(১)
এবারের ৩০শে জানুয়ারি এসেছে ২২ শে জানুয়ারির পর – দেশের এমন এক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে, যার সঙ্গে ১৯৪৮ পরবর্তী যেকোনো জানুয়ারি মাসের ৩০ তারিখের মিল খুঁজে পাওয়া ভার। অন্তত ভারতীয়দের কাছে তো বটেই।
ছিয়াত্তর বছর আগে আজকের দিনটিতে উগ্র হিন্দুত্ববাদী নাথুরাম গডসের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধী। দিল্লিতে বিড়লা হাউসে প্রার্থনা সভায় যাওয়ার সময় গান্ধীজী আক্রান্ত হন। এ ঘটনার দিন দশেক আগেও গডসেরা বিড়লা হাউসেই গান্ধীজীকে হত্যার চেষ্টা করে। তবে সফল হয়নি।
গান্ধী – হত্যা বলাবাহুল্য শুধু মাত্র বিকারগ্রস্ত এক ধর্মান্ধের আকস্মিক দুর্বুদ্ধি ছিল না। ব্যক্তি গান্ধীকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়াই এই হত্যাকান্ডের মূল লক্ষ্য ছিল না। জঘন্য এই হত্যাকান্ড এবং হিংস্র সাম্প্রদায়িক উন্মাদনার পিছনে ছিল গেরুয়া বাহিনীর সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক পরিকল্পনা। সাম্প্রদায়িক বিষের পরিণতিতেই যে গান্ধীজীর অমূল্য জীবনের বলিদান দেশকে সহ্য করতে হয়েছে, একথা স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার বল্লবভাই প্যাটেল নিজেই লিখেছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ প্রধান এম এস গোলওয়ালকারকে। ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের চিঠি। গান্ধীজীর হত্যাকান্ডের পর আর এস এস-র লোকজন মিষ্টি বিতরণ করার ঘটানাও চিঠিতে সখেদে উল্লেখ করেন সর্দার প্যাটেল। গান্ধী হত্যার প্রেক্ষাপটে আর এস এস-কে নিষিদ্ধ করে নেহরু সরকার। রাজনৈতিক কাজকর্মে যুক্ত না থাকার মুচলেকা দিয়ে নিষেধাজ্ঞা মুক্ত হয় আর এস এস।
(২)
কেন আর এস এস-কে নিষিদ্ধ করা হচ্ছে তার কারনও স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয় সরকারী নির্দেশিকায় (তারিখ-৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮): আমাদের দেশের মধ্যে সক্রিয় এমন ঘৃণা ও সহিংসতার শক্তিকে নির্মূল করা। যে শক্তি জাতির স্বাধীনতাকে বিপন্ন করছে এবং তার সুনামকে কালিমালিপ্ত করছে।
প্যাটেল ১৯৪৮ সালের ১৮ জুলাই শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জিকে লেখেন: কোনো সন্দেহ নেই, গান্ধী হত্যার ষড়যন্ত্রে হিন্দু মহাসভার চরম অংশ জড়িত। আরএসএস-র কার্যকলাপ সরকার ও রাজ্যের অস্তিত্বের জন্য স্পষ্টতই বিপদ।
গান্ধী হত্যার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে ধোঁয়াশার কোনো অবকাশ নেই। কেন স্বাধীনতা প্রাপ্তির সাড়ে পাঁচ মাসের মাথাতেই গান্ধীজীকে হত্যা করার মতো চরম পথ হিন্দুত্ববাদীরা নিয়েছিল? উত্তর সকলেরই জানা। হিন্দুত্ব-রাজনীতির ধ্বজাধারীরা, এমনকি গডসে ও তার ঘনিষ্ঠরা পর্যন্ত তাদের উদ্দেশ্য গোড়া থেকেই স্পষ্ট করে দিয়েছে। গান্ধীজীকে শারীরিকভাবে নিশ্চিহ্ন করার মাধ্যমে গেরুয়া রাজনীতি সাধারণভাবে দেশবাসীর ঔপনিবেশিকতাবাদ বিরোধী সংগ্রামের ইতিহাসকে- বিশেষভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্রবাদের যাবতীয় ইতিবাচক অভিজ্ঞানকে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছে।
ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে সার্বিক বিযুক্তিই হিন্দুত্ববাদের মূল সংকট। শুধু বিযুক্ত নয়, তারা ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামেরই প্রতিপক্ষ। ঔপনিবেশিক প্রভুরা সব সময়ই সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পৃষ্ঠপোষক।
‘বাঞ্চ অফ থটস’ গ্রন্থে (১৯৬৬ সালে সংকলিত) ‘স্বাধীনতা’ সংগ্রাম ‘ব্রিটিশবিরোধী’ সংগ্রামে পরিণত হওয়ায় আক্ষেপ প্রকাশ করে গোলওয়ালকার লিখছেন,‘ব্রিটিশ বিরোধীতাকে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের সমতুল্য করা হয়। এই প্রতিক্রিয়াশীল দৃষ্টিভঙ্গি স্বাধীনতা সংগ্রামের সমগ্র ধারা, তার নেতৃত্ব এবং সাধারণ মানুষের উপর বিপর্যয়কর প্রভাব ফেলেছে।’ (‘বাঞ্চ অফ থটস’, ২০১৮; পৃষ্ঠা ১৩৮)
হিন্দুত্ববাদীরা ঔপনিবেশিকতাবাদবিরোধী সংগ্রামের বদলে ‘হাজার বছরের’ সংগ্রামের কথা বলে! কল্পিত এবং ইতিহাস-অস্বীকৃত হিন্দু-মুসলিম সংঘাতের ধূর্ত ন্যারেটিভে সংখ্যাগুরুবাদী সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদের কুনাট্য জমে উঠে।
ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র হিসেবে ঔপনিবেশিক-উত্তর ভারতের ধারণার সঙ্গে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির দ্বন্ধ স্বভাবতই মৌলিক। ঔপনিবেশিক-উত্তর ভারত তাদের ইচ্ছামতো হিন্দু-রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভুত না হওয়ায় হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি তার হতাশা গোপন করেনি। স্বাধীন ভারতের কোনো কিছুতেই তাঁদের সায় ছিল না। জাতীয় পতাকা থেকে যুক্তরাষ্ট্রীয় নীতি; ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠন; ধর্মনিরপেক্ষতা, সামাজিক ন্যায় এবং নারী-পুরুষ সমনাধিকারের ধারণার সাংবিধানিক স্বীকৃতি সম্পর্কে সংঘ পরিবারের নেতারা প্রকাশ্যেই উষ্মা প্রকাশ করে গেছেন। দীন দয়াল উপাধ্যায় তাঁর ‘ইন্টিগ্রাল হিউম্যানিজম’ (‘একাত্ম মানবতাবাদ’) পুস্তিকাতে (১৯৬৪-৬৫) ভারতের সংবিধানের ‘মৌলিক ভ্রান্তি’ বলতে উল্লেখ করেছেন ‘ভারতমাতা’র ধারণার অনুপস্থিতি। তিনি চান ‘ধর্মরাজ্য’; যে ‘ধর্মরাজ্য’-এ ‘আইনসভা’ ও ‘বিচারবিভাগ’-এর উপরে হবে ‘ধর্ম’-র স্থান
‘মনুস্মৃতি’ কেন স্বীকৃতি পেল না সংবিধানে সে নিয়েও হিন্দুত্ববাদের মাথারা লিখে রেখে গেছেন একেবারে সরল বাক্যে। এসব তারা কখনই গোপন করেনি। ঠিক যেমন নিজেদের স্বভাবজাত হিংসা প্রবণতা জাহির করতে তারা ছিল দ্বিধাহীন।
স্বাধীনতা সংগ্রামের শেষ লগ্নে অসাম্প্রদায়িকতার পক্ষে গান্ধীজীর আপোষহীন নৈতিক অবস্থান অবিস্মরণীয়।‘দ্বিজাতি তত্ব’ এবং সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষবাদকে তিনি সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯৪৭-৪৮ সালে দাঁড়িয়ে তথাকথিত ‘উদ্বাস্তু বিনিময়’ ব্যবস্থাকেও তিনি মানেননি। পাকিস্তান থেকে হিন্দুরা চলে আসবেন ভারতে, আর ভারতের মুসলিমরা পাড়ি দেবেন পাকিস্তানে—এই ব্যবস্থাকে স্বত:সিদ্ধ হিসেবে তিনি মানতে চাননি। পাকিস্তানের মতো স্বাধীন ভারত ধর্মতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হোক একথা তিনি মেনে নেননি কখনও।
উল্টোদিকে সংঘ পরিবার ছিল দেশভাগের প্রবল প্রবক্তা। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষকে প্রাতিষ্ঠানিক বৈধতা দেওয়ার লক্ষ্যে। পাকিস্তান যদি ‘ইসলামিক রাষ্ট্র’ হয় তাহলে ভারত হবে ‘হিন্দুরাষ্ট্র’! হিন্দুত্ববাদী নৈরাজ্যের সরল সমীকরণ!
হিন্দুত্ববাদী এই সমীকরণ স্বাধীনতা প্রাপ্তির সময় মেলেনি। ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের দু:খজনক পরিণতি সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিপদের দিকটি দেখিয়ে দিলেও স্বাধীনতা প্রাপ্তির সেই লগ্নে হিন্দুত্ব সাম্প্রদায়িক শক্তি জয়লাভ করেনি। রাষ্ট্র ক্ষমতার দখল পায়নি। শাসক শ্রেণীগুলি স্বাধীনতার উষালগ্নে রাষ্ট্রপরিচালনার জন্য সংহিস সাম্প্রদায়িক শক্তির উপর ভরসা করেনি। সেই হতাশা থেকেই হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি কেড়ে নিয়েছিল গান্ধীজীর প্রাণ।
(৩ )
তৎকালীন ভারত সরকার আর এস এস-র মুচলেকার ভিত্তিতে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলেও হিন্দুত্ববাদীরা গান্ধী-হত্যার প্রশ্নে পরবর্তীকালে কৌশলী অবস্থান নেয়। প্রকৃত কোনো অনুশোচনা তাদের ছিল না, থাকার কথাও নয়। এদেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কর্মপরিকল্পনা গান্ধী-বিদ্বেষ ছাড়া নিরুপায়। গেরুয়া রাজনীতির কাছে গান্ধীজী যেন এক ঐতিহাসিক প্রতিবন্ধক।
ফলে গান্ধী প্রসঙ্গে গেরুয়াবাদী তঞ্চকতা চিরকালই বহুরূপী। গান্ধীজীর রাজনীতির সঙ্গে তাদের বিরোধ মৌলিক হওয়া সত্বেও ভারতীয় জনতা পার্টি’র দলিলে (প্রতিষ্ঠা ১৯৮০) ‘গান্ধিয়ান সোশ্যালিজম’ দলের অন্যতম রাজনৈতিক দিশা। রাজনৈতিক প্রহসনের এমন নজির বিরল।
১৯৮৪-র লোকসভা নির্বাচনে মাত্র দুটি আসন প্রাপ্তি থেকে ১৯৯১ সালে লোকসভায় দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে উত্থান এবং ১৯৯৮ সালে বাজপেয়ী সরকার; সেখান থেকে ১৯১৪ সালে মোদীর নেতৃত্ব লোকসভায় বিজেপির একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ এবং ২০১৯ সালে মোদীর দ্বিতীয় বার প্রধানমন্ত্রী পদপ্রাপ্তি — শাসক শ্রেণীর সংকট বৃদ্ধির সমানুপাতিক হারেই ভারতীয় রাজনীতিতে প্রতিপত্তি বাড়িয়েছে হিন্দুত্ববাদ। তবে সব পর্বেই অভিন্ন টার্গেট গান্ধীজী,তাঁর অবিচল অসাম্প্রদায়িক অবস্থান।
গান্ধীজীকে শুধু একবার হত্যা করা হয়নি, গত সাড়ে সাত দশক ধরে হিন্দুত্ববাদীরা বার বার তাঁর নৈতিক অবস্থানকে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছে প্রবল আক্রোশে।
(৪)
গডসেই বোধ হয় হত্যাকারী হিসেবে আদালতে দন্ডিত একমাত্র অপরাধী যার নৃশংস অপকর্মের মিথ্যা সাফাই বই হিসেবে বাজারে বেরিয়েছে। শুধু মাত্র এই তথ্য থেকেই সংকটের গভীরতাকে উপলব্ধি করা যায়।
নাথুরাম গডসের ভাই এবং গান্ধী হত্যার ষড়যন্ত্রে যুক্ত থাকায় দন্ডপ্রাপ্ত গোপাল গডসে ষোলো বছর জেল খেটে মুক্তি পায়। ২০০৫ সাল পর্যন্ত জীবিত ছিল। জেলমুক্তির পর বাকি জীবন গোপাল গডসে গান্ধী হত্যার সমর্থনে প্রকাশ্যে সাফাই দিয়ে গেছে। এদেশের শাসক শ্রেণীর সব সংকটের সুযোগ নিয়েছে হিন্দুত্ববাদী শক্তি।
২০১৪-উত্তর পর্বে কর্পোরেট-কমিউনাল রাজনীতির আঁতাতে হিন্দুত্ববাদী প্রকল্পের আগ্রাসী রূপায়নের প্রেক্ষাপটে গান্ধীজীর জীবনাচরণে দৃষ্টান্তিত স্বাধীনতা সংগ্রামের মৌলিক মূল্যবোধগুলির উপর রাষ্ট্রীয় আক্রমণ নেমে আসছে নজিরবিহীন মাত্রায়। এক দিকে গান্ধীজীর জীবনাচরণ একদিকে সংকুচিত ‘স্বচ্ছ ভারত অভিযান’-র বিজ্ঞাপনী প্রতীকে, অন্যদিকে গেরুয়াবাদী শাসকের দৌলতে গডসেদের বানানো হচ্ছে ‘দেশপ্রেমী’। ঔপনিবেশিক শাসকদের কাছে মুচলেকা দেওয়া সত্বেও সাভারকারকে ‘স্বাধীনতা সংগ্রামী’-র স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
২০১৪-পরবর্তী কালে শাসক গেরুয়া বাহিনীর গান্ধী-ভাষ্যেও লক্ষ্য করা যাচ্ছে নতুন ধাঁচ। ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ গঠনের আদত লক্ষ্য পূরণের কর্মসূচী যত গতি পাচ্ছে ততই নিহত গান্ধীজীর স্মৃতিকে তারা তাড়া করছে। গান্ধী প্রসঙ্গে মুখ্যত দু’ভাবে তাদের প্রতিক্রিয়া প্রকাশিত। প্রথমত, গান্ধীজী সম্পর্কে উচ্চকিত কুৎসার ‘গরম’ পন্থা। দ্বিতীয়ত, কুশলী মিথ্যাচারের ‘নরম’ পন্থা।
উত্তরপ্রদেশের প্রভাবশালী বিজেপি সাংসদ সাক্ষী মহারাজ খাস সংসদের সামনে দাঁড়িয়ে নাথুরাম গডসেকে ‘দেশপ্রেমিক’ আখ্যা দেন। “গডসে হয়তো কিছু ভুল করে থাকবেন। কিন্তু তিনি দেশদ্রোহী ছিলেন না। তিনি আসলে দেশপ্রেমী ছিলেন।” কথাটা যে মুখ ফসকে নয়, তা বোঝা যায় ‘নাথুরাম গডসে শৌর্য দিবস’ পালন কিংবা গডসে’র নামে ‘মন্দির’ বানানোর উদ্যোগে।
উত্তর প্রদেশে হিন্দু মহাসভা নেতা কয়েক বছর আগে ৩০ শে জানুয়ারি গান্ধীজীর ছবিতে গুলি চালিয়ে গডসে-প্রীতির প্রমাণ দেন। বিজেপি নেতা গান্ধীজীকে ঘোষণা করেন ‘পাকিস্তানের জনক’ হিসেবে।
কয়েক বছর আগে হরিয়াণার বিজেপি সরকারের এক মন্ত্রী ভারতীয় মুদ্রা থেকে গান্ধীজীর ছবি সরিয়ে মোদীর ছবি ছাপার নিদান দেন। হরিয়ানার খাদি উদ্যোগের ক্যালেন্ডারে গান্ধীজীর ছবি সরিয়ে মোদীর ছাপা হয় ‘গান্ধীজীর চেয়ে মোদীর ব্র্যান্ড ভ্যালু বেশি’ বলে।
অন্যদিকে গত বছরের ২৮শে মে সাভারকারের ১৪০ তম জন্মবার্ষিকীতে নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। ২০০৩ সালে সংসদে সাভারকারের ফটো টাঙানোর ব্যবস্থা করেন তৎকালীন বিজেপি প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ী। দু’দশক পর নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধন পর্বে সাভারকারকে কার্যত গান্ধীজীর ‘সমতুল্য’ হয়ে উঠলেন।
তবে সাভারকার নিজেও যা ভাবেননি তাই করেছিলেন মোদী মন্ত্রীসভার প্রভাবশলী সদস্য রাজনাথ সিং। সাভারকারকে নিয়ে সঙ্ঘপরিবার-ঘনিষ্ট দু’জনের লেখা একটি বই প্রকাশ করতে গিয়ে আর এস এস-প্রধান মোহন ভাগবতের উপস্থিতিতেই রাজনাথ সিং বলেন, বন্দীদশা থেকে মুক্তির জন্য ব্রিটিশ সরকারের কাছে পেশ করা সাভারকারের মুচলেকা নাকি স্বয়ং গান্ধীজীর পরামর্শপ্রসূত! গান্ধীজীর পরামর্শেই নাকি সাভারকারের মুচলেকা!সত্যের অপলাপের কোনো সীমা নেই!
( ৫)
সর্বোপরি উত্তর প্রদেশে রামমন্দির উদ্বোধনের আগের দিন প্রধানমন্ত্রীকে পাঠানো রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর শুভেচ্ছা বার্তা। অযোধ্যার ‘মহোৎসব’কে ‘ভারতের চিরন্তন আত্মার বহিঃপ্রকাশ’ উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতির মন্তব্য, ‘‘গান্ধীজিও ভগবান রামের বড় ভক্ত ছিলেন।’’
‘রামমন্দির’ প্রশ্নে মোদী কি গান্ধীজীর ‘অনুসারী’? মোদী-কথিত ‘নতুন ইতিহাসের সূচনা’-র সঙ্গে গান্ধীজীকে মিলিয়ে দেওয়া কি সত্যিই ইতিহাস-সম্মত?
সাম্প্রতিক ‘অর্গানাইজার’ পত্রিকা লিখছে, রামমন্দির নির্মাণ ‘জাতীয় পুনর্গঠনের প্রতীক’। ‘হিন্দুরাষ্ট্র’-র প্রবক্তারা কি ১৯৫০ সালের ২৬ শে জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত ভারতীয় সাধারণতন্ত্রের ইতিমধ্যেই অবসান ঘটেছে বলে মনে করছেন?
‘রাম মন্দির’ এবং অযোধ্যা শহরের পুনর্গঠনের সমগ্র প্রকল্পের উদ্দেশ্য এখন আর অস্পষ্ট নয়। হিন্দুত্ব এবং রাষ্ট্র-শক্তি একীকৃত। প্রধানমন্ত্রী এবং ‘রাম রাজ্য’-এর জনক হিসেবে নরেন্দ্র মোদীর অভিষেক পর্ব ‘রাম মন্দির’ উদ্বোধনে তাঁর প্রধান ভূমিকার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়েছে। তিনি যেন কান্ডারী, যুগপৎ ‘ঈশ্বর’ এবং আমআদমির। “ঈশ্বর আমাকে ভারতের সব মানুষের প্রতিনিধিত্ব করার ভার দিয়েছেন। এ এক গুরুদায়িত্ব”, মোদীর নিজের ঘোষণা। শাসন করার ঐশ্বরিক অধিকার এখন তারঁই হাতে সমর্পিত!
গান্ধীজীর নির্মম হত্যা যে শুধুমাত্র এককালীন বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল তা আজ অনেক বেশি স্পষ্ট। তাই আজও সাম্প্রদায়িক বীভৎসার বিরুদ্ধে গান্ধীজীর নিষ্কম্প নৈতিক প্রতিরোধের পর্বগুলি আমাদের আগামী লড়াইয়ের পাঠ দেয়।
২২শে জানুয়ারি পরবর্তী ৩০ শে জানুয়ারি শুধুমাত্র নতুন পরিস্থিতির অভিজ্ঞতা নয়, নতুন ব্যূহ রচনারও সূচনাকাল হতে পারে।