general-strike-2025

9 July Strike: The Indian Railway

রানা গুপ্ত

৯ জুলাই  শ্রমিক কৃষক সংগঠনের ডাকে সারা দেশ স্তব্ধ হতে চলেছে। কেন্দ্রীয় সরকারের ভয়ঙ্কর শ্রমিক বিরোধী নীতির বিরুদ্ধে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত এই ধর্মঘটে রেল কর্মীরাও অংশ নিতে চলেছেন। কিন্তু কেন এই ধর্মঘট, কেন সংগঠিত রেল শিল্পের শ্রমিকদের অংশ নেওয়া প্রয়োজন তার চর্চা চলছে দেশের অন্য প্রান্তের সাথে রেলের অভ্যন্তরেও।

বর্তমানে রেল পরিচালিত হচ্ছে কর্পোরেট স্বার্থ সুরক্ষিত রাখতে। সেকারণে ন্যাশনাল মনিটাইজেশন পাইপলাইন -এর সুপারিশ মতো বর্তমানে রেলে ব্যাপক  হারে বেসরকারিকরণ চলছে। এই বেসরকারিকরণ নতুন শব্দ আর নয় আজ, নয়া উদারবাদ এর সাথে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের বেসরকারিকরণ যুক্ত। কিন্তু এতদিন অব লোডিং  আউটসোর্সিং  বলতে বোঝা যেতো রেলে তৈরি হয় সেই সামগ্রী বাইরে থেকে কিনে আনা,আজ শুধু সামগ্রী নয় জীবন্ত শ্রম বাইরে থেকে আউটসোর্সড  করা হচ্ছে। স্থায়ী কর্মী সংখ্যা দ্রুত কমছে, আর এই স্থায়ী কর্মীর কাজ অস্থায়ী কর্মীকে দিয়ে করানোর মাধ্যমে কাজের গুণগত মান শুধুমাত্র নামিয়ে আনা হচ্ছে তাই নয় একই সাথে ব্যাপক শ্রমিক শোষণ চলছে। দেশের সব চেয়ে বড় নিয়োগ কর্তা ভারতীয় রেল। ৯০-এর দশকেও ১৭ লক্ষাধিক রেল কর্মী থেকে আজ ১১  লক্ষে নামিয়ে আনা হয়েছে, অথচ নতুন ট্রেন চলাচলের সংখ্যা তখন থেকে অতিরিক্ত অনেক সংখ্যায় বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৯১-এ যেখানে প্যাসেঞ্জার ট্রেন চলতো ৮২০০-র মতো, সেখানে ২০২৪-এর হিসাবে ১৩২০০০-র মতো শুধুমাত্র প্যাসেঞ্জার ট্রেন প্রতিদিন চলেছে। এর সাথে মাল গাড়ি অতিরিক্ত সংখ্যা য় চলেছে। সেফটি সম্পর্কিত কাজ বেসরকারি সংস্থার হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে, এর ফলে যাত্রী সুরক্ষার সাথে আপস করা হচ্ছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে প্রতি বছর মুম্বাইতে ট্রেন দুর্ঘটনায় ২৫০০-৩০০০ মানুষের মৃত্যু হয়। ২০২২-এর ট্রেন দুর্ঘটনার হিসাবে এক বছরে ২১ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল, যার মধ্যে ৭৩% ট্রেন থেকে পড়ে গিয়ে। যেখানে লন্ডনে এক বছরে মৃত্যু হয় ৩,প্যারিসে বছরে দুর্ঘটনায় মৃত্যু ৬০, আর আমাদের মুম্বাইয়ে ৩০০০!একের পর এক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হচ্ছে সাধারণ নাগরিকের। এর পর এই দুর্ঘটনার দায় রেল কর্মীদের উপর চাপিয়ে ভুল সরকারি নীতির সংশোধনের কোনও প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে না। বরং আরও বেশি বেসরকারিকরণের দিকে এগিয়ে চলেছে রেল মন্ত্রণালয়। রেলের সম্পদ দেশের সাধারণ জনগণের সম্পদ। দেশ গড়ার স্বার্থে মানুষের নিজের জমি জায়গা শুধু নয় নিজের অর্জিত অর্থের ট্যাক্সের টাকায় রেলের সম্পদ গড়ে তোলা হয়েছে। সেই সম্পদ আজ জলের দরে বহুজাতিক কোম্পানির কাছে তুলে দেওয়া হচ্ছে। স্টেশন ডেভেলপমেন্ট অথরিটি গড়ে স্টেশনগুলো বিক্রি  করার কাজ চলছে, রেলের ভাড়া নির্ণয় করার জন্যে আজ আর পার্লামেন্টে আলোচনার প্রয়োজন হয় না—এক কর্পোরেট বডি তৈরি  করে দেওয়া হয়েছে যারা যাত্রী ভাড়া, পণ্য পরিবহণের ভাড়া ঠিক করছে, যথেচ্ছভাবে ভাড়া বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্যানিটেশন, ক্লিনিং, ক্যাটারিংয়ের কাজ সম্পূর্ণ বেসরকারি হাতে যাওয়ার পর পরিষেবা তলানিতে ঠেকেছে। সাধারণ যাত্রীদের যাতায়াতের স্লিপার কোচ, চেয়ার কারের সিটের সংখ্যা কমিয়ে দিয়ে মানুষকে বাধ্য করা হচ্ছে এসি কোচে বেশি ভাড়া গুনতে। সাধারণ ট্রেনগুলোকে একই পরিষেবা রেখে অতিরিক্ত ভাড়ার জন্যে সুপার ফাস্ট ট্রেনের নাম দিয়েছে। করোনার সময়কে ব্যবহার করে বয়স্ক মানুষদের যে ছাড়ের  ব্যবস্থা ছিল তা বন্ধ করা হয়েছে, এখনও আর নতুন করে চালু করা হলো না। এর পরেও যে অর্থে ভারতীয় রেলে যাত্রীরা যাতায়াত করতে পারছেন রেল বেসরকারি হওয়া মানে ট্রেন টিকিটের অস্বাভাবিক মূল্য  বৃদ্ধি হওয়া, প্রাইভেট ট্রেন তেজস-এর ভাড়া আর একই সময়ে চলাচল করা জনশতাব্দীর  ভাড়া দেখলেই বোঝা যায় প্রাইভেট ট্রেন পরিষেবা আসলে সাধারণ মানুষকে কিভাবে শোষণ করবে! রেল বেসরকারিকরণ করার জন্যে সরকার যে কথা বলেছিল তার কোনোটাই সত্য নয় তা যতো সময় যাচ্ছে আরও স্পষ্ট হচ্ছে। বলা হয়েছিল আরও উন্নত আধুনিক বিশ্বমানের ট্রেন  পরিষেবা দিতে বেসরকারিকরণ  জরুরি। মাল পরিবহণ রেলের সবচেয়ে লাভদায়ক ক্ষেত্র, এই জায়গা কর্পোরেটের  হাতে  তুলে দিতে ফ্রেইট করিডোর কর্পোরেশন গড়া হয়েছে। বলা হচ্ছে আগামী ২০৩৫ -এর মধ্যে ৫০%  পণ্য  ও ২০৪৫ -এর মধ্যে ১০০% পণ্য বেসরকারি সংস্থার  ট্রেন  পরিবহণ করবে। রেল লাইন পেতে দেবে সরকার, জমি  দেবে দেশের মানুষ, আর এতে ব্যবসা করবে কর্পোরেট। খাদ্য সামগ্রী থেকে শিল্পের  প্রয়োজনের কাঁচা মালপত্র সরবরাহ বেসরকারি সংস্থার হাতে যাওয়া মানে সমস্ত পণ্যের লাগাম ছাড়া মূল্যবৃদ্ধি হওয়া। লাভ করবে কর্পোরেট আর এর দায় বহন করতে হবে আম নাগরিকদের।

দেশের সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আধুনিক শিল্প ক্ষেত্র রেলের উৎপাদন কেন্দ্রগুলো। এগুলো বেসরকারি  সংস্থার কাছে তুলে দেওয়া বা কর্পোরেট নির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে  বর্তমান সরকার নীতি তৈরি করছে। রাকেশ মোহন কমিটি, ভিশন ২০২০, ১০০ দিনের প্ল্যান ওয়ার্ক   বা NMP সবই একই  লক্ষ্যে  গড়ে তোলা হয়েছিল। এই সব কমিটি উৎপাদন কেন্দ্রগুলোকে রেল থেকে বিচ্ছিন্ন করা ও এই উৎপাদন কেন্দ্রগুলোকে বেসরকারিকরণ  করার সুপারিশ করা হয়েছে। ২০১৪  থেকে কেন্দ্রীয় সরকার এই লক্ষ্যে  কাজ করবে বলে সর্বপ্রথম রেল বাজেট উঠিয়ে দেয়। নীতি আয়োগের সুপারিশ মতো ৫  বছরের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা  ঘোষণা করা বন্ধ হয়। কেননা কোনও বেসরকারি সংস্থা ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পে দীর্ঘমেয়াদি লাভ ছাড়া অর্থ বিনিয়োগ করতে চাইছে না। তাই কর্পোরেট সংস্থার পরামর্শ মতো প্রতি মুহূর্তে উৎপাদন ব্যবস্থার পরীক্ষা-নিরীক্ষা অব্যাহত আছে। বিদেশের উপর থেকে রেল পরিচালনার নির্ভরতা কমানোর জন্যে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সহায়তায় যে শিল্প কাঠামো গড়ে তোলা হয়েছিল, নিজেদের আত্ম  নির্ভর গড়ে তোলা হয়েছিল তাকে আবার ধ্বংস করে বহুজাতিক কোম্পানির কাছে তুলে দিতে এই সরকার উদগ্রীব হয়ে উঠেছে. যে আধুনিক ৬০০০, ৯০০০ বা ১২০০০ হর্স পাওয়ারের ইঞ্জিন ভারতীয় রেল করে দেখিয়েছে সেই কাজ দেশের টাকায় পরিকাঠামো গড়ে দিয়ে বহুজাতিক কোম্পানির কাছ থেকে কেনার অর্ডার দেওয়া হয়েছে। নিশ্চিত মুনাফার ব্যবস্থা করে দিতে আগামী ৫-১০  বছর ধরে ইঞ্জিন কেনার অর্ডার দেওয়া হচ্ছে। ভারতীয় রেলের পরিকাঠামোর আধুনিকীকরণ  না করে ২২  হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে গুজরাটের দাউদে সিমেন্স  কোম্পানিকে ইঞ্জিন উৎপাদনের জন্যে পরিকাঠামো গড়ে দেওয়ার কাজ চলছে। এরকম আরও অনেকগুলো প্রজেক্ট বর্তমান মোদী সরকার করেছে।  একইরকম বন্দেভারত বা কোচ তৈরির  সফল উৎপাদন ভারতীয় রেল করলেও এই কাজ বেসরকারি সংস্থার কাছ থেকে কেনার টেন্ডার ডাকা হয়েছে। তাহলে আগামী দিনে ICF, CLW, BLW, RCF -এর মতো গুরুত্বপূর্ণ উৎপাদন কেন্দ্রগুলোর ভবিষ্যৎ কী হবে তা বোঝাই যাচ্ছে!

এই ধর্মঘটে রেল কর্মীদের এর জবাব চাইতে হবে, এই সরকার কার স্বার্থে পরিচালিত হচ্ছে? সাধারণ মানুষের মতো রেল কর্মীদের ঘরের ছেলে মেয়েরা আজ কোথায় যাবে? অ্যাক্ট  অ্যাপ্রেন্টিস পাশ করে নতুন প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা আজ কাজ পাচ্ছে না, এই ধর্মঘট তার জবাব চাওয়ার দিন।

রেলে কাজ করলে আগে বলা হতো মাইনে কম পেলেও পেনশন আছে, রিটায়ারমেন্টের পর নিশ্চিত একটা জীবন আছে। বর্তমান সময় ২০০৪-এর পর যারা চাকরিতে এসেছে তাদের জন্যে NPS-এর নামে যে ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে তা কর্মীদের অনিশ্চিত জীবনের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এর বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখে UPS  নামক এক স্কিম  এই কেন্দ্রীয় সরকার এনেছে, এটাও OPS-এর দাবির প্রতি অসম্মানজনক ছাড়া আর কিছুই নয়। এর জবাব চাইতে সকলের জন্যে OPS চালুর দাবিতে ধর্মঘট ছাড়া আর কোনও পথ খোলা নেই।

রেল কারখানা, স্টেশন, রেল লাইন, ট্রেন, স্টেডিয়ামের জমি বিক্রি করা মানে দেশ বিক্রি হতে দেওয়া মেনে নেওয়া। তাই এর বিরুদ্ধে এই ধর্মঘট। আমাদের আজ ভেবে সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন, আমরা কি চাই? আমরা এই রেল বিক্রি করার সিদ্ধান্ত মেনে নেবো, না এর প্রতিবাদ করব? আমরা রেলের শূন্য পদ খালি রেখে বেকার বাহিনীকে ক্রীতদাস বানানোর জন্যে বেসরকারিকরণ  মেনে নেবো, না এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হবো? নয়া শ্রম কোড এর নামে কাজের সময়ের  কোনও বিধি নিষেধ নেই, একেক জন কর্মীকে আজ ১০–১২  ঘণ্টা কাজ করতে বাধ্য করা হচ্ছে, অকারণে চার্জশিট, পানিশমেন্ট দেওয়া শুরু হয়ে গেছে, এই থ্রেট  কালচারের বিরুদ্ধে আমাদের সোচ্চারে ৯ জুলাইয়ের ধর্মঘটে শামিল হতে হবে।

এই ধর্মঘট সরকারকে হুঁশিয়ারি দেওয়ার জন্য, যদি এর থেকে শিক্ষা গ্রহণ না করে সরকার তাহলে আমাদের লাগাতার আন্দোলনে যেতে হবে। তার প্রস্তুতির জন্য এই ধর্মঘট জরুরি।

ঠিকা শ্রমিকের নূন্যতম মজুরি,সমকাজে সমবেতনের  দাবিও আজ স্থায়ী রেল কর্মীদের দাবি হতে হবে,কারণ এই একইরকম কাজ আজ ঠিকা শ্রমিক আর রেল শ্রমিক একই সাথে করছে। ১৯৭৪  সালের রেল ধর্মঘটের পর সংগঠিত  শিল্পের স্থায়ী শ্রমিকের সংখ্যা কমানো চলছে, যাতে সরকারের জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদে দেশ স্তব্ধ না হয়।  তাই দাবি আদায়ের লক্ষ্যে  রেলের  স্থায়ী কর্মীদের ঠিকা কর্মীদের সাথে লড়াইয়ে  অংশ নিতে হবে। এই ধর্মঘট তার প্রস্তুতির জন্য জরুরি।

শ্রমিকের  ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের  মহড়া  এই ৯  জুলাইয়ের ধর্মঘট। দেশ বিক্রি করার শক্তির বিরুদ্ধে দেশ রক্ষার— গড়ে তোলা শক্তির লড়াই আজ মুখোমুখি। এই সংগ্রামে রেল কর্মীরা অতীতের শিক্ষা আর অভিজ্ঞতার নিরিখে সঠিক ভূমিকা পালন করবে এই প্রত্যাশা গোটা দেশের শ্রমজীবী মানুষের।

লেখার সঙ্গে ব্যবহৃত ছবিটি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করে নির্মিত

Spread the word

Leave a Reply