শেক্সপিয়ার লিখেছিলেন “What’s in a name? That which we call a rose/By any other name would smell as sweet।” পাতি বাংলায় বলতে গেলে নামে কি এসে যায়? যে নামেই ডাকুন গোলাপের সুগন্ধ একই থাকবে। ঠিকই বলেছেন তো!
যেমন ধরুন আমাদের গ্রামের প্রবীণ যাত্রা শিল্পী সুকুমার কাকু। একসময় গ্রামে গ্রামে দাপিয়ে পৌরাণিক যাত্রাপালায় অভিনয় করতেন দাপিয়ে। ফেভারিট চরিত্র ভীম। সখ করে সুকুমার কাকু নিজের ছেলের নামও রেখেছিলেন ভীম। পালোয়ান দুরস্ত বড় হয়ে ‘ভীম’ বরং হল তালপাতার সেপাই।
এই যে, ইংলিশ সুইং কে কে কাবু করে ম্যানচেস্টার টেস্টে ঝকঝকে ৬৯ করে এখন ক্রিকেট দুনিয়ায় চর্চায় পাকিস্তানের ব্যাটসম্যান বাবর আজম। না যতই বাবর হোক না কেন, টিভি খুলে এনাকে দেখতে বসলে হাতে ব্যাট পাবেন। তরবারি তো আর পাবেন না। যার নাম ‘খোকা’, তিনি কি সারাজীবন হামাগুড়িই দেবেন? যিনি ‘স্পন্দন’, তিনি কি নিরন্তর,নিরলস ধকধকই করবেন? জর্জ বুশের সাথে কি ঝোপ-ঝাড়ের কোনও সম্পর্ক ছিল? ‘পটলচেরা’ চোখ যদি সবার এত প্রিয়ই হবে, তাহলে পটল চিরে কে দোরমা কে বানাবে? আরে মশাই চুলোয় যাক শেক্সপিয়ার। আপনিই বলুন তো নাম দিয়ে কি যায় আসে?
অ্যাটম বোমের নাম যদি ‘লিটল বয়’র মত কিউট আর ‘ফ্যাট ম্যান’র মত, আলুভাতে মার্কা হতে পারে, বিস্ফোরণের ফলে নিঃসৃত ধোঁয়ার নাম যদি ‘মাশরুম ক্লাউড’র মত তুলতুলে হতে পারে, তাহলে কানা ছেলের নামও তো পদ্মলোচন হতেই পারে। আলবাত পারে।
২ বিলিয়ন ডলারের ম্যানহাটন প্রজেক্টের, ট্রিনিটি সাফল্যের পর, হিরোহিতোর রণ ক্লান্ত, ‘বেয়াড়া’ জাপান কে শিক্ষা দেওয়ার অজুহাতে, পারমাণবিক বিস্ফোরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট তার নামও ছিল– ‘ট্রুম্যান’। কতটা ট্রু আর কতটা ম্যান সেই আলোচনা না হয় বকেয়া রইলো।
হিরোশিমা আর নাগাসাকির ইতিহাস মানব সভ্যতার লজ্জা। এত নৃশংসতা আগে দেখেনি পৃথিবী। এক মুহূর্তে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু, অসংখ্য মানুষকে তিল তিল করে অনিবার্য মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া, জনপদের পর জনপদ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া। সুদ বাবদ তেজস্ক্রিয়তার অভিশাপ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ যে কত ভয়ঙ্কর, কতটা মানবঘাতী হতে পারে, তা প্রত্যক্ষ করে সেদিন বিস্ময়ে বোবা হয়ে গিয়েছিল বিশ্ব।
১৯৪৫ সালের ৬আগস্ট সকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনী জাপানের হিরোশিমা শহরের ওপর ‘লিটল বয়’ এবং এর তিন দিন পর নাগাসাকি শহরের ওপর ‘ফ্যাটম্যান’ নামের দুটি পারমাণবিক বোমা ফেলে। এই হামলায় হিরোশিমায় প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার নাগাসাকিতে তৎক্ষণাৎ ৭৪ হাজার লোক মারা যান। বোমার প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্ট রোগগুলোর ওপর হাসপাতাল থেকে পাওয়া গণনার তথ্য অনুযায়ী হিরোশিমায় ২ লাখ ৩৭ হাজার এবং নাগাসাকিতে ১ লাখ ৩৫ হাজার লোকের মৃত্যু ঘটে। যারা এখনো বেঁচে আছেন, তাদেরও ওই তেজস্ক্রিয়তার উত্তরাধিকার বহন করতে হচ্ছে।
” ….চারিদিকে নিকষ অন্ধকার। পায়ের সামনে, রক্তে আর ধুলোয় মাখামাখি খান পঞ্চাশ লাশ। কারো পাকস্থলী বেরিয়ে গেছে। কারো চোখ উপড়ে এসেছে। কারো হাত নেই। লাশগুলো গাদা করে আগুন ধরিয়ে দিলাম। হঠাৎ মনে হল ওই আলো-আন্ধারি পথে থপথপ করে কেউ হেঁটে বেড়াচ্ছেন। সামনে আসতে বুঝলাম ২৪-২৫ বছরের এক মহিলা। শরীরের পুড়ে যাওয়া অংশগুলি থেকে পুঁজ বেরোচ্ছে। এখান ওখান থেকে গলা চামড়া গুলো ঝুলছে। একটা মৃত শিশু কে বুকে আঁকড়ে, আমাদের এসে বলল, আমার ছেলে কে বাঁচিয়ে দিন।সান্ত্বনা দিয়ে তার মৃত শিশুকেই কোলে তুলে, বললাম আপনার নিজেরই চিকিৎসা দরকার। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের পায়ের কাছে লুটিয়ে পরে মেয়েটি মারা গেল। সন্তান কে বাঁচানোর তাগিদেই আগুন থেকে বেরিয়ে এসেছিল সে।…”
(হিরোশিমার-নাগাসাকির একজন ত্রাণ কর্মী, নাকারচি নাকামুরার, জবানবন্দী)
জাপান আত্মসমর্পণ করেছিল। যুদ্ধও থেমেছিল। ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার কালগর্ভে, আলোচনা, সমালোচনার গোল টেবিলের, NPT, CTBT চুক্তির আর, ‘পারস্পরিক বিশ্বাসের’ নিরিখে ধীরে ধীরে পারমাণবিক অস্ত্র নষ্ট করে ফেলার গপ্পের দুধ কলায়, বিশ্বজুড়ে গত সত্তর বছরে, প্রায় কুড়ি হাজারের বেশি পারমানবিক অস্ত্রের কালসাপ পোষা হয়েছে। এখন বিশ্বে যত পরমাণু অস্ত্র আছে, তা দিয়ে পৃথিবীকে অনেকবার ধ্বংস করা সম্ভব।
হিরোশিমা-নাগাসাকির স্মৃতি উস্কে দিয়ে ফিরে এসেছে পারমানবিক চুল্লি। ৭৯’র পেনসিলভানিয়ার থ্রি-মাইল আইসল্যান্ডে পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিস্ফোরণে তেজস্ক্রিয়তা, ১৪ বছর ধরে ১০০ কোটি ডলার দিয়ে ‘সাফাই’ করতে হয়েছে আমেরিকার সরকার কে। ৮৬ ‘র চের্ণোবিলর পর ২০০০-এ রাশিয়াও ঐ পারমানবিক কেন্দ্র বন্ধ করে দেয়। ১১তে ফুকুশিমার দাইচির দুর্ঘটনার, কুড়ি দিন পরে জাপান সরকারও পারমানবিক কেন্দ্র বন্ধ করে দেয়। একই পথে হেঁটেছে ফ্রান্সও। ‘গ্লোব-স্ক্যানের’ তেইশটি দেশের সমীক্ষায়, শতকরা ৭৮% মানুষ, এখন ‘পারমাণবিক শক্তির’ বিরুদ্ধেই, বিপক্ষেই।
আজ যারা পারমাণবিক শক্তির জোরে জামার কলার তুলে ঘুরে বেড়ান, পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হবার আনন্দে রাত্রে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে যাচ্ছেন যারা, পরবর্তী প্রজন্ম কে পারমানবিক বিদ্যুৎ চালিত টেবিল ফ্যানের হাওয়া খাওয়ানোর কথা ভাবছেন, জামাই কে পারমাণবিক চুল্লি যৌতুক দেবার স্বপ্ন দেখছেন, তারা কি হিরোশিমার-নাগাসাকির একজন ত্রাণ কর্মী, নাকারচি নাকামুরার, জবানবন্দী পড়েছেন? পারমাণবিক শক্তির হুজ্জতে নব্য দেশভক্তরা কি চের্ণোবিল ওয়েব সিরিজে দেখে ভয়াভয়তা উপলব্ধি করেছেন?
মোদী সরকার ক্ষমতার আসার পরই মিডিয়া লেজ তুলে জানিয়ে দিয়েছিল ব্যারাক ওবামার ভারত সফরের সাফল্য নাকি অভূতপূর্ব। আসলে কংগ্রেস সরকার বিরোধী’দের প্রবল বিরোধিতার কারণে নিউক্লিয়ার ডিলে ক্ষতিপূরণের বিষয়ক আমেরিকার শর্ত মেনে নেয়নি। বরং সরবরাহকারীদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয় এক আইনে। তাই ক্ষতিপূরণের প্রশ্নে বেঁকে বসে মার্কিন কোম্পানিগুলি। নিউক্লিয়ার ডিল ঠাণ্ডা ঘরে চলে যায়। ওবামার সঙ্গে চুক্তিতে মোদী মার্কিন কোম্পানির উদ্বেগ দূর করার ব্যবস্থা করেছেন ভারতের বীমা সংস্থার ঘাড়ে ক্ষতিপূরণে দায় চাপিয়ে দিয়ে। বর্তমান চুক্তি অনুযায়ী পরমাণু চুল্লিতে কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে আক্রান্তরা চুল্লির বিদেশি অপারেটরদের বিরুদ্ধে কোনও মামলা করতে পারবেনা। পার্টনারশিপে থাকা দেশি অপারেটররাই একমাত্র মামলা করতে পারেন আবার নাও পারেন।
আসলে সামরিক শক্তি কোন সভ্য রাষ্ট্রের উন্নতির মাপকাঠি হতে পারে না। প্রযুক্তি কোন সভ্য রাষ্ট্রের সর্বরোগহর বটিকা হতে পারে না। সভ্য রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক প্রাচুর্যর মাপকাঠি তার প্রতিরক্ষার বাজেটের জলছবি হতে পারে না। হলে হিটলারের জার্মানি সভ্যতার ইতিহাসে আজ ঘৃণিত হত না। হলে করোনা প্যান্ডেমিকের আবহে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের “উন্নতি”র অন্তঃসার শূন্যতা আজ বিশ্বের বুকে বে-আব্রু হত না।
আসলে সভ্যতা মানে সবার আগে আগে মানুষ। সত্যজিৎ রায়ের বিখ্যাত সিনেমা আগন্তুকের পৃথ্বীশকে মনে পড়ে? সে প্রশ্ন করেছিল ‘‘ক্যানিবালিজম-কে আপনি সভ্যতার কোন স্তরে ফেলবেন?’’ তির্যকতা ছিল উত্তরে: ‘‘সভ্য কে জানেন?… সভ্য হচ্ছে সেই মানুষ যে আঙুলের একটা চাপে একটা বোতাম টিপে একটা ব্রহ্মাস্ত্র নিক্ষেপ করে একটা গোটা শহরকে সমস্ত অধিবাসীসমেত ধ্বংস করে দিতে পারে।’’
আমি রক্তস্নাত হিরোশিমা কে জেনেছি। নাগাসাকি কে চিনেছি। আমি ভিয়েতনামের নাপামের শিশুর আর্তনাদ শুনেছি। আমি আইলান কুর্দির লাশ গুনেছি। আমি কাশ্মীর বুঝেছি, প্যালেস্টাইনের দেখেছি। যুদ্ধের শহীদের মৃত্যু শোকের শীতলতা অনুভব করেছি। যুদ্ধে গিয়ে নিখোঁজ আপনজনের অপেক্ষার যন্ত্রণা টের পেয়েছি। তাই, যুদ্ধ আমার কাছে ফ্যান্টাসি না। যুদ্ধ আমার কাছে রোমাঞ্চ না। যুদ্ধ আমার কাছে পাড়ার মোড়ে চায়ের কাপের চুমুক কিম্বা আপিসের রাজনীতির আড্ডার উদ্ধত তর্জনীর বন্দুক না। যুদ্ধ আমার কাছে দেশপ্রেমও না। যুদ্ধ আমার কাছে কাউন্টার স্ট্রাইকের ভিডিও গেম না।
সমস্ত কিছু লণ্ডভণ্ড করে যুদ্ধ যেদিন হবে, ওঁদের দেশের ইতিহাস বইয়ে ওরা সেদিন জিতবে, আমার দেশের ইতিহাস বইয়ে আমরা। তাই সেদিন শহীদ জওয়ানের লাশের পাহাড়ে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ জয় সেলিব্রেট করে সভ্যতার জয়গান আমি গাইতে চাই না। শহীদ জওয়ানের রক্ত ভেজা মাটিতে যুদ্ধ জয়ের উল্লাসে আমি মাততে চাই না। শহীদ পরিবারের মরা কান্নার চোখের জলে দেশপ্রেমের পুণ্য স্নান আমি করতে চাই না।
বন্ধ হোক যুদ্ধ। বন্ধ হোক রক্ত। চায়ের কাপে বিতর্কের তুফান উঠে ঢেউ পৌঁছে যাক পার্লামেন্ট ঘুরে রাষ্ট্রসংঘে, পরমাণু শক্তিধর দাদাদের দাদা-গিরি বন্ধ করে, দশমী তে অস্ত্র ভাণ্ডারের বিসর্জন দিয়ে, অনির্দিষ্ট কালের জন্য, নতুন অস্ত্র তৈরিতে বিশ্বজুড়ে পালিত হোক একাদশীর নির্জলা উপোষ। নাহলে মানব সভ্যতার ময়নাতদন্তে, ভূমিকম্প, আগ্নেয়গিরি, হিমবাহ, গ্লোবাল ওয়ার্মিং, মহাজাগতিক রহস্য কিম্বা এলিয়েন নয়, রক্ত দিয়ে লেখা থাকবে অনিয়ন্ত্রিত শক্তি ও প্রযুক্তির এই ব্যবহারের কথাই।
নাগাসাকি ও যুদ্ধ জিগির – সুশোভন পাত্র…
Spread the word