general-strike-2025

9 July Strike: The Labour Hour

গার্গী চ্যাটার্জী

‘যে শ্রম ঘামে ভেজে, সেই ঘামেই গড়ে ওঠে সভ্যতা’—এ কথা নতুন নয়। কিন্তু এই সভ্যতাই যখন মুনাফার নেশায় শ্রমিকের ঘাম, রক্ত ও জীবনকে বিনিময়মূল্য করে তোলে, তখন সেই সভ্যতা আর মানুষের থাকে না, পুঁজির দাসত্বে বন্দি হয়ে পড়ে।

ভারতের বর্তমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে নয়া শ্রমকোডের মাধ্যমে শ্রমঘণ্টা বৃদ্ধির যে বিপজ্জনক প্রবণতা স্পষ্ট হচ্ছে, তা আসলে এই পুঁজিবাদী শোষণেরই আরেকটি নগ্ন রূপ।

ভারত স্বাধীনতা-উত্তর যুগে শ্রমিকদের অধিকার রক্ষার জন্য যে শ্রম আইন কাঠামো গড়ে তুলেছিল, তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল ন্যায্য ও সীমিত শ্রমঘণ্টা। কিন্তু আজ রাজ্য সরকারগুলিকে ব্যবহার করে, ‘সংস্কার’ আর ‘উন্নয়ন’-এর মিথ্যা বুলি আওড়িয়ে- সেই কাঠামোই কর্পোরেট স্বার্থে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে—রাজ্য সরকারগুলিকে ব্যবহার করে, ‘সংস্কার’ আর ‘উন্নয়ন’-এর মিথ্যা বুলি আওড়িয়ে।

শ্রমঘণ্টা নিয়ন্ত্রণের ইতিহাসএকটি সংক্ষিপ্ত পটভূমি

১৮-১৯ শতকের শিল্প বিপ্লবের সময় শ্রমিকরা একটানা ১৪-১৬ ঘণ্টা এমনকি ১৮ ঘণ্টা কাজ করতে বাধ্য হতেন। শিশু শ্রমিকও এই শোষণের বাইরে ছিল না। এই অমানবিক অবস্থার বিরুদ্ধে পশ্চিমি দেশগুলোতে যখন শ্রমিক আন্দোলন শুরু হয়, তখনই ‘৮ ঘণ্টার কাজ, ৮ ঘণ্টার বিশ্রাম, ৮ ঘণ্টা নিজের জন্য’—এই স্লোগান ইতিহাস গড়ে দেয়।

ভারতে ব্রিটিশ শাসনকালে রাজ্য সরকারগুলিকে ব্যবহার করে, ‘সংস্কার’ আর ‘উন্নয়ন’-এর মিথ্যা বুলি আওড়িয়ে কিছু শ্রম আইন তৈরি হয়, কিন্তু স্বাধীনতার পর শ্রমিকদের আন্দোলনের জোরেই Factories Act, 1948 কার্যকর হয়, যা দৈনিক ও সাপ্তাহিক কাজের সময় বা শ্রমঘণ্টা সীমিত করে দেয়। পাশাপাশি Shops and Establishments Act শহরাঞ্চলের দোকান, অফিস, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের শ্রমঘণ্টা নিয়ন্ত্রণে রাখে।

এই আইনগুলি যদিও পুঁজিবাদী শোষণ পুরোপুরি বন্ধ করতে পারেনি, কিন্তু শ্রমিক শ্রেণিকে ন্যূনতম বিশ্রাম ও জীবনের অধিকার কিছুটা হলেও নিশ্চিত করেছিল।

করোনার পরবর্তী সময়ে শ্রম সংস্কারের নামের আড়ালে শোষণের পুনর্জন্ম

২০১৯-২০২০ সালে করোনা অতিমারী যখন শ্রমিকদের জীবন-জীবিকা বিপর্যস্ত করল, ঠিক তখনই কেন্দ্রের বিজেপি সরকার শ্রম আইনগুলিকে নতুন করে ‘সংহত’ করার নামে Code on Wages, Code on Industrial Relations, Code on Social Security এবং Occupational Safety, Health and Working Conditions Code (OSH Code) পাশ করল।

নতুন OSH Code-এ সপ্তাহে ৪৮ ঘণ্টার সীমা রাখা হলেও স্প্রেড ওভার ১২-১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত ও ওভারটাইম সীমা বাড়িয়ে দেওয়া হল ১২৫ ঘণ্টা পর্যন্ত। রাজ্যগুলিকে বলা হল নিজেদের প্রয়োজনে আরও বিধি তৈরি করতে। এটাই কর্পোরেটদের জন্য খোলা লাইসেন্স—যে রাজ্য যত কর্পোরেট ঘনিষ্ঠ, তারা তত কাজের সময় বা শ্রমঘণ্টা বাড়াবে, শ্রমিকের পিঠে চাবুক ফেলবে। নীচের উদাহরণ কটি তার একটি স্পষ্ট চিত্র ।

১. অন্ধ্রপ্রদেশ: নতুন সরকার (NDA জোটের শরিক তেলেগু দেশম পার্টি) ঘোষণা করেছে—সব কারখানা ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে দৈনিক শ্রমঘণ্টা ৯ থেকে বাড়িয়ে ১০ ঘণ্টা করা হবে। এর অর্থ মাসিক ওয়ার্কিং আওয়ার বাড়বে, অথচ বেতন বৃদ্ধির কোনো নিশ্চয়তা নেই।

২. কর্ণাটক: ২০২৩ সালে Factories (Karnataka Amendment) Act পাস করে শ্রমঘণ্টা ১২ পর্যন্ত বাড়ানোর অনুমতি দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি টানা ৬ ঘণ্টা একটানা কাজের বিধান চালু হয়েছে। ত্রৈমাসিক ওভারটাইম সীমা ৭৫ ঘণ্টা থেকে এক লাফে ১৪৫ ঘণ্টা করা হয়েছে— যা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সম্পূর্ণ বিপরীত।

আই.টি ও বিপিও’র ক্ষেত্রে ১২ ঘণ্টারও বেশি কাজের ছাড় দেওয়ার চেষ্টাও হয়, যদিও KITU (Karnataka IT/ITeS Employees Union)-এর আন্দোলনে তা আপাতত স্থগিত হয়েছে।

৩. তেলেঙ্গানা: রাজ্য সরকার চার বছরের জন্য IT এবং ITeS ক্ষেত্রে শ্রমআইনের প্রায় সমস্ত নিয়ম থেকে ছাড় দিয়েছে। এর অর্থ: কোনো নির্দিষ্ট ‘ওয়ার্কিং আওয়ার’ নেই, কোনো ওভারটাইম সীমা নেই, অসুস্থতা, মাতৃত্বকালীন ছুটি, ছুটির ন্যায্য হিসাব— সবই কোম্পানির ইচ্ছাধীন।

৪. গুজরাট: নরেন্দ্র মোদির নিজের রাজ্যের কর্পোরেট-বন্ধুত্বের নয়া নজির সৃষ্টি করেছে- এই রাজ্যটি সর্বভারতীয় সাধারণ ধর্মঘটের মুখে দাঁড়িয়ে একধাক্কায় ১২ ঘণ্টা দৈনিক শ্রমঘণ্টা ঘোষণা করে অর্ডিন্যান্স জারি করেছে। এটি আসলে ধর্মঘটের আগাম প্রতিরোধের প্রচেষ্টা— শ্রমিকদের লড়াইকে ভয় দেখানো, বিভ্রান্ত করা।

৫. তামিলনাড়ু: এখানেও একই ধরনের শ্রমঘণ্টা বৃদ্ধির আইন আনার চেষ্টা হয়, কিন্তু শ্রমিক আন্দোলনের কারণে সরকার পিছু হটতে বাধ্য হয়।

পরিস্থিতি বুঝে পুঁজিবাদের মুখপাত্ররা শ্রমিকের ঘাম-রক্তের দরকষাকষিতে লিপ্ত হয়েছে-

কাজের সময় বা শ্রমঘণ্টা বাড়ানোর প্রক্রিয়ার একেবারে শীর্ষে রয়েছেন দেশের বিখ্যাত কর্পোরেট ব্যক্তিত্বরা । ইনফোসিসের সহ-প্রতিষ্ঠাতা নারায়ণ মূর্তি প্রকাশ্যে বলেছেন—‘ভারতের যুব সমাজকে সপ্তাহে ৭০ ঘণ্টা কাজ করতে হবে।’

L&T-এর চেয়ারম্যান এস এন সুব্রহ্মণ্যম তো একধাপ এগিয়ে বলেছেন—‘৯০ ঘণ্টা কাজ করাই উচিত, বাড়িতে গিয়ে কী করবে, স্ত্রীর মুখ কতক্ষণ দেখবে?’

এরা নিজেরা এক বছরে ৫০-১০০ কোটি টাকা বেতন নেন, অথচ নতুন কর্মীদের বেতন বাড়ে বছরে মাত্র ৪%। ইনফোসিসের ক্ষেত্রে ২০২৪ সালের অর্থ বর্ষে CEO-এর বেতন ছিল গড় কর্মীর বেতনের ৫০০ গুণের বেশি! এই বেতন-বৈষম্যই বলে দেয়—পুঁজিবাদের সারমর্ম কীভাবে ‘মৃত শ্রম’ জীবিত শ্রমকে চুষে খায়।

আন্তর্জাতিক মান ও বাস্তবতা: ILO রিপোর্ট

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ILO)-এর ২০২৩ সালের রিপোর্ট ‘Working Time and Work-Life Balance Around the World’ দেখিয়েছে:

  • সুস্থ কাজ-জীবনযাপনের মধ্যে ভারসাম্য থাকলে উৎপাদনশীলতা বাড়ে।
  • মানসিক স্বাস্থ্য উন্নত হয়।
  • কর্মী ও প্রতিষ্ঠানের সম্পর্ক দৃঢ় হয়।

কিন্তু ভারতের ক্ষেত্রে বাস্তবতা এই যে,

  • ILO হিসাব বলছে, ৫০.৫% ভারতীয় কর্মী সপ্তাহে ৪৯ ঘণ্টার বেশি কাজ করেন।
  • ৮৮% কর্মী কাজের সময়ের বাইরে অফিসের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করতে বাধ্য হন।
  • ৮৫% কর্মী অসুস্থ হলেও ছুটি পান না, কাজ চালিয়ে যেতে বাধ্য হন।

এভাবে একদিকে শ্রমিকের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ভেঙে ফেলা হয়, অন্যদিকে উৎপাদনশীলতা নামেই বাড়ে—আসলে শোষণ বাড়ে।

মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে শোষণ অতিরিক্ত শ্রমের সূত্র

কার্ল মার্ক্স বলেছিলেন, পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার মূল চালিকাশক্তি ‘অ্যাবসোলিউট সারপ্লাস ভ্যালু’ আর ‘রিলেটিভ সারপ্লাস ভ্যালু’।

‘অ্যাবসোলিউট সারপ্লাস ভ্যালু হ’ল – শ্রমিকের কাজের সময় বাড়িয়ে শ্রমিক থেকে যত বেশি সম্ভব অতিরিক্ত মূল্য তৈরি করা। রিলেটিভ সারপ্লাস ভ্যালু হ’ল -প্রযুক্তি ও দক্ষতা বাড়িয়ে কাজের সময়ে আরও বেশি উৎপাদন আদায় করা।

পুঁজিপতিরা কখনোই কম কাজ, বেশি মজুরি চাইবে না। তাদের স্বার্থ— অধিক শ্রম, কম মজুরি।
মার্ক্স একে ব্যাখ্যা করেছেন— ‘Capital is dead labour which, vampire-like, lives only by sucking living labour, and lives the more, the more labour it sucks.’ অর্থাৎ, ‘পুঁজি হলো মৃত শ্রম, যা রক্তচোষা পিশাচদের মতো, কেবল জীবিত শ্রম চুষে বেঁচে থাকে, এবং যত বেশি বেঁচে থাকে, তত বেশি শ্রম চুষে নেয়।’

শ্রমজীবী মানুষের লড়াই যেখানে বাঁচার স্বপ্ন বেঁচে

এই শোষণের বিরুদ্ধে শ্রমিকরা কখনোই নিশ্চুপ ছিলেন না। কর্ণাটকে KITU, তামিলনাড়ু, গুজরাট—সব জায়গায় শ্রমিক সংগঠনগুলি রাস্তায় নেমেছে। ইনফোসিস-এর ৭০ ঘণ্টা সপ্তাহের প্রস্তাব যে ক্ষোভ তৈরি করেছিল, তার জেরে ইনফোসিস পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে—তাদের বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সপ্তাহে ৪৬ ঘণ্টা ১৫ মিনিট সর্বোচ্চ কাজের সীমা নির্ধারণ করতে হয়েছে।

এ ঘটনা প্রমাণ করে—শ্রমিকদের সংগঠিত শক্তি এখনও পুঁজিবাদের একচেটিয়া ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে।

৯ই জুলাই আহুত সারাভারত ধর্মঘট নিছক এক দিনের কর্মবিরতি নয়—এই ধর্মঘটের মাধ্যমে আসলে শ্রমিক শ্রেণির সমবেত কণ্ঠস্বর সোচ্চারে সরকারের বিরুদ্ধে ঘোষণা করবে- ‘মেহনতকারী মানুষের বিরুদ্ধে- কর্পোরেট স্বার্থে নেওয়া তোমার প্রতিটি পদক্ষেপ আমরা শ্রেণী ঐক্যের অটুট সুদৃঢ় প্রাচীর দ্বারা শুধুমাত্র প্রতিরোধ করবো না, প্রয়োজনে তাকে শাণিত করে সরকারকেই পরিবর্তনের লক্ষ্যে এগোবো।’

গুজরাট সরকার যখন ধর্মঘটের মুখে ১২ ঘণ্টা কাজের বিজ্ঞপ্তি জারি করে, তখনই স্পষ্ট হয়— বিজেপি সরকার কতটা কর্পোরেট স্বার্থরক্ষায় মরিয়া। কিন্তু শ্রমিকরাও রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ধর্মঘটে সামিল হচ্ছেন। এই ধর্মঘট জানিয়ে দেবে—শ্রমিকরা পুঁজির বিরুদ্ধে কোন পথে হাঁটতে চান।

পুঁজিবাদ নয়, বিকল্প সমাজতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ

শ্রমঘণ্টা সীমিত রাখা নিছক মানবিক দয়া নয়—এটি শ্রমিক শ্রেণির রক্তঝরা লড়াইয়ের ফসল। যতক্ষণ পুঁজিবাদ থাকবে, ততক্ষণই শোষণ, বেতন বৈষম্য ও শ্রমঘণ্টা বৃদ্ধির চক্রান্ত চলতেই থাকবে।

সুতরাং, একদিনের ধর্মঘটই যথেষ্ট নয়—এই লড়াইকে বৃহত্তর সংগঠিত আন্দোলন, বিকল্প অর্থনৈতিক ব্যবস্থার দিকে নিয়ে যেতে হবে, যেখানে কাজ হবে মানুষের জন্য, মুনাফার জন্য নয়।

আজকের ভারতবর্ষে কর্পোরেট ও পুঁজিপতিদের লোভের সীমা নেই। ইনফসিসের প্রধান যখন ৭০ ঘণ্টা কাজের কথা বলেন, L&T-র চেয়ারম্যান ৯০ ঘণ্টা কাজের কথা বলেন— তখন স্পষ্ট বোঝা যায়, এরা শ্রমিককে মানুষ নয়, কেবল ‘মুনাফার যন্ত্র’ ভাবেন।

তাদের এই রক্তচক্ষু ভেঙে দিতে পারে কেবল সংগঠিত শ্রমিক আন্দোলন। ধর্মঘট, মিছিল, বিক্ষোভ— এসবই হচ্ছে শ্রেণি সংগ্রামের প্রাথমিক ধাপ। শেষ পর্যন্ত একটাই লক্ষ্য— শোষণহীন, সাম্যের সমাজ, যেখানে শ্রমিকের শ্রম শুধু মুনাফার পণ্য নয়, মানুষের মর্যাদা ও জীবনের অধিকার হিসাবে প্রতিষ্ঠা পাবে।

লেখার সঙ্গে ব্যবহৃত ছবিটি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করে নির্মিত

Spread the word

Leave a Reply