স্বাধীনতার লড়াইতে বিশ্বাষঘাতক যারা
স্বাধীনতার লড়াইতে যাদের কোন সংগ্রামী ভুমিকা ছিল না, তারাই আজ দেশ চালানোর দায়িত্বে। স্বাধীনতার লড়াইতে যারা বরাবর আপোষের পথে চলেছে, তারাই আজ দেশের মানুষের প্রতি বিশ্বাষঘাতক করছে। আর এস এসের জন্মের পর এমন কেউ নেই যাকে সেলুলার জেলের কারান্তরালে থাকতে হয়েছে। একজনও মোদী-শা নেই যাকে স্বাধীনতার লড়াইতে ফাঁসি কাঠে ঝুলতে হয়েছে। স্বাধীনতা সংগ্রামের গোটা সময়কালে আর এস এসকে একদিনের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করেনি বৃটিশ সরকার। নিষিদ্ধ হয়েছে স্বাধীনতার পর। ১৯৪৮ সালে, মহাত্মা গান্ধীর খুনের পর।
প্রতিটি ক্ষেত্রেই কমিউনিস্টদের ভুমিকা ছিল বিপরীতে। আপোষহীন লড়াই, সংগ্রাম, কঠিনতম কারান্তরাল – সবই। বরং বৃটিশ আমলে কমিউনিস্ট পার্টিকে বেশিরভাগ সময়ই নিষিদ্ধ থাকতে হয়েছে। ১৯৩৭ পর্যন্ত প্রায় একটানা। তারপর খানিকটা ছাড়। আবার ১৯৪০ সাল। ফ্যাসিবাদ বিরোধী লড়াই এর সময় খানিকটা ছাড়। বাস্তবটা এরকমই।
আর এস এস কি স্বাধীনতার মূল্যবোধ, সংবিধানের মর্মবস্তু এমকি দেশের পতাকাকেও কখনো মেনে নিতে পেরেছে? ১৯৪৭ এর ১৫ই আগষ্ট দেশের স্বাধীনতা দিবস। আগের দিন, ১৪ই আগষ্ট, পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস। আর এস এসের মুখপত্র অর্গানাইজার পত্রিকা সম্পাদকীয়তে লিখল – “বরাত জোরে যে সব লোকেরা ক্ষমতায় এসেছে, তারা আমাদের হাতে তেরাঙ্গা ধরিয়ে দিলেও হিন্দুরা কখনোই একে সম্মান করবে না এবং মেনে নেবে না। তিন সংখ্যাটা এমনিতেই অশুভ। তিন রঙের পতাকা অবশ্যই অত্যন্ত খারাপ মানসিক প্রভাব ফেলবে এবং দেশের পক্ষে তা ক্ষতিকর”।
১৯৪৭ এর ১৫ই আগষ্ট কারান্তরালে বহু শত কমিউনিস্টরা। জেলের অভ্যন্তরে স্বাধীনতার পতাকা উড়ল। সামিল হলেন কমিউনিস্টরা সহ সবাই। ভেল্লুর জেলে পতাকা তুললেন বিশিষ্ট কমিউনিস্ট নেতা এ কে গোপালন। দেশপ্রেমের বায়না নাকি আর এস এসের হাতে! তারা দেশপ্রেমিক আর দেশদ্রোহী দাগাচ্ছেন! বাস্তবের দেশদ্রোহী, বিশ্বাষঘাতককেরা আজ দেশের ক্ষমতায়! দেশ এবং মানুষের প্রতিদিনের স্বপ্নভঙ্গের দায় প্রকৃত অর্থে তো ওদেরই ঘাড়ে।
ভারতের সংবিধান – সেটাও সঙ্ঘের না পছন্দ
গুরুত্বপূর্ণ যে প্রশ্নটা হল সংঘ কি দেশের সংবিধান সম্পর্কে মর্যাদাশীল? মান্যতা দিতে চায় সংবিধানের মর্মবস্তুকে? অবশ্যই না। সংবিধানের প্রস্তাবনার বিপরীতে এদের অবস্থান। সমাজতন্ত্র দূরের কথা, সংবিধান নির্দেশিকা গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সার্বভৌমত্বকে মান্যতা দিতে চায় না এরা। স্বৈরাচারী মনোভাব স্পষ্ট। সাম্প্রদায়িকতা, বিভাজনের রাজনীতির প্রতি দিন বাড়তে সাহায্য করছে এরা। সংবিধান নির্দেশিত যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর বদলে কেন্দ্রীকরণের প্রবল প্রয়াস। সংবিধান বর্ণিত ন্যায়, স্বাধীনতা, সমতা, সৌভ্রাতৃত্বের মর্মবস্তু এদের কাছে বাস্তবত মূল্যহীন। সমতার বদলে এদের পছন্দ সমসত্বতা। India that is Bharat shall be Union of States। কেন্দ্রীয় না রাজ্যগুলির সম্মিলন। নানা রাজ্য, নানা ভাষা, নানা জাতি, নানা ধর্ম, নানা অভ্যাস – সব মিলিয়েই ভারত। বৈচিত্রের মধ্যেই ভারতের ঐক্য।
রবীন্দ্রনাথ বলছেন – ‘হেথায় আর্য, হেথায় অনার্য হেথায় দ্রাবিড়-চীন, শক-হনুদল, মোঘল-পাঠান এক দেহে হল লীন।’ এই সাধারন সত্য থেকে সরে যাবার প্রয়াস কেন? পরমত সহিষ্ণুতা, ঐক্য, সম্প্রীতির গণতান্ত্রিক সার্বজনীন মনোভাবের উল্টো যে পথে সংঘ চলতে চাইছে, তা কখনই মেনে নেওয়া যায় না। মানুষের অধিকার, ব্যক্তির স্বাধীনতা, সমতা, ন্যায় এবং সৌভ্রাতৃত্বের মূল্যবোধকে যেভাবে প্রতিদিন ভাঙছে দিল্লিওয়ালারা, ভবিষ্যতের জন্য তা ক্রমশই বিপজ্জ্বনক চেহারা নিতে বাধ্য।
দেশের সংবিধানের মূল ভিত্তি তাকেই সংঘের না পছন্দ। ১৯৪৭সালের ৩০ শে নভেম্বর সঙ্গের ইংরেজি মুখপাত্র ‘অর্গানাইজার’ এ ‘দ্যা কনস্টিটিউশন’ নামক সম্পাদকীয় কলমে বলা হয় ভারতের নতুন সংবিধানের সবচেয়ে খারাপ বিষয়টি হলো যে এর মধ্যে দিয়ে ভারতীয়ত্ব বলে কিছু নেই সংবিধান প্রণয়ন ব্রিটিশ-আমেরিকান কানাডা এবং এরকম আরো কিছু সংবিধান থেকে উপাদান সংগ্রহ করে এর মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে। কিন্তু তার মধ্যে সনাতন ভারতীয় সাংবিধানিক আইন কানুন প্রতিষ্ঠান পরিভাষা শব্দ বিন্যাসের কোনো চিহ্নমাত্র নেই। ১৯৬১ সালে জাতীয় সংহতি পরিষদের সভায় গোলওয়ালকার লিখিত পাঠালেন লিখিত মোট পাঠালেন – ” বর্তমানের যুক্তরাষ্ট্রীয় ধরনের সরকার শুধু বিচ্ছিন্নতাবাদী জন্ম দেয় না তাই অনুভূতিকে স্পষ্ট করে এমনভাবে যে তা এক নিশানকে স্বীকার করতে প্রত্যাখ্যান করে। একে সম্পূর্ণ উৎপাটিত করতে হবে। সংবিধানকে বিশুদ্ধ করতে হবে এবং এককেন্দ্রিক ধরনের সরকার স্থাপন করতে হবে। “
মনুসংহিতা ভিত্তিক সংবিধানই ওরা চায়। আধুনিকতার পথে অগ্রগমন নয়, দেশ ও জাতির পশ্চাদগতির পক্ষেই সঙ্ঘের যাত্রার মতিগতি। মানুষ তা মানবে কেন?
দেশের সংবিধান প্রসঙ্গে বাবাসাহেব আম্বেদকার কে স্মরণ করে আমাদের সতর্ক থাকা খুবই জরুরী। আম্বেদকর বলেছন “on the 26th of January 1950 we are going to enter into a life of contradiction. In politics we will have equality and in social and economic life we will have inequality. In politics we will be recognised the principle of one man, one vote and one vote one value. In our social and economic life we shall by reason of our social and economic structure continue to deny the principle of one man one value. This is the contradiction.” আম্বেদকর সতর্ক করছেন যে সতর্কবার্তা আমাদের সকলের কাছে জরুরী বলছেন ” if we continue to deny it for long we will do so only by putting our political democracy in peril…… He must remove the contradiction at the earliest or else those who suffer from this inequality will break the structure of this political democracy that this assembly has so laboriously built. এই সতর্কবাণী অস্বীকার করলে বিপদে পড়তে হবে দেশকেই।
প্রকৃতপক্ষে আরএসএস এবং তার সংগঠনসমূহ কখনোই দেশের স্বাধীনতার লড়াই কিংবা ব্রিটিশের বিরোধিতায় আগ্রহ দেখায়নি। স্বাধীনতার পতাকাতেও ওদের বিরোধ। জাতীয় সংগীত তাদের মনঃপূত নয়। ভারতের স্বাধীনতা অথবা স্বাধীনতার সংগ্রাম সঞ্জাত ভারতের সংবিধানের কোনোটাকেই তারা সদর্থকভাবে গ্রহণ করতে পারে না।
স্বভাবতই ১৫ ই আগস্ট এর বিনিময়ে ৫ই আগষ্টকেই ওদের বেশি পছন্দ। ৫ আগস্টকেই স্বাধীনতার প্রকৃত দিন বলে চিত্রায়িত করতে চায় ওরা। কাশ্মীর রাজ্যের অবসান অথবা রাম মন্দির এর ভিত্তি স্থাপনের মধ্য দিয়েই নাকি দেশ স্বাধীনতার আস্বাদ গ্রহণ করতে পারছে। বস্তুত এর মধ্যে দিয়ে ইতিহাসের বিকৃতি ঘটাচ্ছে সংঘ। অবমাননা করা হচ্ছে দেশের স্বাধীনতা দিবসকেই।
ঠিক একইভাবে ২৬ শে জানুয়ারি সাধারণতন্ত্র দিবসকে খাটো করে ২৬ শে নভেম্বর সংবিধান দিবসের প্রস্তাবনা ওদের। কে বোঝাবে যে ভারতের সংবিধান এদেশে কার্যকরী করা হয়েছে ২৬শে জানুয়ারি ১৯৫০ থেকে। এটাই সাধারণতন্ত্র দিবস। তার আগের অন্তবর্তী সময়টায়, দেশ পরিচালিত হয়েছে ব্রিটিশের তৈরি ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্ট এ্যাক্ট।
আসলে দেশের স্বাধীনতার লড়াইতে সঙ্ঘের যেহেতু কোন অবদানই নেই, তাই স্বাধীনতা ইতিহাস সংক্রান্ত কোনকিছুকেই ওরা মানতে পারে না। স্বাধীনতা দিবস, সাধারণতন্ত্র দিবস, জাতীয় সংগীত, পতাকা সংবিধান – পারলে সবই ওরা বদল করতে চায়। তারই নির্লজ্জ প্রদর্শন ক্রমশই স্পষ্ট হচ্ছে।
দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্যে দিয়েই দেশের স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃতির যত প্রচেষ্টায়ই হোক না কেন – পথ, মত এবং সংগ্রামের গতিতেই বিভিন্ন অংশের ভূমিকা স্পষ্ট। সে সত্য অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
স্বাধীনতাকে অর্থবহ করতে হবে দেশ এবং দেশের মানুষের সার্বিক স্বাধীনতা সামাজিক,রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক – সব মিলিয়েই। স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল লক্ষ্যকে বাস্তবায়িত করার পথে শ্রমজীবী মানুষের মুক্তি, নারী মুক্তি, সামাজিক আর্থিক ভাবে পিছিয়ে থাকা মানুষের মুক্তি। সমাজতন্ত্রের পথেই মুক্তি। সেই লক্ষ্যেই কমিউনিস্টরা।
সংঘের বিবেচনায় স্বাধীনতা পূর্ণতা প্রাপ্তি হতে পারে একমাত্র হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের মধ্য দিয়ে। পাশের নেপাল হিন্দু রাষ্ট্র থেকে সরে এসেছে। পাকিস্তান ধর্মের ভিত্তিতে গঠিত হলেও বিভাজিত হয়ে ভাষা এবং জাতির ভিত্তিতে বাংলাদেশর স্বাধীনতা। এসব বোঝার কোন দায় সঙ্ঘের নেই।
গঠনের আগে এবং গঠনের পরে সংঘ এবং তার সহযোগী গঠন সংগঠনসমূহ কোনো অর্থেই স্বাধীনতার লড়াইতে সদর্থক অংশ নেয় নি আপস বিশ্বাসঘাতকতা অথবা দালালি ইতিহাস তাদের জন্য অন্য কোথাও উঁকি মারা দরকার হয়না আয়নায় নিজের চেহারা দেখলে ইতিহাস অথবা মহাফেজ খানা ডুব দিলেই সঙ্গে দেশদ্রোহী চেহারাটা স্পষ্ট হয়ে যায়।
দেশের স্বাধীনতা এবং সংগঠন সংবিধানের মূল মর্মবস্তুকে বাতিল করতে চায় যে শক্তি, তারা আজ দেশের পরিচালক। দেশদ্রোহের ঐতিহ্য তাদের শিরায় শিরায়। প্রতিদিনের নানান ঘটনায় সেটা ক্রমশই পরিষ্কার হচ্ছে। বিস্তৃত করতে হবে শ্রমজীবী মানুষের অধিকার। রক্ষা করতে হবে ব্যক্তি স্বাধীনতা, ন্যায়, সমতা, ভাতৃত্বের অন্তর্দৃষ্টিকেই। গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার পথ থেকে যারা দেশকে বিচ্যুত করতে চায়, তাদের ছেড়ে দেওয়া যাবে না। রক্ষা করতে হবে দেশের স্বাধীনতার শপথ এবং সংবিধানের মর্মবস্তুকে। বিস্তৃত করতে হবে সমাজ পরিবর্তনে লড়াইকে। এ দায় দেশের মানুষের। প্রতিটি দেশপ্রেমিক নাগরিকের। ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, নাগরিক সমাজের। দেশপ্রেমিক এই কর্তব্যবোধই স্বাধীনতার লড়াইয়ের ঐতিহ্য। সেই ঐতিহ্য নেই বামপন্থার লড়াই। কমিউনিস্টদের দায়বদ্ধতা।