ্ধতা সম্পর্কে সংবিধানের ৩২৪ নং ধারায় স্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে।
খবরে প্রকাশিত, ২০২১ সালের ১লা এপ্রিল নতুন করে আরেকবার ইলেক্টোরাল বন্ড বিতরন করা হবে। এখনও অবধি পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বলা যায়, এযাবৎ ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে যত অর্থ জমা হয়েছে তার ৫২ শতাংশই হয়েছে বিজেপি’র খাতায়। বাকি অর্থটুকু জমা হয়েছে দেশের অন্যান্য সবকটি রাজনৈতিক দলের কাছে। দ্য অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্র্যাটিক রিফর্মস (এ ডি আর) -এর প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে ব্যাবহৃত মোট ইলেক্টোরাল বন্ডের ৯৫ শতাংশই বিজেপির হাতে গেছিল। খুবই স্বাভাবিকভাবেই এমন হলে তার প্রভাবে বিরুদ্ধ প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে। একদিকে বিজেপির পক্ষে এক বিরাট আর্থিক সংস্থানের হদিশ পাওয়া যায়। আরেকদিকে সেই বিরাট অংকের অর্থ ব্যবহারে নজরদারি চালানোর ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের কোন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেই। এই পরিস্থিতিতে আমাদের পক্ষে আর কোন উপায় নেই আর তাই আমরা দাবী করতে বাধ্য হচ্ছি –
ক) ইভিএমের তিনটি অংশকে পুনরায় একযোগে অনুক্রমিক নির্দেশ বহনের উপযোগী করে তোলা হোক, যাতে ব্যালট ইউনিটে নির্বাচকের পছন্দের ভোট কন্ট্রোল ইউনিটে নথিভুক্ত থাকে এবং তারপরেই সঠিকভাবে ভিভিপ্যাটে মুদ্রিত হয়।
খ) প্রত্যেক বুথেই ভিভিপ্যাটের আউটপুটের সাথে ইভিএমের কন্ট্রোল ইউনিটে নথিভুক্ত তথ্যের একশো শতাংশ সদৃশতা প্রয়োজন।
গ) নির্বাচনে অসাধু উদ্দেশ্যে বিশাল পরিমান অর্থের ব্যবহার রোধের বন্দোবস্ত সম্পর্কে সর্বোচ্চ আদালতের সামনে নির্বাচন কমিশন যে হলফনামা জমা করেছে তার বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশ করতে হবে। একইসাথে সেই বন্দোবস্তের কাজে কতদূর এগোনো গেছে তাও জানাতে হবে।
যেহেতু পাঁচটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের ঘোষণা ইতিমধ্যেই হয়ে গেছে এবং সেইসব রাজ্যে প্রচারের কাজও শুরু হয়ে গেছে তাই অত্যন্ত দ্রুততার সাথে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে যাতে জনসাধারনের মনে ভোটদানে স্বচ্ছতার বিষয়ে কোন সংশয় না থাকে। নির্বাচন কমিশনের কাজে স্বচ্ছতার সাথেই নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় বিশ্বাসযোগ্যতার প্রশ্নটি একান্তভাবে সংযুক্ত।
ধন্যবাদ ও অভিনন্দন সহ
সীতারাম ইয়েচুরি
সাধারণ সম্পাদক
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)